মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯

শর্মিষ্ঠা দত্ত




বহুরূপে সম্মুখে তোমার
___________________________________

মন্দিরের বাইরে ঘুরঘুর করছিল ছেলেটা ...বছর সাতেক বয়েস ...মাথার চুলে জটা পরে গেছে ; ততোধিক নোংরা জামা ... গায়েও কাদামাটির প্রলেপ ...কতদিন স্নান হয়নি কে জানে ! বনানী পুজো দিয়ে বেরোতেই আঁচলটা চেপে ধরল l "দুটা টাকা দে না ক্যানে আম্মি  ...বড় খিদা লাইগছে ..."ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে বড় মায়া হলো বনানীর l কালো হাড়-জিরজিরে শরীর কিণ্তু অদ্ভুত মায়াময় দুটো চোখ ... ডালা থেকে প্রসাদ বের করে দিতেই প্রায় ছোঁ মেরে মুখে পুরে দিল সে l

মন্দিরের বাইরেই বেশ অনেকগুলো ঝুপড়ির মত দোকান ...কচুরি-তরকারি , জিলিপি পাওয়া যায় I সেদিকে এগোতে এগোতে বনানী ডাকলেন "আয় l " সমীরণ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিলেন ...."এখানে খাবে ! ..." সমীরণ নিজের ক্লাস সম্পর্কে অসম্ভব সচেতন ....তাই মুখে বিরক্তি স্পষ্ট l সমীরণ স্টীল-প্ল্যান্টের আধিকারিক হয়ে এ শহরে এসেছেন মাসখানেক হলো ...এই প্রথম এই মন্দিরে পুজো দিতে এসেছেন বনানী l

বনানী নির্বিকারমুখে কচুরি-তরকারির অর্ডার করলেন ...তারপর ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলেন "তোর নাম কি ?"... ওর নাম আব্বাস ; পথশিশুদের কোনো ঠিকানা থাকে না ... স্টেশনচত্বরে নানীর সঙ্গে থাকে ; বাবার নাম জানে না ...মা সালমা ওর দেড়বছর বয়েসেই পালিয়েছে দুসরা আদমির সঙ্গে l দাদীর নাম রাবেয়াবিবি ....সেও ভিখারিনী l

পরের সপ্তাহেই আবার দেখা হলো আব্বাসের সঙ্গে ...বনানীকে দেখেই একগাল হাসল ছেলেটা l আবার ঝুপড়িতে বসে খাওয়াদাওয়ার অবসরে অনেক গল্প হলো ; কি মনে হলো... একশটা টাকা ওর  হাতে গুঁজে দিলেন বনানী l

প্রতি সপ্তাহেই আব্বাসের সঙ্গে দেখা হয় ...বনানীকে এখন আম্মি বলেই ডাকে আব্বাস l ওর সঙ্গে গল্প করে পথশিশুদের অবস্থান সম্পর্কে  অনেককিছুই জেনেছেন ইতিমধ্যে l কুকুর-বেড়ালের মত ডাস্টবিন খুঁটে খাওয়া ; রোদ-ঝড়-জলে নিজের মাথাটুকু বাঁচানোর জন্য এই বয়েসেই নানারকম ছলচাতুরী ও লড়াই ; গাঁজা ও  ডেনড্রাইটের নেশায় জীবনীশক্তি খুইয়ে ফেলা আব্বাস , শংকর অথবা মাইকেলের মধ্যে কোনো তফাত নেই l

ওদের নিয়ে একটা স্কুল করেছেন বনানী ... স্টেশনচত্বরেই l পড়াশোনার সঙ্গে মিড-ডে মিলের ব্যবস্থাও হয়েছে একটা এন-জি-ওর সহযোগিতায় l নাচ-গান-ছবি আঁকা-নাটক ইত্যাদি  বিভিন্ন ধরনের অ্যাকটিভিটির মাধ্যমে ওদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটছে দ্রুত ...নেশার কবল থেকে মুক্তি পেয়ে মানবিক চেতনা ফিরে পাচ্ছে বাচ্চাগুলো l  পাশে পেয়েছেন প্যাট্রিশিয়া আর নাজমার মত বন্ধুদের ...দুপুরবেলা ক্লাস শেষ হওয়ার পর  সবাই মিলে হইচই করে খিচুড়ি আর ঘ্যাঁট-তরকারি ...মাঝেমধ্যে ডিমভাজা দিয়ে দারুন পিকনিক হয় ওদের l

এখন আর মন্দিরে পুজো দেন না বনানী ....তাঁর ঈশ্বর যে স্বয়ং তাঁকে সেবা করার সুযোগ দিয়েছেন !

ছবি সমরন্দ্র. মন্ডল 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন