বাংলা পর্নোগ্রাফির ভূত ও ভবিষ্যৎ
------------------------------ ------------------
পম্পেই মন্দির ও প্রাসাদ পৃষ্ঠে খোদাই করা মূর্তিগুলি ছিল পর্নোগ্রাফির বেহতৃণ নমুনা, যা কালক্রমে একটি গ্রিক জঁর হিশেবে স্বীকৃতি পায়। কিন্তু আমাদের অজন্তা-ইলোরা বা খাজুরাহো-কোনারকের স্থাপত্য অমন কোনো পৃথক জঁর বলে দাগায়িত হয়নি। কারণ এ দেশীয় অলঙ্কারশাস্ত্রে যৌনতা মোটেই অনৈতিক বা অবৈধ ছিল না। যৌনতা বিষয়ে সনাতন ভারতীয় মূল্যবোধটি ইসলামিক চাপে পিষ্ট হয়ে ছিটকে গিয়ে পড়েছিল বৃটিশ ইম্পিরিয়ালিজমের থাবায় তলায়। ওই শ্বেতাঙ্গ বণিকরাই এ দেশে পর্নোগ্রাফি ইমপোর্ট করেছিল ফের তাকে নিষিদ্ধ করার আইনটিও। সিকিভাগ রেনেসঁসের কৃপায় বাঙালির শব্দ ও তার অর্থ মেট্রপলিস গিল্টি পায় এবং বাংলা শব্দ ক্ৰমে 'নান্দনিক' হয়ে ওঠে। বেশি নয়, উনিশ শতকীয় সহজ সরল শব্দ 'মাগী' কীভাবে কালক্রমে নিছক অবজ্ঞা, হীনতা ও খিস্তির রূপ পরিগ্রহ করল সেটি ঠিকঠাক গবেষিত হলে বাঙালি কৌমের স্মৃতি বিপর্যয়ের ধন্দটিও ফাঁস হয়ে যাবে।
বৃটিশ হস্তক্ষেপে বাংলা সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণের কর্তৃত্বটি চলে যায় 'ছোটো ইংরেজ', অর্থাৎ হিন্দু সবর্ণদের হাতে। মানে, বাউন-কায়েত-বদ্যিদের কব্জায়। ফের রবিবাবু নোবেল পেলে বাঙালি কবিসাহিত্যিকদের কৃশ গাঁড়ে 'বুদ্ধিজীবী'র ঠাপ্পাটাও গেঁথে বসে এবং সবর্ণপুঞ্জের উক্ত চাঙড়টি একটি 'সুবর্ণ মডেল' ধার্য করে বাংলা সাহিত্যের ন্যাড় আটকে দেন। নিক্তির মাপে, এবং যষ্টির প্রহারযোগে তাঁরা বুঝিয়ে দেন, 'এটা' লিখবে কিন্তু 'ওটা' লিখবে না। এ-ভাষায় লিখবে, ও-ভাষায় লিখবে না। প্রেম লিখবে, কিন্তু রতি লিখবে না। বোঝানো হলো : জীবন সম্ভোগ মানে পাপ। যাহা পাপ, তাহা সাহিত্যে বর্জ্যবস্তু।
কিন্তু ইতিহাস নামক গুনিনটি অতিশয় ঘাগু। সে ওই ধাপকি ধরে ফেলল। কলকাত্তাই সবর্ণপুঞ্জের সমস্ত গদ ও মালিন্য তথা জরা কালক্রমে ফাঁস হয়ে পড়তে থাকে একশ্রেণীর লেখকদের কাছে। তাঁরা বাংলা সাহিত্যের ওই কলোনিয়াল ভাবকল্পটিকে ক্রমশ ঘৃণিত ও ত্যাজ্য মনে করতে থাকেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে জীবন-সম্ভোগ মানে পাপ নয়। জীবনে যা-কিছু সম্ভোগ, কোনোটাই পাপ নয়। জীবনকে লেখা পাপ নয়। সাহিত্যে ভদ্র-অভদ্র, শ্লীল-অশ্লীল, ছাপ্য-অছাপ্য বলে কিছুই হয় না। সাহিত্যের ভাষা বা বিষয় কারুক্কে শ্লীল বা অশ্লীল করে না। হিংসা, হত্যা ও রেন্ডিগিরি সমাজের আদিমতম এবং সবচেয়ে জমাটি বৃত্তি। হিংসা ও হত্যার খুঁটিনাটি বিবরণ দিয়ে তিলে তিলে গড়ে তোলা হয় বেস্টসেলার ক্রাইম স্টোরি। কেউ সেটাকে পাপ বলে না। অশ্লীল বা অভদ্র বলে না। এক মৈথুন বিষয়ক খুঁটিনাটি লিখলেই কাশীদাসী থানইট পাপবিদ্ধ হয়?
ব্রিটিশ হস্তক্ষেপের আগে পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য 'পাপ' বা 'অশ্লীলতা'র তোয়াক্কা করেনি। কারণ তা স্ফুরিত হতো মূলত দেশজ বাঙালি ----- কর্মকার-মালাকার-বৈরাগী-ময়রা-মু চি প্রভৃতির মাধ্যমে, ইংরেজদের জলচোয়া জ্ঞান-যুক্তি-এনলাইটেনমেন্টের আলোয় যাঁরা কখনই আছন্ন হয়নি। তবু কেন-জানি বাংলায় কামসাহিত্যের আগাগোড়া অভাবই থেকে গেছে। উনিশ শতকের আগে অব্দি ভারতচন্দ্রের 'বিদ্যাসুন্দর'ই ছিল বাংলা কামসাহিত্যের সম্ভবত একমাত্র, এবং অবশ্যই সর্বাধিক প্রভাবশালী নিদর্শন-গ্রন্থ। বিদ্যাসুন্দরের জনপ্রিয়তা ছিল গগনস্পর্শী। অতএব অনুমান করা যেতে পারে বিদ্যাসুন্দরের দেখাদেখি বা তাকে নকল করে বাংলায় সেসময় আরও অনেক বই লেখা হয়ে থাকবে। কিন্তু সেইসব কাম ও যৌনকেন্দ্রিক তামাম 'অশ্লীল' সাহিত্যকর্মের সঙ্গে, লোকসমাজে প্রচলিত ধাঁধা-কৌতুকী-ছড়া এবং সামাজিক বিশ্বাসের মতই, ব্যবসায়িকতার সরাসরি কোন সম্পর্ক ছিল না বলে সেগুলি তেমন প্রচার পায়নি। ফলে, সেহেন অজস্র বইয়ের হদিশও লঙ সাহেব বা তাঁর অনুচরের দল পায়নি। বাংলায় তথাকথিত শিষ্ট সাহিত্যের পাশাপাশি আদিরসাত্মক বা পর্নোগ্রাফিক লেখার ঢল শুরু হয় ছাপা বইয়ের বাজার গড়ে ওঠার পর ----- উনিশ শতকের মাঝামাঝি।
সেসময় দেশীয় উচ্চবর্গের তথাকথিত 'শিষ্ট-ভদ্র' সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকদের হায়রার্কির চোখে বইগুলি 'বিপজ্জনক' প্রতিভাত হয়েছিল। অর্থাৎ ঘুরেফিরে আবার সেই তথাকথিত ভদ্রপুঞ্জের লোকেদের নিরেট ধাপ্পাবাজির কথাই এসে পড়ে। যাদের চিরাচরিত আতঙ্ক যে এহেন সাহিত্য অশ্লীল এবং এই অশ্লীলতার টুঁটি টিপে না ধরলে তাদের ভদ্দরপুঞ্জের সাহিত্য কলুষিত হয়ে পড়বে। ভাষা ও সংস্কৃতির যে স্ট্যান্ডার্ডাইজেশান প্রক্রিয়াটি সেদিন এলিট অভীষ্ট ছিল, সেই কর্তৃত্বের ধারণাটিকেই যেন চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল ওইসব বটতলা ও আদিরসাত্মক বইপত্র। দেশজ ব্রাহ্মণ্য রক্ষণশীলতা এবং ভিক্টরীয় মূল্যবোধ যুগপৎ মিলেমিশে গড়ে তুলেছিল ভাষা-র ভিতর থেকে আদিরসাত্মক অনুষঙ্গ, শরীরী উল্লেখ বর্জন করার এই ক্ষমতা-প্রক্রিয়া। স্পষ্টতই বটতলার আদিরসত্মক বই ছিল সেই ক্ষমতা-কাঠামোর প্রতি এক ধরনের অন্তর্ঘাত, বা ঘামলাঘাট।
যৌনতাকে 'অশ্লীলতা'র সঙ্গে কীভাবে যুক্ত করতে হয়, সাহিত্যে যৌনতাকে কীভাবে আড়ালে-আবডালে রাখতে হয় ---- এর কেরদানি আমরা ইংরেজদের কাছে শিখলাম। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালির এই যৌনসংস্কার ও যৌন-অবদমন পরবর্তী বাংলা সাহিত্যকে রাহুর মতো গ্রাস করেছিল।
কামসাহিত্য যদি পাপ হয়, মাঝেমাঝে অমন পাপ করা উচিত। পুণ্যের মত। পাপ না করলে পুণ্যের স্বাদ মেলে না। শুধু কিনারে দাঁড়িয়ে আচমন-মাত্র করে সমুদ্রের স্বাদ পাওয়া অসম্ভব, তাতে নামতে হয়। বইপাড়া বা বইমেলায় সহজলভ্য যেসব ব্লো-হট উপন্যাস বিকোয় মনোলোভা ব্রেসিয়ারের মোড়কে, সেসব গল্প-আখ্যান আর যাই হোক ---- প্ৰকৃত কামসাহিত্য বা পর্নোগ্রাফি নয়। তাছাড়া আজকের দিনে ফুটপাথে বস্তা বিছিয়ে যেসব চক্ষুহারী হলুদ বই দেখা যায়, সেগুলিও কাম সাহিত্য নয়। সেসব ভুল বানান ও প্রমাদ-কণ্টকিত অক্ষরে ছাপা অতি-চটুল পুস্তিকা সমূহ আমাদের অভিনিবেশ দাবি করতে পারে না। সেগুলিই আসল অশ্লীল বই। সেগুলিই আসল মল, যা বর্জ্যবস্তু। আদিরসত্মক ন্যারেটিভ বা পর্নোগ্রাফি ওসব নয়। সত্যিকারের পর্নোগ্রাফি, যাহা একাধারে কাম ও সাহিত্য, যতই অশ্লীল বা পাপকর্ম হোক, পড়তে হয়।
অথচ বাংলা ভাষায় 'পর্নো' আর 'সাহিত্য' এখনো দু-ফালা বেদানার মত দু সাইডে আরক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। শরৎচন্দ্র গৃহভৃত্য আর ঝি-এর মশলা-প্লট যদি বা এনেছিলেন, ----- ঝিয়ের সঙ্গে মালিকের গাবগুচিই দেখাতে পারলেন না। তেমনি, দেওর-বৌদির প্রেম ও যৌন সম্পর্ক যদি-বা 'নষ্টনীড়ে' একটু-আধটু এল ---- কিন্তু বড্ড মিউমিউ করে। পরবর্তীকালে সুপারহিট সুড়সুড়িবাজ নিমে ভটচাজও বউদিকে শাড়ি-ব্লাউজের ওপাশেই রেখে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। এমনকি, ---- বন্ধুর মা, মাতৃসমা নারী, নয়নের সঙ্গে গোপালদেবের যৌনসম্পর্কও এনেছেন অসীম রায়, কিন্তু সেখানেও 'অত হামলিয়ে আদর করিস নে, ওটা টেঁকে না' বলে শাড়ি জড়িয়ে ফেলেছে নয়ন। ঝিয়ের সঙ্গে গৃহকর্তার গাবগুচির গল্প লিখেছেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ('মাঝের দরজা'), কিন্তু সেখানেও কন্ট্রাসেপ্টিভ লাগাবার পর মশারির অন্দরে অন্ধকার ঘনাইয়া আসে।
এ কথা ঠিক যে প্রথম শ্রেণীর উচ্চাঙ্গ দেহব্রতী উপন্যাস রচনার চেষ্টা ---- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'চতুস্কোণ', সমরেশ বসুর 'বিবর', কমল চক্রবর্তীর 'ব্রাহ্মণ নবাব', সুবিমল মিশ্রর কতিপয় গ্রন্থ, এমনকি অজিত রায়ের 'যোজন ভাইরাস', 'ঘামলাঘাট' এবং 'খানাখারাব'কে মাথায় রেখেই বলছি ---- বাঙালি লেখকরা খুব-একটা করেননি। কেননা যৌনতাকে নিয়ে লেখা সবচেয়ে কষ্টকর এবং সে-ক্ষমতার একান্ত অভাব থেকে গেছে তাঁদের মধ্যে। এছাড়া কৈশোর থেকে কাম ও যৌন বিষয়ে নানারকম অবগুণ্ঠনজনিত বিকৃতি নিয়ে বেড়ে ওঠা বাঙালি লেখকদের মস্তিষ্কের কাছে যৌনতার মতো গম্ভীর বিষয় নিয়ে নিরপেক্ষ রচনা আশাও করা যায় না।
প্রকৃত সত্য হল, বাংলা সাহিত্যে 'পর্নো' আর 'সাহিত্যের' মাঝখানে এখনও সেই নষ্টনীড়ের দেওর-বউদি সম্পর্ক। দুজনেই দুটি ভিন্-ভিন্ কামরায় শুয়ে কাতরাচ্ছে। বৃহত্তর বাংলা সাহিত্যে তাদের ঠাঁই জোটেনি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন