রবিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২১

মীনাক্ষী ঘোষ

           



কোল্হাপুর ডায়েরী ৪

অ‍্যাপার্টমেন্টের নীচেই একটা সাউথ ইন্ডিয়ান রেষ্তোঁরা আছে সেখান থেকে লাঞ্চের অ‍্যারেঞ্জমেন্ট হোলো।
আগামিকাল সূর্যের জয়েনিং ডেট।
বিকেল চারটে বাজে। দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তে অবস্থানের কারণে সূর্যাস্ত হয় দেরীতে। লাঞ্চের পরে সবাই যখন নিজের নিজের ঘরে বিশ্রামের আয়োজন করছে মিমি পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ালো লিভিংরুম লাগোয়া বর্গাকৃতি ছোট্ট খোলা ছাদটার রেলিং ঘেঁষে। এখানে সবাই এই ধরণের সংলগ্ন খোলা ছাদকে টেরেস বলে।  ব্যালকনিকে
বলে গ্যালারি।
তিনতলার টেরেস থেকে নীচে ব্যস্ত সড়কের ছবি প্রতীয়মান। মিমি তার দৃষ্টি ভাসিয়ে দিলো সুদূরে। দূরে চক্রাকারে বেষ্টিত পাহাড়ের  অস্পষ্ট রেখা দিগন্তে গিয়ে মিশেছে। আপাতশান্ত কোলাহলবিহীন এই শহরটির প্রতি এক অজানা ভালবাসা বুকের ভেতর জারিয়ে যাচ্ছিলো আস্তে আস্তে।
সম্বিৎ ফিরলো কলিংবেলের আওয়াজে। এইসময় আবার কে এলো? দরজা খুলতেই সামনে দাঁড়িয়ে সৌম্যদর্শন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক ও পাশে স্মিতহাস্যে মধ্যবয়সিনী  ভদ্রমহিলা। চকিতে মিমির মনে পড়লো সূর্য বলেছিলো বটে ওর নতূন অফিসের বস কোম্পানির এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর মিঃ বোস আসতে পারেন।  ওর মাথা থেকে কথাটা একেবারেই বেরিয়ে গেছিলো।ইশশ ছি ছি। ওর অপ্রস্তূত মখ দেখে ভদ্রলোক হাতযোড় করে নিজের পরিচয় দিলেন। কোনরকমে অপ্রস্তুত ভাব সরিয়ে মিমি ওঁদের ভেতরে আসতে অনুরোধ জানালো। এই কোম্পানিতে সূর্য ছাড়া উনি আর একমাত্র বাঙালি।
অল্পক্ষণের মধ্যেই অপরিচয়ের দূরত্ব কমে অন্তঙ্গতার সুরটি ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠলো। মিসেস বোস ক্রমশ হয়ে উঠলেন মিমির কাছে 'বৌদি'। স্নেহশীলা এই মানুষটি মিমিকে প্রথম থেকেই  নিজের ছোট বোনের মতো করে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। মিমিও তাকে নিজের বড়দিদি  ভেবেই ক্রমশ ঘনিষ্ঠ হয়েছিলো ধীরে ধীরে।
নানান আলাপচারিতায় মিমি জানতে পারলো কোল্হাপুরের মহালক্ষ্মীদেবীর মন্দিরের কথা।মিমির উৎসূক মন জানতে পারলো আরো অজানা কিছু তথ্য।করবীর তালুকার অন্তর্ভুক্ত কোল্হাপুরকে করবীর তীর্থ ও বলা হয়।
বৌদি প্রস্তাব দিলেন পরদিন সকালে সূর্য অফিসে বেরিয়ে এগেলে উনি মিমিকে নিয়ে মহালক্ষ্মী মন্দির দর্শন করাতে যাবেন। নতুন জায়গায় মাতা অম্বাবাঈয়ের কাছে পুজো দিয়ে শুভারম্ভ করা ভালো।
পরদিন সকালে সূর্য অফিসে বেরিয়ে গেলে মিমি স্নান করে
রেডি হয়ে রইলো। ছেলেমেয়ের ব্রেকফাষ্ট  টেবিলে ঢাকা দিয়ে বৌদি আসা মাত্র  বেরিয়ে পড়লো দেবী সন্দর্শনে।। বাড়ি থেকে খুব বেশী দূর নয় মন্দির। বৌদির সাথে গাড়ী ছিল। মিনিট দশেকের মধ্যেই ওরা পৌঁছে গেল মন্দিরের কাছে। মন্দিরের প্রবেশপথ মোট চারটি। পশ্চিমদিকের প্রবেশদ্বার দিয়ে মিমি আর বৌদি প্রবেশ করলো মন্দিরে।
মিমি অবাক বিস্ময়ে দেখছিলো মন্দিরের কারুকাজ।
পঞ্চগঙ্গা নদীটি কোল্হাপুরকে বেষ্টন করে প্রবাহিত হয়ে চলেছে।আর এর তীরেই রয়েছে বিখ্যাত দেবী মহালক্ষ্মীর মন্দির।প্রায় ছয়হাজার বছরের পুরনো এই মন্দিরটি কালো গ্রানাইট পাথরে গুহার আদলে নির্মিত। অপূর্ব স্থাপত্যশৈলী ও ভাস্কর্যের মেলবন্ধনে এই মন্দিরটির শৈল্পিক গুরুত্ব ও অপরিসীম।
মূল মন্দিরটির শীর্ষদেশে পাঁচটি চূড়া। চূড়াগুলিতে যথাক্রমে পাঁচটি বড় ও ছোট সোনার কলস স্থাপিত।। এত সকালেও দূরদূরান্ত থেকে ভক্ত সমাগম যথেষ্ট।
,  হরি পুরাণের  কাহিনী অনুসারে তপস্বী ভৃগু বৈকুন্ঠে পদার্পণ করে কলহবশত বিষ্ণুর বুকে পদাঘাত করলে বিষ্ণুপত্নী কুপিতা হন। বিষ্ণুবক্ষেই যে দেবী লক্ষ্মীর অধিষ্ঠান!স্বামীর অপমানে ক্রোধান্বিতা দেবী এত অপমানের পরেও শ্রী বিষ্ণুকে প্রসন্ন ও সহাস্য বদনে মহর্ষি ভৃগুর প্রতি ক্ষমার্হ নয়নে দৃষ্টিপাত করতে দেখে  বিষ্ণুধাম পরিত্যাগ করে মর্ত্যে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।মর্ত্যে দেবী যে স্থানটিকে নির্বাচন করেন সেটি হোলো এই কোল্হাপুর। স্বয়ং বিষ্ণু ও দেবীর সাথে বৈকুণ্ঠ  পরিত্যাগ করে শ্রীক্ষেত্রে বসবাসের সূচনা করেন।দেবীর অগণিত ভক্তের আকুল আবেদনে মাতা চিরকালের মতো এখানেই আপন অধিষ্ঠান স্থাপনা করেন।তদবধি তিনি সমস্ত রকম দৈব রোষ থেকে এই স্থানের রক্ষাকর্ত্রী হিসাবে পূজিতা। এমনকি প্রলয়কালে যখন সমগ্র ধরিত্রী জলরাশিতে নিমজ্জিত তখনো শ্রী বিষ্ণু ও মাতা লক্ষ্মী ভক্তদের পরিত্যাগ করে বৈকুণ্ঠ গমনের ইচ্ছা পরিহার করেন। কোল্হাপুরে তাই বিষ্ণু এবং লক্ষ্মীর চিরকালীন অধিষ্ঠান। লোকশ্রুতি, কোল্হাপুরে কেউ কখনো অন্নাভাবে অভুক্ত থাকেনা।
অন্য মতানুসারে দেবাদিদেব মহাদেবের বরে অপ্রতিরোধ্য কোলাসুরকে দেবী যুদ্ধে পরাস্ত করে হত্যা করতে উদ্যত হলে অসুর মিনতি করেন তার মৃত্যুর পর এই স্থানটিকে যেন তাঁর নাম অনুসারে নামাঙ্কিত করা হয়।
তার নামানুসারে স্থানটির নাম হয় কোল্হাপুর।
দেবীকে মাতা ভবানী  উমা বা পার্বতী পক্ষান্তরে অম্বা মাতা রূপে পূজা করা হয়।
এই মন্দিরটি সপ্তম শতাব্দীতে চালুক্যবংশীয় রাজা কর্ণদেব নির্মাণ করান। সামনে দক্ষিণভারতীয় স্থাপত্যশৈলীর আদলে  একটি বৃহৎ দীপাধার। গুহার আদলে তৈরী মন্দিরটির প্রবেশাভিমুখে বাঁদিকে দেবীর চরণ চিহ্ণ যা শ্রীযন্ত্র নামে খ্যাত সেখানে প্রণাম করে মূল মূর্তির অভিমুখে যাত্রা। প্রবেশপথটি অত্যন্ত অপরিসর। সিংহদরজা পেরিয়ে মাতৃসন্দর্শনের স্থানটি অপেক্ষাকৃত পরিসরযুক্ত।
কালো পাথরে তৈরী মাতৃমূর্তিটি নাতিবৃহৎ। দৈর্ঘ্যে তিনফুট। নানানরকম দুর্মূল্য রত্নালঙ্কার ভূষিতা মূর্তির ওজন চল্লিশ কিলোগ্রাম।মূর্তির পিছনে  কালো পাথরে রচিত সিংহমূর্তি দেবীর বাহন। মূর্তির মস্তকোপরিভাগে শেষনাগ ছত্ররূপে বিরাজমান।
মাতৃমূর্তি চতুর্ভূজা।  দেবীর নিম্ন দক্ষিণহস্তে একটি ফল- মতুলিঙ্গ।দক্ষিণ উপরিভাগে একটি বৃহদাকার গর্ধভের মস্তক ভূমি নিবদ্ধ দৃষ্টি।বাম উপরিহস্তে একটি বর্ম ধৃত এটিকে খেতক বলা হ য়। ও বাম নিম্নহস্তে একটি পানপাত্র। দেবীমূর্তি পশ্চিমমুখী। বৎসরের তিনদিন পশ্চিম দেয়ালের একটি ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠ থেকে অস্তগামী সূর্যের  বিদায়রশ্মি দেবীর মুখে  আলো প্রদান করে দেবীকে প্রনিপাত জানায়।
মুগ্ধ হয়ে মিমি মন্দিরের অনুপম ভাস্কর্য দেখছিলো। এই পাথরের গায়ে গায়ে কত অজানা কাহিনী লিপিবদ্ধ হয়ে আছে তার কথা আর কে বলবে! নির্বাক অথচ বাঙ্ময় যেন প্রতিটি গাত্র শৈলী।
শুধু দেবীমূর্তি নয় এই অদেখা ভাস্করদের  অনুপম কারুনৈপুণ্যের প্রতি প্রণাম জানিয়ে মিমি মন্দির থেকে বেরিয়ে এল।
ক্রমশঃ

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন