সোমবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৮

সম্পাদকীয়



সম্পাদকীয় 

মরমী বুকে আহ্বান করি পৌষের ভরা শীত 
এসো প্রিয়তম
সঙ্গমকালে জড়িয়ে ধরি পশমের নিঃশ্বাস 
ঈশ্বরীয় রসে ভরে যাক শরীর 
আর কোন যুক্তাক্ষর নয়
সম্পূর্ণ চিত্র তৈরী হোক আমাদের 


শীতকাল  মানেই হাজারো শব্দ ঘোরা ফেরা করে পৌষের ব্যালকনিতে ।খুঁজে নি  অসমাপ্ত কুয়াশা ,যা ঢেকে দেয় স্বপ্নের আঁচল ৷ বহুদিন পর শীত উপভোগ করলাম নরম চাদরে ৷ বয়স বাড়ছে মনের ৷ সাথে কলমের ৷ কলম আর আগের মত শক্তিশালী নয় ৷ ঋণ বেড়ে চলছে সংলাপের ৷ আমাদের মধ্যে যা রয়ে গেছে তা কি আদৌ পরিশোধযোগ্য ? কত সম্পর্ক দূরে চলে যায় কত কাছের হয় ৷ মূল্যায়ন হয় না কোন কিছুর ৷কতটুকুই বা আমরা পারি ৷ ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন থেকেই যাবে ৷  চিহ্ন খুঁজে নেবে পরিসর যা কখনো হবে  না গতিশীল । আমাদের জীবনে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যার ব্যাখা  পাওয়া যায় না বা আমরা চাইও না ৷

ডিসেম্বর আসলেই  খেজুর গুড় ,মোয়া ইত্যাদি ইত্যাদি কথা মনে পড়ে ৷সাথে মেলা ৷ লিটিল ম্যাগাজিন মেলা ,বইমেলা । এই ডিসেম্বরে সৃজন দুই  বছর অতিক্রম করল ৷ প্রথম দিন থেকে যাদের আমরা পাশে পেয়েছি তাদের কাছে কৃতজ্ঞতা অসংখ্য ৷ আমারা প্রকাশ করেছি সৃজনকে  মুদ্রিত আকারে ৷যার নাম " আমার সৃজন 
"সম্প্রতি প্রকাশ হতে চলেছে বই সংখ্যা ৷ ১৩ জানুয়ারি প্রকাশ পাবে বই সংখ্যা লিটিল ম্যাগ মেলায় ৷ আপনাদের ভালোবাসার হাত ধরে আমরা আরো অনেক পথ এগোতে চাই ৷সবাই সৃজনে থাকুন , ভালোবাসায় থাকুন ৷


সম্পাদিকা 
পারমিতা চক্রবর্ত্তী
ঠিকানা - ২৩ ,বিপিন গাঙ্গুলী রোড ,কলি - ৭০০০৫o 

পিয়ালি বসুঘোষ,




#সুপর্ণাদের_একদিন_প্রতিদিন -------------------------------------------- কতোকিছুই নিজের নয় তবু নিজের বলে ভ্রমে বিভ্রমে কেটে যায় দিন, কে যেন বলেছিলো একটা শরীর শরীর তাপ লাগে সেই উৎসাহে গরম জামার নীচে লুকিয়ে রাখি শীত হাত বাড়িয়ে পেড়ে নিই নিভে আসা ধোঁয়ার চিনেকাপ ধূলোমাখা বই হাতে শুকনো মাটির আহত সংকেতে দেখি আলোর প্রমিতি নিভে যাবার আগে ছড়িয়ে থাকে তাচ্ছিল্যের মায়া জানিনা সূর্যেরও কি শরীর আছে ? সময় এগোয় কমলালেবু রোদের লোভে কিন্তু সকাল কখন দিন হয়ে যায় দিন একদিন হয় সেদিন সন্ধ্যে কখন সে-রাতের স্মৃতি হয়ে নীল নীল ক্ষতদের ঢেকে দেয় বাহারি ব্ল্যাঙ্কেটে আমাদের ভিতরঘর নেই গোলমরিচের মতো অন্ধকারে কেবল ঘরের ভিতরে দেখি অনুযোগহীন 'বড়দিনের' কাছে গোটা শীতকাল জমা রেখেছেন একলা ভাস্কর দেখছেন কিভাবে পাতা ঝরে যায় বেপরোয়া সুপর্ণাদেরও .....


যুগান্তর মিত্র

সাপ
………




ভুবনের মনটা কদিন ধরেই এলোমেলো হয়ে আছে। ময়না আজকাল বড্ড খিটখিট করে। কেন যে এত রাগ ওর প্রতি কে জানে ! বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে মাঠের পশ্চিমকোণে, মরা বিকেলে, বকুলগাছের নীচে বসে আছে ভুবন। হঠাৎই সরসর শব্দে পিছন ফিরে দেখে হাত চারেক দূর দিয়ে একটা সাপ চলে যাচ্ছে। শুকনো পাতায় শব্দ তুলে সাপটা নিজের মনেই চলে যাচ্ছিল।

কেমন যেন রোখ চেপে গেল ভুবনের। একটা লাঠিও পেয়ে গেল হাতের কাছে।  লাঠি দিয়ে লেজে খোঁচা দিতেই গতি বাড়িয়ে মাঠের দিকে অনেকটা এগিয়ে গেল সাপটা। ভুবন মরিয়া হয়ে দ্রুত পা ফেলে আবার খোঁচা মারল লেজে। এবার সাপটা ঘুরে গিয়ে ফোঁস করে উঠল, ফণা তুলল কোমর সমান।

~ শ্লা, ফণা তোলোস ? আর চল্লিশ বছর বয়সে আমার সাপের ফণা ওঠে না ! মাজাকি হচ্ছে শ্লা !

সাপ যেন তার ভাষা বুঝতে পারে। তাই মাথা দোলাতে থাকে ফণা তুলেই। চেরা জিভে চেটে নিচ্ছে হাওয়া।

~ আমারে তুই টিটকারি দ্যাস? জিভ বাইর করস হারামজাদা?

সাপটা কী বুঝল কে জানে। এবার মাথা নামিয়ে আবার চলতে শুরু করল।

~ আমার বয়সে আমার বাবা বুইনের জন্ম দিসে। আর আমি শালা এমন অধম …

আবার খোঁচা মারে ভুবন। সাপটা এবারও ঘুরে মাথা তুলে ফোঁস ফোঁস করে। দোলে তার মাথা। লাঠি বাগিয়ে ধরে ভুবন। রাগে কাঁপতে কাঁপতে লাঠিটা সজোরে ছুঁড়ে মারে সাপের গায়ে। হুমড়ি খেয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে সাপ। একই জায়গায় নড়াচড়া করে। চলার ক্ষমতা নেই তার।  নেই ফণা তোলার ক্ষমতাও। লাঠিটা কুড়িয়ে নিয়ে বারবার আঘাত করে। রক্তাক্ত সাপ ছেঁড়া দড়ির মতো পড়ে থাকে।

~ ফণা তোলোস? এত্ত সাহস তোর?

আচমকা ভুবন টের পায় তার সাপও জেগে উঠছে। ফণা তুলতে চাইছে। শিরশির করে ওঠে তার শরীর।

দ্রুত বাড়ির পথে হাঁটা দেয় ভুবন। ময়না, ময়না রে, অনেকদিন বাদে আমার সাপ ফণা তুলব মনে হয় আইজ। নিজেকেই বলে সে।

রাতে বিছানায় গিয়ে টের পায় তার সাপটা ছেঁড়া দড়ির মতো গুটিয়ে আছে। ময়নাকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে সে।

~ রাইতদুপুরে আর নাটক করা লাগব না। চুপ যাও। পাশের ঘরের সব্বাই শুনব। পুরুষ মাইনষের ফণা থাইকতে হয়, ফোঁস থাইকতে হয়। ন্যাতার পারা হলি চলে না। 

ময়না পাশ ফিরে শোয়। অনেক পরে ভুবন ময়নার শরীরে হাত দিয়ে দেখে সাপের শরীরের মতোই ঠাণ্ডা। 

পরদিন সকালে লোক ভিড় করে দেখে বকুলগাছে ঝুলছে ভুবনের রোগা হিলহিলে শরীর। আর অদূরেই শুয়ে আছে রক্ত শুকিয়ে যাওয়া হিলহিলে মরা সাপ।

দেবাশিষ মুখোপাধ্যায়



   The last kiss—
Debasis Mukhopadhyay

On that day, I wanted from you as my last wish
It was nothing precious but an innocent kiss.
You halted at the door, made no promise
Then turned, went away to search for my sis.

I didn’t had time long enough to stay or wait
For me, somewhere, someone opened a gate
Then you came back, bestowed upon my cold lips a kiss
Oh! Dear! That made my journey filled with heavenly bliss.

শোভন বাগ

#আগুন


১.
এক গেলাস চা আর খানকয় লেড়ো বিস্কুট খেয়ে, গেলাসটা ঠক্ করে নামিয়ে রাখলেন পুরুষ্টু বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ও হীরক খচিত তর্জনি।
গরিবি খিদের আগুন থেকে পায়রা ওড়ানো বনেদিয়ানায় ফিরে এসে, তাচ্ছিল্যের আগুনে নিজেকে সেঁকে, স্ফটিকের কুঠুরির দরজা বন্ধ করলেন ঠক্ করে।

২.
চায়ের দোকানের ছেলেটি ফেলে আসা ঘরের মায়ায়, না যেতে চাওয়া স্কুলের টানে, ছেঁড়া কাঁথায় মায়ের ওমের খোঁজে, ছুঁড়ে দেয়া ভাতের অনাদরের সাথে লড়তে লড়তে - খিড়কির পুকুর, পুকুরের ওপর ঝুঁকে আসা খেজুর গাছ, পোষা নেড়ি, খেলার মাঠ, শাঁখের শব্দ, বাবা-মা-ভাই-বোন সবার সাথে গা ঘসাঘসি করে না থাকতে পারার ক্ষোভের আগুনে জ্বলতে জ্বলতে, হীরের আংটির প্রতি হিংসায় এঁটো গেলাসটি ঠক্ করে নামিয়ে রাখে ধোয়ার জায়গায় ।

৩.
রাতেরবেলা ফেরার পথে, হীরের আংটি দামি গাড়ির দরজা খুলে, রাস্তার পাশ থেকে তুলে নেয় রঙ মাখা শরীর ।দশ পনেরো মিনিট পর দড়াম করে খুলে যায় দরজা । ছিটকে পড়ে শরীর। যে অঙ্গগুলো একটু আগেও ছিল কামনার, এখন সেগুলো শুধুই কিছু কুৎসিত শব্দ । মুখ দিয়ে সেইসব কুৎসিত শব্দ ওগরাতে ওগরাতে, একরাশ থুথু আর কয়েকটি নোট ছুঁড়ে দিয়ে হুশ করে চলে যায় দামি গাড়ি।

কিছু পরে চুলার আগুনে প্রেসার কুকারে ভাতের ভোঁ ওঠে।

৪.
জড়োয়া গয়না তখন নাইটিটা বুক পর্যন্ত গুটিয়ে তুলে, তুমুল আশ্লেষে কাছে টেনে নিচ্ছিল ছোকরা চাকরকে।
"বল, কী খাচ্ছিস?"
"বল, কী ঢোকাচ্ছিস?"
"বল, কী করছিস?"
অশ্লীলতা আর শীৎকারের শব্দে শরীরের আগুন সুখ খুঁজে পায়। তারপর খুট করে দরজা বন্ধ করে চাকরটা ফিরে যায় নিজের ঘরে ।
মোবাইলে ভেসে আসে, "বাবা, এবারে জমিখান ঠিক ছাড়িয়ে নেব।"

বাবার চাষী-বুকে জ্বলতে থাকা আগুনে শান্তির জল পড়ে।

৫.
বাড়ী ফিরে হীরের আংটি চেপে ধরল কলিংবেল। দরজা খুলে দিল কেউ।
জড়োয়া গয়না শুনতে পাচ্ছে খট খট শব্দটা এগিয়ে আসছে তাদের শোবার ঘরের দিকে।
খুট। খুলে গেল দরজা।
খুট। খুলে গেল আলমারি। আরেকটা গয়না হল জমা।
আরেকটা শব্দ হল। অভিধান বলল, ওটা চুম্বন।

শুধু আগুনটাই যা জ্বলল না।


শুভশ্রী সাহা


মরমিয়া

মনেরে নিয়ন্ত্রণ করা কি অত সহজ
বাউল মন যখন যেমন
এ যে বেজে যায় নিজের মত করে
স্তব্ধতায় মগ্ন থেকে

সাড়া নেই  কোনো গভীর তৃপ্তিতে পুলকে
থেকে থেকে জেগে ওঠে
তবু ছুঁতে গেলেই শূন্য যেন
জানিনা এর কি কারণ

ভাবনারা মেলে দেয় ডানা
নীল আকাশ নেই ছোঁবার মানা
তবু দু পায়ে কিসের বাঁধা
জানি না কি কারণ
অকারণ পুলকে আপ্লুত আমি
ভেসে আছি মগ্নতায়
সব আছে চারপাশে
শুধু আমি নেই আমার মাঝে

জানি না কি কারন, জানিনা কি কারন


২)

মৃত সঞ্জিবনী দিও দেবী আরবার
তোমার চরণ প্রান্তে চুমি একবার
এ কলম তোমার প্রসাদ ধন্য অনুক্ষন
ভক্ত আমি রিক্ত কবি অক্ষরেই দেবী দর্শন।

৩)

ছেঁড়া বিকেল-

বৃষ্টি  স্নাত  বিকেল, গোখেল রোডের গোল মন্দির
ছপে ছপে জলে  নন্দন  ভেজে একলা গম্ভীর

আজ কুছ  আজীব হো যায়ে, অচল ট্রাফিক
দিল মাঙ্গে মোর, অটোতে দেখা পুরোনো প্রেমিক

স্বপন রায়





রিয়া আবার-১৮ # স্বপন রায়
#
যেন হয়, মেয়েলি আসমা ধরে জন্নত, যেন হয় মহিলা আকাশের যা কিছু
ফেরেশ্তা ছুঁয়ে রিয়া
রিয়া?
#
ইংলিশভাপায় যে ফিফথ এভেন্যু রিয়াকে আসন্ন এপ্রিল দেয়
বালুচ র‍্যান্ডম দেয়
রিয়া তার পার্টটাইম টোকা, বাড়ি ফেরে
হেলো হাই আদাব ফেলে দিয়ে
রাস্তায়
যে রাস্তায় রিয়া ইয়াসমিন চারা পুঁতেছিল
আর দেখেছিল একটা কাঠবেড়ালি দৌড়চ্ছে
একটা প্রজাপতি উড়ছে
জন্নত
সেই ছোটবেলার শুধু, জন্নত ছোটই এখনো
#
রিয়া হাসে
রিয়া ভাসে
সূঁচের ডগায় লেগে থাকা কারুকাজের অবহেলা যেন, দুনিয়াবরণ যেন 
...





রিয়া আবার-২০  


#
শেষে পোচ নামে হায় হায়
#
ধোঁয়া ওঠে আঁধারমা
খয়েরে না-ডোবা ভাদুরতা বয়ে যায়
পান বলে, জিও
পাতা গায়, ' আমি যাবো না যাবো না যাবো না ঘরে...'
#
কোন ভয় নেই
চাঁদ লটকে আছে, তালগাছ খচ্‌রামি করছে
রিয়া আবার সাজতে সাজতে পানপাতা হবে কিনা এই সন্দেহে
হি হিম পড়ে যাচ্ছে
ম্যাচোহিম
#
এক পোঁচ দু'পোঁচ কুয়াশা নামে
ডিমের গন্ধ নিয়ে
আমার আবাল গোঁফে তা দেয় পালক না হতে পারা শীষ
কাঁচা পাকা
#
খুব সরু হয়ে নামে পোচ
দখিনামোহনে পৌঁছে...


রীনা রায়




"পিকনিক"
********
মনসিজ এপার্টমেন্টে নন্দিনীরা নতুন এসেছে। এপার্টমেন্টের ক্লাবের উদ্যোগে প্রতিবারের মত এবারেও পিকনিক হচ্ছে।
সকালে সাড়ে সাতটা বাজতে না বাজতেই সবাই রেডি হয়ে ক্লাবের সামনে জড়ো হয়ে গেছে। নীচে নেমে বাচ্চা গুলোর কলকাকলি দেখেই মনটা ভালো হযে গেল নন্দিনীর।
সাদা পালাজো আর ফুলছাপ কুর্তি পড়েছে নন্দিনী। তার ওপর একটা মেরুন লং কোট চাপিয়ে নিয়েছে। বেলার দিকে গরম লাগলে খুলে রাখবে।
নতুন এসেছে বলে এপার্টমেন্টের সবার সাথে পরিচয় না হলেও কিছু জনের সাথে আলাপ হয়েছে।
নন্দিনী খুব চেষ্টা করছে নিজেকে সবার সাথে মানিয়ে নিতে।
ও তো পিকনিকে আসতেই চায়নি।
সৌহার্দ্যর জোরাজুরিতে আসতে হলো। আসলে, ওর কোনো কিছুই ভালো লাগেনা। যেন করতে হচ্ছে তাই করে। জীবনটাকে যেন জোর করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সৌহার্দ্য তো কম চেষ্টা করেনি ওকে ভালো রাখার। কিন্তু নন্দিনী পারে কই সৌহার্দ্যকে কাছে টানতে...

পিকনিক স্পটটা বেশ ভালো লাগলো নন্দিনীর।কৃত্রিমভাবে সুন্দর সাজানো হলেও একটু দূরেই ঘন সবুজ বনানী চোখে পড়ছে। একদিকে সবুজ পাহাড়, পিকনিক স্পটের কাছেই একটা সরু নদী বয়ে চলেছে।
ক্লাবের ম্যানেজার সুমিত জয়সোয়াল সবকিছুর তত্বাবধানে আছে। যাওয়ার সাথে সাথেই গরম কফি, জুস চলে এলো। একটু পরেই টিফিনের পর্ব। এখানেও দু রকম ব্যবস্থা আছে। সাবেকি লুচি আলুরদমও আছে, আবার কেক, ডিমসিদ্ধ, কলাও আছে।
টিফিনের পর্ব মিটলে যে যার নিজের মত আনন্দে মেতে উঠেছে।
ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট, কেউ কেউ নৌকাবিহারে চললো।
পাশের ফ্ল্যাটের অপূর্বদা আর বৌদির খাওয়া নিয়ে খুনসুটি অব্যাহত।
সৌহার্দ্যও ছোটগুলোর সাথে ক্রিকেট নিয়ে মেতেছে। মাত্র দু বছর হল ওদের বিয়ের, নন্দিনীর কিছু ভালো লাগেনা। সব ছেড়ে পালাতে ইচ্ছে করে। ওর মনটাই যে অন্য কারোর।
আনমনে পায়ে পায়ে নদীর ধারে এগোয় নন্দিনী।
আরো বেশ কিছু পিকনিক পার্টি এসেছে।
একটা বল এসে গায়ে লাগতেই চমকে ওঠে ও। বলটা ফেরত দিতে গিয়ে ওর হৃদস্পন্দন থমকে যায়।
সামনে কে দাঁড়িয়ে...ওর ঋত!
আনন্দে দৌড়ে ও ঋতর কাছে যাবার মুহূর্তে এক ঝলমলে তরুণী ছুটে এসে বললো, ''ডার্লিং, একটু তাড়াতাড়ি... চলো, এবার আমাদের টার্ন'', হাত ধরে টানতে টানতে ঋতকে নিয়ে চলে গেল।
এ কে? ঋতর গার্লফ্রেন্ড না বউ? সিঁথিতে মনে হলো যেন সিঁদুর ছিলো! ঋত এরমধ্যেই বিয়ে করে নিয়েছে? বেশ তো খুশিই মনে হলো।
ভালো, ভালো খুব ভালো।
ভালো থেকো ঋত... আমিই শুধু বোকার মত...কান্নাটাকে চেপে
পিছন ফিরতেই দেখে সৌহার্দ্যও কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
''চলো, নৌকায় চড়বে?''
কিছু না বলে ও সৌহার্দ্যর হাতটা নিজের মুঠোর মধ্যে নিলো।
-------------------------------

ঋষেণ ভট্টাচার্য্য



নারী



যে সমস্ত মহিলাগণ নিম্নবর্ণিত নিবন্ধটি পড়িবার উপক্রম করিতেছেন, অনুগ্রহ করিয়া পাঠপূর্বে সর্বপ্রথম ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়কে প্রণাম জানাইবেন।
ইহার কারণ সেই ব্যক্তিটি না জন্মাইলে আজও আপনাদিগের সম্মুখে অকাল বৈধব্যে দুইটি পথই উন্মুক্ত হইতো, হয় সহমরণ অথবা দেবদাসী হিসাবে সমাজে দেহদান। সদ্যজাত শিশু-কন্যার নগ্ন পশ্চাৎদেশ দর্শনে পিতা নরকগামী হইয়া থাকেন - উক্ত যুগে এমত ন্যক্কারজনক ধারণাও বহুল প্রচলিত আখ্যা পাইতো।
অদ্যাপি আপনাদের পরমতম হিতৈষীগণ ভাবিতেন, স্ত্রী-জাতির বিদ্যাভাসই তরান্বিত বৈধব্যের হেতু। 
অবশ্য কেবল নারীই নহেন, তিনি পুরুষদিগেরও প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি। প্রকৃত অর্থেই তিনি নারী পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেকের প্রণম্য।

এ হেন মহামানব, যিনি তাঁহার সমগ্র জীবন অতিবাহিত করিলেন বঙ্গীয় তথা, ভারতীয় নারীমুক্তি এবং উহাদিগের যন্ত্রণামোচনে, যিনি প্রভুত অর্থোপার্জন এবং তাহার সিংহভাগ নির্দ্বিধায় উক্ত প্রয়োজনে ব্যয় করিয়াও শেষ জীবনে সমস্ত ভুলিয়া সাঁওতালপল্লীতে আদিবাসীদিগের সহিত শাকসব্জি চাষাবাদে দিনপাত করিয়াছিলেন।
তাঁর ন্যায় মহাপুরুষের এরূপ সিদ্ধান্তের কারণ তিনি শেষ জীবনে তাঁহার সমগ্র জীবন ও কর্মের প্রতি বীতশ্রদ্ধ ও তিতিবিরক্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন।  আশ্চর্য লাগিলেও ইহাই সত্য বীতশ্রদ্ধার কারণ সেই নারীজাতি! ইহা সত্যই অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক, যে নারীজাতির প্রতি তিনি তাঁর শেষ রক্তবিন্দু ব্যয় করিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন, তিনিই শেষ জীবনে তাঁহাদের প্রতি চূড়ান্ত হতাশাগ্রস্থ হইয়া সমাজ ত্যাগ করেন।

সমাজত্যাগ কালে অত্যন্ত ক্ষোভের সহিত তিনি জানাই দেন, তাঁহার জীবনের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ভ্রান্তি নারীজাতির সেবা ও উহাদের উন্নতিসাধনের প্রচেষ্টা। কারণ, তাঁহার মতে যিনি নিজ অবস্থান সম্পর্কে সম্যক সচেতন নহেন, যিনি সর্বদা অদৃষ্ট এবং তাঁহাদিগের চালিকাশক্তির বশবর্তী থাকিয়া কেবল ভিক্ষাপ্রার্থণা করিয়া দিনযাপনকেই আপন নিয়তি হিসাবে মানিয়া লইতে অভ্যস্ত, যিনি কদাপি আপনাকে পুরুষের সমকক্ষ মানিয়ে লইয়া আপন দাবী প্রতিষ্ঠা করিতে অপারগ এবং যিনি সর্বক্ষণ কাহারো ছত্রছায়ায় থাকিয়া নিকৃষ্টতর জীবনযাপনেও সাচ্ছন্দ বোধ করিয়া থাকেন, তিনি আর যাহাই করিয়া থাকুন না কেন, তাঁহার জীবদ্দশায় দুঃখ মোচন সম্ভবপর নহে।
নিজ চেতনা এবং বিবেক জাগ্রত না হইলে যেরূপ নিজ উন্নতিসাধন সম্ভব নহে, তদ্রুপ বাহির হইতে যতই বলপ্রয়োগ করা হউক না কেন উহাদের অবস্থান অনড়ই রহিবে।

এহেন মহাপুরুষের মৃত্যুর বহু বৎসর অতিবাহিত হইবার পর, ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভের বহু পরে, বর্তমান যুগে কতিপয় রাজ্য ব্যতিত প্রায় সমগ্র দেশ ভ্রমণ করিয়া যুগপৎ বিস্মিত ও ব্যথিত হইয়া আমি লক্ষ্য করিয়াছি, শহর গ্রাম প্রভৃতি বিভিন্ন জনপদে, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে, কেবলমাত্র আর্থিকভাবে অনগ্রসর, দরিদ্র এবং দারিদ্রের সর্বশেষ সীমায় অবস্থানকারী এবং পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী ব্যতিত আমাদিগের দেশের নারীর অবস্থার সামান্য বাহ্যিক পরিবর্তন হইলেও, অন্তরের প্রকৃত অবস্থানের বিন্দুমাত্র উন্নতিসাধন ঘটে নাই। 

আর্থিক অনগ্রসর ও নিম্ন এবং নিম্নতর ও তম আয়ভুক্ত পরিবারের নারী এবং পার্বত্য অঞ্চলের নারীরা প্রকৃত অর্থেই বর্তমানে আর্থিক শারীরিক ও মানসিকভাবে স্বাধীন হইয়া, পুরুষের মুখাপেক্ষি না থাকিয়া, সংসার তথা তাহাদের সমাজের বিভিন্ন বিষয়ে দৃঢ় ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ লইয়া চালিকাশক্তি হিসাবে নিজ নিজ ক্ষেত্রে নিজমত প্রতিষ্ঠা করিতে সক্ষম হইয়াছেন। ইহা ভিন্ন দেশের প্রতিটি শ্রেণীতে অবস্থিত ভিন্ন ভিন্ন নারীর আভ্যন্তরীণ অবস্থান একটি অঙ্গুলিপ্রমাণ অগ্রসর হইয়াছে কিনা ইহা তর্কসাপেক্ষ।
বর্তমান যুগেও স্বোপার্জিতা নারীর উপার্জনহীন অথবা তুলনামূলক নিম্নোপার্জিত পুরুষের সহিত বিবাহ কেবল ব্যতিক্রম হিসাবেই পরিগণিত হইয়া থাকে।

ইহা সত্যই লজ্জার বিষয়, অদ্যাবদি নারীজাতি উহার দাবী অর্জন অপেক্ষা শারীরিক গঠন ও সামাজিক সুরক্ষা এবং সংস্কারের দোহাই পাড়িয়া পুরুষের নিকট দাবী ভিক্ষা ও আশ্রয়দান শ্রেয় মনে করিয়া থাকেন।

নারী বিষয়ক প্রবন্ধ রচনাকালে কেবল দুইটি কথা মনে আসিয়াছিলো।
প্রথম হইলো ইহাই যে, উক্ত মহাপুরুষটির মহানির্বাণের পর উঁহার আত্মা পঞ্চভূতে বিলিন হইবার শত বৎসর অতিক্রান্ত হইবার পরও সহস্র কোটি প্রবন্ধ রচনা করিবার পরেও আমাদিগের দেশের বিভিন্ন সমাজ ব্যবস্থায় বসবাসকারী নারীগণের প্রকৃত আভন্তরিণ মুক্তি ও অগ্রগতি কতকটা হইয়াছে? যাহা হইয়াছে, তাহাও কী পর্যাপ্ত? আমাদিগের সমাজে নারী মুক্তি, নারী স্বাধীনতা, নারী প্রগতি ইহা কী আদৌ আলোচনার স্তরে পৌঁছোইবার যোগ্য?
দ্বিতীয়ত, অপর যে কথাটি মাথায় আসিয়াছিলো, বর্তমান যুগের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি, শিক্ষা, নারী তোষণ, ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে কেবল একজন নারীর মুখই মনে পড়িয়া যায়। যে গ্রাম্য নারী আজ হইতে শতবর্ষ পূর্বে সম্পূর্ণ নিরক্ষর হইয়াও, মানসিকভাবে এমত উন্নত মনস্ক ও আধুনিকা ছিলেন, যিনি, এক বিদেশিনী মহিলাকে নিঃশংকোচে এবং নির্দ্বিধায় তাঁহার হস্ত চুম্বনে সম্মতি দান করিতেন।

দারিদ্র অশিক্ষা কুশিক্ষা এবং অন্তরসারশূন্য জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ ও প্রয়োগবিহীন পুঁথিগত শিক্ষা দীর্ণ ভারতবর্ষে আমার চোখে তিনিই আদর্শ নারী, নারী সম্বন্ধীয় প্রবন্ধ অসম্পূর্ণ থাকিয়া যায় যে মহিয়সী মহিলার নাম স্বীকার না করিলে, যিনি সেযুগেও বিজাতীয় স্পর্শশুচিতাকে জয় করিয়াছিলেন, সেই সারদামণি দেবী।

শর্মিষ্ঠা দত্ত

টেকেন ফর গ্র্যান্টেড 
___________________

ঠিক বিকেল পাঁচটায়  অ্যাকাডেমির সামনে চলে এল ব্রত...আজ নাট্যচিন্তার শো আছে । সাড়ে ছটায় শো । সুরঞ্জনা নিশ্চয়ই এখনই এসে গ্রীনরুমে ঢুকে পড়বে । আলাপ হওয়ার পর থেকে ওর প্রতিটি শোই দেখতে এসেছে ব্রত  , সে তার অফিসে  যতই ব্যস্ততা থাকুক না কেন । ফেসবুকেও  প্রতিদিন চ্যাটবক্সে  গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে একটা প্রত্যাশা জন্মেছিল মনে , তাই সরাসরি প্রেমের প্রস্তাবটা দিয়েই ফেলেছিল । প্রত্যুত্তরে বন্ধুত্বের সংজ্ঞা নিয়ে সাতশো একান্ন শব্দের একটা জ্ঞানবহুল মেসেজ দিয়ে তাকে ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে ব্লক করেছিল সুরঞ্জনা । 

ক্যাবটা আজ প্রায় সবকটা  সিগন্যালে আটকাতে আটকাতে অবশেষে পাঁচটা ঊনত্রিশে  অ্যাকাডেমিতে পৌঁছালো । গ্রীনরুমে ঢুকেই ডিরেক্টর মানসদার বকুনি খেতে হবে আজও । ওঁর দোষ নেই ...নাটকের প্রধান চরিত্রই  যদি সময়মতো উপস্থিত না হয় তাহলে টেনশন তো হবেই । এর মধ্যেই চারবার কল  এসে গেছে সুরঞ্জনার ফোনে ,  ক্যাব থেকে নেমে হনহন করে হাঁটতে শুরু করল সুরঞ্জনা। 

গেটের সামনে আবার এসে দাঁড়িয়েছে ব্রত মিত্র নামের সেই  ছেলেটা , বিরক্তিতে সুরঞ্জনার মুখটা কুঁচকে গেল । হাতে আবার চকোলেট আর গিফটের প্যাকেট ! সাহস তো কম নয় ! ফেসবুকে ব্লক করে দিয়েছে ...তবু ! দেবে না কি  রামধোলাই ! সময় নেই অবশ্য । বন্ধু শর্মিলী আসবে আজ , সকালে ফোন করে বলছিল । ঝাড়ের  দায়িত্বটা ওকেই  দেওয়া যাক ...শর্মিলীর নম্বরটা ডায়াল করার  আগেই সুরঞ্জনা দেখতে পেল  বাঁ দিক থেকে শর্মিলী এগিয়ে যাচ্ছে ব্রতর দিকে ,  "সরি , দেরি হয়ে গেল গো ...অনেকক্ষন এসেছ ? "

গিফট আর চকোলেট ওর হাতে দিয়ে , হাত ধরে রাস্তা ক্রস করে মোহরকুঞ্জের দিকে  যেতে যেতে  ব্রত বলল  , "তুমি একেবারে পারফেক্ট টাইমে এসেছ শর্মিলী ..."

বুকের ভিতর একটা কাঁটা খচখচ করছে ...অপমানের নাকি বিশ্বাসঘাতকতার !  ধীর পায়ে গেটের ভিতর  মোরামের রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগল সুরঞ্জনা...


মৃত্তিকা মুখার্জী চট্টোপাধ্যায়

শপিংমল থেকে......
মৃত্তিকা মুখার্জী চট্টোপাধ্যায়

##
পিৎজা হাটে সদ্য কাজপাওয়া মেয়েটি 
এর আগে এতো আলো দেখেনি কখনও
শহরতলির কলাবাগান আর খাল পেরোনো
এককামরার ঘরে এখনও অবিরাম
সেলাই মেশিন চালাচ্ছেন তার মা......
'চাকুরিরতা' মেয়ে তাঁকে এখনও পর্যন্ত
একটুকরো পিৎজার পৃথিবী দেখাতে পারেনি।

##
নিজেকে ছাড়া কাউকে নিয়ে ভাবার
সময় নেই ছেলেটির,
এমনই ভাবতো সবাই......
বাজাজ স্প্লেন্ডারের তুফানী ঢেউয়ে
বেশ ক'টা বসন্ত কাটিয়ে,বাইশের কোঠায়
আজ সে বিদেশী পারফিউমের সেলসম্যান,
ঝাঁ চকচকে এক শপিং মলে-
হঠাৎ কোন গন্ধে এখন তার মনকেমন করে ওঠে,
মনে পড়ে ছোট বোনটার জন্য
অনেকদিন হলো হাতে করে কিছু
নিয়ে যাওয়া হয়নি

##
আড়চোখে দেখে নিচ্ছি পাশের সুবেশিনীকে,
ব্র্যান্ড, প্রাইস বোঝার অদম্য কৌতুহলে
বাড়াবাড়িই করে ফেলছি একটু......
আসলে অফশোল্ডার জামার আড়ালে 
উঁকি দেওয়া মাখন মাখন ত্বক বা 
ঠোঁটের র‍্যাভিশিং রেড এর কাছাকাছি যেতে
আর কতোগুলো ওভারটাইম লাগবে,
ঈষৎ ঈর্ষা ঈর্ষা চাওনিতে
সেটাই বোঝার চেষ্টায় আছি
: হে প্রেম, হে নৈঃশব্দ
মৃত্তিকা মুখার্জী চট্টোপাধ্যায়

সন্ধের মুখে গলা সাধে মেয়েটি,
ছাদের আলসে বেয়ে 
কাটা ঘুড়ি নেমে এসে আটকে থাকে
বারান্দার জুঁই গাছে,
সরগমের বাঁকে বাঁকে জড়িয়ে যায়
'হিরো' সাইকেলের চাকা
ঝাঁপতালে কাহারবায় রক্তদাগ সাক্ষী রেখে
অনন্তকাল আটকে থাকে দিশাহারা ঘুড়িটি-

ছেলেটি লিকার চায়ে
দু টাকার বিস্কুট ভেজায়.....
সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে
তানপুরা, বিস্কুট আর গোধূলির সূর্য
ডুবে যায় অতল অন্ধকারের বুকে।

অমিতাভ দাস

লাহিড়ি বাবার আশ্রম॥ অমিতাভ দাস

পড়ার ব্যাচে অনেক দিন ধরেই কথা হচ্ছিল স্যার , আপনি কত জায়গায় বেড়াতে যান । আমাদের কোথাও নিয়ে চলুন । কাছেপিঠে যা যা আছে সব-ই প্রায় আমার যাওয়া । বাংলার নতুন একটি পর্যটনের খোঁজ পেলাম লাহিড়ি বাবার মন্দির । স্টুডেন্টরাও রাজি হয়ে গেল । গতকালকেই আমরা একটা অটো রিজার্ভ করে চলে গেলাম আমাদের নতুন দ্রষ্টব্য স্থান ভ্রমণে ।

আকাশ মেঘাচ্ছন্ন । অক্টোবরের শেষ । দুপুর তিনটে বাজল পৌঁছুতে । ব্যান্ডেল স্টেশান থেকে -সাড়ে তিন -চার কিমি পথ । জায়গাটার নাম রাজহাট । গ্রাম পঞ্চায়েত । নির্জন রাস্তা । দু-পাশে বাঁশবন । অন্যান্য বড় বড় গাছও আছে। ছাত্রী অনন্যা বললে , গত বছর স্যার আমি ঐ জঙ্গলে ময়ূর দেখেছিলাম । আমার তেমন বিশ্বেস হল না । বললাম ,  জঙ্গল থেকে খাটাস , বন বিড়াল বেরুতে পারে -- ওই দেখ সাদা বক । ওই দেখ দুটো কুকুর ছুটে যাচ্ছে । সবাই হেসে উঠল । এমনকি গম্ভীর প্রকৃতির অটোওয়ালাও হেসে ফেলল । 
মেন রাস্তার ডান দিকে সরু রাস্তায় ঢুকে গেল আমাদের অটো । শুনলাম  আগে মাটির ছিল । এখন ঢালাই রাস্তা হয়েছে । পৌঁছে শুনলাম মন্দির চারটায় খুলবে । চারিদিক নির্জন । মন্দিরের গেটে তালা ঝুলছে । দারোয়ান ঘুমুচ্ছে বসে বসে । একটি মাত্র দোকান খোলা । সেখানে চা-বিস্কুট-ঘুগনি পাওয়া যাচ্ছে । চারিদিকে কেবল গাছ আর গাছ । যেন অরণ্যে এসেছি । বড় বড় তাবু -- শুনলাম রাতে তাবুতে লোক থাকে । ওরা গাছ পাহারা দেয় । ফল পাহারা দেয়  । একটা লোক নির্জন জঙ্গলের ভিতর মাছ ধরছিল । বললাম , কী আর করবে , ওই যে দূরে চৌকি পাতা -- পড়তে বসো-- আরেক রাউন্ড পড়াশুনো হোক ।
--তার আগে পেট পুজো হোক, আমার কাছে টিফিন আছে , বলেই প্রিয়ান টিফিন বক্স বার করলে  । আমরা লুচি- আলু ভাজা খেলাম । মধুমিতা আবার ঘুগনি -চা কিনল । 
এখানে এসে একটা কুকুরের সঙ্গে ভাব হয়েছে আমাদের । সে অনেক সময় আমাদের পিছু পিছু ছিল । ওকে বিস্কুট দিয়েছি, ফলে খুব খুশি ।



এসেছি লাহিড়ি বাবার মন্দিরে । কে এই লাহিড়ি বাবা ? ইনি একজন আধ্যাত্মিক সাধক, যোগীরাজ । নাম শ্যামাচরণ লাহিড়ি ।জন্ম নদীয়া জেলার ঘূর্ণী গ্রামে, ৩০ সেপ্টেম্বর ১৮২৮ সালে । তাঁর গুরু ছিলেন মহাবতার বাবাজি । পাঁচ বছর বয়সে নিজেদের বাড়ি বন্যায় ভেসে গেলে তিনি বাবার সঙ্গে বারাণসীতে চলে আসেন ।শৈশবে গঙ্গাস্নান করে নিত্য বেদপাঠ আর শিবপুজো করতেন বালক শ্যামাচরণ । ১৮৪৬ সালে তাঁর বিবাহ হয় । তিনি ছিলেন গৃহীযোগী ।
১৮৬১ সালে হিমালয়ের পাদদেশে রাণীক্ষেতে পাহাড়ে চলার সময় গুরু মহাবতার বাবাজির দেখা পান । দীক্ষা লাভ করেন ক্রিয়াযোগের এবং নিজেকে নিযুক্ত করেন মানবসেবায় । বহুমানুষ তাঁর শিষ্য ছিলেন । যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরমহংস যোগানন্দ । ১৮৯৫  সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর এই মহাপুরুষ ইহলোক ত্যাগ করেন ।


মন্দির খুলে গেল ঠিক চারটায় । এই মন্দিরে প্রবেশের কিছু নিয়ম-নীতি আছে । পুরুষরা টুপি ও বারমুডা পরে ঢুকতে পারবে না । মহিলারা মাথায় ওড়না ছাড়া ঢুকতে পারবে না । ওখানে ওড়না ভাড়াও পাওয়া যায় । পা ধুয়ে মন্দিরে প্রবেশ করতে হয় ।

মন্দিরটি চমৎকার শ্বেত পাথরের । একদিকে লক্ষ্মী-সরস্বতী অন্যদিকে ত্রিদেব ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ । মন্দিরের গর্ভগৃহ পাতালে-- রয়েছে শিবলিঙ্গ এবং যোগীশ্রেষ্ঠ শ্যামাচরণ লাহিড়ির মূর্তি । চারিদিকে দেবধূপের গন্ধে আমোদিত। দেওয়ালের গায়ে নানা আঙুলের ধ্যানমুদ্রা । মন্দিরটি বিরাট এবং জলের ওপর স্থাপিত ।
মন্দির সংলগ্ন বাগানটি চমৎকার । দেখলাম কত যে সাদা রাজহাঁস । ডানদিকেই পদ্ম ফুটে আছে জলাশয়ে ।বা দিকে কৃত্রিম কুঁড়েঘর--গুহার মতো । ভিতরে বিরাট এক শিবের মূর্তি , ধ্যানস্থ , সাদা রঙের । ওপর থেকে ঝরনার জল পড়ছে । ভেতরে ঢুকলে আশ্চর্য হতে হয় , কোথায় এলুম রে বাবা-- বাইরে যেন জোর বৃষ্টি হচ্ছে এমন মনে হবে ।নানা রকম পাখি আছে । আছে আরো কিছু মন্দির । 

সকালে গেলে ভোগ পাওয়া যায় । পুজোর ধূপ-মোমবাতি ও অন্যান্য ভেতর থেকেই কিনতে হবে । 

বড় ভালো লাগল । সবাই অনেক আনন্দ করে , ছবি তুলে ফিরলাম ঠিক পাঁচটার পর । কাছাকাছি এত সুন্দর একটা জায়গা আছে অনেকেই জানে না । গেলে বিস্মিত হতে হয় । মুগ্ধ হতে হয় ।



অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়




নিও-রিয়ালিস্ম

______________________________________________________


শট -

দীপ্তি ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োর কৃষ্ণচূড়া গাছটার নীচে ভাঙা বেঞ্চিটাতে বসেছিল কমল শটটার ফাইনাল টেক ওকে করে বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরিয়ে দীপ্তির পাশে এসে বসে বলল, কোথা থেকে যে ধরে আনে এদের, না পারে ডায়ালগ বলতে, না পারে ঠিকঠাক পজিশন নিতে
-কেন, মেয়েটাকে তো দেখতে শুনতে ভালো
-তাতে কি? শোন্‌ , ক্যামেরায় কাজ করতে গেলে আগে জানতে হবে আলো কি ভাবে নিতে হয়তারপর দেখতে হবে কামেরা কেমন ফ্রেম ধরছে। এস পি হলে একরকম, মিড শটে আবার অন্যরকম। আরে বাবা বেসিকটা তো ঠিক রাখতে হবে। উতরে যাচ্ছে কেন জানিস? নেহাত ঢপের সিরিয়াল তাই। পড়ত তেমন লোকের পাল্লায়, বুঝত।
-তাও তো এরা অভিনয় করছেহিরোইনের রোল। আর আমার দেখ, চারটে বছর হয়ে গেল, সেই এক্সট্রার রোল।
-ওসব ভাবিস না, অভিনয়টা মন দিয়ে করে যা। সুযোগ একদিন আসবেই। ও শোন, রুপাদি সেদিন তোর কাজের প্রশংসা করছিল। আমায় জিজ্ঞাসা করল, মেয়েটা কে। আমার মনে হয় বীণাদি একটা নতুন কাজ নামাবে। তারই কাস্টিং চলছে।

-ও আমায় নেবে না। কে দেখেছে আমার অভিনয়। কোথায় রুপাদি কি বলল আর তুমিও একেবারে বীণাদির সিনেমায় আমায় দেখে নিলে। তোমারও না... যতসব... আমার এখন রোজ কাজ দরকার। মায়ের শরীর ভালো না। কাল বলছিল আর চার বাড়ির বাসন মাজতে পারে না। বাসন মাজা, ঘর মোছা, দু বাড়ির জল আনা। পেরে ওঠে না আর। দেখো মাসে অন্তত দিন পনেরো কাজ পেলে আমি মায়ের দুটো বাড়ি ছাড়িয়ে দিতে পারি। এদিকে বাপ শুনছে না। বলছে যা পাচ্ছিস জমিয়ে রাখ, বিয়েতে কাজে আসবেআর বিয়ে...

কমল সিগারেটটায় একটা লম্বা টান মেরে মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষে দিতে দিতে বলল, এই হল তোদের নেগেটিভ মাইন্ড সেট। দেখই না কি হয়। চল আমার শট রেডি, আলো হয়ে গেছে, তুই এখন কি করবি? আর বাকি আছে কাজ?
-হ্যাঁ, রাহুলদা বসতে বলেছে, একটা শট রি-টেক করবে না কি। আমি আছি, তুমি সেরে নাও।
-সাড়ে নটা তো বাজল, আর কখন বাড়ি যাবি? শীতের রাত। দেখি রাহুলকে বলে তোরটা যদি আগে নিয়ে নেয়।
-ছেড়ে দাও কমলদা। লোক সুবিধের নয়। অন্য চোখে দেখবে। তুমি যাও, আমি আছি। আর তোমার যদি মিটে যায় তো আমায় তোমার বাইকে করে খালপাড়টা পার করে দিয়ে এসো। ওখানে মদ জুয়ার ঠেক তৈরি হয়েছে কিছুদিন। যদিও পাড়ার মেয়ে বলে ঘাঁটায় না, তবু, বোঝোই তো...





শট২ টেক -

বারোটার পরে কমলের সেট কেন কোথাও কোন শট থাকে না নাকতলায় একটা এক কামরার ঘর নিয়েছে কমল মোটামুটি সাজানো গোছানো সামনের পল্টনের দোকান থেকে খাবার আসে যখন যা হয় আজ সয়াবিনের তরকারি কমল সেসব ভাবে না সেটের আগুন থেকে মুক্তি তো সে ভালো করে স্নান করার জল গরম করে বারোটা বাজতে আর বেশী সময় নেই এক্ষুনি আসবে সে খাটের পাশে কমল স্নান সেরে খেয়ে নেয় আজ জানতেই হবে কে তুমি? কি চাও আমার কাছে? তুমি কে? কার আত্মা? সত্যজিৎ রায়? নাকি কুরসাওা? কি চাও? আমি সাধারণ যে চেষ্টা করলেও চ্যানেল আমায় সুযোগ দেবে না ওই ইন্তারলিউদ অবলঙ্গিটি আমার কাট টু শট বহেমিয়ানিস্ম কুয়াসার চাদরে নিওরিয়ালিস্ম তোমরা ত্রুফো ফাসবিন্দারে মাতো, আমি তো এখনও খোয়াইয়ের পারে টলোমলো সূর্য দেখি  


শট২ টেক

আজ বীণার কি হয়েছে কে জানে এত অবিন্যস্ত, অগোছালো সে কোনদিনই ছিল না এতগুলো জাতীয় আর আন্তর্জাতিক পুরস্কার তার ঝুলিতে এত গুছিয়ে কাজ করে এসেছে এতদিন প্রতিটা স্ক্রিপ্ট দশটা সিকুয়েন্সে ভেঙে, প্রতিটা টেক আগে থেকে সাজিয়ে পুরো প্ল্যান করে এতদিন ফিল্ম বানিয়ে এসেছে কিন্তু আজ কয়েকদিন হল কোন কিছুই যেন ঠিকঠাক হচ্ছে না এবারের সিনেমার প্লট সে অনেক ভেবে সাজিয়েছিল নেওরিয়ালিস্মের ওপরে প্রখর বাস্তব সামাজিক সমস্যাকে তুলে ধরে কিন্তু সবসময় মনে হচ্ছে গল্পটার হৃদয়টাই যেন বাদ পড়ে যাচ্ছে বলবো বলবো করেও আসল কথাটা যেন বলা হয়ে ওঠা হচ্ছে না সাউথ সিটির এই চব্বিশ তলার ফ্ল্যাটে ব্যালকনির খোলা দরজা দিয়ে হুহু করে হাওয়া এসে স্ক্রিপ্টের পাতাগুলো  এদিক সেদিক উড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে ঘরময় কিছুক্ষণ চেষ্টা করে সে হাল ছেড়ে মেঝের ওপর হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়ল

একটু কফি হলে ভালো হতো কিন্তু উঠতে ইচ্ছে করছে না মালতীও দিন সাতেকের ছুটি নিয়েছে ওর ছেলের বিয়ে বীণা খুব ভালো করে জানে যে সে সাতদিন বলে দিন দশেক আসবে না আজকাল আর টেম্পোরারি কাজের লোক পাওয়া যায় না এখানে তো একেবারেই নয়

রুপার আসার কথা আছে মূল চরিত্রে রুপাকেই নেবে ঠিক করেছে সে ও এখন যে বয়স আর মানসিক সন্ধিক্ষণে আছে তাতে এই রোলটা খুব ভালো তুলতে পারবে। দীপকের সঙ্গে ওর বিবাহ বিচ্ছেদটা বড্ড চোখে লাগে। আসলে দুজনেই ছিল যাকে বলে আইডিয়াল জীবনসঙ্গী। অন-স্ক্রিন বা অফ-স্ক্রিন, দুজনকে সব জায়গাতেই ভারী মানাতো। একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে বীণার। সুমনের কথা হঠাৎ এক পলকের জন্য চোখের পাতা ছুঁয়ে যায়।
এই স্বার্থপর, নীতিবোধহীন, অন্তঃসারশূন্য, অসুস্থ সমাজে দাঁড়িয়ে তার এই ছবিটা বড় প্রাসঙ্গিক। তবু কেন যে গল্পে প্রাণ আসছে না কিছুতেই বুঝতে পারছে না বীণা।

শট -

-এই দীপ্তি, কি রে, হল টা কি তোর?
-দীপ্তি, শট ওকে, ওঠ এবার, কি রে কথা শুনতে পাচ্ছিস না?
প্রীতমদার ডাকে হুঁশ ফেরে তার। কোথায় যেন হারিয়ে গেছিল সে। মায়ের মৃত্যু, ননদের অপমানের কথা জেঠিমাকে বলতে বলতে সে কখন যে ওই রাজ্যে ঢুকে পড়েছিল খেয়াল নেই। মনেই পড়ে নি সে অভিনয় করছে। আলো নিভে গেছে। ক্যামেরা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে সেটের অন্য কোণে, তবু সে দেখে যে সে ঠায় বসে আছে মেঝেতে। স্বাভাবিক। কাজের মেয়ে কি আর চেয়ারে বসবে। মাটিতেই তো তার যায়গা।

-তোর আজ আর কোন সিন নেই রে, ভালো কাজ করেছিস, কাল সকাল সাড়ে সাতটায় কল টাইম। চলে আসবি। আর প্রোডাকশন থেকে তোর এই সপ্তাহের পেমেন্টটা তুলে নে। আমার বলা আছে।

খুব ধীর পায়ে উঠে পড়ে দীপ্তি। এখনও যেন সেই চরিত্রের মধ্যে ডুবে আছে। কোন রকমে মাথা নেড়ে বলে, আচ্ছা প্রীতমদা।

বাইরে বেরিয়ে সূর্যের আলোটাকে বড় চোখে লাগে তার। ভিতরের আলো আধারিতে চোখ সওয়া হয়ে গেছিলো। অনেকদিন পর আজ দিনের বেলা তার প্যাক আপ হল। এক্সট্রার রোল, সে সব শেষে হয়। তাও তো এই সিরিয়ালে ছোট হলেও একটা ভালো চরিত্র সে পেয়েছে। মেক আপ রুম থেকে পরমা আর স্নেহা বেরিয়ে ফ্লোরের দিকে চলে গেল। তাকে ঘুরেও দেখল না। এই নিয়ে অবশ্য তার মাথা ব্যথা নেই। শুধু রোজ কাজ পেতে হবেস্বপ্ন সেও দেখত শুরুতে। ইদানীং দেখা বন্ধ করে দিয়েছে। বাপের কাজ এখন বিড়ির দোকানে হেল্পারি। যেদিন পি পি ক্যাপের কারখানায় মেশিন চালাতে গিয়ে বুড়ো আঙুলটা উড়ে গেল সেদিন থেকেই দীপ্তি স্বপ্ন দেখা বন্ধ করেছে। আজ অভিনয় তার স্বপ্ন নয়, তিনটে মানুষের পেটের দু মুঠো ভাত।

শট

-শিবু, এই শিবু, কি আলো করেছিস হ্যাঁ? ইয়ার্কি মারছিস? জানিস সিরিয়ালটা এয়ারে আছে, এইভাবে সময় নষ্ট করলে প্রোডাকশন ছেড়ে দেবে মনে করেছিস?
-কেন দাদা কি হয়েছে?
-আর ন্যাকামো করতে হবে না। রিয়াদির জন্য কটা নেট মেরেছিস?
-দুটো দাদা।
-শালা, হাজারো বার বলেছি রিয়াদির গায়ের রঙ ফেটে পড়ছে, মিনিমাম চারটে নেট দিয়ে আলো কাটবি নইলে স্ক্রিনে রঙ জ্বলে যায়, কোন কিছু খেয়াল করিস না কেন?
-তুমি বাপু বড্ড খুঁতখুঁতে। একটা তো এস পি যাবে, নিয়ে নাও না।
-চোপ শালা, তাড়াতাড়ি নেট দে।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে রুপা ফ্লোর পেরোতে পেরোতে কমল আর বিশুর কথাগুলো শুনতে পেল। হাসি খেলে গেল ঠোঁটের কোণে। ছেলেটা সিরিয়াস। কাজটাও ভালো বোঝে। রুপা কাজ করে দেখেছে। কমলের সঙ্গে কাজ করার সুবিধে হল কোন আর্টিস্ট কিসে স্বচ্ছন্দ সেটা খুব ভালো বোঝে বলে ছবির টেক্সচারটা ঠিক বার করে আনতে পারে। এই সব ছেলে সিনেমার কাজ পেলে করে দেখিয়ে দেবে। কিন্তু কি আছে ওর কপালে কে জানে। কোনোদিন এসে বলেনি, দিদি আমার জন্য একটু দেখো। ওর যত হম্বিতম্বি সব সেটে। বাইরে একেবারে মুখচোরা।

সে বাইরে এসে দেখল দীপ্তি চুপচাপ ওই কৃষ্ণচূড়া গাছটার নীচে বেঞ্চিটাতে বসে আছে। চোখাচুখি হতেই হেসে উঠে দাঁড়ালো।

-দিদি, ভালো আছেন?
-হ্যাঁ রে, তোর খবর বল, কাজটাজ পাচ্ছিস তো ঠিকঠাক? 
-এ কদিন তো চলছে। কিন্তু ইউনিয়নের নতুন নিয়ম, সবাইকে কাজ ভাগ করে দিতে হবে। আবার তোমাদেরও তো শুনছি চ্যানেল নাকি বলছে এক নায়িকা একসঙ্গে দুটো চ্যানেলে নাকি হিরোইন হতে পারবে না। কেন গো?
-ওদের ধারণা তাতে নাকি নতুন সিরিয়ালের টি আর পি পড়ে যাবে। যাক আমার কথা বাদ দে। শোন সেদিন রাতে জলসায় একটা সিরিয়াল দেখছিলাম। তুই তো ফাটিয়ে দিয়েছিস! ওইটুকু রোলের মধ্যে দিয়ে কি সব জিনিস বার করেছিস রে!
-তুমি দেখেছো দিদি! তোমার ভালো লেগেছে!
-না লাগলে এমনি এমনি বলতাম?
-থ্যাংক ইউ দিদি, জানো এই চার বছরে এই নিয়ে দুবার কেউ বলল আমি কিছু পেরেছি। একজন হল পীযূষ দা। আহা বড় ভালো মানুষ ছিল গো, যেমন অভিনয় তেমন গানের গলা। আমাকে খুব উৎসাহ দিত। জানো দিদি ওরা যদি ফ্রেমে আমায় আর চল্লিশ সেকেন্ড দিত আমি কিন্তু আরও ভালো করতে পারতাম। কিন্তু...
-সে সময় তুই পাবি, দেখে নিস। শোন, এখন কি শুট আছে তোর?
-না দিদি, আজকের মতো প্যাক আপ হয়ে গেছে।
-তাহলে এক কাজ কর, চল আমার সঙ্গে।
-কোথায় গো?
-রেড লাইট এরিয়ায়। মরণদশা, আবার প্রশ্ন করছে দেখো, চল বীণাদির বাড়ি যাব, কাজ আছে।
-তাই! তুমি গাড়িতে বস আমি পেমেন্টটা তুলে নিয়ে এক্ষুনি আসছি।

শট

আজ রাতে খুব ভালো করে ব্যাপারটা বুঝতে হবে। রোজ রোজ রাতে কে আসে ঘরে? কি বলতে চায় তাকে? কমল বাইক নিয়ে ফিরতে ফিরতে সে কথাই ভাবছিল। আজ সারাটা দিন মন খুঁতখুঁত করে গেছে। প্রডিউসার কিছুতেই রি-টেক করতে দেবে না। অথচ সে জানে শটগুলো সব এন জি ছিল। কিন্তু তার হাতে আর কতটুকু? ভালো কাজের দাম কে দেয়? এদের সময় নেই, ঘোড়ায় জিন পরিয়ে এসেছে। সেদিন একটা উপন্যাস পড়ছিল। এত মনে ধরেছে যে ভিতর ভিতর ফ্রেম তৈরি করতে শুরু করে দিয়েছিল সে। গল্পটা নিয়ে স্ক্রিপ্টও লিখছিল। কিন্তু কিছুটা এগোতেই, কি লাভ, বলে খাতা সরিয়ে রেখেছে। তাও কি ইচ্ছে হল, না, আজ একবার দেখবে রাতে দাঁড় করানো যায় কিনা গল্পটা। কমল দেখতে পাচ্ছে সে একটা লং শট ক্লোজ করতে করতে প্যান করছে। দূর থেকে হাইওয়ে ধরে একটা হোন্ডা সিটি দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে। প্রায় ক্যামেরা যখন গাড়ির বনেট উচ্চতায় এসে পড়েছে, গাড়িটা রাস্তা থেকে নেমে পাশের ধাবাটার সামনে এসে সজোরে ব্রেক কষল। সঙ্গে সঙ্গেই কাট টু ফ্রেম, ধাবার মালিকটা হন্তদন্ত হয়ে কাপড়ে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসছে। ব্যাকগ্রাউন্দে দেখা যাচ্ছে উনুনে কেটলির জল ফুটছে, মুখটা দিয়ে অল্প অল্প ধোঁয়া বেরোচ্ছে। না না, এটা দেওয়া যাবে নাচাপা উত্তেজনা বোঝাতে এই শট বহুদিন আগে ঋত্বিক বাবু ব্যবহার করেছিলেন মেঘে ঢাকা তারাতে। সঠিক লোকেদের সেটা ধরে ফেলতে অসুবিধে হবে না। তার চেয়ে বরং অন্য কিছু ভাবতে হবে। ঠিক করল, বাড়ি ফিরে খাতা কলম নিয়ে নতুন করে ভাববে সে।

শট৫ টেক

-এসেছিস রুপা, আয় আয়। সঙ্গে এটি আবার কে রে?
-দিদি কেমন আছো গো?
-ভালো না রে।
-কেন গো, কি হল আবার?
-কিছুই ঠিকঠাক নেই, সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
-সে তুমি যাই বল, ফিগারটা এমন রেখেছ যে আমাদেরও লজ্জা হয় তোমার সামনে দাঁড়াতে। কি বল দীপ্তি? ও তোমাকে পরিচয় করে দেওয়া হয় নি। এ হল দীপ্তি, অভিনয় করে সিরিয়ালে ছোট ছোট রোলে।
-তাই! বাহ, দাঁড়াও তো মেয়ে ওই জানলাটার সামনে। না, না, আমার দিকে তাকিয়ে নয়, ওই আকাশের দিকে তাকাও তো।
-দিদি তুমি পারোও বটে, এই তো এলাম আমরা...নে দীপ্তি, দিদি যেমনটি বলছে তেমন কর। ও দিদি তোমার কাজের মেয়েটা আছে? একটু কফি খাবো।
-দাঁড়া বাপু, একটু সবুর কর। এই যে মেয়ে, আরে ওই ভাবে নয়...
-দিদি আপনি যদি বুঝিয়ে না দেন কি করতে হবে তাহলে ...
-আচ্ছা মনে করো তুমি যাকে জীবন দিয়ে ভালবাসতে, আজ জানলে সে বহুদিন তোমায় ছেড়ে চলে গেছে।  কিন্তু সেই জন্য তুমি বিচলিত নও। তোমার চিন্তা কাল কি খাবে। এমন একটা সিচুএশনে তুমি কি করবে? কালকের জন্য প্রস্তুত হবে, নাকি তার কথাই ভাববে?
-তার কথাই ভাববো আমি।
-তার মানে কালকের ব্যাপারটা রিয়ালিটি নয়? তুমি সু-রিয়ালিস্মে বেঁচে থাকতে চাও? কালকে যে খেতে পাবে না?
-দিদি তা নয়। কালকের প্রস্তুতি আমি কাল ভোরেও নিতে পারবো। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার সত্ত্বা, আমার চেতনা যে আমার কাঙ্ক্ষিতকেই জড়িয়ে থাকবে। আমি বারবার নিজেকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করবো, কি এমন ভুল করেছিলাম যে যাকে আমার সবটুকু দিয়েছি, সে আজ এমন হেলায় আমায় ছেড়ে চলে যেতে পারলো?
আমি যে তাকে জড়িয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম দিদি। সেই যদি চলে যায় তাহলে নতুন করে কি নিয়ে বাঁচব? আর খিদের জ্বালা? তার জন্য শরীরটা তো পড়েই রইল, সেই ভাঙিয়ে চলে যাবে যদি একান্তই জীবন সংগ্রামে হেরে যাই।

বীণার দুহাতের মাঝে ক্যামেরার ভঙ্গি যেন স্তব্ধ হল। রুপার মুখে কোন ভাষা নেই। এ কি শুনছে সে? এ কোন মেয়ে? সে চেয়ারে চুপ করে বসে পড়ল। বীণা দি আনমনে দূর আকাশের পানে চেয়ে, কিছু বা অবিনস্ত্য, আলুথালু। নিস্তব্ধতা পেরেক ঠুকছে দেওয়াল ঘড়িতে। পল পল কেটে যাচ্ছে সময়।
দীপ্তিই মৌনতা ভাঙল। নিজেকে গুছিয়ে হেসে বলল, দিদি, রাগ করলে?

বীণা ওর দিকে তাকিয়ে বলল, এতদিন কোথায় ছিলিস মুখপুড়ি? বহুদিন পর কেউ আমায় জুতো মারল, নিজেকে বড্ড বেশী হোতা মনে করতাম। আয় আমার কাছে আয়। রুপা, এই দেখ আমার ল্যান্ডস্কেপ। আমার গল্পটার যে হৃদয় খুঁজে পাচ্ছিলাম না, আজ যেন একটু একটু করে তাকে আবিস্কার করছি। ও তুই কি যেন বললি? কফি? তাই না? মালতী তো ছুটিতে...

দীপ্তি হেসে বলল, ও দিদি আমি বানাই?
-তুমি? আচ্ছা দেখো কোথায় কি আছে।
-তার মানে তোমার রাতের খাবারটাও তো...
-ও আমি আনিয়ে নেব।
-কেন দিদি, সবে তো সাতটা বাজে, আমি করে দিয়ে যাই? দেখোই না এই গরীবদের সংসার কি ভাবে চলে। আর কোন সাহসের বশে তারা এমন কথা বলে যে মনের মানুষ আগে তারপর তো সংসার। সিনেমায় যতই ভুখা পেটের কথা বলা হোক আসলে বুকের আঁচরের ঘা যে কি দাগ রেখে যায় তার হদিস কি সবাই পায়? আমি বরং রান্নাঘরে যাই।

বীণা অবাক চোখে দীপ্তির চলে যাওয়া দেখে। তারপর রুপাকে বলে, এরা কারা? কই এতদিন তো সিনেমা বানিয়েছি, এদের তো কাছ থেকে দেখিনি কখনও? বেঁচে থাকার তাগিদ বুঝেছি, তবু এই মূল্যবোধ তো কখনও ধমনীতে অনুভব করি নি রে।

রুপা উঠে বীণা দির পাশে গিয়ে বসে। পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলে, এত ভেবো না দিদি, আর একবার বস তোমার স্ক্রিপ্টটা নিয়ে।
রান্নাঘর থেকে দীপ্তির গলার শব্দ, দিদিভাই, রুটি আর পাঁচমিশালী তরকারি করি? ফ্রিজে তো সবই আছে গো...

শট৬ টেক -

দু পেগ খেয়ে একটা সিগারেট ধরাতেই বুকের বাঁ দিকটায় একটা ব্যথা চেপে ধরে। কমল একবার ওষুধের বাক্সটা খুঁজে দেখে। আসলে অনেকদিন পর দারু খাচ্ছে। দারু সে আজকাল আর খেতে চায় না। এত অস্পষ্ট দেখায় ছবিগুলো। তবু কখনও কখনও কোন স্ক্রিপ্ট যখন সহজে হাতে ধরা দেয় না তখন মনে হয় একটু খেলে ক্ষতি কি। আজ একটু আগে যেমন দেখল স্বামী স্ত্রী ঝগড়া করছে। সেটা প্রেম হোক, মান অভিমান হোক, আবেগ হোক, তাদের হাতাহাতি না দেখিয়ে তাদের ভেলভেটের মাথার বালিশ ছিঁড়ে তুলো উড়ছে ঘরময়। যা বোঝানোর তো হয়ে গেল। আজ ওই দোকানে তড়কা বানিয়েছে। কমল ভাবল, না স্নান করে আসি। দেখি রোজ রাতে এরা কারা আসে আমায় জ্বালাতে।

-তুমি তো অনেক দিন আঁকছ জীবন।
-তাতে কি? আমি তো আমার ভাবনার মধ্যেই থাকি, কই কখনও তো বেরিয়ে যাই না। হ্যাঁ বলতে পারো স্বপ্ন দেখি, কিন্তু স্বপ্ন দেখা কি ভুলের?
-কে বলেছে ভুল? তবু স্বপ্ন মানেই তো শেষ রাতের ঘাসে প্রথম শিশিরে লাজুক মুখ ডোবানো নয়। ভালবাসা তো আজও বেঁচে থাকে আনাচে কানাচে।
-কে তুমি? আমায় ভালবাসা সেখাতে এলে? আমি তো প্রেমে পড়িনি, তবু কেন?
-শোনো তুমি প্রেমে পড়েছ, বুঝতে পারছ না, অবসেসড, লেখাটা তোমার মনে ধরেনি?
-হ্যাঁ, হ্যাঁ, ধরেছে, তাবোলে ওটা কি প্রেম?
-হ্যাঁ তো কেন প্রেম মানেই কি নারীসঙ্গ?
-না, না, আমি কি সে কথা বলেছি? কিন্তু তোমরা কারা? কেন আমায় রোজ রাতে বিরক্ত করো? দেখো আমি যে সাধারণ কর্মী...
-সেটাই তো বোঝাতে চাই, তোমার লজ্জা করল না, ওই ক্রেন শটটা তুমি শালা সাদামাটা ভাবে উতরে দিলে
-কি করবো? বল আমাকে, কি করবো? কে বুঝবে আমার এই ক্রাইসিস। শালা ভাগারের দলে বাস। কি আর নতুন করতে পারি, অথচ, কলকাতা আমার লেন্সে দেখেছো?  ভিক্টোরিয়া? হাড়কাটা  গলির রাতপরীদের ডাক। দেখেছো শুন্য স্থানে চন্দ্রবিন্দু আঁকা হয়ে থাকে ওই মেয়েটার কপালে?
-তুমি প্রেমে পড়েছ
-না,
-শোনো, কখনও জ্যোৎস্না দেখেছো? কান পেতেছ? নৈশব্দতায় মাঝ-বুক পেতে কোজাগরীর গান?
-কি চাও? কি চাও বল?
-তুমি স্বপ্ন দেখো, স্বপ্নে বাঁচো, আর আমরা কি চাই বল? ফ্রেম, কাট, টেক টু, মন্তাজ, প্যাক আপ, এ শব্দগুলো যেন কবে শেষ শুনেছি। তোমায় বিশ্বাস করলাম আমরা, শেষ বিশ্বাস।

শট৬ টেক ২

-তোর সঙ্গে অনেক কাজ আছে তুই বরং কিছুদিন আমার এখানে থেকে যা দীপ্তি
-বাড়ি ফিরব না রাতে বীণা দি?
-না, ফিরবি না আমি তোর মায়ের সঙ্গে কথা বলবো দরকারে শোন, অভিনয় করতে গেলে অনেক স্যাক্রিফাইস করতে হয় দুদিন তো হাতে পেলি, স্ক্রিপ্টটা পড়েছিস?
-হ্যাঁ দিদি।
-কি বুঝলি?
-কি আর নতুন করে বুঝবো দিদি, এ তো আমাদের জীবনের নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। চরিত্রের নামগুলোই যা পাল্টেছে। তবে হ্যাঁ রুমার চরিত্রটা মনে দাগ কাটে। যেন মনে হয় কত কথা বলার ছিল কিন্তু সে বলে উঠতে পারছে না। সন্তান এলে শরীরে যেমন মাতৃত্বের ছাপ ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে তেমনই রুমার না বলা কথাগুলো ওর কাজের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পাবে। ওর হাঁটাচলা, ওর চোখের ভাষায়, ওর থমকে থাকা ঠোঁটের কোলে। জানো দিদি... না থাক...
-কি বলবি বল না।
-না না, কিছু না। তুমি বলছ যখন আমি নিশ্চয়ই থাকব তোমার সঙ্গে।
-শোন দীপ্তি, কাল একটা স্ক্রিন টেস্ট রাখছি। তোর ডেট নেই তো কাল?
-আছে গো দিদি, তবে কল টাইম দেখে মনে হয় দিনে দিনে শেষ হয়ে যাবে।
-ঠিক আছে, শেষ হলে ফোন করে নিস আমায়। কোথায় আসতে হবে জানিয়ে দেবো।
-আচ্ছা, এবার বল রাতে কি খাবে?
-রোজ রোজ রান্না করবি নাকি? ওই সময়টা স্ক্রিপ্ট পড়। ভাব, আরও ভাব।
-কেন গো দিদি আমার রান্না মুখে লাগছে না তাই না?
-হতভাগী এত ভালো রান্না করিস, আমি সেই জন্য বলিনি। বলেছিলাম যাতে বাজে সময় নষ্ট না হয়।
-না না, তুমি কাজ করো, আমি সেরে নিচ্ছি দিদি।


শট

-আহ, ছাড়ো দিপু
-কি হয়েছে তোমার আজ? শরীর জাগছে না
-ছাড়ো বললাম তো
-কেন?
-লাগছে ছাড়ো
-এত ড্রাই তো তোমায় কোনোদিন পাই নি রুপা
-সরো, ওঠ, আমার ভালো লাগছে না
-হ্যাঁ, আর আমাকে ভালো লাগবে কেন, আজকাল বাজোরিয়ার ছেলেটা সব থেকে প্রিয় তো আমি তো পরতি নায়ক এখন ওর সাথে পাঁচতারা হোটেলের রাতগুলো আজকাল বড় মধুর তাই না? শুনলাম নতুন ছবিতে তোমায় নিয়েছে, লোকেশন ফেলেছে মালদ্বীপে
-জাস্ট ফাক অফ ইউ বাস্টার্ড লজ্জা করে না তোমার স্কাউন্দ্রেল?
-হ্যাঁ এখন তো বলবেই, একদিন বুকে জড়িয়ে নিয়ে কত কথা বলেছিলে, আজ সব ভুলে গেলে?
-শুধু শরীর শরীর শরীর, এর বাইরে কিছু বোঝো তুমি? কেন তোমার ঘরের খানকিটা খিদে মেটাতে পারে না?
-ওই শালি, একটা কথা বললে গলা টিপে দেবো
-দেখলে, এই হলে তোমরা জাস্ট ফাক অফ ফ্রম মাই লাইফ, গেট আউট ইউ পপার, সিমপ্লি গেট আউট উফ, আমাকে শেষ করে দিলো আর এর জন্যই আমি


-বীণা রয়, ইউ নো, দেয়ার ইজ এ সাবষ্টেন্স ইন ইওর ফিল্ম। সাম আনক্যানি ফিলিং।
-হাহাহা, তাই নাকি সাহেব? কি আছে আমার ছবিতে যা তোমাদের নেই?
-এ মন্তাজ আনভিজিটেড
-রিয়ালি! হোপ ইউ আর নট সিডিউসিং মে, হাহাহাহাহা...


শট -৮ টেক

বীণার এটা চার নম্বর। সে সিগারেট হাতে উঠে আসে রান্নাঘরে। দীপ্তি আপন মনে রান্না করছে। দরজাটা ধরে চুপ করে দাঁড়ায় সে। দেখে কড়াইতে সর্ষের তেলটা বোতল থেকে না ঢেলে চামোচে করে একটু একটু নিয়ে প্যানে দিলো। তারপর তেল গরম হতেই ফোড়ন ছেড়ে সবজিগুলো দিল।

এই তো আমার চরিত্ররা, এদের নিয়েই তো আমার বইহাহা, সে দীপ্তিই হোক বা রুপা কি আসে যায় তাতে। তবে হ্যাঁ, এই স্ক্রিপ্টটা পাল্টাতে হবে অনেকটা যায়গায়। রিয়ালিস্মের আমি কি বুঝি? চব্বিশ তলার খোলা হাওয়ায় আস্তাকুঁড়ের ছবি কি ফোটে? সেখানে যে সব সময়ই বসন্ত, হ্যাঁ হ্যাঁ আমি বীণা রায়, সাকসেস আমার পায়ের তলায়... ওই মেয়ে রান্না হল? ... স্ক্রিপ্টটা আর একবার পড়ে সিন সতেরোটা একবার অভিনয় করে দেখা দেখি। ওখানে তোর পেটে অবাঞ্ছিত সন্তান, তোকে হাসপাতালে এবর্‌শনের নাম করে ফেলে রেখে গেছে লম্পটটা। দেখা করে, কি হল, দেখা...

শট৮ টেক

-শোন যখন দুটো চরিত্র কথা বলবে তখন ক্যামেরা একেবারে নড়াবি না। স্টিল একটা ফ্রেম ধরে রাখবি।
-কেন? লোকে বুঝবে কি করে?
-লোক বলতে কে? তুই কি শ্বাশুরি কাঁদছে বৌমা হাগছে বানাবি? তাহলে?
-কিন্তু কেন এই ফ্রেম? লোকে তো বিরক্ত হবে।
-হতে দে না, যখন দেখবি চূড়ান্ত বিরক্ত তখন প্যান করবি, দেখাবি বিজনেস।
-বুঝলাম, কিন্তু আমায় এগুলো কেন বল তোমরা? কি করেছি তোমাদের?
-আমাদের অন্তরাত্মায় বিশ্বাস জাগিয়েছিস, তুই পারবি... আর শোন ওই শটটা নিস না।
-কোনটা?
-ওই টপ শট। পাখা ঘুরছে সিলিঙে, নীচে আলো কাটছে ক্যারেক্টারের  মুখে... আমি জানি তুই কি বলবি... দীপ জ্বেলে যাই তে ছিল তো? ভুল আঙ্গেল, অমন করিস না।
-আচ্ছা সব বুঝলাম, কিন্তু আমায় কেন, আমি তো ... আমি তো... আমার হাতে তো...
-আমাদের বিশ্বাস আছে তোর ওপর, বাই দা ওয়ে, আজকের কাজ খুব ভালো হয়েছে... সাবলাইম সিরিনিটি বুঝিস? শেষ দেখা গেছিলো হিচককের দা রেয়ার উইন্ডোতে। আজ তোকে এই কমপ্লিমেন্ট দিলাম আমরা। শুধু মনে রাখ চোখ কি বলছে তা নয় মন কি বলছে সেটাই চোখের ছবি...


শট

-ওঃ গড! কাট কাট কাট, ওই দীপ্তি, এসব কি, হ্যাঁ? কিসব বলছিস? এগুলো সিনে ছিল? দীপ্তি এই দীপ্তি।

চমকে ওঠে মেয়েটা, ‘না মানে আমি ...’
-গেট আউট, জাস্ট গেট আউট, কি মনে করেছে কি নিজেকে? একটা সুযোগ দিয়েছিলাম, তাবোলে অকারণে এত ফুটেজ!
-দাদা, ভুল হয়ে গেছে, আর হবে না।
-হবে না মানে? গত তিনদিন দেখছি তুই মুখে আলো পড়লেই কোথায় হারিয়ে যাস, চরিত্রর মধ্যে আবার একটা নতুন চরিত্র মুখ বুজে কথা বলে। তুই কি সিরিয়ালের আসল স্বাদটাই নষ্ট করে দিবি? এত সাহস তোর? শালি এক্সট্রা...

আমি যে বীণা দির রুমা হয়ে গেছি, কেউ বুঝলে না? ... মনের মধ্যে কে যেন বলে ওঠে তার

শট -১০

-কেন এত মাথা গরম করছ বীণা দি? আরে সৈকত নেই তো কি হয়েছে? ভালো কাজের প্রচুর লোক আছে তো।
-তুই চুপ কর। ওকে কে চিনতো? সেবার ভেনিসে ছবি পুরস্কার পেল, সব আঙ্গেল আর ফ্রেম আমার, ও শুধু কাজ টুকু করেছে। তাই বলে এত দেমাক? দেড় কোটি চাইছে? জানে এন এফ ডি সির  বাজেট কত? ছোটলোক ছেলে, ইজ্জত রাখতে জানে না...
-দিদি আমি বলি? খুব ভালো কাজের ছেলে আছে, একবার দেখে নেবে ওকে?
-চুপ কর তুই, দে ফ্রিজ থেকে একটু সোডা দে। এই রুপা, তুই নিবি তো...
-হ্যাঁ দিদি, ওই একটা, দীপ্তি কার কথা বলছিস?
-দিদি কমলদার কথা গো, একটা চান্স যদি পায় করে দেখিয়ে দেবে।
-ধুস শালা, কত দেখলাম, সব আমার নামের সাথে নিজেদের জড়িয়ে নিতে চায়।
-জানি দিদি, তবে এই ছেলেটা একটু অন্য রকম, ক্যামেরার সঙ্গে কথা বলে...
-কি বললি? কথা বলে ক্যামেরার সাথে? দে ফোন নাম্বার দে ...

শট১১ টেক ১

-কমল কোথায়?
-এইতো বাইক চালাচ্ছি
-উফ, তাড়াতাড়ি এসো
-আসছি ওয়েট...
-বুকের খাঁজে মাতন লেগেছে যে... তাড়াতাড়ি এসো ডার্লিং...
-জ্যাম রাস্তায় তো, অপেক্ষা করুন...

শট১১ টেক ২ 

-সিগারেটের গন্ধ আমার সহ্য হয় না। এত ঘন ঘন খান কেন?
-এক একটা কাট শট জুড়তে জীবনে সিগারেট লাগে যে...
-এবার উঠতে দিন, খুব ক্লান্ত লাগছে বীণাদি...
- দি! হাহাহা, আজ একশো দিনের সেলিব্রেশন, সারা ভারত ভেঙে পড়েছে, তোমার ক্যামেরায় জাদু... খুব  তাড়াতাড়ি বার্লিন যাব আমরা।
-আর দীপ্তি?
-কে? কে দীপ্তি?
-যে এমন অভিনয় করল, যাকে দেখে রুপা দি নিজে না করে দীপ্তিকেই রোলটা দিয়ে দিলো ওর মতো পারবে না বলে, তাকেই ভুলে গেলেন?
-হেই বেবি, কারা স্টার, কে দীপ্তি? শোনো শোনো, ওর দেখানো নিওরিয়ালিস্মের পথ আমার স্ক্রিপ্ট বদলেছে, ব্যাস, এইটুকুই ওর যথেষ্ট প্রাপ্য না কি? দে আর অব্লিভিওন, দে আর ডাইং পাস্ট, হু কেয়ারস?
-সত্যিই তো, আমি ক্যামেরা করলাম, এতগুলো পুরস্কার...
-ওঃ শাট আপ ম্যান, শরীর দিয়েছি নিজের প্রয়োজনে, তার মানে এই নয় তুমি হিরো বনে গেছ। কে তুমি ? ব্লাডি বুলসিট, বীণা রায়ের সিনেমায় লোকে শুধু বীণা রায় কেই খোঁজে।


শট -১২

-লাইট, সাউন্দ, ক্যামেরা... দীপ্তি, ক্যামেরা ক্লোজ হচ্ছে, তোমার বুকের ভাঁজ ছুঁয়ে তোমার না বলা কথারা   সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, এবার আর্তনাদ করো, ভাঙবে, ভাঙ্গবে ভাঙ্গবে, রক্তে চোবানো হাতগুলো আজ নীল মেরুতে বুদবুদ হয়ে মিশে গিয়ে নীলকণ্ঠ হবে...

-পারবো আমি? পারবো কমলদা?
-পারবে, পারবে, তোমাকে যে পারতেই হবে

ওকে, সাইলেন্স প্লীজ... ক্যামেরা রোল...রোলিং, সাউণ্ড... রোলিং, ক্ল্যাপস্টিক... নিও-রিয়ালিস্ম... সিন টু... টেক ওয়ান...দীপ্তি, অ্যাকশন...