রবিবার, ১৯ জুন, ২০২২

সৌমী আচার্য্য

 

                




শ্রাবণের ধারার মত



শেষ পর্ব

ঊশ্রীকে এয়ারপোর্টে ছেড়ে এসে নিজেকে হঠাৎ অনাথ মনে হল দেবপ্রিয়ার। বাবা চলে গিয়েছিলেন যখন তখন সে সবে সেভেন, কষ্ট হয়েছিল কিন্তু মায়ের আঁচলের নীচে কখনোই অনাথ মনে হয়নি নিজেকে। অনুজ চলে গেলেও তেমন মনে হয়নি আর মা চলে গেলে ভীষণ ফাঁকা লাগলেও ঊশ্রী যেন জড়িয়ে নিয়েছিল সবটুকু। আজ সারা বাড়ি জুড়ে নৈঃশব্দ‍্য তাকে গিলতে আসছে। চলে যাবার আগে একটা সাংঘাতিক কাজ করেছে ঊশ্রী যার কোনো আভাস বা কল্পনা দেবপ্রিয়ার ছিলনা। হঠাৎ সন্ধ্যার দিকে ঝোড়ো কাকের মত মেয়ে ফিরেছে। চোখের জলের দাগ তখনো লেগে রয়েছে। দেবপ্রিয়া পড়ছিলেন। দ্রুত উঠে এসে মেয়ের কাছে আসতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে।

-সব আড়াল আজ ভেঙে দিলাম মা। সব আড়াল। এতদিন লড়াইটা আমাদের ছিল। এবার ওদের পালা।

-কী হয়েছেরে মুনিয়া? 

-আজ জোনাকমাসির কাছে গিয়ে নিজে সব বলে এসেছি। সাথে বন্ধুদের নিয়ে গিয়েছিলাম। ওদের বাইরে দাঁড় করিয়ে ভেতরে গিয়েছিলাম। বলেছিলাম যদি শুনিস বেশি চিৎকার চ্যাঁচ্যামেচি হচ্ছে এই বাড়িতে সোজা ঢুকে আসবি।

দেবপ্রিয়া স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছে শুনে। কী করে করল মেয়েটা এমন! সব বলে দিল সব! সোফায় ডুবে রয়েছে। ঘোরের ভেতর বলেই চলেছে বিড়বিড় করে।

-মাসির জন্য কষ্ট হচ্ছিল খুব তবু বলে এসেছি। আর কতোদিন এভাবে ভয় পেয়ে বাঁচবো? ঐ বরুণ দত্তের চোখে চোখ রেখে বলেছি আমার ছবি ভাইরাল করুন আপনি, তারপর আমি পুলিশে জানাব সবটা। আমার মায়ের জীবন নিয়ে কী ভাবে খেলছেন সেটাও বলবো।

দেবপ্রিয়া আজ আর কাঁদতে চায়না। লবণস্রোতে জীবন যার তার নতুন করে আর কান্না আসে না। চুপ করে থাকে মেয়ের দিকে তাকিয়ে। ঊশ্রী হঠাৎ যেন ঝলমল করে ওঠে, 'মা আমি অনেক আগেই এটা করতে পারতাম, করা উচিৎ ছিল। আমার নিজেকে হালকা লাগছে মা। বোধহয় দীপ্তার্ককে এবার একটু স্পেস দিতে পারবো।' নতুন চরিত্রের আগমনে নড়ে বসে দেবপ্রিয়া। মায়ের কৌতূহল লক্ষ্য করে ঊশ্রী বলে, 'এমন কিছু না। হ্যাণ্ডসাম একটা ছেলে ঐ পুলিশেই চাকরী টাকরী করে। ডিজি ফিজি কিছু একটা হবে। ফেসবুক থেকেই আলাপ। একটু বেশি এ্যাটেনশান দিচ্ছে মাস ছয়েক তাই বললাম আরকি।' হেসে ফেলে দেবপ্রিয়া। যদিও ঊশ্রী কথা থামায়নি।

-মরুণকিশোর আছেন বলেই তুমি যাচ্ছো না মা! উনি কিন্তু আজো তোমায় ভোলেননি। কত বছর আগের কথা একবার ভেবে দেখো। আশ্চর্য জানো আমার চোখে উনি যেন তোমাকেই দেখছিলেন। তুমি আমার সাথে আসলে ভালো করতে মা। হয়ত একটু শান্তি পেতে, ভালো লাগত তোমার।

-মুনিয়া, মরুণ আমাকে কেন ভালোবেসেছিল? কতটা ভালোবেসেছিল আমি জানিনা। জানতে চাইওনা কারণ আজ আর তার কোনো মানেই হয় না। এই বয়েসে হৃদয় অপর কারো দুঃখের কারণ হবার দায় নিতে চাইবে না বোধহয়। তাছাড়া আমার এখানে কিছু কাজ আছে। সেসব না মিটিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। যদিও যাবনা কখনো একথা বলছি না।

-বেশ তোমার যা ইচ্ছে। তবে আমি বেশিদিন তোমায় ছাড়া থাকতে পারিনা এটা মনে রেখো।

মেয়েটা নিজেকে ঠিক সামলে নিল। চারিদিক কেমন যেন শান্ত হয়ে আসছে। এই ফাঁকা বাড়িতে একাই থাকতে হবে এখন থেকে। দিন কারো জন্য বসে অপেক্ষা করেনা। বয়ে যায়। ঊশ্রী যাবার পাঁচ ছদিন পর ছেলেটা এল। বেশ উঁচু লম্বা গায়ের রঙ ঈষৎ চাপা তবে তিক্ষ্ণ চোখ। বসার ঘরে কথা হল ছেলেটির সাথে। দেখা মাত্রই দুহাত তুলে নমস্কার জানাল বেশ কেতাদুরস্ত। বসতে বলল দেবপ্রিয়া।

-আমি দীপ্তার্ক সেন। ঊশ্রী আমাকে আপনার সাথে দেখা করতে বলেছিল। আমি কোলকাতায় এসেছি একটা বিশেষ কাজে। আজ এই বেলাটা অবসর আছে তাই এলাম।

-বেশ করেছো। আমাকে ফোন করেছিল মুনিয়া। তোমার পোস্টিং এখন কোথায়?

-কার্সিয়াং...

-বাহ্ সুন্দর জায়গা। মা বাবা কী তোমার সাথেই থাকেন?

-না মা বাবা থাকেন ব্যাঙ্গালোর। বাবা এখনো ইন সার্ভিস। মা প্রফেসার ওখানেই একটি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে আছেন।

-বাহ্ খুব ভালো। 

ছেলেটি অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। দেবপ্রিয়া ওকে দেখতে থাকতে মন দিয়ে। এরমধ্যে ধলিদি চা, কুকিজ, কেক, কাজুবাদাম রেখে যায়। 'তুমি কিছু বলবে?' দেবপ্রিয়ার প্রশ্নে একটু চমকে ওঠে ছেলেটি। নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বলে, 'আমি ঠিক জানিনা কী ভাবে কথাটা বলা উচিৎ। আসলে ঊশ্রী আমায় সবটা শেয়ার করেছে। সবটা। গত কয়েক মাসে ওর জীবনের সবটুকু আমায় বলেছে। আপনাদের সকলকেই আমি চিনি ওর কথা থেকে। দেখুন ম্যাম বরুণ দত্তের বাড়িতে যাবার সাজেশনটাও আমার। এখন বিষয় হল ঊশ্রীর ধারণা হয়েছে আপনার এই একা থাকাটা নিয়ে সমস্যা হতে পারে। মানে বরুণ দত্ত মরিয়া হয়ে কিছু একটা করতেই পারে। ম্যাম আপনি ঊশ্রীর কাছে আপাতত কেন যেতে চাইছেন না সেটাও আমি জানি। এখন বিষয় হল আমি পরশু কার্সিয়াং ফিরে যাচ্ছি। আপনাকে এভাবে একা রেখে যেতে চাইছি না।' দেবপ্রিয়া অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। কে এই ছেলে? এত মায়া দিয়ে একথা বলছে কী করে? অধিকারটাই বা কী? ঊশ্রী ওর বিশেষ বন্ধু যদি হয় তাতেও কী এতটা উদ্বেগ স্বাভাবিক?

-আমায় ভুল বুঝবেন না ম্যাম। আসলে ঊশ্রী এত চিন্তিত থাকলে কাজ কিছুই করতে পারবে না। ইনফ্যাক্ট আমার মনে হয়েছে ও যে কোনো মুহূর্তে কাজ ছাড়তে পারে। রাতে তো ঘুমাচ্ছেই না। ওর রাত বাড়লে আতঙ্ক বাড়ছে।

-তোমায় বলেছে এসব ও?

-না ম্যাম বলেনি, তবে টেক্সট করেছে। আমি সকালে দেখেছি। আমি বলি কি আপনার তো নতুন লেখা শুরুর জন্য একটা চেঞ্জ দরকার চলুন না আমার সাথে। ভালো লাগলে ওখানে থেকে যান কয়েক মাস। প্রথমে আমার বাংলোয় উঠুন পরে নয় একটা ঘর ভাড়া করে নেবেন পছন্দ মতো। এতে মেয়েটা একটু স্বস্তি পায় এই আরকি।

-তুমি তো বেশিদিন ঊশ্রীকে চেনোনা দীপ্তার্ক। এতটা ওর জন্য ভাবছো কী করে?

-সন্তান গর্ভে আসা মাত্র মা তাকে ভালোবাসে, না দেখে না জেনে, দশমাস তাকে শুধু অনুভব করেই জীবনে শ্রেষ্ঠ সম্পদ বলে গ্রহণ করে তবে একটা মানুষকে দেখে জেনে বুঝে সাতমাসে এটুকু ভালবাসা যায় না ম্যাম?

-কী সহজে বললে তুমি। তোমায় বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়। বেশ আমি কাল তোমায় জানাচ্ছি। তুমি কখন ফ্রি হবে কাল?

-কাল ফ্রি হয়তো হব না তবে আমার লোক থাকবে আপনার এখানে।

-আমি যে ক্রমশ ভিআইপি হয়ে উঠছি।

-হওয়াই তো উচিৎ ছিল। এতদিন কেন হননি সেটাই ভাবছি। 


দীপ্তার্ক চলে গেলে খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইল দেবপ্রিয়া। একটা ফোন করল খানিক পর।

-কেমন আছো?

-ভালো আছি। তুমি?

-আমি বোধহয় এবার ভালো থাকব। তোমায় একটা কথা জানাতে ফোনটা করেছি।

-হ্যাঁ বলো।

-আমি কোলকাতা ছেড়ে যাচ্ছি অনুজ। একটা ক্ষীণ আলোর রেখা দেখতে পাচ্ছি। দেখি জীবন নতুন কিছু শুরু করতে দেয় কিনা।

-কোথায় যাচ্ছ?

-সত্যি তুমি জানতে চাও? কিন্তু কেন?

-না ঠিক আছে না বললেও চলবে।

-আমি কার্সিয়াং যাচ্ছি। যে শহরে তুমি নিয়ে যাবে কথা দিয়েছিলে।

-অথচ কখনো নিয়ে যাইনি। ভালো থেকো। ঊশ্রীর কাজে মন বসছে তো? ফোন করলে ধরো।

সত্যিই যে কোনদিন সব ছেড়ে যাওয়া যেতে পারে দেবপ্রিয়া ভাবিনি। কেয়ারটেকার রনেন ছাড়া সবাইকে দুমাসের মাইনে সহ ছুটি দিয়ে দিল। চলে এল অচেনা এক ছেলের হাত ধরে কার্সিয়াং। ছোট্ট বাংলোর ডানদিকে দীপ্তার্ক থাকে বাঁয়ে দেবপ্রিয়া। বাংলোর চারিদিকে পাইনঘেরা উঁচুনীচু জমি। নাম না জানা ফুলের সমারোহ। একটা পাহাড়ের প্রায় মাথার কাছাকাছি বাংলো। সামনে দিয়ে বড় রাস্তা চলে গিয়েছে। ওপাড়ে যতদূর চোখ যায় উঁচু নীচু পাহাড় আর তার মাঝেমাঝে গ্রাম। রোজ ভিডিও কলে কথা হচ্ছে মেয়ের সাথে। মেয়ে আনন্দে আটখান। গতরাতে ঘুম ভেঙে গেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওদের দুজনের কথা শুনেছে দেবপ্রিয়া।

-ম্যাডাম এবার নিশ্চিন্ত তো! আর কোনো হুকুম?

-ভাবছি ভেবে বলছি। 

-আমাকে নিয়ে কিছু ভাবলেন?

-হুম্! আমার মায়ের পাশে আপনাকে বেশ মানাচ্ছে। ফেসবুকের ছবি দেখে একটু পোড়া গন্ধ পেলাম নিজের দীর্ঘশ্বাসে। আসলে মহিলা এখনো বড্ড সুন্দরী।

-তা ঠিক তবে লেখিকার সাথে প্রেম করার মতো অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান আমার হয়নি ম্যাডাম। তাছাড়া উনি একটু বেশিইই সুন্দরী । আমার আরেকটু কম সুন্দরী পছন্দ।

-মানেটা কী? আমি সুন্দর না?

-না না সুন্দর তবে একটু কম।

-যাও কথা বলবো না। তুমি বাজে জঘন্য। 

-একটা কথা বলবো ম্যাডাম? একদিনের জন্য আসবো আপনার ওখানে? আপনাকে একবার জড়িয়ে ধরেই পরের প্লেনে ফেরৎ আসবো, পারমিশান দেবেন এই জঘন্য লোকটাকে। বড্ড ছুঁতে ইচ্ছে করছে ঊশ্রী। তোমার ঘাড়ের কাছের লালচে তিল আর...

আর দাঁড়ায়নি দেবপ্রিয়া ঘরে চলে এসেছে। সারা শরীর জুড়ে ভীষণ অতৃপ্তি তাকে ভেতর থেকে নিংড়ে নিয়েছে বারবার। আজ ভোরে হাঁটতে বেরিয়ে কেবল সে রাতের কথাগুলোই মনে পড়ছে। কোনো মানুষের বিশেষ আগ্রহের কারণ হয়ে বেঁচে থাকায় কী ভীষণ তৃপ্তি। কতদিন কতদিন হল সে বৃষ্টিভেজে না! পাহাড়ের যে বাঁকটায় ধাপে ধাপে চা বাগান শুরু হয়েছে। সেখানেই রোজ চুপ করে বসে থাকে। যতদূর চোখ যায় সবুজ মনোরম শোভা। এখানেই একসাথে থাকবে কথা ছিল দুজনে। তবু অনুজ কিসের টানে সব ছেড়ে চলে গেল কে জানে সে কথা? সবাইকে যে ভালোবাসে তাকে ভালোবাসার মত যোগ্যতা হয়ত দেবপ্রিয়ার ছিলনা। আর ঐ যে এক কিশোর তাকে আজো বাঁচিয়ে রেখেছে তাকেই বা সে ভালোবাসতে পারেনি কেন? কে জানে এই উত্তর? জীবন বয়ে চলে নিজের ছন্দে। আকাশ জুড়ে মেঘ আসে আপন খেয়ালে। একা মানুষী মধ্য যৌবনে হেঁটে যায় এই আশায় শ্রাবণের ধারার মতো কারো ভালোবাসা অঝোরে ঝরবে তার কল্পনায়। সে প্রেম বাঁচিয়ে রাখবে সে অক্ষরে অক্ষরে। নিজের সবটুকু অতৃপ্তির দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে। ভালো থাকুক অনুজ, ভালো থাকুক মরুণকিশোর। ভালো থাকুক ঊশ্রী ভালো থাকুক তার সদ্য প্রেম। দেবপ্রিয়া হেঁটে যায় পাহাড়ি পথের বাঁকে একা।






রবিবার, ১২ জুন, ২০২২

সৌমী আচার্য্য

                   


পর্ব -১২
সৌমী আচার্য্য

আদিত‍্য ভাবিয়াছিল যেকথা কহিয়া সে চন্দ্রনাথের বাড়ি হইতে ফিরিয়া আসিয়াছে সম্ভবতঃ ইহারপর চন্দ্রনাথ আর কখনো সোহাগকে লইয়া তাহার অসূয়া ব্যঙ্গ বিদ্রুপে প্রকাশ করিবে না। যদিও তাহার বুকের ভিতর একটি সূক্ষ্ম ব্যথা জাগ্রত হইয়া আছে। চন্দ্রনাথকে সে হয়ত ভালোবাসে তাই কঠিন বাক্য বলিবার অভিপ্রায় হয়না। তবু চন্দ্রনাথ গৃহে আসিয়াই যখন চড়বড় করিয়া উঠিল, তাহার যথার্থই মনঃকষ্ট হইয়াছে। বাহিরের আকাশও তাই বুঝি গভীর কালো হইয়া উঠিয়াছে।

-তোমার পৌরুষত্ব সম্পর্কে আমি ভাবিত হইয়া পড়ি। যাহার বিবাহ তাহার হুঁশ নাই আর পাড়া পড়শির ঘুম নাই। যাহার স্ত্রী সে থম মারিয়া বসিয়া আছে আর তুমি কিনা পূর্ব নির্ধারিত কাজকম্ম ছাড়িয়া তাহার স্ত্রীকে লইয়া ডাক্তার বদ্দ‍্যি করিতেছ। অথচ তুমি জানিতে তোমায় ছাড়া আমি অসহায় হইয়া পড়িব বারাণসীতে।

-আমি আশ্চর্য হইতেছি চন্দ্রনাথ তোমার অনুভূতি নামক বস্তুটি সম্ভবত লোপ পাইয়াছে। কর্কট রোগ শুনিয়াও এত কঠিন বাক্য তুমি বলিতে পারিলে।

-দেখ আদিত্য আমি তোমাকে চিনি এহেন ঘটনায় বিচলিত হইবার পাত্র তুমি নও। বাহিরের ডাক উপেক্ষা করিয়াছ আসলে অন্য কাহারো প্ররোচনায়।

-তুমি কি সোহাগকে দোষারোপ করিতেছ? এই ভ্রমে থাকিও না যে সে আমারে কিছু কহিয়াছে। বস্তুত তাহার সহিত আমার বাক্যালাপ প্রায় বন্ধ। বিগত একমাসে সে আমার ঘরে নিজে হইতে আসে নাই পর্যন্ত।

-বাব্বা ইহা আবার সদর্পে ঘোষণা করিতেছ। ভালো।

-চন্দ্রনাথ আজ তোমারে একটি কথা স্পষ্ট জানাইতে সাধ হয়। তুমি আমার বন্ধু তবে আমার স্ত্রীকে উপহাস করা তোমার এক্তিয়ার নহে। এমনকি ঠাট্টা করিয়াও তুমি তাহাকে অসম্মান করিতে পারো না। তোমার স্ত্রীকে আমি বৌঠান বলিয়া সম্বোধন করি, তাহাকে উপযুক্ত সম্মান করিয়া থাকি। সুতরাং তুমিও এই শালিনতাটুকু বজায় রাখিবে এই আমার আশা।

-আমার স্ত্রী আমার বিষয়ে খবরদালালিটি কম করেন কিনা।

-চন্দ্রনাথ, সোহাগ আর দশটি স্ত্রীলোকের হইতে আলাদা বলিয়াই তাহাকে ছোট দেখাইতে চাহে কেহ কেহ। তাহাকে ঈর্ষা অথবা তাহার মতো স্ত্রী রত্ন না পাইবার জ্বালা হইতেই সম্ভবতঃ এই আচরণ, আমি তাহা বুঝি। সে আমাকে নিয়ন্ত্রণ করিতে চাহেনা। কেবল তাহার হৃদয় জুড়ে আমার অবস্হানটিকে সগর্বে ঘোষণা করিতে চাহে মাত্র। 

চন্দ্রনাথ ফোঁস করিয়া 'আচ্ছা' বলিয়া হাঁটা লাগাইল। আদিত্য ভারী বিব্রত হইয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিল সত্যিই কি এত কিছু বলিবার প্রয়োজন ছিল।

-তুমি বলিতে পারিতে বারাণসীতে যাইবার কথা, আমি ঠিক সামালাইতে পারিতাম।

চমকে ওঠে আদিত্য। সোহাগ একটি রেকাবিতে সাদা নাড়ু, কুচো নিমকি আর খাস্তা কচুরী লইয়া দাঁড়াইয়া আছে। মেঘরঙা শাড়ির সহিত ফিরোজা পাড় মায়া জন্মাইয়াছে চেহারায়। চোখের নীচে কালচে ছোপ গভীর হইয়া জাগিয়া আছে। আদিত্যকে রেকাবিটি আগাইয়া দিয়া কহিল, 'কহো নাই কেন?'

-বসো সোহাগ। বৌঠান কি ঘুমাইতেছেন?

-না জোর করিয়া ভাসুরঠাকুরকে উহার সম্মুখে বসাইয়া আসিয়াছি। কথা কহিতেছে।

-বাহ্, উত্তম।

-আপনি কহিলেন না।

অতি আবেগে সোহাগ আদিত্যকে আপনি সম্বোধন করিয়া থাকে। আদিত্য আপনি ডাকটি শুনিয়া মনে মনে আবেগতাড়িত হইয়া উঠিল। এ যেন পূর্বরাগের প্রকাশ।

-সোহাগ মানুষ কখনোই নিজের অন্তরকে সঠিক ভাবে প্রকাশ করিতে সমর্থ হয়না। আজ তুমি নিজে হইতে কেন আসিয়াছ আমার ঘরে ইহা তুমিও জানো আমিও। আমি বারাণসীতে যদি যাইতাম তুমি আরো দূরে যাইতে।

সোহাগের চক্ষু হইতে টপটপ করিয়া জল ঝরিয়া পড়িল, 'আজ আপনি চন্দ্রনাথবাবুকে যাহা কিছু বলিয়াছেন আমি শুনিয়াছি। তবু মনে হয় আমি নিজেকে সঠিক ভাবে ব্যক্ত করিতে পারি নাই। আর আপনিও সবটা বোঝেন নাই।'

-আমিও পারি নাই সোহাগ।

-আপনি আমাকেও কখনো দূরদেশে সাথে করিয়া লইয়া যাইবেন। আপনি কখনো কখনো কেবল আমার জন্য সব ছাড়িয়া সবাইকে ছাড়িয়া আসিবেন। ঐ ছাদের আলসেতে আমরা দূর আকাশের ছায়াছবি দেখিব এইসব আশা করিয়াছি।

-সোহাগ!

আদিত্য সোহাগকে জড়াইয়া ধরিতেই সে বুকের উপর আছড়াইয়া পড়িল। আদরে আদরে পরস্পরকে অস্হির করিয়া তুলিতেই, বাহিরে শ্রাবণের ধারা ঝরিয়া পড়িল।

-----–------------------------------------------------------

এই প্রথমবার লেখা শেষ হতেই ঊশ্রীকে পড়ে শোনাল দেবপ্রিয়া। মেয়ে চেয়ে আছে বাইরে। দেওয়াল ঘড়িটা টিকটিক করেই চলেছে। নীচে ড্রাইভারের ঘর থেকে হিন্দীগানের সুর ভেসে আসছে।

-মা! জীবনের গল্পগুলো এত সহজে মেলেনা কেন?














রবিবার, ৫ জুন, ২০২২

সৌমী আচার্য্য

                  


শ্রাবণের ধারার মত


পর্ব-১১

মরুণকিশোর কোলকাতা বিমানবন্দরে নেমেই থমকে গেল। বয়সের সাথে মনটা আরো একটু বাড়লে বোধহয় ভালো হত। এসব কাজ তার ভালো লাগেনা। আশাভরা মুখগুলির দিকে তাকিয়ে নিজেই কেমন হেরে বসে থাকে তবু সিদ্ধান্ত জানতে হয়। প্রত্যাখ্যান চিরকাল তাকে  এমন এক সুরঙ্গে নিয়ে যায় যেখান থেকে পরিত্রাণের পথ তার জানা নেই। কেবল দমবন্ধ করা পরিস্হিতিতে সময়ের উপর নির্ভর করে হাল ছেড়ে দিতে হয়। সাইন্সসিটির বড় অডিটোরিয়ামে একঝাঁক তরুণ ছেলেমেয়ে জড়ো হয়েছে। সেখানে পৌঁছে হলে ঢুকে মরুণকিশোর ভীষণ সংকুচিত হয়ে উঠল। উদ্যোক্তারা ভালো ভালো কথা বলেছে। বুঝিয়ে দিচ্ছে তাদের উদ্দ্যেশ্য কী।

-আমরা চাই তোমরা যারা নতুন প্রজন্ম তারা প্রত্যন্ত এলাকা চেনো জানো। তোমাদের মধ্যে সবাই যে হায়ার স্টাডি করবে তেমনটা নয়। অনেকেই আছে বিভিন্ন কারণে এখনি উপার্জন করতে চায় অথচ তাদের রেজাল্ট আউট স্ট্যাণ্ডিং। আমরা চাই জিওলজিক্যাল সার্ভের বিভিন্ন ক্ষেত্রগুলো তোমরা ভালো করে বুঝে নাও। ঘাটশিলার কপার মাইনের কর্মকর্তারা আমাদের এই কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন। তোমাদের মধ্যে থেকে দশজনকে নির্বাচন করবেন তারা। একবছরের কাজ শেষে তোমরা পেপারস্ জমা দেবে ওনারাই তোমাদের কাজের ভিত্তিতে তিনজনের হায়ার স্টাডিজের ব্যবস্থা করবেন বা স্হায়ী চাকরীর। এই একবছর তোমাদের গবেষণামূলক কাজটির জন্য ওনারা তোমাদের চারলক্ষ টাকা দেবেন। অর্থাৎ নিজে উপার্জন করবে এবং স্বনির্ভর হবে।

সারা হল হাততালিতে ফেটে পড়ল। আরো অসহায় হয়ে উঠল মরুণকিশোর। গোধূলিমাসির বাড়িতে গরমের ছুটিতে এসেছে সে। তার গল্প বেরিয়েছে নামকরা পত্রিকায়। হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে বলল, 'পড়ে দেখো আমাদের পুরীর গল্প আছে।'  পড়তে গিয়ে হতবাক হয়, এক এমন পুরুষের সাথে দেখা হয় এক অষ্টাদশীর যার গ্রেস স্টাইল সব যেন চমকে দেবার মতো। অষ্টাদশী যে দেবপ্রিয়া তা বোঝা যায় সহজেই কিন্তু পুরুষটি মরুণকিশোর নয়। বুকের ভেতর যে কারিগর নরম হাতে ছবি আঁকছিল আচমকা দুরমুশের শখ জাগে তার বুক মুচড়ে ওঠে। কী বলবে সে ঠিক কী বলা উচিৎ তার? ক্যারিয়ার সবার আগে! মন প্রেম মানুষ স্মৃতি সব ব্যর্থ?

-আমি আসলে খুব বাজে বক্তা। প্রকৃতপক্ষে মস্তিষ্ক নামক বস্তুটা আমার কমজোরি। তবে যদি সত্যিই অন্তরের তাগিদ অনুভব করো তবেই এসো এগিয়ে। টাকা সব নয় বলেই আমার অনুমান।

এটুকু বলে আবার গুটিয়ে গিয়েছে নিজের ভেতর। ছবি ছাড়া প্রোফাইল ও কেন কাজটা করতে চায় স্টুডেন্ট সেটাই জানতে চাওয়া হয়েছিল। সবচে ভালো লাগা কাগজের মেয়েটির নামটি ঊশ্রী রায়। মেয়েটি আসতেই মরুণ চোখ নামিয়ে নিল। এমন চোখ দেখলেই সে ভয় পায়।

-লিখেছো কুশ্রী অতীত থেখে মুক্তি চাও আর মাকে নিয়ে কোলকাতা থেকে দূরে যেতে চাও তাই এইকাজ চাই। পড়াশোনা বা অর্থ তোমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়?

-না নয়। আমার যতটুকু চাহিদা ততটুকু আমার মা ভালো মতো মেটাতে পারেন। আর পড়াশোনা আমি যতদূর চাই উনিই করাতে পারেন।

-হুম্! বাবাকে নিয়ে যাবেনা সাথে।

-জানিনা আপনার এই প্রশ্ন কতটা জরুরি তবু বলছি আমার ঠিকঠাক বুদ্ধি হবার আগে থেকেই বাবা মা আলাদা। আর কিছু জানতে চান?

-হ্যাঁ চাই। তুমি যদি কাজটা পাও কাকে জানাবে আগে?

-দিদামাকে।

মরুণ বলে, 'ওনাকে ফোন করো'। মেয়েটা ম্লান হাসে, 'ওখানে ফোন নেই।'

-কোথায়?

-স্বর্গে।

মরুণ তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিতেই মেয়েটি বলে, 'আর কিছু প্রশ্ন করবেন? নাহলে আমি যাব। মা আজকাল টেনশান করেন।'

-কী করেন তোমার মা?

-আমার মা লেখিকা। যদিও আরো অনেক কিছুই হতে পারতেন।

-তুমি তোমার মাকে খুবই ভালোবাসো মনে হচ্ছে।

-উনি ভালোবাসার মতোই। তাহলে আমি উঠি স‍্যার।

-হ‍্যাঁ এসো। এপয়েন্টমেন্ট লেটার পৌঁছে যাবে ঠিক সময়ে।

ঝলমল করে ওঠে মেয়েটা তবে আশ্চর্য সংযত। ওর চোখের ভেতর ছায়া জেগে আছে যার তাকে দেখার সাধটা নিষিদ্ধ বলে দেগে দিয়েছে সময়। মেয়েটা অপ্রস্তুত হচ্ছে হয়ত তাকে লম্পট ভাবছে। মরুণকিশোর চোখ নামিয়ে নেয়। ঊশ্রী যেতে গিয়েও ঘুরে দাঁড়ায়।

-স্যার আপনি কৈশোরে পুরীর মন্দিরে কী কিছু খুঁজতে গিয়েছিলেন?

চমকে ওঠে মরুণ। উঠে দাঁড়ায় চেয়ার থেকে। ঊশ্রী আলতো হেসে বলে, 'মাস তিনেক আগে মা সমুদ্রের পাড়ে বসে আপনার কথা বলেছিলেন এমন অদ্ভুত নাম খুব বেশি মানুষের হবেনা বলেই আমার মনে হয়েছিল তাই একটা চান্স নিলাম। স্যার আসবেন আমাদের বাড়ি সময় পেলে মা আপনাকে দেখলে খুশি হবেন। চলি স্যার।

-শোনো ঊশ্রী তোমার মায়ের নাম...

-অবিশ্বাস্য লাগছে আপনার তাইনা! আমারো লেগেছিল এখানে এসে আপনার নাম জেনে।তবে এটাই সত্যি আমার মায়ের নাম দেবপ্রিয়া।

পায়ের নীচের মাটিটা দুলে ওঠে। ঊশ্রী বেরিয়ে যেতেই হেরে যাওয়া মরুণকিশোর মনে মনে পলাশগাছ জড়িয়ে ধরে সর্ব শক্তি দিয়ে। যতগুলো দিন যতগুলো রাত কেবল তার সাথেই পথ হেঁটেছে সে মনে মনে, সেই ক্রমশ ছোট হতে হতে বিন্দু হয়ে যাচ্ছে অথচ গোধূলিমাসিদের ছাদের পাঁচিলঘেঁষে যেখানে বকুল গাছটা আলসেমি করে জাঁকিয়ে বসেছিল, সেখানেই বলেছিল দেবপ্রিয়া, 'তোমার সাথে থাকলে মনে হয় বৃন্দাবনের পথে পথে কী যেন এক কান্না ভেজা  সময় খুঁজে চলেছি। এই বকুলফুলের গন্ধে ভেতরে ভেতরে রাধা হয়ে উঠছি। অথবা রাজস্হানের এক মেয়ে যে গিরিধারীর প্রেমে বিভোর সে বুঝি আমায় ছুঁয়ে যাচ্ছে। আমার খুব কষ্ট হয় আবার আমার খুব ভালো লাগে। কী করবো বুঝি পাইনা কেবল ছুটে ছুটে গোধূলিমাসির বাড়ি আসি। তুমি মনে মনে আমায় পাগল ভাবছ তাই না?' মরুণ সরমে মরে যায়। এমন মাধুকরীর সঙ্গী হবে বলেই সে যে  পাল তুলে রেখেছে। পাগল হতেই তো চায়। পাগল ভাববার অবকাশ যে তার নেই। 

-আজ থেকে বহু বছর পর আবার যখন দেখা হবে, তুমি বুড়ো হয়ে যাবে, আমিও। সেদিনো তোমাকে দেখলেই আমি বকুলের ঘ্রাণ পাবো মরুণ। কাকে খুঁজছিলে পুরীর মন্দিরে বলো না?

কিছুতেই এই সহজ উত্তরটা দেওয়া হয়না। বুড়ো হলে দেখা হবে কেন? কেন জীবনের আগত সময় তাকে ছাড়া কাটবে এই ধাঁধাঁ কিছুতেই কাটাতে পারেনা মরুণ। আজো পারেনি। প্লেনটা মেঘের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে কোলকাতাকে আবছা করে দিচ্ছে ক্রমশ।



(ক্রমশঃ)