নাচনী
১.
গভীর রাত।পূর্ণিমা।
ছায়া ছায়া কয়েকটি গাছ নিশ্চুপ জেগে। দূর থেকে ভেসে আসছে এক নিঃসঙ্গ কুকুরের করুণ
কান্নার শব্দ।পুরুলিয়ার টাঁড়জমিতে দাঁড়িয়ে ঐ কয়েকটি গাছের অস্পষ্ট ছায়ার ভেতর থেকে
বেরিয়ে আসে এক মানুষ।দূর থেকে বোঝা যায় কিছু একটা ঘষটে ঘষটে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ক্যামেরা
কাছে এলে বোঝা যায় সেটা একজন মানুষের। পাথরে, মাটিতে ঘষা খেতে দেখা যায় একটি
শবদেহ। মাথার চুল,হাতের চুড়ি,পায়ের আলতা দেখে বোঝা যায় সেই শবদেহ একজন মহিলার।
শবদেহ টানতে টানতে রুখুটাঁড়ে মিলিয়ে যায় মানুষটি।আবহে জেগে থাকে একটি শবদেহ টেনে, হিচড়ে, ঘষটে নিয়ে যাওয়ার
শব্দ।
কাট। কাট।কাট।
না।
কোনো ছায়াছবির বর্ণনা
নয়।নাচনীদের জীবনের অন্তিম ছবিটা আরো মারাত্মকভাবে দৃশ্যায়িত হতে পারে।
এদের জীবন বড়ো কষ্টের,
বেদনার। রসিক, যিনি নাচনীর মালিক,তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসাবে যতদিন তাদের যৌবন
থাকে, ' গতর' থাকে,মজা,আনন্দ দেওয়ার ক্ষমতা থাকে ততদিন তাদের খাওয়াপরা,চিকিৎসার
সুযোগ থাকে।কিন্তু বার্ধক্যে অনাহারে, বিনা চিকিৎসায় লোকচক্ষুর আড়ালে নাচনীদের
তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। সমাজে এরা ' বিষকন্যা ', 'অস্পৃশ্য' হিসাবে গ্রামে থাকার সুযোগ পেতেন না।
গ্রামের এক প্রান্তে তাদের কোনোরকম ঠাঁই হোতো।কোনো সামাজিক স্বীকৃতি তাদের ছিল না।
নাচনীদের সঙ্গে রসিকরা বা তারই ঠিক করে দেওয়া কোনো খদ্দের বা ইয়ার শয্যাগমন করলেও
কোনোদিন জীবনসঙ্গিনীর মর্যাদা তাদের জুটত না। তারা যাতে সন্তান ধারণ করতে না পারে
তার জন্য দেশীয় উপায়ে তাদের বন্ধ্যা করে দেওয়া হোতো। এরপরেও কারো যদি সন্তান হয়ে
যেত, তার পিতৃ পরিচয় জুটত
না। সমাজে সেই শিশুটির পরিচয় হোতো
'বেদ্উাবাচ্চা ' বলে। সমাজের ভোগলালসার শিকার হয়ে, 'নীলকন্ঠ ' হয়ে যেদিন তারা
" অমরলোকে" যাত্রা করতো,তখন
কেউই তার শবদেহ সৎকার করতেও
আসতেন না ।রাতের অন্ধকারে গরুর জোয়ালের সঙ্গে শবদেহের পায়ে দড়ি বেঁধে সম্পূর্ণ
অবজ্ঞার সঙ্গে ফেলে আসা হত ভাগাড় থেকে আরো দূরে। শ্মশানেও তাদের ঠাঁই হত
না।স্বর্গে যাওয়ার জন্য তাদের কাছে ধোঁয়ার রথের স্বপ্ন দ্যাখাও ছিল নিষিদ্ধ। এ
অভাগীদের কাছে স্বর্গের স্বপ্নও ছিল নিষিদ্ধ।
#
নাচনী শব্দটি কানে
'প্রবেশিলে' তথাকথিত 'ভদ্দরনোক'দের গা টা
যেন রি রি করে উঠে এখনো। একসময় মানভূম অঞ্চলে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল এই নাচনীদের
'লাচ'। বাঈজীদের নিকৃষ্ট বা অপভ্রষ্ট রূপ এই নাচনীরা। জনপ্রিয় ঝুমুর গানের সঙ্গে,
তালে তালে এই নাচের বিস্তার।
পুরুলিয়ার 'ছো' বা 'ছৌ'
নাচ যেমন পৌরুষদৃপ্ত তেমনি নাচনী নাচ হল রমণীস্নিগ্ধ।
#
সাধারণত সামাজিক,
অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেনির মধ্য থেকেই নির্বাচিত হত নাচনী। অনেকক্ষেত্রে
তারা কিছু পুরুষের লালসার শিকার হয়ে বা সামন্তশ্রেনির কিছু মানুষের উচ্ছৃঙ্খলতার
শিকার হয়ে, ভারতীয় নৃত্যকলা শিল্পের এই ব্রাত্য শাখায় যোগ দিতে বাধ্য হত। অভাবের
তাড়নায় বা কোথাও আবার প্রেমের ফাঁদে পড়েও নাচনী হওয়ার ঘটনা শোনা যায়।মূল
'নাটেরগুরু' বা ' কলকাঠি'র কাজটি করতো 'রসিক'। রসিকদের একাজে সাহায্য করতো সমাজের নানানজন।এব্যাপারে
মহিলারা ছিলেন অগ্রণী। একজন মহিলা 'কানাঘুঘু'র ভূমিকায় অভিনয় করে সহজেই আরেকজন
মহিলাকে রসিকের হাতে তুলে দিতেন,সব জেনে বুঝেই। প্রতিটি নাচনী, রসিকের অধীনে
ব্যক্তিগত সম্পত্তিরূপে ব্যবহৃত হত।
#
মানভূমের সংস্কৃতি ও
ইতিহাস থেকে দেখা যায় অনেকক্ষেত্রে ছোট ভূস্বামী নিজেরাই ছিলেন রসিক। নাচনীরা
যেহেতু রসিকের ব্যক্তিগত সম্পত্তিরূপে পরিগণিত হত সেহেতু নাচনীদের
পারিশ্রমিকের সিংহভাগ বা পুরোটাই রসিক নিজে আত্মসাৎ করত।
জমিদার বাড়িতে সেই সময় ঝুমুর গান সহযোগে নাচনী নাচ সাদরে আমন্ত্রিত
হত ও প্রত্যাশিত পারিশ্রমিক পেত। নাচনীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য,তার 'গতর'টিকে আকর্ষণীয়
রাখার জন্যই নাচনীদের খাওয়া-পরা-চিকিৎসার দেখভাল ও যোগাড় করত রসিক। বিনিময়ে তারা
ইচ্ছেমত নাচনীদের ব্যবহার করত। রূপ- যৌবন-শরীর ক্ষয় হলে তাদের ত্যাগ করে রসিকরা
আবার সন্ধান করত অন্য এক নাচনীর।অনেকে না হলেও কয়েকজন রসিকের কথা জানা যায় যারা
নাচনীকে স্ত্রীর মর্যাদা না দিলেও ' রাখনী' হিসাবে রেখে দিতেন। শোনা যায় আবার
নাচনী লুঠের ঘটনাও। চুরির উপর তো বাটপাড়ি হয়। হয়তো সেই নাচনীর এত সুনাম,আকর্ষণ
ছিল যে লুঠ করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না। গায়ের জোর,ক্ষমতা বা 'পৌরুষ' দেখানোর
জন্য অনেক সামন্তপ্রভু বা রসিক বা অর্থবান মানুষেরাই যুক্ত থাকতেন এই "নাচনীলুঠ"
করার ঘটনায়।
(আগামী সংখ্যায় শেষ হবে
)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন