শ্রাবণের ধারার মত
সৌমী আচার্য্য
পর্ব-১০
বিন্দুবালা সোহাগের আচরণ কোনদিনই সঠিক ভাবে বুঝিয়া উঠিতে পারে নাই। কিছুদিন পূর্বে তাহার স্বামী যে সোহাগকে নিয়া মাত্রা ছাড়াইয়া দুর্বল হইয়া পড়িতেছে একথা সে বিলক্ষণ বুঝিতে পারিয়াছিল। প্রথমাবস্হায় সোহাগ তাহাকে ঘিরিয়া বেতসলতার মতো বাড়িয়া উঠিতেছিল কিন্তু অকস্মাৎ তাহার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে আসিয়া পড়িল বিন্দু। তাহার ভালোবাসা দুর্নিবার। বুকের ভেতর চাপিয়া ধরিয়া যখন সে ঠোঁট ছোঁয়াইয়া কাঁদে বিন্দু আশ্চর্য সুখে হতভম্ব হইয়া যায়। কিছুদিন পূর্বে আদিত্য আকস্মিক ভাবে ঘরের অভ্যন্তরে ঢুকিয়া যাহা দেখিয়াছে আর যাহা বুঝিয়াছে সবটাই সত্য নয়। গতবছর বিন্দুবালার তিন নম্বর বাচ্চাটাও গর্ভেই মারা যাওয়ার পর বামস্তনের একাংশ কচড়া ধরিয়া ফোঁড়ার মতো ফুলিয়া উঠিয়াছে। প্রায় রাতে কম্প দিয়া জ্বর আসে। ক্রমশ সে ক্ষীণকায়া হইয়া উঠিতেছে। সোহাগকে বলিতেই সে যারপরনাই উদ্বেগে তৎক্ষনাৎ দেখিবার জন্য উদ্বিগ্ন হইয়াছে। ভয়ে বিস্ময়ে সে যখন বেড়ে ওঠা মাংসপিণ্ডে স্নেহের পরশ বুলাইতেছিল। অকস্মাৎ দরজা খুলিয়া আদিত্য ঘরে প্রবেশ করে। দরজাটি সোহাগ কেন ভেজাইয়া রাখিয়াছিল ইহা জানা দুঃসাধ্য। তবে বিন্দুবালা অনুমান করিতে পারে আদিত্যকে আঘাত করিবার দুর্দমনীয় প্রচেষ্টা সোহাগ ক্রমাগত করিতেছে। আজ মধ্যাহ্ন ভোজনের সময় সোহাগের রূপ ছিল শান্ত। শাশুড়িমা সোহাগকে অধিক স্নেহ করেন একথা সকলেই জানে। আজ তিনি সকলের সামনেই আদিত্যকে তিরস্কার করিয়াছেন।
-এমন লক্ষ্মীমন্ত বউ ঘরে ফেলে তোমার যে কেন বাইরের এত সাধ সে আমি বুজিনা বাপু। এবার ঘরে থিতু হও। জমিদারী কাজকম্ম বুজতে শেখো।
সোহাগ মৃদু স্বরে কহিয়াছে, 'বাহিরের জগতের আনন্দ আপনি আমি কী জানিতে পারি মা! আমার ভুল ভাঙিয়াছে। ওনাকে আটকাইবার মতো ভুল আর করিবনা। উনি মুক্ত। বাহিরে উনি আনন্দ খুঁজিয়া লইবেন আমি গৃহেই আনন্দ খুঁজিয়া লইব।' সোহাগের কথায় উপস্হিত সকলেই চমকিত। আদিত্যকে বিন্দুমাত্র যে চোখের আড়াল করিতে পারেনা তাহার মুখে এই কথা বিশ্বাস করিতে সংকোচ হয়। অপরাহ্নে গা ধুইয়া ভালো শাড়ি পরিয়া বিন্দুবালা নিজেকে আয়নায় দেখিতেছিল। স্বামী সোহাগ বিহীন জীবন বুঝি হাজার প্রচেষ্টাতেও সুন্দর হইয়া ওঠেনা। দাসী আসিয়া কহিল, 'ছোটোবউ তোমারে ডাকতেছে ছাতে।' বিন্দুর অত সাহস নাই যে সেই ডাক উপেক্ষা করিবে। সিঁড়িতে দুপা উঠিতেই আদিত্য তাহাকে ডাকিল।
-বৌঠান, সোহাগ কোথায়?
-ছাতে, সেখানেই আমাকে ডাকিয়াছে।
-বৌঠান আপনি নীচেই থাকুন আমি উপরে যাইতেছি।
বিন্দু ইতস্ততঃ করিতে লাগিল, 'কিন্তু না যাইলে সোহাগ রাগ করিবে।' ভুরু কুঁচকাইয়া আদিত্য বলিল, 'কিঞ্চিৎ লজ্জা সরম রাখলেন না বৌঠান ছিঃ। দাদা সব জানিয়া চুপ করিয়া রহিয়াছেন বলিয়া আমিও চুপ করিব এতখানি কাপুরুষ নই। আপনি নীচেই যান। আমি যাইতেছি উপরে।' বিন্দু এ রাগের কারণ বুঝিতে না পারিয়া ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। আদিত্য ছাদে গিয়া সুসজ্জিতা সোহাগকে দেখিয়া চমকিয়া উঠিল। এই অপরূপ সাজ কিসের নিমিত্ত? যে রত্ন জীবনে পাওয়া হইয়াছিল তাহা বুঝি হারাইয়া ফেলিল সে। মৃদু স্বরে ডাকিল, 'সোহাগ।' সোহাগ গভীর ভাবনায় ডুবিয়াছিল যেন।
-ও তুমি!
-তুমি অন্য কাহকেও চাহিয়াছিলে।
-বিন্দুবালাকে ডাকিয়াছি। তাহার সহিত কিছু একান্ত আলাপ আছে।
-সোহাগ তুমি কি আমাকে যন্ত্রণা দিবার কারণে এইসব করিতেছ? বৌঠানকে নাম ধরিয়া ডাকিতেছ?
-তুমি সত্যিই জানো যন্ত্রণা কী? শোনো যে কোন কারণেই যে আমাকে ছাড়িয়া দিনের পর দিন অন্যত্র আনন্দ খুঁজিয়া পায় সে আমার কেহ নয়। যে আমার সুখে দুখে ছোটছোট রাগ অভিমানে পাশে থাকে সেই আমার সব। তুমি বোধকরি এইসব বুঝিবে না। উদার প্রকৃতি, মুক্ত পিছুটানহীন জীবন তোমায় অনেক বেশি আনন্দ দেয়। তবে এই মুহুর্তে আমার তোমার সহিত সময় নষ্ট করিতে ইচ্ছা নাই।
-এতখানি কঠিন হইতে তোমার বাধিল না? এত সহজেই বলিয়া ফেলিলে আমার অপেক্ষা বৌঠান তোমার অধিক আপনার?
-তোমায় একটা কথা বলি, দিদির বড়ো অসুখ, আমার সীমিত জ্ঞান বলিতেছে তাকে এইক্ষণে বড় ডাক্তার দেখানো আবশ্যক। আর শোনো দিদিকে বুকে জড়াইয়া যে সুখ পাইয়াছি সে সুখ তুমি কোনদিন দিতে পারিবে না। সে সুখ আশ্রয় দিবার। তুমি আমার কাছে আসিলে একটি মুখ ভাসিয়া ওঠে যাহার নিকট আমি হারিয়াছি। এই সত্য আমার। তোমার কোনো দায় নাই। তুমি চাহিলে আমায় ত্যাগ করিতে পারো।
আদিত্য সবটুকু শুনিয়া বলিল, 'সব কথার উত্তর সময় দিবে সোহাগ। আমি এখন আসি ডাক্তারের খোঁজ করি।'
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন