শ্রাবণের ধারার মত
পর্ব-১১
মরুণকিশোর কোলকাতা বিমানবন্দরে নেমেই থমকে গেল। বয়সের সাথে মনটা আরো একটু বাড়লে বোধহয় ভালো হত। এসব কাজ তার ভালো লাগেনা। আশাভরা মুখগুলির দিকে তাকিয়ে নিজেই কেমন হেরে বসে থাকে তবু সিদ্ধান্ত জানতে হয়। প্রত্যাখ্যান চিরকাল তাকে এমন এক সুরঙ্গে নিয়ে যায় যেখান থেকে পরিত্রাণের পথ তার জানা নেই। কেবল দমবন্ধ করা পরিস্হিতিতে সময়ের উপর নির্ভর করে হাল ছেড়ে দিতে হয়। সাইন্সসিটির বড় অডিটোরিয়ামে একঝাঁক তরুণ ছেলেমেয়ে জড়ো হয়েছে। সেখানে পৌঁছে হলে ঢুকে মরুণকিশোর ভীষণ সংকুচিত হয়ে উঠল। উদ্যোক্তারা ভালো ভালো কথা বলেছে। বুঝিয়ে দিচ্ছে তাদের উদ্দ্যেশ্য কী।
-আমরা চাই তোমরা যারা নতুন প্রজন্ম তারা প্রত্যন্ত এলাকা চেনো জানো। তোমাদের মধ্যে সবাই যে হায়ার স্টাডি করবে তেমনটা নয়। অনেকেই আছে বিভিন্ন কারণে এখনি উপার্জন করতে চায় অথচ তাদের রেজাল্ট আউট স্ট্যাণ্ডিং। আমরা চাই জিওলজিক্যাল সার্ভের বিভিন্ন ক্ষেত্রগুলো তোমরা ভালো করে বুঝে নাও। ঘাটশিলার কপার মাইনের কর্মকর্তারা আমাদের এই কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন। তোমাদের মধ্যে থেকে দশজনকে নির্বাচন করবেন তারা। একবছরের কাজ শেষে তোমরা পেপারস্ জমা দেবে ওনারাই তোমাদের কাজের ভিত্তিতে তিনজনের হায়ার স্টাডিজের ব্যবস্থা করবেন বা স্হায়ী চাকরীর। এই একবছর তোমাদের গবেষণামূলক কাজটির জন্য ওনারা তোমাদের চারলক্ষ টাকা দেবেন। অর্থাৎ নিজে উপার্জন করবে এবং স্বনির্ভর হবে।
সারা হল হাততালিতে ফেটে পড়ল। আরো অসহায় হয়ে উঠল মরুণকিশোর। গোধূলিমাসির বাড়িতে গরমের ছুটিতে এসেছে সে। তার গল্প বেরিয়েছে নামকরা পত্রিকায়। হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে বলল, 'পড়ে দেখো আমাদের পুরীর গল্প আছে।' পড়তে গিয়ে হতবাক হয়, এক এমন পুরুষের সাথে দেখা হয় এক অষ্টাদশীর যার গ্রেস স্টাইল সব যেন চমকে দেবার মতো। অষ্টাদশী যে দেবপ্রিয়া তা বোঝা যায় সহজেই কিন্তু পুরুষটি মরুণকিশোর নয়। বুকের ভেতর যে কারিগর নরম হাতে ছবি আঁকছিল আচমকা দুরমুশের শখ জাগে তার বুক মুচড়ে ওঠে। কী বলবে সে ঠিক কী বলা উচিৎ তার? ক্যারিয়ার সবার আগে! মন প্রেম মানুষ স্মৃতি সব ব্যর্থ?
-আমি আসলে খুব বাজে বক্তা। প্রকৃতপক্ষে মস্তিষ্ক নামক বস্তুটা আমার কমজোরি। তবে যদি সত্যিই অন্তরের তাগিদ অনুভব করো তবেই এসো এগিয়ে। টাকা সব নয় বলেই আমার অনুমান।
এটুকু বলে আবার গুটিয়ে গিয়েছে নিজের ভেতর। ছবি ছাড়া প্রোফাইল ও কেন কাজটা করতে চায় স্টুডেন্ট সেটাই জানতে চাওয়া হয়েছিল। সবচে ভালো লাগা কাগজের মেয়েটির নামটি ঊশ্রী রায়। মেয়েটি আসতেই মরুণ চোখ নামিয়ে নিল। এমন চোখ দেখলেই সে ভয় পায়।
-লিখেছো কুশ্রী অতীত থেখে মুক্তি চাও আর মাকে নিয়ে কোলকাতা থেকে দূরে যেতে চাও তাই এইকাজ চাই। পড়াশোনা বা অর্থ তোমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়?
-না নয়। আমার যতটুকু চাহিদা ততটুকু আমার মা ভালো মতো মেটাতে পারেন। আর পড়াশোনা আমি যতদূর চাই উনিই করাতে পারেন।
-হুম্! বাবাকে নিয়ে যাবেনা সাথে।
-জানিনা আপনার এই প্রশ্ন কতটা জরুরি তবু বলছি আমার ঠিকঠাক বুদ্ধি হবার আগে থেকেই বাবা মা আলাদা। আর কিছু জানতে চান?
-হ্যাঁ চাই। তুমি যদি কাজটা পাও কাকে জানাবে আগে?
-দিদামাকে।
মরুণ বলে, 'ওনাকে ফোন করো'। মেয়েটা ম্লান হাসে, 'ওখানে ফোন নেই।'
-কোথায়?
-স্বর্গে।
মরুণ তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিতেই মেয়েটি বলে, 'আর কিছু প্রশ্ন করবেন? নাহলে আমি যাব। মা আজকাল টেনশান করেন।'
-কী করেন তোমার মা?
-আমার মা লেখিকা। যদিও আরো অনেক কিছুই হতে পারতেন।
-তুমি তোমার মাকে খুবই ভালোবাসো মনে হচ্ছে।
-উনি ভালোবাসার মতোই। তাহলে আমি উঠি স্যার।
-হ্যাঁ এসো। এপয়েন্টমেন্ট লেটার পৌঁছে যাবে ঠিক সময়ে।
ঝলমল করে ওঠে মেয়েটা তবে আশ্চর্য সংযত। ওর চোখের ভেতর ছায়া জেগে আছে যার তাকে দেখার সাধটা নিষিদ্ধ বলে দেগে দিয়েছে সময়। মেয়েটা অপ্রস্তুত হচ্ছে হয়ত তাকে লম্পট ভাবছে। মরুণকিশোর চোখ নামিয়ে নেয়। ঊশ্রী যেতে গিয়েও ঘুরে দাঁড়ায়।
-স্যার আপনি কৈশোরে পুরীর মন্দিরে কী কিছু খুঁজতে গিয়েছিলেন?
চমকে ওঠে মরুণ। উঠে দাঁড়ায় চেয়ার থেকে। ঊশ্রী আলতো হেসে বলে, 'মাস তিনেক আগে মা সমুদ্রের পাড়ে বসে আপনার কথা বলেছিলেন এমন অদ্ভুত নাম খুব বেশি মানুষের হবেনা বলেই আমার মনে হয়েছিল তাই একটা চান্স নিলাম। স্যার আসবেন আমাদের বাড়ি সময় পেলে মা আপনাকে দেখলে খুশি হবেন। চলি স্যার।
-শোনো ঊশ্রী তোমার মায়ের নাম...
-অবিশ্বাস্য লাগছে আপনার তাইনা! আমারো লেগেছিল এখানে এসে আপনার নাম জেনে।তবে এটাই সত্যি আমার মায়ের নাম দেবপ্রিয়া।
পায়ের নীচের মাটিটা দুলে ওঠে। ঊশ্রী বেরিয়ে যেতেই হেরে যাওয়া মরুণকিশোর মনে মনে পলাশগাছ জড়িয়ে ধরে সর্ব শক্তি দিয়ে। যতগুলো দিন যতগুলো রাত কেবল তার সাথেই পথ হেঁটেছে সে মনে মনে, সেই ক্রমশ ছোট হতে হতে বিন্দু হয়ে যাচ্ছে অথচ গোধূলিমাসিদের ছাদের পাঁচিলঘেঁষে যেখানে বকুল গাছটা আলসেমি করে জাঁকিয়ে বসেছিল, সেখানেই বলেছিল দেবপ্রিয়া, 'তোমার সাথে থাকলে মনে হয় বৃন্দাবনের পথে পথে কী যেন এক কান্না ভেজা সময় খুঁজে চলেছি। এই বকুলফুলের গন্ধে ভেতরে ভেতরে রাধা হয়ে উঠছি। অথবা রাজস্হানের এক মেয়ে যে গিরিধারীর প্রেমে বিভোর সে বুঝি আমায় ছুঁয়ে যাচ্ছে। আমার খুব কষ্ট হয় আবার আমার খুব ভালো লাগে। কী করবো বুঝি পাইনা কেবল ছুটে ছুটে গোধূলিমাসির বাড়ি আসি। তুমি মনে মনে আমায় পাগল ভাবছ তাই না?' মরুণ সরমে মরে যায়। এমন মাধুকরীর সঙ্গী হবে বলেই সে যে পাল তুলে রেখেছে। পাগল হতেই তো চায়। পাগল ভাববার অবকাশ যে তার নেই।
-আজ থেকে বহু বছর পর আবার যখন দেখা হবে, তুমি বুড়ো হয়ে যাবে, আমিও। সেদিনো তোমাকে দেখলেই আমি বকুলের ঘ্রাণ পাবো মরুণ। কাকে খুঁজছিলে পুরীর মন্দিরে বলো না?
কিছুতেই এই সহজ উত্তরটা দেওয়া হয়না। বুড়ো হলে দেখা হবে কেন? কেন জীবনের আগত সময় তাকে ছাড়া কাটবে এই ধাঁধাঁ কিছুতেই কাটাতে পারেনা মরুণ। আজো পারেনি। প্লেনটা মেঘের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে কোলকাতাকে আবছা করে দিচ্ছে ক্রমশ।
(ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন