সাঁঝবিহান
প্রথম পর্ব
(১)
ভোরবেলা একটা
তালকানা পাখির ডাক শুনে ঘুম ভেঙে গেলো কলমির,রাত থেকে ডেকেই চলেছে পাখিটা।মাঝে একটু
বিরাম নিয়ে আবার ডাকছে ভোর থেকে ,কেমন উদাস করা ডাকটা। যেন ওর দোসর জঙ্গলে গিয়ে হারিয়ে
গেছে আর ফেরেনি,কলমির স্বামী হারানের মতো ।
হারান নিখোঁজ
হয়েছে সেও অনেক দিন হয়ে গেলো ,এখন কলমির আর ওকে তেমন মনেও পড়েনা শুধু মাঝে সাঝে কোন
শীতকালীন অবকাশে কিংবা এমনি কোনো পাখি ডাকা ভোরে ওর বুকের মধ্যেটা হু হু করে ওঠে ।ওর
তিন মেয়ে ,সাঁঝ ,বৈচি আর ঝিনুক ।অনেকেই বলে এমন নাম এ অঞ্চলে কারো শোনা যায় না ।
সাঁঝ কে নিয়েই
ওর যত জ্বালা এখন ।সারাদিন মেয়েটাকে একলা ঘরে ফেলে ও বেরিয়ে যায় ,ফেরে সেই সূয্যি ডুবলে
।বৈচি আর ঝিনুক ও ইস্কুলে বেরিয়ে যায়।
প্রায় পাচঁ
কিলোমিটার হেঁটে সরকারী স্কুলে যায় ওরা প্রতিদিন ।পড়ার আগ্রহ শুধু নয় ,ওখানে ফি'দিন
খিচুড়ি দেয় হোক সে চালে পোকা ,ডালে ছাতকুড়ো পড়া গন্ধ, তবু গরম খিচুড়ি পেটে পড়লেই ওরা
কেমন যেন বল পায় শরীরে ।ফেরার পথে হেঁটে আসতে আসতে সন্ধ্যে নামে !ফিরেই ইস্কুলের থলেটা
মাটিতে ফেলেই ঘুমিয়ে পরে ওরা।কোনও কোনও দিন মন্টু মাস্টার পাশ
দিয়ে সাইকেল
নিয়ে যাবার সময় বলে ,"চল বৈচি তোদের কে বাড়িতে নামিয়ে দিই ।"বৈচি রাজি হয়না
বরং ঝিনুকের হাতটা শক্ত করে ধরে বলে , "ঝিনুক সাইকেলে চড়তে ভয় পায় মাস্টারবাবু,আপনি
যান ।"ও জানে মাস্টারের মতলব ,মাস্টার যেতে চায় সাঁঝের জন্য ।ও অনেক দিন দেখেছে
সন্ধ্যার অন্ধকারে যে জানলার ধারে সাঁঝের বিছানা পাতা থাকে সেখানে কার যেন একটা হাত
নেমে আসে ওর বুকে।সাঁঝ কুঁই কুঁই করে উঠলে পালিয়ে যায় সে ।
হাতের মধ্যমায়
একটা আংটি দেখেছিলো বৈচি একদিন ।পরে ইস্কুলের মাঠে যেদিন ও খেলায় প্রথম হলো সেদিন মন্টু
মাস্টারের হাতেও ঠিক একইরকম একটা আংটি দেখেছিলো ও ।সেদিন থেকে মন্টুকে দেখলেই বড্ড
গা ঘিন ঘিন করে ওর ।
(২)
সতীশ এই অঞ্চলে
সরকারী কাজের ঠিকাদারি নিয়ে এসেছে ।লাল মোরামের পথ,শালবনের- মহুয়াবনের সবুজ অরণ্য সতীশ
কে টেনেছিল খুব ।তাই কাজটা পাবার পর বাড়ির কথা ভাবেনি একমুহূর্ত আর।আসার দিন শাল্মলী
এসেছিলো দেখা করতে ,হাতে কিছু জুঁই ফুল ,কথা বলেনি কোনো ।নিঃশব্দে টেবিলে রেখে চলে
যাবার সময় সতীশ ওর হাত ধরে হ্যাচকা টান মেরেছিলো।নিজেকে ছাড়াতে পারেনি শাল্মলী ।ঘোড়ায়
চড়া সহজ অনেকের কাছেই কিন্তু নামাটা যে কঠিন সেটা বুঝতে বুঝতেই শাল্মলীর কিঞ্চিৎ অনাবৃত
কাঁধে ঠোঁট রেখেছিলো সতীশ ।
শাল্মলীর দুই
বুক তড়িতাহতের মতো কাঁপছিলো সতীশের হাতের তালুর মধ্যে ।এলোমেলো কাপড় ঠিক করতে করতে
চোখ থেকে জল পড়ছিলো ওর ।
সতীশ বললো,"কাঁদছিস
কেন বোকা মেয়ে ?তোর জন্যই তো যাওয়া রে,ফিরে আসার জন্যই তো যাওয়া" বলেই ওকে ছেড়ে
দিয়ে জানলার ধারে গিয়ে একটা সিগ্রেট ধরায় ।
শাল্মলী অনেকক্ষন
চোখ নামিয়ে ছিল,বুড়ো আঙুলে পা'টা মাটিতে গেঁথে ফেলছিল প্রায় । সতীশের কথা শুনে চোখ
তুলে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ।
সতীশ ওরই সমবয়সী
,ছোট থেকেই ওরা একসাথে বড়ো হয়েছে ,পড়াশুনা করেছে ।সতীশ ওর বিধবা বড়ো পিসিমার ছেলে,ও
জানে কোনোদিন-ই ওদের সম্পর্কের সামাজিক সহবস্থান হবেনা তবু বুকের ভিতর ছিলা টান করে
দাঁড়াবার এক আশ্চর্য বাতাস ভরে দেয় সতীশ ।কিন্তু আজ ওর এই কথাটা কেমন স্তুতি মনে হলো
ওর। ও দুম করে সতীশের কাঁধে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললো -"পুরুষ মানেই কি মিথ্যেবাদী!সত্যি
টা কি তারা নিজেরাই মানতে শেখেনি "!
(৩)
সাঁঝ কলমির
বড় মেয়ে।গতবছর শীতলা পুজোর সময় সাঁঝ গিয়েছিলো শালবনের জঙ্গলে শুকনো পাতা কুড়াতে ।শুকনো
পাতায় জ্বালানি হয় ভালো ।ডাল ,ঘুঁটে ,গুল এসব কম লাগে ।পাতা নিয়ে ফেরার পথে গোমস্তা
চৌধুরীর সাথে দেখা ।হাঁটুর ওপর ধুতি টা তুলে হনহন করে জঙ্গলের পথ পাড়ি দিচ্ছিলো সে।সাঁঝ
কে দেখে থমকে দাঁড়ালো-বললো,"তুই কলমির মেয়ে না !"সাঁঝ বলে- হ্যাঁ !
"তা এই
সাঁঝের বেলা জঙ্গলে একলা মেয়েমানুষ তুই কি করছিস রে?"
সাঁঝ পাতার
ঝুড়িটা পাশে রেখে গড় করে চৌধুরীকে, বলে "পাতা কুড়োতে এসেছিলাম গো ,এইবার যাবো
"
চৌধুরী ওর
কাঁধ ধরে তুলে দেবার সময় ওর ছেঁড়া জামার ফাঁক দিয়ে ওর বুকের নরম ফর্সা পাখি দুটো দেখে।
ও হঠাৎই বোঝে ওর ভিতরের পৌরুষ এখনো অক্ষুন্ন আছে ।ও সাঁঝকে কোনোরকম সুযোগ না দিয়ে জাপটে
ধরে মাটিতে ফেলে দেয়।আচমকা সাঁঝ প্রথম পুরুষ স্পর্শে হুঁশ জ্ঞান হারায় ।অবশ হয়ে যায়
ও।তবু বলে "আমাকে ছেড়ে দিন, কেউ এসে পরবে আমার সর্বনাশ হবে"
চৌধুরী তার
হাতের প্রবল চাপে ,ঠোঁটের উত্তাপে চুপ করিয়ে দেয় সাঁঝকে । সাঁঝ আর বাধা দিতে পারে না
।চৌধুরীর হাত তার কচি কদম ফুলের মত বৃন্ত নিয়ে খেলতে থাকে ।এরপর প্রবল উল্লাসে ওই সাঁঝবেলায়
চৌধুরী সাঁঝকে চরমভাবে ভোগ করে । সব শেষ হলে বোকা মেয়েটাকে মৃদু ধমক দিয়ে বলে
"কাউকে বলিসনা সাঁঝ ।তোকে অনেক জিনিস , আদর দেব।মাঝে মাঝে আসবি দুপুরে বৈঠকখানায়
,আমি তোকে শহর থেকে স্নো পাউডার আনিয়ে দেব !
কিন্তু আমার
ক্ষতি করার আস্পর্ধা দেখাসনা যেন "
এরপর উঠে দাঁড়িয়ে
ধুতির খুট বাধঁতে বাঁধতে বললো "এই মেয়ে দিব্যি কেটে গেল বল একথা তুই কারোকে বলবিনা
তো? আজ শীতলা পুজোর দিন মিথ্যে বললে তোর পাপ লাগবে ।"
সাঁঝ উত্তর
দেয়না, জামা কাপড় সামলে বসে থাকে ওই শালবনের অন্ধকারে আরো অনেকক্ষন, অদূরের টাঁড়ে তখন
একটা তিতির ডেকে ওঠে ।ততক্ষনে চৌধুরীও হাঁটা দিয়েছে অন্য পথে ।একসময় টালমাটাল পায়ে
ঘরে ফিরে আসে সাঁঝও । ঝুড়িটার কথা আর খেয়াল থাকেনা ওর ।
ক্রমশ______