শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

সম্পাদকীয়

ভারতীয় চেতনায়  দেবী দুর্গা কিংবা চন্ডী কল্পনা এক অনন্যসাধারণ উপলব্ধি। এই চেতনাকে অবলম্বন করে ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতি বহুদূর প্রসারিত হয়েছে। এই উপলব্ধির গভীর অন্তঃস্থল স্পর্শ করে আমাদের ধর্মবিশ্বাস পরম্পরায় প্রবাহিত হয়ে চলেছে প্রাচীনকাল থেকে।প্রাক্ আর্য-সভ্যতার যুগেও এই কল্পনা সজীব ছিল। মহেঞ্জোদাড়ো, হরপ্পায় আবিষ্কৃত নিদর্শনগুলোর মধ্যে কয়েকটি দেবীমূর্তি পাওয়া গিয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকদের অনুমান যে ঐ মূর্তিগুলো দেবীমূর্তি এবং পৃথিবীদেবী। মহাজাগতিক ক্রিয়াকলাপ এবং অদৃশ্য মহাশক্তির মহালীলার উপলব্ধি থেকে পৃথিবীকে দেবীরূপে কল্পনা করা হয়েছে ৷ যার প্রকাশ জলে স্থলে অন্তরীক্ষে, প্রতিটি অণু-পরমাণুতে, পরমা প্রকৃতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

কাশফুলের আগমনে দুর্গাপূজা উপস্থিত I সাথে সাথে " আমার সৃজন " আত্মপ্রকাশ প্রত্যাশা বাড়িয়েছে বহুগুণ ৷ 


" আমার সৃজন " পত্রিকার পরে সৃজন অনলাইনে " শারদীয়া সংখ্যা" প্রবন্ধ ,ভ্রমণকাহিনী , গল্প ,কবিতায় ঠাসা ৷  সৃজনে থাকুন সবাই  ৷ সবাইকে শুভ শারদীয় শুভেচ্ছা ৷

প্রচ্ছদ শিল্পী :ধীমান পাল

চ য় ন ভৌ মি ক

গো অ্যাজ ইউ লাইক -


তাহলে সম্মান দেওয়া যাক এসো। পুরস্কারে ভরিয়ে দেওয়া যাক কর ও কোঁচড়। লাইন করে দাঁড়াও এবার সব আশ্রমিকগণ। পরপর এসো নাম ডাকা হলে। তোমরাই আমাদের দলের সম্পদ, সভাসদ ও শাসনযন্ত্র। আমাদের লক্ষ্য শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, আর সমন্বয় সংঘর্ষ। আঘাত ছুটে এলে, দলবদ্ধ হয়ে তোমরাই দাঁড়াবে জানি সামনে দেওয়াল হয়ে। রোবটের মতো নির্দেশ গ্রহন করে, প্রতিহত করে দেবে সমস্ত উল্কাপাত। পাল্টা মারে ভেঙে দেবে বিপক্ষের সমস্ত চাল ও ছক। তারপর ফিরে এসে হাডল করবে সবাই মিলে। দলীয় মতবাদ পালন করার জন্য সাধুবাদ দিয়ে শুরু হবে উল্লাস ও সুরাপান আমাদের মধ্যে। তোমাদের দেখে জ্বলতে জ্বলতে খসে পড়বে সাত আকাশের নক্ষত্র। চোখ টাটাবে জমিদার ও জনান্তিকের। কিন্তু তোমরা মন্ত্রপুত সেনানী আমাদের। বিশ্বাসভাজন ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যাং। তোমাদের মঞ্চ দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ আমাদের সনদ। হাতে হাতে তোমরা তুলে ধরেছ করোটি আঁকা কালো পতাকা। জলদস্যুদের কৃষ্টি বহন করে এগিয়ে চলেছ, যুগ যুগ ধরে। কী লিখে রেখে যাচ্ছ, তার দিকে ফিরে তাকাচ্ছ না।।

শাশ্বতী সান্যাল









আত্মজীবনীমূলক      



আমরা বিষণ্ণ হইনা
আমাদের রুমালগুলো বিষণ্ণ হয়।
অনিদ্রায় ভুগে তাদের সাদা রঙ
ক্রমশ পাঁশুটে হয়ে আসে।

আইসক্রিমওলার জন্য
তারা হয়তো অপেক্ষাতে ছিল।
কোনো এক দুপুরবেলা ছাদের রেলিংয়ে ঝুঁকে
ডেকেছিল পাশের বাড়িকে।

বৃষ্টি এসে সেই শব্দ ভিজিয়ে দিয়েছে...


আমাদের জ্বর হয়না,
শুধু রুমালের তাপ বাড়ে
এ শহরে। কল দিলে ডাক্তার আসেনা
প্যারাসিটামল নেই।মুঠোভর্তি স্মৃতির পারদ।

বিকেলের পথে সেই মুঠো খুলে তারা একদিন
খোলা ম্যানহোলে ঝাঁপ দেয়।

মানুষ তো নয়, তাই ফিরেও আসেনা।






অনিন্দ্য রায়


প্রিয় মেনহির


রৌদ্রকোল, পিছলে যে পোষ্য পড়ছে, ফাঁদ পাতি আঁধারঊর্ণায়
প্রতিটি ঘরের কোণে অপরাধ বুনে রাখে আছে
আমিও চাকরিসূত্রে মৃত পোকাদের পরিষ্কার করি আর
                   তাদের শরীর টিপে বের করি রস-মেটাফর

কাগজে মাখিয়ে দিই, আঙুল বোলাই, তাতে
বাংলা অক্ষরের মতো বাহান্নটি দাগ
তাস বেটে নিয়ে খেলতে বসেছি

এইটুকু আমার কবিতা, এটুকুর লোভ দেখিয়ে তোমার ধূর্ত বেড়ালটিকে
আমাদের দলে টানলাম



প্রচ্ছদ শিল্পী : সুদীপা কুন্ডু







ধীমান পাল





স্নেহাংশু বিকাশ দাস

প্রবাহ



ক্রমশ অন্ধকার গাঢ় হয়…
সঠিক বিন্যাসে আরো বেশি রং
ছেড়ে আসা মেঠোজন্মের কথা
মিলেমিশে যায় মৃত পাতা
এলোমেলো ঋতু
নির্ভুল সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে
নৈর্ঋত আলোর শরীর
মুখ ফিরিয়ে রাখা দীর্ঘছায়া
অন্যমনে দেখে গতজন্মের স্থিরচিত্র

প্রচ্ছদ শিল্পী : সুদীপা কুন্ডু

শৌনক দত্ত

মন চায় মন চায় না 




বাইরে বৃষ্টি অঝোর ধারায় ঝরছে।এমন সময় অবসর ঠেলে ঘিরে আসে একরাশ স্মৃতি,অব্যক্ত অনেক কথা যা কখনো বলা হয়না।বৃষ্টিদিনের অলসতার এই এক ধারা বুঝি সবার থাকে।প্রতিটি মানুষের মাঝে যে মানুষের বাস সে এমন ধারা বৃষ্টির দিনে কখন বেরিয়ে আসে তা ঐ রক্তমাংসের মানুষটি বুঝতে পারেনা আর পারেনা বলেই হয়ত বৃষ্টির মতো ঝরে যায় মেঘ থেকে পৃথিবীর বুকে। 
মানিয়া... 
মানিয়া সাধারন মানুষগুলোর চেয়ে আলাদা।পেশায় শিক্ষক হলেও কোমল এই নারীর ভেতর কঠিন এক মানবীর বাস।ছাত্র রাজনীতি কিংবা ছোট্টবেলা থেকে বড় হবার সময় পারিবারিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে তার পাশে আবেগ বলে কিছু ছিলো না সেই কারণেই কিনা কে জানে মানিয়া আর পাঁচ দশটা মানুষের চেয়ে একেবারেই আলাদা।তাই বলে এমন ভাবার ও উপায় নেই সে পাথর!সে যেমন ভাল শিক্ষক তেমনি দক্ষ গৃহী।রবীন্দ্রনাথের প্রতি তার আছে ভীষন দূর্বলতা।তার অবসর যদিও খুব কম তবু কখনো যদি অবসর মিলে যায় মানিয়া সাহিত্যে ডুবে যায়,গান শোনে।তার লেখার হাতটি শ্লোগানের সাথে আকাশের দিকে তোলা হাতের মতই বিপ্লবী,আস্থাশীল ও স্বপ্নময়।ছিপছিপে শরীরের মানিয়া শাড়িতে যতটা মমতাময়ী,সালোয়ার কামিজে ততটাই তন্বী।প্রখর মেধাবী মানিয়া চাইলেই ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার কিংবা অন্য যেকোনে পেশায় নিজেকে দেখতে পেতো কিন্তু অন্যসব পেশাকে কেন বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শিক্ষকতা বেছে নিলো এই প্রশ্নটা আজো তার বন্ধু বা সহপাঠীদের কাছে বড় বিস্ময়।ছাত্রাবস্থা থেকে রাজনীতি করা মানিয়ার রাজনৈতিক অবস্থানও খুব দৃঢ় কিন্তু কোনদিন সে কোন পদ দখল করেনি।সুযোগ যে আসেনি তা কিন্তু নয় দলের উচ্চপর্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূলকর্মীরা বারবার চেয়েছে,চায় সে তার জনপ্রিয়তা,দক্ষতা ও রাজনৈতিক মেধাকে কাজে লাগিয়ে সামনে থাকুক।মানিয়া তা কখনো করেনি।নিভৃতপ্রেমী মানিয়া রাজনীতির মতো ব্যক্তিগত এবং পেশাজীবনেও নিভৃতচারী অথচ খুব জনপ্রিয়! 
বৃষ্টি কিছুটা কমে এসেছে।আকাশ এখন আগের চেয়ে বেশ পরিষ্কার।এখন যে ছন্দে বৃষ্টি ঝরছে তা যত না ভাবাতুর করে তার চেয়ে ঢের বেশি করে লোভী,বৃষ্টি মাখতে।একদল পাখি ভেজা পালক থেকে বৃষ্টি ঝেরে উড়ে যায় আবার পালকে বৃষ্টি মেখে দূরে হয়তবা আপন আশ্রয়ে। 
নিনাদ... 
নিনাদ পৃথিবীর আবেগময় মানুষদের একজন।অলস ও আরামপ্রিয়।মেঘের মতো অস্থির কোন কিছুই বেশিদিন ধরে রাখতে সে পারেনি কিংবা পারেনা।ছোট্টবেলা থেকে বাবা মা ছেড়ে বর্ডিং স্কুল কলেজের কঠোরতার ভেতর থাকা মানুষ যে এমন উদভ্রান্ত ছন্নছাড়া হতে পারে তা নিনাদ কে না দেখলে হয়ত বিশ্বাসই হবে না।রাজনীতি তাকে কখনো টানেনি,বোর্ডস্ট্যান্ড করা নিনাদ সবসময় ডুবে থাকে সাহিত্যে।অথচ বিজ্ঞান নিয়ে পড়া নিনাদের সাহিত্য প্রীতি খুব অস্বাভাবিক লাগে অনেকের কাছে।এমন একজন তুখুর মেধাবী কেন কোন চাকরী নিলো না এটা নিয়ে অনেক রকম গুঞ্জন থাকলে ও নিনাদ তা কখনো গায়ে মাখেনা,সে আছে তার খেয়ালে এক মফস্বল জেলা শহরে একান্তে।সব ছেড়ে গেলেও সাহিত্যসৃষ্টি তাকে কখনো ছেড়ে যায়নি কিংবা সব ছেড়ে দিলেও নিনাদ কখনো সাহিত্য ছাড়তে পারেনি।সাহিত্যে নিনাদ পাহাড় পবর্ত ভেঙ্গেছে তেমন কিন্তু নয় বরং নদীর মতো টিকে আছে!জীবনানন্দ দাশের মাঝে নিজেকে খুঁজে ফেরা নিনাদ প্রথাগত সাহিত্যিকদের মতো নয়। 
আপন খেয়ালে চলছে তার সৃষ্টি,রাজহাসের মতো সারা গায়ে জল মেখেও কোথাও সে নেই।নিনাদের পরিচিতির গন্ডি বেশ লম্বাচওড়া হলেও তার উপর কখনো সাহিত্যসম্পাদকের সুনজর পড়তে দেখা যায়নি।সেও তার ব্যক্তিত্বের ঘোরটোপ পেরিয়ে কাউকে কখনো বলেনা।কেউ স্ব তাগিদে লেখা চাইলে নিনাদ তাকে লেখা দেয়।বাজারে গোটাকতক বই থাকলেও নিনাদ সেরকম বহুলপঠিত সাহিত্যিক নয়। 
বৃষ্টি থেমে গেছে।মাছরাঙার মতো বর্ণিল রোদ ঝিলিক দিচ্ছে।বেলা শেষের আকাশে ফুটে উঠেছে রঙধনু।দুধ কফি রঙের মতো জমে থাকা জল পেরিয়ে যাচ্ছে মানুষ। 

মানিয়া এবং নিনাদ... 

দুইপ্রান্তের দুটি মানুষ মানিয়া ও নিনাদ তাদের মাঝে সেতু গড়ে তোলে কবিতা।একটি বিশেষ দিনের উপর নিনাদের কবিতা পড়ে মানিয়ার আগ্রহ বাড়ে নিনাদের প্রতি।বয়সে কয়েক বছরের ছোট নিনাদের সাথে মানিয়ার সখ্যতা গড়ে তোলে নিনাদের লেখা আর মানিয়ার ব্যক্তিত্ব মুগ্ধ করে নিনাদকে।বেশ কতক অমিলের মাঝেও যে এমন বন্ধুত্বতা গড়ে ওঠতে পারে তা হয়ত মানিয়া ও নিনাদ কে দেখলেই বোঝা যায়।পলকের সাথে সময় যায়।বন্ধুত্বতা গাঢ় হয়।নিনাদের বুকের কোণে মানিয়ার মুগ্ধতা ছড়িয়ে যায় ভালোবাসায়।নিনাদ নিজেকে নিজেই বোঝায় অসম এ ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে না তাই এই ভালোবাসা নিজের মাঝেই লুকিয়ে রাখা হবে বুদ্ধিমানের কাজ কিন্তু মন মানবে কেন?মানিয়ার কাছ থেকে একটু একটু করে দূরত্ব তৈরী করে নিনাদ,এদিকে নিনাদের নিখাদ বন্ধুত্বতা, ম্যাচুরিটি মানিয়ার মনে দাগ কাটে ছেলেদের মাঝে মেয়ে দিয়ে যে ধরনের ভাবনা থাকে মানিয়া তা কখনো নিনাদের মাঝে দেখেনি আর তাই নিনাদকে অন্য সবার চেয়ে আলাদা মনে হয় মানিয়ার।
নিনাদের কাছে ভালোবাসা আর প্রেমের সংজ্ঞা আলাদা।নিনাদের মনে হয় ভালোবাসা মানে ভালো লাগার সাথে বসবাস আর প্রেম মানে প্রেষিত কাম।এই জায়গা থেকে নিনাদের কখনো কখনো মনে হয় মানিয়া কে ভালোবাসায় কোন পাপ নেই কোন দায়বদ্ধতা কিংবা পাওয়া না পাওয়ার কোন টানাপোড়েন নেই।মানিয়ার ভালো যেসব সেসবের সঙ্গে কাটিয়ে দেয়ার নামই ভালোবাসা।নিনাদের ভেতর মানিয়ার জন্য প্রেম যে একেবারেই কাজ করে না তেমনটি নয় কিন্তু নিনাদ জানে প্রেমের চেয়ে মানিয়ার প্রতি তার ভালোবাসা অনেক বেশি। 

মানিয়ার ভেতরে যে আরেকটি মানিয়ার বসবাস তাকে মানিয়াই চেনে।বাইরে সে মানিয়া বড় অপরিচিত বড্ড বেমানান।শ্রাবণ শেষের এক বৃষ্টিস্নাত বিকেলে মানিয়ার সাথে কথা বলতে বলতে সহসা অপরিচিত মানিয়াকে খুঁজে পায় নিনাদ।বৃষ্টির ঘোরে নিনাদ কথার ফাঁকে একসময় বহুবছরের পুরোনো শিলালিপির পাঠ উদ্ধারের আনন্দের মতো অন্য এক মানিয়াকে খুঁজে পেয়ে নিজের অব্যক্ত ভালোবাসা ব্যক্ত করে মানিয়ার কাছে।মানিয়া জানে নিনাদ খুব মজা করতে ভালোবাসে আর তাই প্রথমে শোনার পর তার মনে হয় নিনাদ মজা করছে।সে বিশ্বাস করতে পারেনি নিনাদের মনে তার জন্য এমন পাগলামী থাকতে পারে।নিনাদ মাথা নিচু করে বসে থাকে।তার মনে হয় বাইরের আকাশের মেঘ ভেঙে পড়ার চেয়ে বেশি আওয়াজ তার ভেতরে।সম্পর্কটা কি ভেঙে যাবে?বলাটা কি উচিত হলো মানিয়াকে?এমন হাজারো প্রশ্নের ভেতর কতক্ষণ নিজের সাথে নিনাদের কথোপকথন হয়েছে নিনাদ তা বলতে পারবেনা। 

বাইরের বৃষ্টির ঘোর ঘরেও ছড়িয়ে গেছে।মানিয়ার চোখে মুখে বৃষ্টি শেষের নীরবতা। 

দূরের কোনো মসজিদ থেকে সন্ধ্যার আযান ভেসে আসে।পাশের কোনো বাসার উল্লুধ্বনি আর শাঁঙ কাসরের শব্দে নিমগ্নতা ভেঙে যায় ঘরময় ছড়িয়ে থাকা অন্ধকার ভেঙে চুরমার করে মানিয়া আলো জ্বালে।দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে নিনাদ উঠে দাঁড়ায়।মনে মনে খুব,খুব চায় মানিয়া কিছু একটা বলুক।
বাইরের অন্ধকার বেশ গাঢ়।অমাবস্যা নাকি মেঘ নিনাদ ঠিক বোঝেনা।মানিয়ার সাথে সব সম্পর্কের ইতি টেনেই হয়ত এই শেষ মানিয়ার কাছে থেকে বেরিয়ে যাওয়া।মানিয়া দীর্ঘ নীরবতার গুমোট কাটিয়ে খুব স্বাভাবিক গলায় বলে- 
-নিনাদ এটা কতদিন ধরে তোমার মনে চলছে? 
-অনেকদিন। 
-কাকে কাকে বলেছো তোমার প্রেমকাহিনী? 
-কাউকে না। 
-তা ভাই নিনাদ তুমি আমাকে বা আমার সম্পর্কে কতটুকু জানো? 
-এই কয়বছরে যতটুকু জেনেছি 
-তাতে কি ভালোবাসা সম্ভব? 
-আমি জানিয়া মানিয়া। 
-আমার মনে হয় চাওয়াটা তোমার শরীরের। 
-না তা নয়। 
-তা নয় তো কি? 
-হয়ত কিছুটা শারীরিক তবে তা গৌন। 
-ভাই এগুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো।মনে করো আমি কিছু শুনিনি তুমিও কিছু বলোনি। 
-কিন্তু মানিয়া 
-কোনো কিন্তু টিন্তু নেই নিনাদ। 

নিনাদ সেদিন খুব রাগেই বেরিয়ে আসে।এভাবে কেউ তাকে ফেরাতে পারে সে ভাবতে পারেনি।প্রত্যাখানের ভয়েই সে সব সময় দূরে থেকেছে।জীবনের এতগুলো বছর পেরিয়ে কি দরকার ছিলো এই প্রস্তাবনার নিজেকে খুব ছোট মনে হয় নিনাদের।পরক্ষণেই নিনাদ হেসে ওঠে।তার মনে হয় সে মানিয়াকে ভালোবাসে।মানিয়ার যা কিছু ভালো তার সাথেই তার বসবাস এখানে দুঃখ বা প্রত্যাখান বলে কিছু নেই। 

নিনাদ বেরিয়ে যাবার পর মানিয়ার মনে হলো নিনাদকে এভাবে না বললেও হতো।নিনাদ হয়ত কষ্ট পেয়েছে।নিনাদের ভেতর অনেক ছেলেমানুষী আছে।আবেগে নিনাদ যদি কিছু একটা করে বসে।মানিয়ার চোখ মুখ অস্থির হয়ে ওঠে। 

আকাশের মেঘ কেটে গিয়ে জোছনা ছড়িয়ে পড়ে।জল মেশানো দুধের মতো চাঁদ জেগে থাকে একা।জানালার গ্রীল গলে ঢুকে পড়ে জোছনা,আর মায়াবী রাত প্রশয় খোঁজে।একা.. 




প্রচ্ছদ শিল্পী : সুদীপা কুন্ডু





কুহেলী কর্মকার


                                                              এটা ওদের গল্প
                                                              
(১)
           "উফ!! কি ভ্যাপসা গরম.. এতক্ষণ পর ট্রেনটা একটু ফাঁকা হলো। যাই একটু বসি।" কাঁধ থেকে ঝুড়িটা নামিয়ে ট্রেনের দরজার সামনে বসে পড়ল প্রায় ৭০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ। তারপর পকেট থেকে টাকা বার করে গুনতে লাগল। "একশো, দুশো,তিনশো চারশো আর পঞ্চাশ। হলো গে চারশো পঞ্চাশ। আজ ভালো রোজগাড় হয়েছে। এ মাসে ফুলির ইস্কুলের মাইনেটা দিয়ে দিতে পারব।"
বৃদ্ধের ভাঁজ পড়া, কোঁচকানো গালে এক ঝলক্ হাসি ফুটে উঠল। পেছন থেকে ডাক এলো- "দাদু আমাকে একটু ঝাল করে ছোলা, মটর মেখে দাও তো।"
বৃদ্ধ হেসে বললো- "এই লঙ্কাগুলো খুব ঝাল। তুমি খেতে পারবে তো দিদিভাই..?"
স্কুলযাত্রী কিসোরী মেয়েটি উত্তর দিলো- "হ্যাঁ দাদু পারবো। আর একটু বেশী করে টক্ দিও।"
বৃদ্ধ তার স্টীলের টিফিন কৌটে ছোলা-মটর সিদ্ধ, আলু সিদ্ধ, কাঁচা পিঁয়াজ, ধনে পাতা, নুন, বেশী করে লঙ্গা আর লেবু দিয়ে তার তথা কথিত স্টাইলে খটর- খটর, খটা-খট্ করতে করতে চাট্ মেখে মেয়েটির হাতে দিলো। আর বদলে একটি দশ টাকার নোট উপার্জন করলো। মেয়েটির দেখাদেখি তার আরও তিন-চার জন বন্ধুও এসে জুটল- "দাদু আমাদের জন্যেও বানাও তো"।  "হ্যাঁ এখনই বানাচ্ছি"বৃদ্ধের ফাটা ঠোঁট জুড়ে আবার হাসি ফুটে উঠলো।
           বৃদ্ধ ট্রেনে ঘুরে ঘুরে ছোটা,মটর সিদ্ধ বিক্রি করেন। একটা লম্বা গামছার সাথে তার গলায় ঝোলানো থাকে যাবতীয় সাজ-সরঞ্চাম সুদ্ধু তার ছোট্ট চাট্ স্টল অর্থাৎ ঝুড়ি।ঝুড়িটির ভারে মাঝে মাঝে তিনি ঝুকে পড়েন। তবুও পেটের দায়ে তাকে এই ঝুড়িটির ভার বহন করতেই হয়। আর  এই ঝুড়িতেই যে লোকানো আছে জিভে জল আনা মশালা ছোলা,মটরের টক্-ঝাল স্বাদ। নিত্য যাত্রীদের প্রায় মুখচেনা হয়ে গেছেন তিনি। কিছু কিছু কলেজ পড়ুয়ার দল তার আবার খোঁজ খবর নেয় - "কিগো দাদু কেমন আছো..?
বৃদ্ধ একগাল হেসে উত্তর দেয়- "ভালো আছি দাদুভাই। তা ছোলা-মটর মেখে দেবো নাকি..?"
"হ্যাঁ দাদু। বেশ জম্পেশ্ করে মেখে দাও তো দেখি....।"
       এইভাবেই ট্রেনে ঘুরে ঘুরে এই বৃদ্ধ মানুষটার প্রতিদিন কাটে। তারপর বিকেল বেলা সারাদিনের উপার্জন টুকু পকেটে ভরে তিনি ফিরে যান স্টেশনের কাছাকাছি তার ছোট্ট স্যাঁতস্যাঁতে আস্তানায়।সেখানে তিনি আর তার নাতলী ফুলি দুইজনে মিলে থাকেন। এটাই তাদের ছোট্ট সংসার কখনও হাসি-কান্না, কখনও অভাব-অনটন, আর তার মধ্যেই বেঁচে থাকার এক অন্তহীন লড়াই।
        আজ ট্রেনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ বৃদ্ধের নজরে পড়ল এক বাপ-ছেলের দিকে। বছর ৩০শের ছেলেটা ট্রেনে সহযাত্রীদের অনুরোধ করছিল - "দাদা একটু জায়গা দিন না..। আমার বাবা বয়স্ক মানুষ, বেশীক্ষন দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না। একটু চেপে বসুন। বাবা... এইখানে জায়গা আছে বসে পড়ো তাড়াতাড়ি।"
ছেলেটির বাবা বলে উঠল- "তুই বসবি না..?"
"আরে আমি ঠিক আছি। তোমার হাটু ব্যাথা তুমি বসো।" ছেলেটি সবিনয়ে উত্তর দিলো।

           দূরে দাঁড়িয়ে ঐ বাপ-ছেলের কথা কান পেতে শুনছিলেন বৃদ্ধ। পেছন থেকে ডাক এলো- "আমাকে দশটাকার ছোলা-মটর মেখে দাও তো।" কিন্তু গ্ৰাহকের আওয়াজ বৃদ্ধের কান পর্যন্ত পৌঁছালো না। ঐ বাপ-ছেলেকে দেখে তার মন এক অজানা হিংসায় জ্বলে-পুড়ে উঠছিল। মনে মনে তিনি বিড়বিড় করে উঠলেন - "দেখবি তোর অবস্থায়ও একদিন আমার মতো হবে। তোর ছেলেও তোকে একদিন লাথি মেরে বাড়ি থেকে বেড় করে দেবে। তখন বুঝবি.... এই ভালোবাসা সারাজীবন তোর জীবনেও থাকবে না।"
তার পরক্ষনেই তিনি এই অশুভ কামনার জন্যে ভাগবানের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলেন- "ক্ষমা করো ভগবান। এমনটা যেনো আর কারোর সাথে না হয়। ঐ ছেলেটা যেনো আমার ছেলের মতো কোনোদিন না হয় ভগবান। আর কাউকে আমার মতোন ভাগ্য দিও না তুমি। দিও না...।"
         "তবে এই বুড়ো বয়সে গলায় ছোলা-মটরের ঝুড়ি ঝুলিয়ে ট্রেনে ট্রেনে ঘুরে বেড়ানোর ভাগ্য তো আমারও হওয়ার কথা ছিলো না। তবে কেন এমন হলো ভগবান...?" আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধের ঘোলাটে চোখ দুটোয় নোনা জল ছলকে্ উঠল।
(২)
          সে প্রায় চারবছর আগের কথা তখন তারও একটা নাম ছিলো, আপন ছিলো, ঘর ছিলো। আরও কতো কিছু ছিলো। আর এখন দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়া তার জীবনে আর কিছুই বাকি নেই। তখন তিনি ছিলেন শঙ্কর ঘোষ। একটি স্কুলে সামান্য কেরানির চাকরী করে স্ত্রী, পুত্রের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করতেন তিনি। তবে এখানেই তিনি খ্যান্ত হতেন না। হারভাঙা খাটুনির পর বাড়ি এসে আবার সাইকেল নিয়ে মুদির দোকানে মাল ডেলিভারী করতে যেতেন। তার একমাত্র ছেলে শিশিরের ইংরেজি স্কুলের যাবতীয় খরচ চালানোর জন্যে দিনরাত অবিরত তিনি খেটে চলতেন। না করতেন বিশ্রাম, না করতেন নিজের শরীরের বা সুখের চিন্তা। তার জীবনের একটাই প্রতিজ্ঞা ছিলো,
"আমার মতো কষ্ট যেনো আমার ছেলেকে পেতে না হয়। ওর ভবিষ্যৎ আমার মতো যেন না হয়।" আর এই প্রতিজ্ঞা রক্ষার্থে তিনি অর্ধেকের বেশী জীবন অতিবাহিত করে ফেলেন। নিজের জন্যে যে কিছুই করা হয়নি তার। তবু মনে একটা শান্তি ছিলো ছেলের জন্যে তিনি কিছু তো করতে পেরেছেন।
আর তার প্রতিজ্ঞা সফল হয়েছিল সেদিন, যেদিন শিশির একটি বড়ো কম্পানীতে উচু পোস্টে চাকরী জয়েন করেছিল।
তারপর তিনি ভেবেছিলেন এবার অবসর নিয়ে নিজের জীবনসঙ্গীর সাথে তীর্থে বেরিয়ে পড়বেন। তার এই জীবন যুদ্ধে সমান তালে তাকে শক্তি যুগিয়েছে যে সাথী, তার জন্যে কিছুই করা হয়ে ওঠেনি। এবার শুধু তার হাত ধরে অবসর জীবনটা কাটিয়ে দেওয়ার পালা। কিন্তু হায় রে পোড়া কপাল... অবসর এলো কিন্তু জীবনসাথী আর রইল না। শঙ্কর বাবুর স্ত্রী একাই ড্যাং ড্যাং করে ইহলোক থেকে পরলোকে পাড়ি দিলেন।
          তারপর এলো এক অন্তহীন একাকিত্বের পালা। ছেলে সারাক্ষণ নিজের জগতে, নিজের চাকরী নিয়ে ব্যস্ত থাকত। বাবা-ছেলের মধ্যে এক সূক্ষ দূরত্বের প্রাচীর তৈরি হয়েছিল। তারপর ছেলে বিয়ে করলো, পুত্রবধূ ঘরে এলো। আর ধীরে ধীরে এই দূরত্ব বিশাল খাদে পরিনত হলো। এই সংসারে শঙ্কর বাবুর প্রয়োজন ফুরিয়েছে, নানা অছিলায় এ কথা জাহির করা হতো। তবুও তিনি বুঝেও না বোঝার ভান করে যেন সত্যের থেকে মুখ ফিরিয়ে ছিলেন।
কিন্তু এইভাবে কতদিন আর পালানো যায়। অবশেষে সেই দিনটা এসেই গেলো। শিশির আর তার স্ত্রী মিলে শঙ্করকে তাদের জীবন থেকে পুরনো আসবাবপত্রের মতো ছুড়ে ফেলে দিলো।

"বাবা আমি দিল্লিতে ভালো চাকরির অফার পেয়েছি। এই ভাঙা, পুরনো বাড়িটা বেচে আমরা ওখানেই সেটেল হয়ে যাবো। আর তোমার থাকা-খাওয়ার ভালো ব্যবস্থা করে দিয়েছি। চিন্তা করোনা ভালো জায়গা, তোমার মতো আরও লোকজন আছে ওখানে। আমি আসবো মাঝে মাঝে তোমার সাথে দেখা করতে।"
শঙ্কর বাবু ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন, ছেলে কোন জায়গার কথা বলছে। কিন্তু তিনি অবাক হয়ে গেলেন অন্য কারণে, তার ছেলে কিভাবে তার চোখের দিকে তাকিয়ে এই কথা গুলো বলে চলছিল। একটু লজ্জার লেশ মাত্র ছিলো না তার চোখে।
না আর ঘাড় ধাক্কা থেকে হয়নি তাকে, তিনি স্বেচ্ছায় সেদিন ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে এসেছিলেন অজানার উদ্দেশ্যে।
 (৩) 
           দূর থেকে ট্রেনের হুইশেল শোনা যাচ্ছিল। আর শঙ্কর বাবু রেল লাইনের ওপর দিয়ে হেঁটে চলছিলেন। মৃত্যুই তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।
"ভালোই হয়েছে শিশিরের মা আমার আগে চলে গেছে। নাহলে আমার সাথে তারও এই দূর্দশা হতো। আমার এতদিনর কঠিন পরিশ্রমের ফল যে এতো কঠিন হবে স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। আর কি হবে আমার বেঁচে থেকে... মরনই আমার ভালো।"
সূর্যাস্তের পর ট্রেন লাইনে ক্রমশ অন্ধকার নেমে আসছিল। আর তিনি ছুটন্ত ট্রেনের আরও কাছে এগিয়ে চলেছিলেন। হঠাৎ একটি কিশোরীর মেয়ের আওয়াজ কানে এলো- "ট্রেন আসছে। ট্রেন আসছে। সরে যাও। কি করছো, সরে যাও..."
মেয়েটি হেঁচকা টানে শঙ্করকে ট্রেন লাইন থেকে দূরে সরিয়ে আনল।আর দ্রুতগামী ট্রেন হুশ করে পাশ দিয়ে চলে গেলো। মৃত্যুও তাকে গ্ৰহন করলো না পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।

        বছর ১২র মেয়েটির নাম ছিলো ফুলি। স্টেশনের কাছাকাছিই তার ছোট্ট ঘর। সেখানেই থাকত সে আর তার মা ইন্দুমতী। সেইদিন থেকে শঙ্কর বাবুর এক নতুন ঠিকানা হলো। আর শিশির... সে মনেহয় তার বাবার খোঁজ আর করেনি। খোঁজ করলে না পাওয়াটা এতো অসাধ্য ব্যাপার ছিলো না।
শঙ্কর বাবু ভাগ্যের এই পরিহাসে হেসে বলে  উঠলেন- "কি আজব এই দুনিয়াটা। আমার আপন ছেলে আমায় ঘরছাড়া করলো। আমাকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিলো। আর এই অচেনা কিশোরী মেয়েটা আর তার মা, আমার জীবনের দুখঃ আর অসহায়তার কথা শুনে আমাকে আপন করে নিলো। তাদের এই ছোট্ট ঘরটার একটা কোনে জায়গা দিলো। বাবা ডেকে বেঁধে নিলো এক পরম আত্মার বাঁধনে।"

          ইন্দুমতী শহরের বাবুদের বাড়িতে ঠিকে কাজ করে নিজের আর নিজের মেয়ের পেট চালাতো। তাছাড়া মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্যে একটা ছোট্ট হোটেলে বাসনপত্র ধোয়ারও কাজ করতো। শঙ্কর বাবু দেখলেন, তাদের জীবনেও সেই একই সংঘর্ষ। ইন্দুমতীর একটাই স্বপ্ন ছিলো মেয়েকে পড়াশোনা শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করবে।
গরীব হোক আর বড়লোক সব বাবা,মার স্বপ্ন বোধহয় একই রকমের হয়। ইন্দুমতী একদিন ভেজা চোখে শঙ্কর বাবুকে বলেছিল- "জানিস বাপ, মু জীবনে অনেক কষ্ট পাইসি। তাই মু চাই মুর মেয়েটা যাতে সেই কষ্ট না পায়। ওকে মু নেখাপড়া শিখ্খে অনেক বড়ো করে তুলবো।"
কিন্তু গরীবের স্বপ্ন রাত পোহালেই বাসী হয়ে যায়। সেদিন ইন্দুমতী বলে গিয়েছিল- "বাপ মু তাড়াতাড়ি ফিরবো। ফুলিকে দেখিস।"
           সেদিন দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে রাত হয়েছিল, কিন্তু ইন্দুমতী ফেরেনি। ফুলির হাত ধরে, শঙ্কর বাবু ইন্দুমতীকে খুঁজতে বেড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু কেউ তার খোঁজ দিতে পারিনি। ইন্দুমতীর সাঙ্গিনী গৌরি বলেছিল, যে আজ তার সাথে ইন্দুমতী ফেরেনি। কথাটা শুনে শঙ্কর বাবুর কপালে চিন্তার রেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
"দাদু, মা কোথায় ..?" ফুলি ভেজা চোখে প্রশ্ন করেছিল।
          আর এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গিয়েছিল পরের দিন সকালে। গৌরি এসে সেই সাংঘাতিক ঘটনার বিবরন দিয়েছিল।যে ইন্দুমতী আর বেঁচে নেই। শহরের হিংস্র পশুদের দল কাল রাতে তাকে ছিঁড়ে খেয়েছে। বড়ো রাস্তার ধারে পড়ে থাকা তার নগ্ন দেহটা পুলিশেরা থানায় নিয়ে গেছে।
শঙ্কর বাবুর বুকটা যেন এক ধাক্কায় খালি হয়ে গিয়েছিল। ঘোলাটে চোখে নোনতা জল বাঁধ মানছিল না। টলোমলো পায়ে তিনি থানার দরজায় গিয়ে পৌঁছেছিলেন। ইন্দুমতীর অবস্থা দেখে শঙ্কর বাবু কেঁপে উঠেছিলেন। কি ভয়ানক সেই দৃশ্য!! তার শরীর জুড়ে কি নিদারুন হিংস্রতার ছাপ।
পুলিশ প্রশ্ন করেছিল- "আপনি চেনেন..?" "হ্যাঁ চিনি। ও আমার মেয়ে। আমার অভাগী মেয়ে। ওর এই অবস্থা কারা করলো...? কারা করলো...?" কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন তিনি।
          এই ঘটনার কিছুদিন পরে জানা গিয়েছিল, ইন্দুমতী যে শহরের বাবুর বাড়ি কাজ করতো। তারই ছেলে আর তার বন্ধুরা মিলে ইন্দুমতীর ওপর শারীরিক অত্যাচার করেছিল। কিন্তু সত্যিটা সবার সামনে থাকা সত্বেও কোনো বিচার পাইনি ইন্দুমতীর ক্ষতবিক্ষত ডেড্ বডিটা। শঙ্কর বাবু  অনেক থানা, পুলিশ করেছিলেন। বিচারের আশায় ছুটে মরেছিলেন। কিন্তু গরীবেরা তো বিচার পায় না, পায় শুধু লাঞ্ছনা আর অপমান। প্রভাব- প্রতিপত্তিশালী প্রতিপক্ষের সামনে, বৃদ্ধ- অসহায় শঙ্কর বাবু হেরে গিয়েছিলেন। অবশেষে ফুলির হাত ধরে ফিরে গিয়েছিলেন তাদের ছোট্ট আস্তানায়।
(৪)
           আর সেদিন থেকে ফুলি আর শঙ্কর বাবু একে- অপরের সংসার। ইন্দুমতীর স্বপ্ন পূরণ করতে, তিনি কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন ঐ দায়িত্বের ঝুড়িটা। ছোট্ট ফুলির হাতে তার পড়ার বইগুলো দেখে তিনি মনে মনে শক্তি জুগিয়েছিলেন। শঙ্কর বাবু মনে মনে আবার একটা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ইন্দুমতীর কাছে , যে ফুলিকে পড়ালেখা শিখিয়ে যোগ্য করে তুলবেন। সেই প্রতিক্ষা রক্ষার্থে তিনি বুড়ো হাড়ে আবার সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
তবে জীবনের লড়াইটা যে কোনোদিনই সহজ ছিলো না। বিশাল জনসমুদ্রে ছোট্ট নুড়ি-পাথরের মতো দুটি প্রাণ, কঠিন বাস্তবের সাথে ধাক্কা খেতে খেতে ভেসে চলেছিল।
তার ওপর ফুলি বড়ো হওয়ার সাথে সাথে শঙ্কর বাবুর সমস্যাটা বেড়ে চলছিল। নাতনীকে নিয়ে তার দুশ্চিন্তার অন্ত ছিলো না। তিনি এই বস্তি ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাওয়ার কথা ভাবছিলেন। কারন বস্তির কিছু খারাপ লোকের নোংরা নজর পড়েছে ফুলির ওপর। তারা একদিন তেমনই ইঙ্গিত দিয়েছিলো শঙ্কর বাবুকে- "ফুলি বেশ বড়ো হয়েছে। দেখতেও সুন্দর। ওকে আমরা ভালো কাম দিবো দাদু। অনেক টাকা পাবে। তোমাদের সব দুখঃ দূর হয়ে যাবে।"
       শঙ্কর বাবু ওদের কথা শুনে শিহুড়ে উঠেছিলেন - "না আমার প্রাণ থাকতে, তোর জীবন আমি নষ্ট হতে দেবো না। আমি তোকে অনেক দূরে নিয়ে চলে যাব ফুলি। অনেক দূ্রে..।" নাতনীকে বুকে জড়িয়ে ভয়ে কেঁপে উঠেছিলেন তিনি। ফুলি নিষ্পাপ মনে প্রশ্ন করেছিল- "ওরা মুকে কি কাজ দিবে দাদু..?" শঙ্কর বাবু সে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি। শুধু একরাশ কান্না বুকে নিয়ে ফুলিকে আঁকড়ে ধরেছিলেন।
           আর সেইদিন থেকে দ্বিগুণ পরিশ্রম করে একটা একটা করে টাকা জমাচ্ছেন তিনি।তিনি মনস্থ করেছেন,এই মাসেই অন্য জায়গায় চলে যাবেন।
        সন্ধ্যা নেমেছে আকাশে, সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে শঙ্কর বাবু ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছেন। চলতে চলতে তিনি বইয়ের দোকানে ঢুকলেন। সেই দোকান থেকে রঙ পেনসির কিনলেন। বহু দিন ধরে ফুলি রঙ, পেনসিলের বায়না করছে। আজ এইগুলো দেখে সে খুব খুশি হবে। মনে মনে ফুলির হাসি মাখা মুখটার কল্পনা করছিলেন তিনি।  ঝুড়ি হাতে ক্লান্ত শরীরে শঙ্কর বাবু বড়ো রাস্তা পাড় হয়ে, বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন।এমন সময় একটি দ্রুতগামী লড়ি দানবের ন্যায় গর্জে এসে সজোরে তাকে ধাক্কা দিলো।আর শঙ্কর বাবু খড়-কুটোর মতো রাস্তায় ওপরে ছিটকে্ গিয়ে পড়লেন।
লোকজনের ভীড় ছুটে এলো ঘটনা স্থলে।
"ঈশ!! কিভাবে পিষে দিয়ে গেলো।"
"উফ্ !! কি রক্ত। মানুষের প্রাণের আজকাল কানাকড়িও দাম নেই।"
"দেখ তো লোকটা বেঁচে আছে কিনা..?"
"আরে দেখ নিশ্বাস নিচ্ছে।এখনও প্রাণ আছে মনেহয়।"
 "তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।"
"পুলিশে খবর দিতে হবে আগে।"
    ঘটনাস্থলে উপস্থিত লোকজনের কথাগুলো শঙ্কর বাবুর কানে এসে পৌঁছাচ্ছিল। কিন্তু তিনি প্রতিক্রিয়া করতে পারছিলেন না। তার দেহ ধীরে ধীরে কেমন অসাড় হয়ে আসছিল। চোখে ধোঁয়াশা নামছিল। গলার স্বর জড়িয়ে আসছিল।
       একটা সময় ছিলো যখন তিনি স্বেচ্ছায় মরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এখন তিনি বাঁচতে চান। ফুলিকে নিয়ে তিনি বাঁচতে চান। শঙ্কর বাবুর রক্তাক্ত শরীরটা বার বার নড়ে উঠছিল। যেন ইঙ্গিতে তিনি প্রান ভিক্ষা চাইছিলেন।
"আমি বাঁচতে চাই....। আমি বাঁচতে...।"
অচেনা মানুষের ভীড়ে শঙ্কর বাবুর রক্তে ভেজা চোখ দুটো খুঁজে চলেছিল ফুলিকে। "ফুলি..." "ফুলি..." মনের ভীতরে তিনি বীভৎস ভাবে চিৎকারে করে ডাকছিলেন তাকে।
      হঠাৎ ধোঁয়াসার মাঝে তিনি দেখতে পেলেন ফুলির মুখটা। ভীড় ঢেলে সে যেনো তার দাদুর কাছে এগিয়ে আসছে। কিন্তু ফুলির একি সাজ দেখছেন শঙ্কর বাবু!!  তার পড়নে রঙিন শাড়ি, কপালে রঙিন টিপ, ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপ্সটিক, চোখের নীচে কালচে কাজল আর ঘন কালো চুলে জুঁইয়ের মালা
হঠাৎ ফুলি বলে উঠল- "এ বাবু আসবি নাকি আমার ঘরে..??"
তীরের মতো সে কথা শঙ্কর বাবুর বুকে এসে বিঁধল। হাজার কষ্ট ছাপিয়ে গেলো তার যন্ত্রনা। বিস্ফারিত চোখে তিনি ফুলির দিকেই তাকিয়ে রইলেন।
"অ্যাম্বুলেন্স এখনও এলো না।"
"লোকটা মনেহয় মরে গেছে।আর নিশ্বাস নিচ্ছে না। ঈশ!!! "

        শঙ্কর বাবুর নিষ্প্রান দেহটা রাস্তায় ওপড়ে পড়ে রইল। ছোলা-মটরের ঝুড়িটা দুমড়ে-মুছড়ে একটু দূরে রাস্তার ধারে পড়েছিল। কিন্তু তার মুঠোয় তখনও রঙ পেনসিলের প্যাকেটটা ধরা ছিলো। আর একবুক স্বপ্ন..  সেটা তো লড়ির চাকার তলায় পিষে গিয়েছিল।
সমাপ্ত







                                                                 সংঘাত
                                                          কুহেলী কর্মকার

(১)
        জৈষ্ঠ মাসের এক ঊষ্ণতম দুপুর।মিত্র বাড়ির ছাদে খাঁ খাঁ করছে রোদ্দুর। গোলাপ গাছের পাতাগুলো শুকিয়ে হলুদ হয়ে গেছে। রাস্তাঘাট প্রায় জনমানবহীন, যেন চারিদিকে লু বইছে। এমন সময় হঠাৎ চেঁচামেচির আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো দীপার। বাড়ির কাজ শেষ করে তিন্নীর মাথার কাছে বসে, তার মাথার হাত বোলাতে বোলাতে কখন যে দুচোখে ঘুম নেমে এসেছিল খেয়ালই করেনি। ঘুমের মধ্যে প্রতিবেশীদের বীভৎস চিরকার কানে এলো-
 "এই পড়ে গেলো, পড়ে গেলো। মেয়েটাকে কেউ ধর... পড়লে তো মরে যাবে। তাড়াতাড়ি ডাক ওদের। "
প্রতিবেশীরা জোরে জোরে ডেকে উঠল "দীপা বৌদী... ও দীপা বৌদী।তিন্নী কি করছে দেখো...।"
         দীপা তথমত খেয়ে লাফ দিয়ে উঠল।তিন্নী ঘরে নেই দেখে চমকে উঠল সে। "তাহলে কি তিন্নী ছাদে চলে গেছে।" ভয়ে বুক শুকিয়ে গেলো তার। ছুটতে ছুটতে ছাদের দিকে গেলো দীপা। সেখারকার দৃশ্য দেখে শিহুড়ে উঠল সে। উতপ্ত ছাদের পাঁচিলে ওপর দাঁড়িয়ে খিলখিলিয়ে হাসছে তিন্নী। নিষ্পাপ শিশুর ন্যায় সেই হাসি। কিন্তু কি ভয়ংকর। আর্তনাদ করে উঠল দীপা। "তিন্নী...তিন্নী... কি করছিস মা..? নীচে নেমে আয়। পাগলামী করিস না। মায়ের কাছে চলে আয়। পড়ে যাবি মা, নীচে নেমে আয়।"
তিন্নী হাসতে হাসতে উত্তর দিলো "মা ঐ দেখো দাদাভাই দাঁড়িয়ে আছে। দাদাভাই আমায় ডাকছে। বোন বোন বলে ডাকছে, তুমি শুনতে পাচ্ছো না...।" তিন্নীর কথা শুনে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল দীপা। কিন্তু তিন্নী নিজের মতো কথা বলতে বলতে ছাদের পাঁচিলের ওপর দিয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে। দীপা চিৎকার করে উঠল "কেউ বাঁচাও আমার মেয়েটাকে। কেউ বাঁচাও।"
নীচে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিবেশীরাও ভয়ার্ত কন্ঠে চিৎকার করে উঠছিল। তাদের মধ্যেই কিছু লোকজন দীপার সাহায্যের জন্যে ছুটে এলো। তারাই ধরাধরি করে তিন্নীকে নীচে নামিয়ে আনল। ছটফট্ করছিল তিন্নী, কিছুতেই সামলানো যাচ্ছিল না তাকে।
এইসব খবর পেয়ে, ডাক্তার নিয়ে বাড়ি পৌঁছালো তিন্নীর বাবা মলয় বাবু। অবশেষে ডাক্তার ঘুমের ইনজেনশন্ দিয়ে ঘুম পারিয়ে দিলো তিন্নীকে। মেয়ের এই অবস্থা দেখে বাবা মার বুক কেঁদে উঠছিল। প্রতিবেশীরা কিছুক্ষন পর সান্তনা বাক্য শুনিয়ে, যে যার বাড়িতে ফিরে গেলো। প্রতিবেশী প্রভাকর বাবু ঝাঁজিয়ে বলে উঠলেন, "দেখো মলয় দা রোজ রোজ এই ঝামেলা আর আমাদের ভালো লাগেনা। নয় মেয়েকে বেঁধে রাখো, নাহলে কোনো মেন্টাল অ্যাসাইলেম্ এ অ্যাডমিট করে দাও।" 
      কথাটা শোনার পর মলয় বাবু থম্ মেরে বিছানার ওপর বসে রইল। দীপা স্বামীর কাঁধে মাথা রেখে কেঁদে উঠল "কি করব বলো আমি, আমার ফুলের মতো মেয়েটাকে আমি কি করে বেঁধে রাখব..? ছেলেটাকে তো আগেই হারিয়ে ফেলেছি, এবার কি মেয়েটাকেও হারিয়ে ফেলব..?"
বাবা মার এই যন্ত্রণা থেকে পুরো অনভিজ্ঞ তিন্নী তখন ছোট্ট শিশুর মতো তার দাদাভাইয়ের ফটো আঁকড়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। কিন্তু ঘুম থেকে উঠলে সে আবার দাদাভাই দাদাভাই করে চেঁচিয়ে উঠবে। কি যন্ত্রণা সেই চিৎকারে। কি তীক্ষ্ণ সেই আওয়াজ... যেন বুকের পাঁজড় ভেদ করে হৃদয় গুঁড়িয়ে দেয়।
(২)
        চার বছর আগের ঘটনা। মিত্র বাড়িতে তখন চারিদিকে রোদের ঝিলিকের মতো হাসি ঝলমল্ করে উঠত। দীপা আর মলয় বাবুর ভরপুর সংসার ছিলো। তারা দুজন আর তাদের দুই ছেলে মেয়ে। তিন্নী আর তন্ময় পিঠো-পিঠি দুই ভাইবোন। মাত্র দুবছরের ছোটো-বড়ো তারা‌। তাই বোধহয় তাদের মধ্যে একটু বেশীই মিল ছিলো। এতো মিল যে তাদেরকে এক জায়গায় রাখলে চুলোচুলি বেঁধে যেত।
তিন্নী ছিলো বাবার আদুরে মেয়ে। ছেলে মেয়ের ঝগড়ায় সর্বদা মেয়ের পক্ষ নিয়ে তিনি কথা বলতেন। এই নিয়ে তন্ময়ের অভিযোগের অন্ত ছিলো না। সে তো তার বোনকে বাবার চামচী বলে ডাকত। কারন সে বাবার প্রাইভেট গোয়েন্দা হয়ে তন্ময়ের গোয়ান্দাগিরি করতো। দাদার ছোট-বড়ো সব খবর সে বাবাকে পৌঁছে দিতো।
       সেই বার ভ্যালেনটাইন্স ডের দিন তন্ময় যখন তার বান্ধবী মেঘনাকে লাভ্ লেটার দিয়েছিল। সেই খবরটা তিন্নী এসে তার বাবার কানে তুলে দিয়েছিল। ব্যাস আর কে দেখে, সেদিন রাতে বাড়িতে হুলুস-থুলুস কান্ড বেঁধে গিয়েছিল। মলয় বাবু রনমূর্তি ধারণ করেছিলেন- "বেয়াদপ ছেলে, পড়াশোনা ছেড়ে লাভ্ লেটার দিয়ে বেড়াচ্ছে। আশীকীর ভূত মাথায় চেপেছে। এবার যদি তোর এইচ.এস -এর রেজাল্ট খারাপ হয়। তাহলে দূর করে দেবো বাড়ি থেকে।" ওদিকে তিন্নী তখন ভয়ে গুটিশুটি মেরে দূরে দাঁড়িয়ে আছে, "এবার আর আমার রক্ষা নেই। দাদা হেবী ক্ষেপে গেছে।"
অন্যদিকে বাবা ছেলের বচশায়, ছেলেকে রক্ষা করতে এগিয়ে এলো দীপা- "তুমি ছেলেটাকে এতো বকছো কেন..? এই বয়সেই তো একটু প্রেম ভালোবাসা করবে। তুমি কি করতে মনে নেই... ঝুড়ি ঝুড়ি প্রেমপত্র পাঠাতে আমাকে। তোমার ছেলে তো তোমার মতোই হয়েছে।"
মলয় বাবু আগুনের মতো রেগে উঠলেন- "দীপা তুমি ছেলে-মেয়ের সামনে এইসব কথা বলছ। ছেলেকে আরও মাথায় ওঠাও। পড়ে কিছু হলে তুমি বুঝবে।" ব্যাস স্বামী স্ত্রী দুজনের মধ্যে ছেলে মেয়েকে নিয়ে দ্বন্দ্ব বেঁধে গেলো। তিন্নী সুযোগ বুঝে, আস্তে আস্তে ওখানে থেকে সরে পড়ল।
সেদিন তো দুই ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে গেলো। তন্ময় তিন্নীর পিছন পিছন ছুটল, তাকে মারার জন্যে।
"দাঁড়া শয়তান। কোথায় পালাচ্ছিস..? আজ তোর একদিন কি আমার একদিন... বাবার কাছে আমার নামে চুকলি করা বের করে দেবো।"
তিন্নী সুযোগ বুঝে ঘরে ঢুকে, তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দিলো।ফলে এ যাত্রায় সে বেঁচে গেলো। তন্ময় রেগে-মেগে বলে উঠল "আজ থেকে তুই আমার বোন না। একদম আমার সামনে আসবি না।"
পরের দিন থেকে দুই ভাইবোনের মধ্যে মুখ দেখা-দেখি‌ বন্ধ। দাদা বোন একই বাড়িতে অপরিচিতের মতো ছিলো।কেউ কারুর সাথে কথা বলত না। সেই বারের ঝগড়াটা একটু বেশী দিন স্থায়ী হয়েছিল।
(৩)
          কিছুদিন বাদের ঘটনা। তিন্নী কদিন ধরে কেমন মন মরা হয়ে থাকে। চুপচাপ, শান্ত, কারুর সাথে বেশী কথা বলে না। স্কুলে যেতে চায় না। পড়তে যাওয়ার সময়ও নানা নতুন নতুন বাহানা করে। কিন্তু বাবা মার চাপে পরে অনিচ্ছা সত্বেও তাকে স্কুল, টিউশন্ সব জায়গায় যেতে হচ্ছিল। সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা তাই তিন্নীকে নিয়ে সবার খুব টেনশন। কিন্তু তন্ময় লক্ষ্য করেছিল, তার বোনের মুখে বিষন্নতার ছায়াগুলো। একদিন সে তার মাকে জিজ্ঞেস করলো- "মা তিন্নীর কি কিছু হয়েছে? সারাদিন চুপচাপ থাকে ...
দীপা রান্না করতে করতে উত্তর দিলো- "কি আবার হবে... হয়তো পরীক্ষার টেনশন করছে।"
     পরের দিন তিন্নী স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে, সোজা নিজের ঘরে গিয়ে ধুম্ কলে দরজা বন্ধ করে দিলো। বাইরে থেকে তন্ময়ের কানে এলো বোনের কান্নার আওয়াজ। তন্ময় মনে ভাবল - "নিশ্চিত কিছু সিরিয়াস হয়েছে। আমাকে জানতে হবে ব্যাপারটা।"
সমস্ত ঝগড়া তাকে তুলে তন্ময় রাত্রিবেলা নিজে যেঁচেই বোনকে কাছে ডাকল। তারপর সে জিজ্ঞেস করল- "কি হয়েছে তোর ? কোনো সমস্যা হয়েছে ? আমাকে বল, আমি তোকে সাহায্য করব।"
"না দাদাভাই। কিছু হয়নি তো আমার। তুই ভুল ভাবছিস।"
"আমি কিছু ভুল ভাবছি না। আমি অনেক দিন ধরে লক্ষ্য করছি। তুই স্কুল যেতে চাস না, টিউশন যেতে চাস না। সবসময় কি যেন ভাবিস। সত্যি করে বল কি হয়েছে??"
তিন্নী বার বার প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু তন্ময়ের জেদের কাছে অবশেষে সে হার মানল। কাঁদো কাঁদো মুখে সে দাদাভাইকে মনের সব কথা উজাড় করে বলে দিলো।
"দাদাভাই দুটো বাজে ছেলে আমায় খুব জ্বালাতন করে। আমি যেখানেই যাই আমার পিছু করে। আমায় খুব নোংরা নোংরা কথা বলে। আমায় ভয় দেখায়। দাদাভাই ওরা খুব বাজে। আর কাল ওরা আমাকে.... "
কান্নায় তিন্নীর কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছিল।
তন্ময় গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল "কাল ওরা কি করেছে ??" 
"কাল যখন স্কুল থেকে ফিরছিলাম, ওরা হঠাৎ আমার সামনে চলে আসে। তারপর ওরা আমাকে জোর করে, ওদের সাথে নিয়ে যাচ্ছিল। আমি চেঁচামেচি করাতে, দুটো লোক চলে আসে ওখানে।ওনারা আমার সাহায্য করেন। আর ছেলেগুলো ভয়ে পালিয়ে যায়। দাদাভাই আমার ভয় লাগছে। ওরা যদি আবার ওমন করে।"
তিন্নীর কথাগুলো শুনে,ঐ ছেলেগুলোর ওপর খুব রাগ হচ্ছিল তন্ময়ের "আমার বোনের গায়ে হাত দিয়েছে ওরা। এতো সাহস ওদের। তুই ভয় পাশ না একদম। আমি কাল তোর সাথে স্কুলে যাব।ঐ ছেলেগুলোকে ভালো করে সায়েস্তা করে দেবো।"
"কিন্তু দাদাভাই ঐ ছেলেগুলো খুব বাজে।আমার ভয় করছে।"
"ভয় কিসের, আমি তো আছি তোর সাথে। আমি থাকতে, কোনো ভয় নেই তোর।"
        তিন্নীর মনে তখন একটা অনুসুচনা বোধ জাগ্ৰত হলো। সে বলে উঠল- "সরি দাদাভাই আমি অনেক জ্বালাত্বন করেছি তোকে। আর কোনোদিন এমন করব না। আমি মেঘনা দির সাথে তোর কথা বলিয়ে দেবো। সব ঠিক করে দেবো আমি।"
 তন্ময় হেসে বললো- "খুব পেকে গেছিস।
তুই কি ভাবলি ..তুই মেঘনার সাথে আমার কথা বলিয়ে দিবি বলে, আমি তোর হেল্প করছি...
তা নয় রে। তুই যতই শয়তান হোস, যতই আমার নামে চুকলি করিস। কিন্তু তুই আমার বোন। তোর প্রতি আমার একটা দায়িত্ব আছে। আমি তোকে সবসময় রক্ষা করব।" বোনের মাথায় হাত রেখে ভরসা দিলো সে।
কথাটা শোনার পর, কিছুক্ষণ তিন্নী একদৃষ্টিতে তার দাদাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। আজ যেন তার দাদাকে অন্যরকম লাগছিল। ঠিক যেন বাবার মতোন। বাবা মাথায় হাত রাখলে, যেমন নিশ্চিত লাগে, ঠিক তেমনি অনুভূতি হচ্ছিল তার মনে।
সেদিন ভাইবোনে ঝগড়া না করে একসাথে খাওয়া -দাওয়া করেছিল।এক সাথে হাসাহাসি করে টিভি দেখেছিল। মা বাবা তো ছেলেমেয়ের এই হঠাৎ মিত্রতা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল।
 (৪)
       পরের দিন স্কুল যাওয়ার সময় তন্ময় একটু দূর থেকে তিন্নীর পিছু পিছু আসছিল। "কৈ ঐ ছেলেদুটোর তো দেখা নেই।" তিন্নী ভয়ে ভয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলছিল। কিন্তু ছেলেগুলো কোথাও ছিলো না। স্কুল শেষ হওয়ার পর তিন্নী বাড়ি ফিরে এলো। তন্ময়ও বোনের পিছু পিছু ফিরল। তবে এবারও ফেরার পথে ছেলেগুলোর দেখা নেই। বাড়ি ফিরে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো তিন্নী। "দাদাভাই ঐ ছেলেগুলো মনেহয় ভয় পেয়ে গেছে। সেদিন ঐ লোকগুলো ওদেরকে পুলিশে দেবে বলেছিল। তাই হয়তো ভয়ে ওরা পিছু করা বন্ধ করে দিয়েছে।" নিশ্চিন্ত হয়ে গেলো তিন্নী। কিন্তু তন্ময় নিশ্চিন্ত হতে পারল না। বোনকে নিয়ে তার চিন্তা থেকেই গেলো। সন্ধ্যাবেলা তিন্নীর টিউশন পড়া ছিলো। তন্ময় বাড়ি ছিলো না তাই সে একা একাই চলে গেলো পড়তে। বাড়ি ফিরে তন্ময় বোনের খোঁজ করাতে মায়ের কাছে জানতে পারলো, তিন্নী  পড়তে গেছে। মায়ের ওপর রেগে গেলো তন্ময়-" তুমি কেন তিন্নীকে একা একা যেতে দিলে..? আমাকে তো একটা ফোন করতে পারতে..."
এ সব ঘটনা থেকে অনভিজ্ঞ দীপা ছেলের রাগের কোনো কারন খুঁজে পেলো না। তন্ময় হন্ত দন্ত হয়ে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
         টিউশন যাওয়ার পথটা ছিলো নির্জন আর অন্ধকার। কিন্তু সেদিন পূর্ণিমার পূর্ণাঙ্গ চাঁদের আলোয় রাস্তাটা আলোকিত হয়ে ছিলো। তবুও তিন্নীর কেমন একটা ভয় ভয় লাগছিল। সে মন শক্ত করে হেঁটে চলছিল। হঠাৎ করে তার নজরে পড়ল দূর থেকে দুজন লোকের ছায়া তিন্নীর দিকে এগিয়ে আসছে।চাঁদের রূপালী আলোয় সেই ভয়ংকর মুখ দুটোয় শয়তানের হাসি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিল তিন্নী। তার শরীর আর পা দুটো ভয়ে কেমন আড়ষ্ঠ হয়ে আসছিল। তিন্নীর কিছু করার আগেই ছেলেদুটো তীরের বেগে এসে তার হাত দুটো চেপে ধরলো। তারপর তাদের নোংরা হাত দিয়ে টানতে টানতে তিন্নীকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল তারা।
 ডানা কাটা পাখির মতো ছটফট্ করছিল তিন্নী। প্রাণমন শক্তিতে সে চিৎকার করে উঠছিল "বাঁচাও,,বাঁচাও.. আমকে কেউ বাঁচাও প্লিজ"
কিন্তু তিন্নীর আওয়াজ শোনার মতো ওখানে কেউ ছিলো না। তিন্নীর বুকফাটা আর্তনাদ তাদের জমকালো হাসির মাঝে ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল।হিংস্র পশুর মতো তিন্নীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা তিন্নীকে নিরবস্ত্র করে চলেছিল। তখন তিন্নীর চোখে ভেসে উঠছিল তার দাদাভাইয়ের মুখটা। দাদাভাই ডাকটা গোঙানী হয়ে তার গলায় জড়িয়ে আসছিল।

       এমন সময় হঠাৎ কে যেন এসে ছেলেদুটোকে এক ধাক্কায় দূরে ঢেলে দিলো। তারপর দেবদূতের ন্যায় তিন্নীর দিকে দুটো হাত এগিয়ে দিলো। তিন্নী ডেকে উঠল- "দাদাভাই..."
হ্যাঁ তন্ময় এসেছিল সেদিন তার বোনকে রক্ষা করতে। তিন্নী তার দাদাভাইকে জড়িয়ে কেঁদে উঠেছিল।তন্ময় দুহাত দিয়ে বোনের চোখের জল মোছাতে মোছাতে তার এলোমেলো বস্ত্রগুলো ঠিক করে দিচ্ছিল।
"আমি এসে গেছি বোন। তোকে কেউ কিছু করতে পারবে না। আমি তোকে রক্ষা করব বোন। তুই ভয় পাশ না।"
হঠাৎ পেছন থেকে ছেলেদুটো এসে এক ধাক্কায় তন্ময়কে মাটিতে ফেলে দিলো। তারপর ছেলেদুটোর সাথে তন্ময়ের সংঘাত শুধু হলো। সেই সময় এক অদ্ভুত শক্তি এসে গিয়েছিল ১৮বছরের তন্ময়ের শরীরে। একাই সে ছেলেদুটোকে কাবু করে দিয়েছিল। ছেলেদুটোও পাল্টা জবাব দিচ্ছিল। তন্ময়ের মুখ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল, তবুও সে সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করে চলছিল। তিন্নী ভয়ার্ত কন্ঠে বারবার দাদাভাই দাদাভাই করে ডেকে চলেছিল। তারপর তন্ময়ের ঘুসিতে ছেলেদুটো মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। এক মুহূর্তের জন্যে মনে হলো যেন সে যুদ্ধে জিতে গেছে। কিন্তু হঠাৎ তাদের মধ্যে একজন ধারালো ছুরি নিয়ে তন্ময়ের দিকে এগিয়ে এলো। চাঁদের রূপোলী আলোয় ছুরিটা চকচক্ করে উঠেছিল। নিমেষের মধ্যে সে দৌড়ে এসে সজোরে ছুরিটা তন্ময়ের বুকে বসিয়ে দিলো। তিন্নী আর্তনাদ করে উঠল- "দাদাভাই...."
ছুরির এক আঘাতে তন্ময় ধূলো মাখা পথে লুটিয়ে পড়ল। ছেলেদুটো অবস্থা বুঝে, সেখান থেকে পালিয়ে গেলো।
তিন্নী ছুটে তার দাদাভাইয়ের কাছে গেলো। লাল রক্তে ভেসে যাচ্ছিল তন্ময়ের শরীর। দাদাভাইকে বুকে টেনে নিলো তিন্নী। পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল সে সাহায্যের জন্যে। কিন্তু কেউ এলো না। তিন্নীর কোলে মাথা রেখে যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগলো তন্ময়। তিন্নী তার ওড়না দিয়ে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করল। কিন্তু কিছু লাভ হলো না। আস্তে আস্তে তন্ময়ের ছটফটানি কমে আসছিল আর সে নিস্তেজ নিষ্প্রাণ হয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে বোনের কোলে মাথা রেখে সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিল। তন্ময় সেদিন তার বোনকে রক্ষা করতে পারলেও, নিজেকে রক্ষা করতে পারিনি। হাসপাতালের ডাক্তার বলেছিল, প্রচন্ড রক্তপাত হওয়ার কারনে সে মারা গেছে।
মলয় আর দীপা নিজের হাতে ছেলের শেষ কাজ সম্পন্ন করেছিল। যে সন্তানকে জন্ম দিয়েছেন, আদর করে বড়ো তুলেছেন... নিজের হাতে তার মুখাগ্নি করা...এর থেকে বড়ো কষ্ট কোনো মা বাবার পক্ষে হতে পারে না।
       আর সেদিন থেকে তিন্নী মানসিক ভাবে অসুস্থ। কতো ডাক্তার দেখানো হয়েছে তাকে। কিন্তু প্রায় ৪বছর ধরে তিন্নী এমনই আছে। তার মানসিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। আপন মনে সে তার নিজের জগতে তার দাদাভাইকে নিয়ে থাকে। পাড়ার লোকে এখন তাকে মিত্র বাড়ির পাগল মেয়ে নামেই জানে।
আর ঐ ছেলেদুটোর কি হয়েছে জানেন.........ছেলেদুটোর নামে দীপা আর মলয়বাবুর এখনও কেশ লড়ে চলেছেন, তবে তাদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে এখনও পারেননি। তিন্নীর মানসিক অসুস্থতাকে ব্যবহার করে তারা আজ জামিনে জেল থেকে মুক্ত হয়ে গেছে। কারন তিন্নী ছাড়া এই ঘটনার আর কোনো সাক্ষী নেই। এতো জঘন্য অপরাধ করেও তারা আইনের ফাঁক থেকে বেরিয়ে আজ স্বাভাবিক জীবন কাটাচ্ছে। হয়তো তিন্নীর মতোই অন্য কোনো মেয়ে তাদের নোংরা প্রবৃত্তির শিকার হবে। আর আবার হয়তো এভাবেই তারা আইনের হাত থেকে রেহাই পেয়ে যাবে। আর শাস্তি পাবে কতগুলো নির্দোষ মানুষ।
       সেদিন ঐ ছেলেদুটোর নোংরা লালশা, একটা গোটা পরিবারকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। এই ঘটনাটা না ঘটলে তন্ময় আজ বেঁচে থাকত, পড়াশোনা করে কলেজে উঠত।আর তিন্নীরও অন্যরকম ভবিষ্যৎ হতো। তাকে এইভাবে পাগলের আখ্যা পেতে হতো না। কিন্তু এসব কিছুই আর সম্ভব হলো না। সমাজের কতগুলো নোংরা কীট তাদের ভবিষ্যৎ কেড়ে নিয়ে, তাদের গহীন অন্ধকারে ডুবিয়ে দিলো।.....
সমাপ্ত





                                                       লাভ্ ইস্ কমপ্লিকেটেড্
                                                            কুহেলী কর্মকার
                       
(১)
      পন্ত বিকেল, সূর্য বিদায় নেওয়ার ক্ষনে। আকাশের সাদামাঠা মেঘগুলো সূর্যাস্তের আভায়, লালচে রঙ নিয়েছে। যেন নীলচে ক্যানভাস জুড়ে কেউ সিঁদুরে রঙ ছিটিয়ে দিয়েছে।
         নিরালায় বসে, আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা সিগারেটে ধরালো আবীর।তার বুকে পরম সোহাগে মাথা রেখে শুয়ে আছে তাদের জি.এস তন্ময় ঘোষালের গার্লফ্রেন্ড মৈত্রী। আবীর তার এলোমেলো চুলে আঙুল মিশিয়ে খেলা করছিল।আর তার ঠোঁটে গোঁজা জ্বলন্ত সিগারেটের ধোঁয়া দক্ষিনা বাতাশের সাথে মিশে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল বারংবার।
হঠাৎ মৈত্রী আবীরের গা ঘেঁশে এগিয়ে এলো, আর নিকোটিনের গন্ধ মাখা তার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট মিশিয়ে দিলো। ঊষ্ণ নিশ্বাসে অগোছালো হয়ে উঠল দুজনে। আবীরের পুরুষালী হাতদুটো মৈত্রীর নরম চুল আঁকড়ে ধরল আর তার ভেজা ঠোঁট চুম্বনে চুম্বন ভরিয়ে তুললো।
     কতক্ষণ যে তারা এইভাবে ছিলো, তারা নিজেরাই জানেনা। হঠাৎ একটা শব্দে তাদের ঘোর কাটল। থতমত্ খেয়ে আবীর আর মৈত্রী পেছন ফিরে তাকালো। পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলো কুহু। একটু অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে গেলো দুজনে। মৈত্রী নিজের অগোছালো বস্ত্রগুলো তাড়াতাড়ি ঠিকঠাক করতে করতে কুহুর পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।  
      আবীর, মৈত্রীকে এইভাবে দেখে কুহুর হাত থেকে জলের বোতলটা পিছলে গিয়েছিল। সেও আবীরের মতোই থতমত্ খেয়ে গিয়েছিল। আবীর নিজেকে সামলে নিয়ে, কুহুকে ঝাঁজিয়ে বলে উঠল- "কি হলো, তুই এখানে কেনো..?"
 কুহু আমতা আমতা করতে করতে উত্তর দিলো- "মেঘনা দি তোমায় ডাকতে বললো মিউজিক প্র্যাকটিসের জন্য।তাই..."
"ডাকছিল তো, তোর এখানে আসার দরকার কি ছিলো... একটা কল্ করতে পারতিস তো।"
"সরি্।আমি বুঝতে পারিনি তোমারা এখানে..."
"থাক ঠিক আছে। তুই যা আমি আসছি।"
কুহু পেছনে ফিরে দাঁড়ালো। তার চশমা পড়া চোখদুটোয় অশ্রুকণা চিকচিক্ করে উঠল। আবীর লাইটার বার করে আবার আরেকটা সিগারেট ধরালো।তার মধ্যে একটা অচেনা অপরাধবোধ কাজ করছিল।
আবীর মনে মনে বলে উঠল-  "কুহুর তুই কেনো এলি... তোর সামনে আমি এইভাবে আসতে চাইনি।" তারপর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সে মিউজিক প্র্যাকটিসে চলে গেলো।
(২)
           আবীর সান্যাল কলেজের দ্যি মোস্ট পপুলার গাই্। লম্বা, জিম করা বডি, টিকালো নাক, হাল্কা খোঁচা খোঁচা দাড়ি, গায়ের রঙটা শ্যামলা, কিন্তু দারুণ মানায় তাকে।কলেজের মেয়েরা তো রীতিমতো পাগল তার জন্যে। যেই তার সংস্পর্শে আসে সেই তাকে ভালোবেসে ফেলে। এটাই আবীরের বিশেষত্ব। সেও নিজেকে কলির কেষ্টর থেকে কিছু কম মনে করে না,যার চারপাশে সুন্দরী গোপীনিরা প্রজাপতির ন্যায় উড়ে বেড়ায়। আর আবীর এই ব্যাপারটা বেশ এনজয়্ করে। আর এই কারনেই কলেজের অন্যান্য ছেলেদের কাছে সে চক্ষুশূল। তবে আবীরের এতে কোনো যায় আসে না।
        আবীর আর তার দশ-বারোজন বন্ধুদের নিয়ে ইউনিভার্সিটিতে একটা গ্যাঙ্গ্ আছে, দ্যি কুল গ্যাঙ্গ। আর তাদের একটি মিউজিক ব্যান্ড আছে, নাম হলো "ফেরারি মন।" আবীর এই ব্যান্ডের লিড সিঙ্গার। আশ্চর্য রকম ভাবে,এই ব্যান্ড গড়ে ওঠার দু-এক বছরের মধ্যেই তা বেশ নামডাক অর্জন করেছে। ইউনিভার্সিটির যে কোনো প্রোগ্রামে তো তাদের সো্ মাস্ট, তাছাড়া ইউনিভার্সিটির বাইরেও বিভিন্ন প্রাইভেট ইভেন্টে তারা পারফর্ম করেছে। আবীরের আর তার বন্ধুরা মিলে স্বপ্ন দেখেছে যে এই ব্যান্ডটাকে তারা আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। মিউসিক অ্যালবম্ বানাবে। আর তার জন্যে তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করে। বিভিন্ন ফাঙশানে তাদের সো্ করতে ডাকা হয়।
 তবে এই ব্যান্ডে অনেক ট্যালেনটেড্ মিউজিশিয়ান থাকলেও একজন ভালো ফিমেল্ সিঙ্গারের অভাব ছিলো।আবীরের বেস্টফ্রেন্ড মেঘনা অবশ্য তার সাথে গাইত। কিন্তু মেঘনার পুরুষালি কন্ঠস্বর সব গানের সাথে মানাতো না। আবীর নিজে গান লিখতো, নিজেই সুর দিতো। কিন্তু তার গলার সাথে গলা মিলিয়ে গাওয়ার মতো একটা মিষ্টি কন্ঠস্বরের অভাব বোধ করতো সে। ব্যান্ডের পপুলারিটি বৃদ্ধির সাথে সাথে এই সমস্যাটা জটিল আকার ধারন করেছিল। এদিকে নতুন নতুন সো্-র বুকিং আসছে। অন্যদিকে তারা কোথা থেকে পাবে মিষ্টি ফিমেল ভয়েস....। অবশেষে আবীর একটা অডিশন নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। ইউনিভার্সিটির প্রায় সকল মেয়েরা দলে দলে অডিশন দিয়ে গেলো। কিন্তু আবীরের কারুর আওয়াজই ঠিক পছন্দ হলো না। এই আইডিয়াটাও ফ্লপ হয়ে গেলো। এখন ভগবানই ভরসা তাদের।
       অবশেষে তাদের মুশকিল আসান হয়ে এলো ফাস্ট ইয়ারের এক নিউ স্টুডেন্ট কুহু রায়। সেদিন কলেজে ফ্রেশার্স পার্টি ছিলো। আর প্রথাগত নিয়ম মেনে কলেজের সিনিয়র স্টুটেন্ডরা, জুনিয়রদের নিয়ে ঠাট্টা তামাশায় মেতে উঠেছিল। আবীরের আর তার গ্যাঙ্গ ছিলো তাদের প্রধান উদ্যোগতা। সমস্ত নিউকামারদের কিছু কিছু টাস্ক দেওয়া হচ্ছিল। কাউকে গান করতে, কাউকে ডান্স করতে আবার কাউকে অ্যাকটিং করে দেখাতে বলা হচ্ছিল। কতো হাসাহাসি, হইহুল্লোড় চলছিল। এসবের মাঝে কুহু আড়ষ্ঠ ভাবে এককোনে দাঁড়িয়ে ছিলো। একে একে সবার পালা চলে গেলো, অবশেষে এলো কুহুর পালা।
কুহু ভয়ে ভয়ে সিনিয়রদের সামনে এসে দাঁড়ালো। সর্ট হাইট, দুধের ন্যায় ফর্সা গায়ের রঙ, দুগালে ডিম্পল, আর নাকের ওপর কালো চশমা। কুহুকে একটি ছোটোখাটো চাইনিস ডলের মতো লাগছিল, কিউনেসে ভরপুর। আবীর দূর থেকে দাঁড়িয়ে কুহুকে পর্যবেক্ষণ করছিল। আর কুহু ভয়ে জড়োসরো হয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে ছিলো।
"আমি একে টাস্ক দেবো।" আবীর বলে উঠল।
"তোমার নাম কি?? কোন ডিপার্টমেন্ট?? "
কুহু ইতস্তত করতে করতে ধীরু গলায় জবাব দিলো- "কুহু রায়। বাংলা ডিপার্টমেন্ট।"
পাশের বন্ধুরা হেসে বললো- "এর তো গলার আওয়াজ বেরোয় না দেখছি। একে কি করতে দিবি আবীর ? "
আবীর বলে উঠল- "এর গলার আওয়াজ বের করবো।... তুমি একটা রবীন্দ্রসংগীত গাও।"
       কুহু মাথা নীচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। "চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলে হবে না। সবথেকে সিম্পল টাস্ক দিয়েছি তোমাকে। কমঅন্ ডু ইট।"
চারপাশে সবাই কুহুকে নিয়ে হাসাহাসি করছিল। ফলে কুহু আরও ঘারড়ে যাচ্ছিল।
 আবীর সবাইকে ধমক্ দিয়ে উঠল - "গাইস্ কি হচ্ছে টা কি... স্টপ লাফিং। কুহু তুমি গান ধরো।"
কুহু চোখ বন্ধ করে গান ধরলো- "আমারও পরাণ যাহা চায়, তুমি তাই... তুমি তাই গো...আমারও পরাণ যাহা চায়।"
আবীর মন্ত্রমুগ্ধের মতো কুহুর দিকে তাকিয়ে রইল। কি মিষ্টি তার আওয়াজ, মনে ছুঁয়ে গেলো তার। আবীর তখনই মনে মনে ঠিক করে নিলো কুহুই হবে তার ব্যান্ডের লিড্ ফিমেল সিঙ্গার। এইভাবেই হয়েছিল আবীর আর কুহুর প্রথম আলাপ।
(৩)     
            সেদিন থেকে আবীর তার ভাবনা মতো কাজে লেগে পড়লো। কিন্তু কুহুকে রাজি করানো অতো সহজ ব্যাপার ছিলো না। স্বভাবে সাই্ অ্যান্ড্ রিসার্ভ মাইন্ডের কুহুকে রাজি করানোর জন্যে আবীরকে অনেক সাধ্য-সাধনা করতে হয়েছিল। এতো পরিশ্রম তো কোনো মেয়ে পটানোতেও হয়নি তার। আবীর আর তার বন্ধুরা মিলে হাজার বার বোঝানোর পর কুহু রাজি হয়েছিল। কিন্তু একটা সর্তে, এর ফলে তার লেখাপড়ার ক্ষতি যেনো না হয়। তবুও সমস্যা ছিলো, একে তো কুহুর কোনো প্রপার ট্রেনিং ছিলো না আর অন্যদিকে তার স্টেজ ফিয়ার। সবকিছুতেই তার একটা আড়ষ্ঠ ভাব। যেটা কিছুতেই কাটানো যাচ্ছিল না।
           অবশেষে আবীর কুহুর প্রপার ট্রেনিং আর এই স্টেজ ফিয়ার দূর করার দায়িত্ব নিলো। ঘন্টার পর ঘন্টা ট্রেনিং, হোম ওয়ার্ক, তার সুর ধরিয়ে দেওয়া, গানের কথা মুখস্ত করানো। আবীর কুহুকে নিয়েই সারাদিন ব্যস্ত থাকতো। যেনো কোনো ছোট্ট শিশুকে সে অ-আ সেখানোর দায়িত্ব নিয়েছে। তারওপর কুহু একটু বেশি ইমোশানাল্ ছিলো, একটু ধমক্ দিলেই কেঁদে ফেলত। তাকে সফ্টলি্ হ্যান্ডেল করতে হতো। তবে কাঁদলে কুহুকে খুব কিউট্ লাগতো। তাই আবীর মাঝে মাঝে বদমাইশি করতো, ইচ্ছা করে কুহুকে কাঁদাতো। আর তার কান্না ভেজা চোখের দিখে তৃষ্ণার্থের মতো তাকিয়ে থাকত।
প্রায় পাঁচ মাস ট্রেনিং দেওয়ার পর,অবশেষে ফল প্রকাশের দিন এলো। সেদিন কলকাতার একটি বড়ো কালচারাল্ ইভেন্টে তাদের ব্যান্ডকে ডাকা হয়েছিল। সেইদিন প্রথম স্টেজে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার লোকের সামনে আবীরের সাথে গলা মিলিয়ে ছিলো কুহু। আর সেই প্রোগ্ৰামটা হয়েছিল সুপার হিট। আবীরের পরিশ্রম সফল হয়েছিল, তার মনে খুব উৎফুল্ল হচ্ছিল। যেমন কোনো টিচারের খুশি হয়, যখন তার স্টুডেন্ট পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়। ঠিক তেমনই খুশি হচ্ছিল আবীরের। কুহুও খুব খুশি ছিলো, এমন খুশি সে আগে কখনও অনুভব করেনি। আবীরের হাত ধরে স্টেজে দাঁড়িয়ে নিজেকে নতুন করে খুঁজে পেয়েছিল সে। তার ফর্সা দুগালে ডিম্পল গুলো আরও গভীর হয়ে উঠেছিল। আবীর সেদিন কুহুর নরম গাল দুলো টিপে বলেছিল- "আমার মোমের পুতুল। আই জাস্ট্ লাভ্ ইউ।" আর লজ্জায় লালচে হয়ে উঠেছিল কুহুর গাল দুটো।

       সেইদিনের প্রোগ্রামের পর "দ্যি ফেরারি মন" ব্যান্ডের খ্যাতি আরও বেড়ে গিয়েছিল। কতো নতুন নতুন শো্ করার অফার আসছিল তাদের কাছে।আর আবীর, কুহু আর তার বন্ধুরা মিলিয়ে কতো স্টেজ মাতিয়ে তুলেছিল।
আর তার সাথে কুহু আর আবীরের মধ্যে প্রেমটাও জমে উঠেছিল।
           দুজনে ঘন্টার পর ঘন্টা মিউজিক প্র্যাকটিস্ করতো, সময়ের কোনো হুশ থাকতো না তাদের।আবীর নিজ মুখে স্বীকার না করলেও, সে বেশিরভাগ গান বেঁধেছিল কুহুর কথা ভেবেই। কুহুই তার সুর ছিলো, কুহুই ছিলো তার গানের কলি। তবুও আবীরের কাছে এই সম্পর্কটা ছিলো, জাস্ট্ এ ক্যাসুয়াল রিলেশনশিপ। আবীর এই নিয়ে একদম সিরিয়াস ছিলো না।
   কিন্তু কুহু আবীরকে প্রাণ ঢেলে ভালোবাসতো। সে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিল আবীরের কাছে। আবীরের সাথে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতো সে। নতুন নতুন রান্না করে আবীরের জন্যে নিয়ে আসতো কুহু। যেনো নিজেকে মনে মনে আবীরের স্ত্রী ভাবতে শুরু করেছিল সে।
তবে মেঘনা একদিন কুহুকে আবীরের ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়েছিল- "দেখ কুহু, আবীর কিন্তু তোকে নিয়ে সিরিয়াস নয়। শুধু তুই নয়, ও কাউকে নিয়েই সিরিয়াস নয়। তুই বেশি স্বপ্ন দেখিস না,পরে আফসোস করতে হবে।"
        তবে কুহু সেদিন মেঘনার কথায় আমল দেয়নি। কুহু আবীরের ব্যাপারে সব জানতো,তবু ওর মনে বিশ্বাস ছিলো, যে আবীর ওকে সত্যিই ভালোবাসে। তবে কুহু জানতো না, অলিক স্বপ্নের পেছনে ছুটে চলেছে সে।
(৪)    
            কুহুর চোখে গভীর ভালোবাসা দেখে ভয় লাগতো আবীরের। কেমন যেন নিজেকে অপারধী মনে হতো তার। কারন কুহুর থেকে রিলেশনে থাকাকালীন ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের মেখলার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল সে। কুহুর মতো ভালো মেয়েকে মিথ্যে প্রতিশ্রুতির দিয়ে ঠকাতে চায়নি সে।
        আর এই কারণে সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিল আবীর।কিন্তু কুহুকে এই কথাটা কিছুতেই বলতে পারছিল না সে।
"কুহু ওভার ইমোশানাল, এই কারনে যদি ও কিছু করে বসে, তাহলে কি হবে.? আর যদি ও ব্যান্ডটা ছেড়ে দেয়, তাহলে তো মহাবিপদ!! "
এই চিন্তাগুলোই তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। যেনো দোটানায় এক পড়ে গিয়েছিল সে। তারওপর কুহুর মন ভাঙতে তার কষ্ট হচ্ছিল, তাই সে অভিনয় করে চলেছিল। তবে কুহু বোধহয় এই অভিনয়ের আঁচ পেয়ে গিয়েছিল। তাই সে আবীরের চোখে-চোখ রেখে প্রশ্ন করেছিল- "আবীর..তুমি কি এই সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে আসতে চাও।"
"কুহু তুই কি বলছিস..?"
"প্লিজ আজ অভিনয় করো না। আমি সব জানতে পেরেছি। তোমার আর মেখলার ব্যাপারেও।"
"দেখ তুই তো জানিস আমি এমনই। আই অ্যাম্ রিয়ালি সরি্ বাট্, তুই তো সব জেনে শুনেই...।"
"হ্যাঁ সব জেনে শুনেই আমি তোমায় ভালোবেসেছিলাম। ভেবেছিলাম আমার ভালোবাসা জিতে যাবে, কিন্তু তা হয়নি। তোমাকে আটকে রাখার অধিকার আর নেই আমার। তাই, লেট্স জাস্ট্ ফিনিস্ ইট।
আর ভয় পেও না।আমি তোমার ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে, ব্যান্ড ছেড়ে চলে যাবো না। আমি যেই দায়িত্বটা নিয়েছি, সেটা পালন করবো। এর জন্যে আমার সাথে অভিনয় করতে হবে না তোমার।"
          কুহুর কথা গুলো শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিল আবীর। সেই ওভার ইমোশানাল মেয়েটা, যে কথায় কথায় কেঁদে ফেলত।সে হঠাৎ এতো মেচিওয়র্ডলি বিহেভ্ করলো, না কোনো কান্না, না কোনো ইমোশানাল ব্ল্যাকমেল। আবীরের মনে হলো, যেনো শুধুই শুধুই ভয় পাচ্ছিল সে। তার মনের অপরাধ বোধের ভারটা একটু কম হলো।   "কুহু তুই খুব মেচিওয়র্ড হয়ে গেছিস। আই অ্যাম রিয়্যালি হেপী, যে তুই এই ব্যাপারটা পজিটিভ ওয়ে তে নিয়েছিস। অ্যান্ড ইউ ডিসার্ভ এ ব্যাটার পারশন্ দ্যান্ মি। যে শুধুমাত্র তোকেই ভালোবাসবে।"
কুহুকে স্তোকবাক্য শুনিয়ে যাচ্ছিল আবীর। আর কুহুও নীরবে তা শুনে চলেছিল।
আবীরের সেদিন ভেবেছিল কুহু পাল্টে গেছে, মেচিওয়র্ড হয়ে গেছে। কিন্তু আবীরের ধারনাটা একদম ভুল ছিলো।
কুহু সেই আগের মতো ইমোশানাল ফুল্-ই আছে। শুধু তার ভেতরে একটা জিনিস বদলে গিয়েছিল। সে আর্টিফিশিয়াল হাসির আড়ালে তার ইমোশান গুলো, তার বুক ফাঁটা কান্না গুলো লুকিয়ে রাখতে শিখে গিয়েছিললা
()
       ইউনিভার্সিটিতে সবাই জানত কুহু আর আবীরের অফিসিয়ালি ব্রেকআপ হয়ে গেছে। কিন্তু কিছু আন্অফিসিয়াল জিনিস বোধহয় আজও তাদের সম্পর্কে রয়ে গেছে। যেটা শেষ হয়েও তার রেশ রেখে গিয়েছিল।
      কুহুর সাথে ব্রেকআপের পর, আবীর কিছুমাস মেখলার সাথে ছিলো। তারপর তার সাথেও ব্রেকআপ হয়ে যায়। অ্যাসইউসুয়াল্ টিপিকাল্ আবীর তার পুরনো কলির কেষ্ট ইমেজে আবার ফিরে আসে।
কিন্তু কুহুর পক্ষে সবকিছু ভুলে যাওয়া অতো সহজ ছিলো না। কুহু আর আবীরের মধ্যে আজকাল কথার্বাতা খুব কম হতো। আর যেটুকু হতো শুধু কোনো কাজ সংক্রান্ত বিষয়ে।
          তবে কথা না বলেও আবীরের খুঁটিনাটি সবকিছুর খেয়াল রাখত কুহু। যেমন প্র্যাকটিসের সময় আবীরকে সেই আগের মতো কফি বানিয়ে দেওয়া, তার মিউজিক নোটশ্ সামলে রাখা, দূরে কোনো ইভেন্টে গেলে আবীরের খাওয়া-দাওয়ার খেয়াল রাখা। আবীর বুঝতে পারতো, কুহু এক তরফা ভাবে এখনও সম্পর্কটা বয়ে চলেছে।
আবীর একদিন এই নিয়ে কুহুকে প্রশ্ন করেছিল- "তুই আমার এতো খেয়াল রাখিস কেনো... তুই কি এখনও আমাকে ভালোবাসিস...?"
         কুহু দৃঢ় কন্ঠে উত্তর দিয়েছিল- "হ্যাঁ ভালোবাসি, এখনও। আর হয়তো আরও অনেকদিন ভালোবাসবো। কিন্তু এটা একান্তই আমার সমস্যা। এটা নিয়ে তোমার ভাবার দরকার নেই।
আর যদি বলো খেয়াল রাখি কেনো.. তাহলে বলবো এটা আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। এতো দিনের অভ্যাস তো হঠাৎ করে চলে যেতে পারে না। তবে তুমি যদি না চাও, আমি করবো না তাহলে এসব..।"
 কুহুর কথাগুলো যেনো তীরের সুঁচালো ফলার মতো তার বুকে গিয়ে বিঁধে ছিলো। একটা অজানা অপরাধবোধ আর যন্ত্রণায় তার মন মুষড়ে উঠেছিল সেদিন। কুহুকে এইভাবে একাকিত্বের অন্ধকারে ডুবে যেতে দেখে খুব কষ্ট হতো আবীরের। তাই সে ঠিক করলো কুহুর জীবনে ভালো একজন মানুষকে আনতে হবে। যে কুহুকে খুব ভালোবাসবে। আবীরের চোখে ইউনিভার্সিটিতে সবচেয়ে ভালো ছেলে ছিলো হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের নীলাদ্রি সেন। নীলাদ্রি পড়াশোনায়, স্বভাব-চরিত্রে আবীরের একদম বীপরিত। তাই আবীর ঠিক করলো নীলাদ্রিই কুহুর জন্যে বেস্ট হবে।

        আবীরের প্রচেষ্টাতেই কুহু আর নীলাদ্রির মধ্যে আলাপ হয়। তারপর আলাপ থেকে বন্ধুত্ব হয়। নীলাদ্রির সাথে কুহু কথা বলতো, গল্প করতো, হাসাহাসি করতো। প্রথম প্রথম আবীরের ভালো লাগতো। কিন্তু যতো দিন কাটতে লাগলো কুহু-নীলাদ্রির বন্ধুত্বটা কাঁটার মতো খোঁচা মারতো লাগলো আবীরের বুকে। না চাইলেও নীলাদ্রির ওপর হিংসে হতো ওর।
          সেদিন ইউনিভার্সিটিতে ২৫শে বৈশাখের অনুষ্ঠান ছিলো।কুহু একটা আঁধারি রঙের ঢাকাই শাড়ি পড়েছিল, কালো মেঘের ন্যায় চুলগুলো খোলা রেখেছিল,আর কপালে পড়েছিল গাঢ় লাল রঙের টিপ। আবীর যেনো চোখ ফেরাতে পারছিল তার থেকে। বড়োই মায়াবীনি লাগছিল তাকে। এই প্রথমবার কুহুকে শাড়িতে দেখেছিল সে। আবীর ভাবতো শুধু সর্ট ড্রেসেই মেয়েদের সুন্দর লাগে। কিন্তু এক লহমায় কুহু তার ভাবনা গুড়িয়ে দিয়েছিল। আবীর কেবলার মতো কুহুর দিকে তাকিয়ে ছিলো। এমন সময় নীলাদ্রি কাছে এসে বললো- "আবীর দা আমি আজ কুহুকে প্রোপোজ করবো। উইশ্ মি লাক্। আবিরের ঠোঁটের স্নিগ্ধ হাসি হঠাৎ ম্লান হয়ে গেলো। নীলাদ্রির কথাটা যেনো বিষের থেকেত বিষাক্ত লাগলো তার কানে।
নীলাদ্রি আর কুহু স্টেজে উঠে, রবীঠাকুরের একটি কবিতা আবৃত্তি করে শোনালো। কিন্তু তার একটা লাইন ও আবীরের কানে পৌঁছালো না। তার মনটা জ্বলে, পুড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তার কারন কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিল না সে।
"আমিই তো চেয়েছিলাম কুহু-নীলাদ্রি এক হয়ে যাক। তবে কেন আমার এতো কষ্ট হচ্ছে.? কেন এতো যন্ত্রণা হচ্ছে.? কি যায়-আসে আমার..?
আর কুহু তো ভালোই আছে নীলাদ্রির সাথে। কেমন হেসে হেসে ওর সাথে কথা বলছে। কই আমার সাথে তো এতো হাসতো না।
নীলাদ্রি মতো ইডিয়ট্ ছেলেই ওর যোগ্য। থাকুক ও নীলাদ্রিকে নিয়ে। আমার কিছ্ছু যায় আসে না। কিছ্ছু না। গো্ টু হেল্ ।"
            প্রোগ্রাম থেকে বেরিয়ে এলো আবীর, তারপর বাস স্টপেজে বসে একটা সিগারেটে ধরালো। "এতক্ষণে বোধহয় ঐ ইডিয়ট নীলাদ্রিটা কুহুকে প্রপ্রোস করে ফেলেছে। আর কুহু.. ও কি হ্যাঁ বলে দিলো..? নাই বা বলবে কেনো... নীলাদ্রি কতো গুড্ বয়, আর আমি তো একটা খারাপ, বাজে ছেলে।"  মনের মধ্যে জাঁকিয়ে বসা যন্ত্রণাটা একফোটা অশ্রু হয়ে বেরিয়ে আসলো। আবীর এই নোনতা জলটা একদম পছন্দ করে না, এতে ইমেজ খারাপ হয়ে যাবে তার। কিন্তু কিছুতেই আজ তা আটকানো গেলো না। সে নোনাজল চোখের কোন থেকে গড়িয়ে, ঠোঁটে র কোলে এসে জমা হলো। হঠাৎ মোবাইল স্ক্রীনে নীলাদ্রির নম্বরটা ফুটে উঠল। "আবার এই মালটা ফোন করছে কোনো... হ্যাঁ বল কি হয়েছে..?"
নীলাদ্রি কাঁদো কাঁদো গলায় বললো- "আবীর দা কুহু আমাকে না বলে দিয়েছে। ও আমাকে শুধু বন্ধুর মতো দেখে। আমাকে ভালোবাসে না।"
           নীলাদ্রি কথা শুনে একটু অবাক হলো আবীর। তারপর সহানুভূতির স্বরে বলে উঠল- "কি আর করা যাবে বল। সবই কপাল। তুই মন খারাপ করিস না ভাই। আমি তোর পাশে আছি।"
()
           নীলাদ্রি ফোনটা রাখা মাত্রই দু-হাত পা তুলে একটু নেচে নিলো আবীর। যেনো কোনো দৌড়ে ও সবার শেষে থেকেও জিতে গেছে।  "ইয়েস্.. ইয়েস্। কুহু ঐ ইডিয়েটটাকে রিজেক্ট করে দিয়েছে।"
তবে কিছুক্ষণ পর নিজের আচরণে নিজেরই লজ্জা লাগলো আবীরের।
"আমি কেনো এতো নাচছি... আবীর তুই পুরো পাগল হয়ে গেছিস। মাথাটা গেছে তোর।"
ইডিয়ট্, স্টুপেড বলে নিজেকেই গালমন্দ করতে লাগলো সে। তারপর ভাবলো- "ফিরে গিয়ে কুহুকে বোঝাই। আমার জন্যে যেনো ও নিজের জীবন নষ্ট না করে। নীলাদ্রি তো সত্যিই ভালো ছেলে, আমার থেকে হাজার গুণে ভালো। আমাকেই কুহুকে বোঝাতে হবে।"
       সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে আবীর আবার প্রোগামে ফিরে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ ওর মাথায় সশব্দে কিছু ভারী জিনিসের আঘাত লাগলো। আর রাস্তায় লুটিয়ে পড়ল আবীর। কিছু বোঝার আগেই অজ্ঞাত পরিচয় কতোগুলো ছেলে ওকে মাটিতে ফেলে হকি স্টিকের প্রহার করতে লাগলো। ততক্ষণ করতে থাকলো, যতক্ষন না আবীর আঘাতে আঘাতে বেহুশ হয়ে গেলো।
         আবীরের যখন সেন্স ফিরলো, তখন ও নিজেকে নাসিংহোমের বেডে দেখলো। ওর সামনে কুহু বসে ছিলো। আবীরের সামনে নিজের চোখের জল লোকানোর চেষ্টায় কুহুর চোখটা বারবার লাল হয়ে উঠছিল।
"আরে আমি একদম ঠিক আছি কুহু। দেখ, দিব্যি আছি। এখনও মরিনি।"
কুহু কাতর কন্ঠে বলে উঠল- "ফালতু কথা বলবে না একদম। আর কে তোমার এই অবস্থা করলো..?"
          আবীরের বন্ধুরা বলে উঠল- "কে আবার.. ঐ মৈত্রীর বয়ফ্রেন্ড জি.এস তন্ময় ঘোষাল।" মেঘনা ঝাঁজিয়ে বলে উঠল- "ওর বড্ডো মৌচাক থেকে মধু খাওয়ার শখ হয়েছিল না। এবার মৌমাছির হুলটাও খেয়েছে। ঠিক হয়েছে... শালা তোর এমনই শিক্ষা হওয়া উঠিত ছিলো।"
আবীর চুপ করে গেলো। হাতটা তো আগেই ভেঙেছে। এবার কিছু বললে, মেঘনা ওর মুখটাই না ভেঙে দেয়।
ভাঙা হাত নিয়ে কোনো রকমে ক্লাসে আসতো আবীর। সামনেই তাদের ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা ছিলো। গান গাইলেও পড়াশোনাটা তো একেবারে ভুলে যাওয়ার উপায় ছিলো না। মনে করানোর জন্যে বছরের শেষে পরীক্ষা তো হতোই। তবে ডান হাত ভাঙার কারনে খুব অসুবিধা হয়ে গিয়েছিল আবীরের। তবে কুহু সবসময় আবীরের পাশে থাকত। ওর নোটশ্ কপি করে দিতো। ওর ছোটো-খাটো দরকার গুলোর খেয়াল রাখত।মিউশিক নোটশ্ লিখতো। আর আবীরও অবলীলায়- "কুহু এটা দে, ওটা আন.." হুকুম করে যেতো।
            অবশেষে এক্সজামের সময় এসে উপস্থিত হলো,  আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি ছিলো। কিন্তু আবীরের হাত তখনও পুরোপুরি ঠিক হয়নি। আবীরের মনে হলো এবার ও কোনো পরীক্ষাই দিতে পারবে না। এই বছরটা লস্ হয়ে যাবে। কিন্তু এই সমস্যার একটা সমাধান পাওয়া গেলো। প্রফেসর বললেন, আবীরের থেকে জুনিয়র কেউ ওর পেপার লিখে দিতে পারে। কিন্তু কে লিখবে... জুনিয়রদেরও তো পরীক্ষা চলছিল। আবীর অনেক জনকে বললো, কিন্তু কেউই ওর পেপার লিখে দিতে রাজি হচ্ছিল না। আবীরের সকল গোপীনিরাও একে একে মিষ্টি সুরে না করে দিলো।
             অবশেষে একজন এককথাতেই রাজি হয়ে গেলো। "ঠিক আছে। আমি ফার্স্ট হাফে আমার পেপার শেষ করে, সেকেন্ড হাফে্ তোমার পেপার লিখে দেবো।" হ্যাঁ, সেই একজন কুহুই ছিলো। মেয়েটা সত্যিই প্রাণ ঢেলে ভালোবাসতে জানত। আবীরের কাছ থেকে কিছু পাওয়ার প্রতাশা রাখত না সে। শুধু নিশ্ব হয়ে সবটুকু উজাড় করে দিতে জানত।
পরীক্ষা দিন এসে উপস্থিত হলো। ফার্স্ট হাফে কুহুর পেপার থাকত। নিজের পেপার শেষ করে ছুটতে ছুটতে আবীরের কাছে আসত কুহু। আবীরের প্রতেকটা কথা শুনে কপি সে করে চলতো। মাঝে মাঝে কিছু মুখে দেওয়ার সময়ও হতো না তার। এইভাবে একের পর এক সব পেপার হতে থাকল। পরীক্ষার শেষদিন কুহু ছুটতে ছুটতে হলে ঢুকল। আবীর তার মুখের দিকে লক্ষ্য করছিল, আজ যেনো তাকে ম্লান আর ক্লান্ত লাগছিলো।
"কি হলো... তাড়াতাড়ি বলো কি লিখবো..."
"হ্যাঁ বলছি।" আবীর বলতে শুরু করল। দেখতে দেখতে সময় পেরিয়ে গিয়ে, লাস্ট বেল্ বেজে উঠল।
           আবীর ভাবলো, আজ কুহুকে একটা স্পেশাল থ্যাঙ্কস্ দেবে। কিন্তু আবীরের থ্যাঙ্কস্ শোনার কোনো অপেক্ষা না করেই, কুহু বাড়ি চলে গিয়েছিল।
           সত্যিই কুহু প্রতিবার আবীরকে অবাক করে দেয় !! যতবারই সে ভাবে কুহু আর কতদিন একতরফা ভাবে তাকে ভালোবাসতে পারবে....? ততবারই কুহু আবীরের ভাবনাকে ভুল প্রমান করে, ভালোবাসা এক নতুন সীমানা তৈরী করে।
()    
               পরীক্ষার পর প্রায় দুসপ্তাহ কেটে গেছে। কিন্তু কুহুর দেখা নেই। মিউসিক প্রেকটিসে ও আসছে না সে। আবীর হাজার বার ফোন করেছে। কিন্তু ফোনটাও বেজে বেজে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কুহু ফোন তুলছে না।
আবীরের যেনো চিন্তায় মাথা ফেটে যাওয়ার জোগাড় হচ্ছিল। মনে না কোনো কথা আসছিল, না সুর...। কুহুকে ছাড়া মিউসিক প্রেকটিসেও মন লাগছিল না তার। কেমন যেন পাগলপাড়া, খাপছাড়া, অগোছালো মনে হচ্ছিল নিজেকে।
         মেঘনা বোধহয় আবীরের মনের অবস্থার আঁচ পাচ্ছিল। মিউসিক প্রেকটিসের শেষে সে এসে বললো- "এই নে কুহুর বাড়ির ঠিকানা, যা ওকে দেখে আয়।"
"তুই কিছু জানিস মেঘনা... কি হয়েছে কুহুর.. কেন আসছে না ও...??"
মেঘনা উত্তর দিলো- "কুহু খুব অসুস্থ। দুসপ্তাহ ধরে জ্বরে পড়ে আছে। ভেবেছিলাম তোকে বলবো না কথাটা। তোর কিইবা যায় আসে বল কুহুর কথা জেনে।কিন্তু তবু বললাম।"
কথাটা শোনা মাত্রই আবীরের মনটা মোচোর দিয়ে উঠল। পরীক্ষার শেষ দিন কুহুর ম্লান, ক্লান্ত মুখটার কথা মনে পড়ে গেলো। আবীর তার হাতের ব্যথার তোয়াক্কা না করে বাইক নিয়ে ছুটলো। তীড়ের বেগে তার বাইক ছুটে চললো, কিন্তু বাইকের তীব্রতাও তার ব্যাকুলাতার কাছে হেরে যাচ্ছিল। কুহুকে একবার দেখার জন্যে মনটা ছট্ফট্ করছিল তার।
           আবীর যখন পৌঁছালো কুহু বিছানায় জ্বরে বেহুশ হয়ে পড়েছিল। কুহুর একমাত্র আপনজন তার বৃদ্ধা ঠাকুমা তার মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছিল। আবীরকে দেখে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। "তুমি কে..?"
"আমি আবীর, কুহুর বন্ধু।"
"ভালো হয়েছে তুমি এসেছ।মেয়েটার জ্বর বেড়েই চলেছে। কি করবো কিছু বুঝতে পারছি না।"
আবীর কুহুর মাথায় হাত ছুঁইয়ে দেখলো, প্রচন্ড উত্তপ্ত তার শরীর। ছোট্ট শিশুর ন্যায় কুহুকে কোলে তুলে নিলো আবীর। তারপর তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো। ডাক্তার কুহুকে ইনজেকশন্ দিলেন। ফলে কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে তার শরীরের তাপমান কমে আসলো। এতক্ষণ পর নিশ্চিন্ত হলো আবীর। কুহুর ক্লান্ত শরীরটাকে আবার দুহাতে তুলে নিলো সে। তারপর তাকে বাড়ি পৌঁছে দিলো।

"সবধানে থাকিস কুহু। নিজের শরীরের খেয়াল রাখিস। আমি চলি এখন,কাল আবার আসবো।"  আবীর বাই বলে চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ কুহু তার হাতটা টেনে ধরলো।
"প্লিজ যেও না। আর একটু থাকো।"
এক আকুল আহ্বান ছিলো তার ডাকে। যেন সারাজগতের সমস্ত যন্ত্রণা মিশে গিয়েছে তাতে। কুহুর ডাকে আবীরের সারা শরীর সারা দিয়ে উঠল। তবুও সে বললো- "অনেক রাত হয়ে গেছে কুহু। তুই রেস্ট নে, আমি পরে আসবো। এখন আমায় যেতে দে।"
অভিমানী হয়ে আবীরের হাতটা এক ঝটকায় ছেড়ে দিলো কুহু- "যাও চলে যাও। আর কালও আসতে হবে না তোমাকে। এখানে আসতেই কে বলেছিল তোমাকে..."
"কুহু তুই রাগ করলি আমার ওপর...?"
"আমার রাগের তোমার কিইবা যায় আসে... তুমি চলে যাও এখনি।"
আবীর অভিমানী কুহুর কাছে এসে তার রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু প্রবলভাবে বার বার আবীরকে নিজের থেকে দূরে ঢেলে দিলো কুহু।
"একদম কাছে আসবে না আমার। জাস্ট্ গেট্ লস্ট্। ছোঁবে না আমায়।"
আবীর তার মানা না শুনে, একপ্রকার জোর করেই কুহুকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলো। আর কুহু সে বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার বৃথা চেষ্টা করে চললো।
"আমায় ছেড়ে দাও কিন্তু... নাহলে আমি চেঁচাবো।"
"ঠিক আছে চেঁচা। জোরে জোরে চেঁচা, আমিও শুনি।"
"ছেড়ে দাও। তোমার মৈত্রীর কাছে যাও। আমার কাছে আসতে হবে না তোমাকে।"
         আবীর কুহুর আরও কাছে এগিয়ে এলো। দুজনের নিশ্বাস এক হতে থাকল। তারপর আবীর কুহুর উত্তপ্ত ঠোঁট দুটোয় নিজের ঠোঁট মিশিয়ে দিলো। গভীর চুম্বনে দুজনায় ভালোবাসার আস্বাদ টেনে নিলো।
"আমি তোকে ভীষণ ভালোবাসি কুহু। ভীষণ ভালোবাসি। তোকে যে কবে থেকে নিজের বুকে রেখে দিয়েছি, নিজেই জানিনা।
আসলে আমি একটা ইডিয়ট, বাব বার তোর থেকে দূরে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তোকে নিয়েই সুর বেঁধেছি, তোকে নিয়েই গান লিখেছি।
তবু বুঝতে পারিনি যে আমি মনে মনে তোকে ভালোবাসি। তোকে বুকের মধ্যে রেখে, পাগলের মতো অন্যের ঠোঁটে সুখ খুঁজে মরেছি।
কিন্তু আর নয়। আর আমি আমি তোর থেকে দূরে যেতে চাই না। এবার তুই যতবারই আমাকে দূরে ঢেলে দিস, তবু আমায় নিজের থেকে দূরে সরাতে পারবি না তুই।"
কুহুর যেনো সবকিছু অবিশ্বাস্য লাগছিল। আবীরের চোখে এতদিন যে ভালোবাসার সন্ধান করছিল ও, আজ সেই ভালোবাসা স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছিল তার চোখে। তবুও কুহুর বিশ্বাস হচ্ছিল না। কাঙালীনির মতো সে আবীরের চোখের দিকে চেয়ে কেঁদেই চলেছিল।
আবীর কাছে এসে তাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বলে উঠল- "পারবি কুহু এই খারাপ ছেলেটার হাজারটা ভুল মাফ করে দিতে...? পারবি কুহু আবার আমাকে ভালোবাসতে....?"
            কুহু একরাশ কান্না বুকে নিয়ে, কম্পিত গলায় বলে উঠল- "আবার করে, কি করে ভালোবাসবো বলো...
আমি তো তোমায় আগে থেকেই ভালোবাসি। আর সারাজীবন ভালোবাসবো। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভালোবাসবো। শুধু ভালোবসবো। শুধু ভালোবাসবো।।"
         সে ক্ষনে ভালোবাসায় স্নাত দুটি মন গভীর রাতের আঁধার ভেদ করে আবার গেয়ে উঠল-  "আমারও পরাণ যাহা চায়, তুমি তাই... তুমি তাই গো... আমারও পরাণ যাহা চায়...।"

প্রচ্ছদ শিল্পী : সুদীপা কুন্ডু