মঙ্গলবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৬

চন্দ্রাণী বসু





হিস্-হিস্....হিস্-হিস্...
শব্দটা শুনলেই কি মনে পড়বে?
পাশের বাড়ির অমুক বৌদি,তমুক দিদি তার কোলের বাচ্চাটাকে হিসু করাচ্ছে...অথবা হেলে সাপ ডাকাডাকি করছে,অবশ্য ফোঁস ফোঁস,না হিস্ হিস্ ,সেটা কনফার্ম নয়...তাই দুইই চলে!!


তো এই হিস্-হিস্ নিয়েই ঘটে গেল দত্ত বাড়িতে এক মহাভারত।
রাজসূয় যজ্ঞটাও মায় বাদ দিলে নেকো!!
ধৃতরাষ্ট্রকে সঞ্জয় যেমনি শুনিয়েছিল,আমিও ধারাবিবরণ খান দিই?কি বলেন?
না !না ভুল বুঝে গাল ফোলাবেন না।আপনাগো অন্ধ বলি নাই। এগুলান হইল কথাগুলার গয়নাগাটি মত।

তো হ্যাঁ !হল গিয়ে....
মাস চারেক আগে দত্ত বাড়ির বড় গিন্নি তিন ছেলে, ছয় বৌমা(তিন আড়ালে),অকম্মের ধাড়ি(চক্কোত্তি গিন্নী এই কইতেন)সোয়ামি, একখান হদ্দ জোয়ান ভাগ্নে, পেটের সুদ শত্রু হাফ ডজন নাতি নাতি রেখে পটল তুললেন,থুরি সজ্ঞে গেলেন।
বডি পুড়িয়ে, সাদ্ধ ইতি করে সবে সবে যখন গয়না গুলো ভাগাভাগির গন্ধ সকলের নাকে ঘুরঘুর করছে,ঠিক সেই সময় ...হিস্ হিস্ !হিস্ হিস্।

প্রথম রাতে হক্কলে ভাবল ছোট বৌমার কীত্তি।কোলের টাকে হিসু করাবার নামে হক্কলের ঘুম ভাঙাবার ফন্দি।

এ বাড়ির কে না জানে!সেই কবে থেকে তার ঘরলাগানো কলঘরের শখ।গিন্নি মা বেঁচে ছিলেন বলেই কি না,ট্যাঁ ফুঁ হয় নি।
এবার শুরু।পাশ ফিরে হক্কলে ঘুম লাগালেন,আর ছোটবৌমার ঘুম হল গিয়ে কুম্ভকর্ণা।তাঁর কানে এ সব ঢোকে না।গিন্নী মা'র অমন বাঁজখাই গলাই ঢুকত না সকাল বেলা...তার এ তো কোন ছাড়!!!

তো!এই নিয়ে পর পর দু দিন হল।কাঁহাতক্ সহ্য হয়‌।পুরুষমানুষ গুলো সারাদিন খেটে খুটে এসে একটু ঘুমোবে তার শান্তি নেই কো??
বড় বউ এর ঘরের খিল খুলল।

"-হ্যাঁরে! ছোট,রাতবিরেতে রোজ কি শুরু করলি বল তো!!তোর সোয়ামীটা না হয় ম্যানতামুখো।আমাদের গুলো তো পুরুষ,না কি??
বলি!!ঘুম টুম তো আছে??না কি??সরাসরি ক'না বাপু,যা কবি।ঘোমটার নীচে খ্যামটা নাচিয়ে লোক জ্বালাস কেন?বলি ও ঠাকুরপো বউ টারে তো মাথায় তুলেছ!লজ্জা সরম কিছু আছে না কি??"

মেজোর ঘরে খিলের আওয়াজ।সচারচর ভাবনা দুই ঘরের এক হয় না আজ হল।

"-যা কয়েছ দিদি! আমারো তো একখান বসার ঘরের কত্ত শখ!কয়েছি কোনোদিন?না এমন তর জ্বালায়েছি।ছোট খিল টা খোল দিকি নি এবার! কি চাস কি? হ্যাঁ?"

ছোটর ঘরের খিলের আওয়াজ।
ছোট দেওয়ের গলা।

"-বলি রাত দুপুরে হচ্ছে টা কি?গালমন্দ করার সময় জ্ঞান ও কি মায়ের সাথে ওপরে তুলে দিয়েছ?
ছোট তো নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে।আর চিন্টুকে সামলাতে একেই আমার ঘুম নেই।তার ওপর দুই বউ মিলে হচ্ছে টা কি? বড়দা ,মেজদা ব্যাপারটা কি শুনি খোলসা করে।"

বড়দা ,মেজদা র ও প্রবেশ রণভূমিতে।যুদ্ধ যখন বেশ জমে উঠেছে তখন এ বাড়ির বড় নাতনী তিন্নীর প্রবেশ।

"-সবাই চুপ করবে???শব্দটা তো এখনো হয়ে যাচ্ছে!!"

এক মুহূর্ত সবাই চুপ! তারপর সকলের দিকে সকলের চোখ স্থির।তারপর ই মুহূর্তে বারান্দা ফাঁকা।
সমবেত কন্ঠে সকলে
"-রাম ! রাম! রাম! রাম!রাম !রাম!"
বহুদিন এমন শোনা যায় নাই।তিন ঘরে একই শব্দ!!

পরদিন সকালে বাড়ির সবাই গোল টেবিল বৈঠকে।বলি হচ্ছেটা কি ?শব্দ শুধু রাতেই হয়!!!!আর সকলের কথায় এটা স্পষ্ট যে শব্দ আসে উঠোনের ওপারের কলঘর থেকেই।

তবে আর তেনাদের ছাড়া কার কাজ হবে?

শাশুড়ি ঠাকুরণ আবার বড় বেশিক্ষণ কলঘরে থাকতেন।ছুঁচিবামনি বলে বউরা তো কম গালি মনে মনে দেয় নি।ভয়টা বেশি তাদেরই তাই।

তারা ঠিক করেই ফেলেছে কলঘরমুখোটি তারা আর হচ্ছে না।এর বিহিত না হওয়া অবধি বাপের বাড়ি চলে যাবে‌।শাড়ি ,গহনা গোছানো ও শুরু।
নিজেদের বরদের ও সামলে দিচ্ছে,রাস্তা ঘাট যেখানে বসে প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে পারে,কিন্তু ঐ কলঘর নৈব নৈব চ!
সবাই প্রায় রাজী,ঠিক এমনি সময় বাড়ির হদ্দ যোয়ান ভাগ্নেটি হাজির।ভূত -প্রেতে তার ভয় নেই।শেষ দুদিন শ্মশানেই তার ঠেক ছিল।
সে এসব তুড়ি মেরে উড়িয়ে বলল, 
"-খোদ রামচন্দ্রের বাড়িতে কোন্ ভূতের আড্ডা।আমি ও দেখতে চাই।কোনো কুকুর বা সাপ হবে!! যত্ত ভীতুর দল সব।"

ভীতুর দল বলে বাকিদের তাচ্ছিল্ল করে সে একটা রাত চাইল।সকলে তার সাহস আর মুগুর ভাঁজা চেহারায় ভরসাও করল।যদিও গিন্নী মা বলতেন এক ফুঁ য়ে তাকে শোয়াতে পারেন।তবুও...দেখাই যাক।তবে আজ সব কলঘরের কাজ পাশের বাড়িতেই করা হবে।ওমুখো আর বাকিরা কেউ হবার সাহস দেখালো না।ভাগ্নেটি যদিও দিব্যি স্নান করেই এল কলঘর থেকে।তারপর পেট পুরে খেয়ে ঘুম ও দিল।বৌদিরা একটু বেশিই যত্ন করল সেদিন তাদের দেওরটিকে।
সন্ধ্যে ঘনিয়ে রাত।সব্ বেশ থমথম।টাইমকলের শেষ জল আসে রাত দশ টায়।ভাগ্নে কল বন্ধ করেনি।তাই দিব্যি জলের আওয়াজ আসছে।
এগারোটায় জলের শব্দ বন্ধ হল।

ঠিক তার কিছুক্ষণ পর!আবার!!রাম!রাম!! ....মনে মনে জপছে সবাই।কারেন্ট অফ্।একটা হ্যারিকেন আর হাতে একটা লাঠি নিয়ে ভাগ্নে বাবাজী চলল।
সবাই ঘরে খিল দিয়েছে প্রায়।শব্দ কিন্তু চলছেই।
হঠাৎ ভাগ্নের চিৎকার....
"-মাগো!!!!"
তারপর চুপ!শুধু হিস্ হিস্ শব্দ আর রাম্! রাম্ ! ছাড়া দত্ত বাড়িতে আর কিছু শোনা গেল না।
ভোর বেলা বড় বউ দরজা খুলেই আবার ঘরে পালাল।বড়কে ধাক্কা মেড়ে বলল...

"পোড়ারমুখো,এখন ঘুমোবার তাল হচ্ছে? বাইরেটায় গিয়ে তোমার ভাইটারে দেখ দেখি।কি ছিত্তির করে বারান্দায় পড়ে আছে।"
বড়দা ধড়মড় করে বাইরে গিয়ে দেখে,পিসতুতো ভাইটির তখনো জ্ঞান ফেরে নাই।নিম্নাংশ পোষাক শূন্য।লাঠি,হ্যারিকেন,লুঙ্গি উঠানে গড়াগড়ি।
জ্ঞান ফেরার পর যেটুকু উদ্ধার হল,কলঘরে কোন জন্তু নেই,একটি লাল কাপড় যেমনটি ঠিক মামীমা পড়তেন।

ব্যাস! এবার সব নিঃসন্দেহ!!!

বড় কত্তা বড় ছেলেকে ডেকে বললেন-
"সব কাজের ভার আর টাকা তো তোমাকেই দিয়েছিলুম।তো কাজ কম্ম সব নিয়মমতে হয়েছে তো?হাতটানের স্বভাব তোমার গেল না বাপু!পুরোহিতকে আমি খবর দিয়েছি।"

বড় ছেলের মুখ শুকিয়ে গেল,আর পুরোহিত ও হাজির।
কত্তা মশাই বলে উঠলেন-

"টাকা নেওয়ার সময় তো,কম হবে নি বাপু! গিন্নি মা নাকি তোরও মা!তো কোথায় ফাঁকি দিয়েছিস সত্যি বল!!নইলে আজ রাত তোর ঠিকানা আমার কলঘর"
কাঁপতে কাঁপতে পুরোহিত বলল-

"-আমি আর কি করলুম,কত্তা বাবা!বড় দাদাবাবুই তো বললেন শর্টে ছাড়তে।মেজো দাদাবাবুও ঘাড় নাড়লেন।আমি একটু ছোট করে দিলুম।কোনটা যে বাদ গেছে কে জানে?আমি কি ছাই মানে বুঝি?কত্তা বাবা ক্ষমা!"
বলেই কত্তার পায়ে একটা লম্বা জাম্প।
কত্তাবাবা রেগে কাঁই।বড় দুই ছেলের দিকে ভস্মকরা দৃষ্টিতে তাকিয়েই বলে উঠল-

"ছাড়! ছাড়! পা ছাড় এখুনি।নিজের বংশ দুটোকে আমি না তাড়িয়েছি তো আমার নাম রঘুনাথ দত্ত নয়।তুই এবার উপায় বল"

পা ছেড়ে উঠেই পুরোহিত বাম হাত দিয়ে ডান হাতের তালু চুলকাতে চুলকাতে কাঁপা গলায় বলল ,

-"উপায় একটা আছে!যজ্ঞ। খরচ......."
-"কত? শুনি?"
-"আজ্ঞে তা হাজার পাঁচেক হবে"
"-তাই কর! কোনো ফাঁকি দিবি নে"
"-না কত্তা বাবা! কান মুলছি,আর নয়,কোথ্থাও দেব নি"

যজ্ঞ হল। তবুও কাজ হলনি।বড় ছেলে নিজের খরচায় গয়ায় গিয়ে পিন্ডি দান করল।তাও এক.. বাড়ির বউরা সব বাপের বাড়ি।

এ ভাবে আর কদিন চলে! জলের দরে বাড়ি বেচাও প্রায় ঠিক করে ফেললেন কত্তা মশায়।

এমন সময় এক দুপুরে এক রোগা পাতলা ছেঁড়া জিন্স পড়া পাড়ার ছোকরা এসে হাজির!!
"-কত্তা বাবু!আসব?একটা কথা ছিল।"
কত্তা বাবু এই ছোকরা গুলোকে একদম সহ্য করতে পারে না।রকে বসে আড্ডা।তার উপর এইটির তো আবার বড় নাতনির দিকে বড় ঝোঁক।নাতনীটিও আড় চোখে তাকায় দেখেছেন কত্তা বাবু।বাড়ি বেচবেন খবর পৌঁছনো মাত্র এসে হাজির বুঝেছেন।টাকার ধান্দা!!
তাই কড়া গলায় বললেন-
"-কি চাই?"
"-বাড়িটা না বেচলে হয় না দাদু?"
"-মানে!"
"মানে ও সব ভূত-ফুত কিছু নয় দাদু,বিজ্ঞান !ঐটা বিজ্ঞান!"

তেলে বেগুনে জ্বলে গেলেন কত্তা বাবু।দুদিনের ছোকরা বলে কি না ... বিজ্ঞান শেখাবে?রেগে বললেন-
"কিসের বিজ্ঞান? বেশ জ্ঞানী হয়েছ দেখছি।তা বেশ ! শব্দটি বন্ধ করে দেখাও দেখি।কপচিও না।"
"ও বন্ধ হবে না ,দাদু"
"কি?"
"হুমম। কিন্তু দিদিমার ভুত ও ও নয়।"
"তবে?"
"আজ সকলকে তবে বাড়ি ফেরান,রাতে আসব।"

বলেই ছোকরা হাওয়া।কত্তাবাবু ভেবে দেখলেন,সব সিদ্ধান্ত তো পাকাই,তার আগে একবার না হয় পরখ করেই দেখি ছোকরা কি বলে।যতই হোক বাপ ঠাকুরদার বাড়ি বেচতে বড় বুকে লাগছে।
তার নির্দেশেই সকলে বাড়ি ফিরল।তিন্নী একটু বেশিই খুশী খুশী কারুর চোখ এড়ালো না।
রাতে মস্ত একটি টর্চ নিয়ে এল ছোকরা।কারেন্ট যদিও সেদিন দিব্যি আছে।ছোকরা কলঘরের আলো জ্বালালো,বহুদিন বন্ধ আলো জ্বলল না।
টর্চ নিয়েই সে এগিয়ে গেল।তিন্নীর অবশ্য বুকটা বেশিই কাঁপছিল।
বাথরুমে ঢুকে কিছুক্ষণ সাড়াশব্দ নেই।সবাই রুদ্ধশ্বাস চুপ।তিন্নী এবার কেঁদেই ফেলবে।ঠিক এই সময় কলঘর থেকে আওয়াজ-
"আলোর সুইজটা টিপুন তো"
তিন্নী দৌড়ে গিয়ে জ্বালালো।কলঘরের আলোটা জ্বলে উঠল।
সবাইকে এবার ডাক দিল ছোকরা।
সবাই বেশ সাহস করে পৌঁছল।দেখল ছোকরা একটা গামছা হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে।
তা দেখেই যোয়ান ভাগ্নে বলে উঠল-
"-এই তো আমার,হারানো গামছা।সেদিন এর পর আর খুঁজে পাই নি"
ছেলেটি বলল-
"-হ্যাঁ,কাকু, দুপুরে ভুলে ফেলে যাওয়া আপনার গামছাই রাতে হ্যারিকেনের আলোয় ,দিদিমার শাড়ি হয়েছিল"
"-কি?"
"হাঁ!এবার আসল কথায় আসি।এখনো শব্দ হচ্ছে।দেখুন ঐ কলের থেকে।কান পেতে শুনতে পারেন যে কেউ।জল এলেই শব্দ হাওয়া হবে।ফাঁপা নলে বায়ু থাকে আর তা থেকেই কোনো কারণে এই শব্দ হচ্ছে।আমার বাড়িতেও হয়"
সব হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।তবে মুখে সবাই কুলুপ এঁটেছে।তিন্নীর চোখে বেশ খুশী।
কত্তা বাবু ই প্রথম কথা বললেন-

"-ছোকরা তোমার এলেম আছে।তা পুরস্কার কি চাও বাপু"
"-আজ্ঞে, তিন মাস হল রেলের ড্রাইভারের চাকরিটা জুটিয়েছি।জাতপাতেও একই আমরা।আমরা কুলীন ঘোষ।যদি তিন্নীর হাত টা পাই"
বড় বউ এর আর তর সইল না।বলে উঠল-
"-তা বাবা,সব কথা কি কল ঘরেই হবে।ঘরে বসেই না হয় ... আমার তো কোনো আপত্তি নেই।হ্যাঁগো তিন্নীর বাবা,কিছু বল।"

সামনের মাঘেই তারিখ ঠিক হল।
মেজো বউ অবশ্য গজগজ করতে করতে বন্ধ ঘরে বলল-
"ভূত তো দিব্যি একটা পাত্র দিল তিন্নীকে,আমার বিন্নীর কি হবে।তোমার মা বরাবরই একচক্ষু।মরেও দেখালো।তুমি ভেড়াই রয়ে গেলে।"

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন