বুধবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৬

সৌমলেন্দু ঘোষ



"বিয়েটা কোন অঙ্ক? এরিথম্যাটিক প্রোগ্রেসান! বাড়তেই থাকবে, তিন, পাঁচ, সাত, নয়। জীবনটাকে নয় ছয় করে দেবে।"

এই অব্দি পড়েই বেশ খানিকটা চমকে গেলুম; চোখটা বোধহয় একটু বড় বড় হল, কপালে একটা সেকেন্ড ব্র্যাকেট ঠেলে উঠল আর সঙ্গে সঙ্গেই কেমন যেন জল পিপাসা পেয়ে গেল। সব্বোনাশ, কয় কি?


অবশ্যি এইরকমই হওয়ার কথা ছিল, আমি হলাম যাকে বলে গিয়ে 'পারফেক্ট পোড়খাওয়া ব্যাচেলর' বা সংক্ষেপে পি.পি.বি, তাই বলে এইরকম হবে? অবশ্যি হওয়ারই কথা, কার লাইন দেখতে হবে তো, সঞ্জীব চাটুজ্যে, হুঁ হুঁ বাওয়া! চালাকি নয়!

কথায় ছিল চাটুজ্যেদের চাটুজ্যে না দেখলে কে দেখবে, তাই দেখাদেখির পালা আজও চলছে; সেই কবে বঙ্কিম চাটুজ্যে 'বিষবৃক্ষ' পুঁতলেন, সেই গাছের ডাল আজও বাঙালী কেটে উঠতে পারল না, সঞ্জীববাবুও বাঙালী তায় আবার চাটুজ্যে, তাই ফের লাগালেন একই ঢাকে কাঠি!
যাক গে, এইসব বলে আপনাদের আর সময় নষ্ট করব না, তবে আমি দেখেছি এখন মানুষের হাতে অঢেল সময় তাই আর ক্ষমা চাইলুম না...

ঠিক ধরেছেন এতক্ষণে, আজ মোগলের হাতে পড়া গেছে, মানে খানা খেতেই হবে সাথে, গল্পতো অনেক পড়লেন একটু লেখকের নিজের কথা শুনেই দেখুন না, খুব উপাদেয় না হলেও সহজপাচ্য হবেই। এই হল ঘোষেদের সমস্যা, একটা সরল কথাকে ল্যাজে খেলিয়ে সিঁড়িভাঙা অঙ্কের মত জটিল করে বলবে, এখানে লেখক ঘোষ তায় ব্যাচেলার, মানে মা মনসার মুখের সামনে ধুনো ধরে রাখা হয়েছে, তাই এইরকম কেত্তন যে শুনতেই হবে তাতে তিলমাত্র (কিঞ্চিৎ বেশী) সন্দেহ নেই। ধান ভানতে শিবের গীত তো অনেক হল, এবার শিবের মুখ থেকেই কিছুটা শুনুন না হয়..

শিবের কথা-
আজ্ঞে, অধমের নাম শিবনাথ গাঙ্গুলী; খাঁটি নিম্নমধ্যবিত্ত, আনন্দবাজার পাঠরত, চীনেখাবার প্রিয়, পরনিন্দায় পটু, কাছাখোলা স্বভাবের বুর্জোয়াবিরোধী মানসিকতার মালিক, বুঝতেই পারছেন যাকে বলে ভেতো বাঙালী। মোক্ষলাভের আর আট বছর বাকি মানে সরকারী কেরানী, বয়স (অবশ্যই ভাঁড়িয়ে) বাহান্ন। শরীর-স্বাস্থ্য ভালই,সবই বামদেব বাবার আসনের দয়া আর ডাল-ভাতের গুণ। অবশ্য ভবিষ্যতে কলিযুগে 'রামদেব বাবা' বলে একজন অবতার আবির্ভূত হবেন, যার এখনো অনেক দেরী, এখন সবে কলির সন্ধ্যে মানে ওই ধরুন উনিশশো আশি হবে, ধরে নিতে ক্ষতি কি? এইবার নিশ্চয়ই আপনার মনে প্রশ্ন জাগবে এই লোক বলে কি, ভবিষ্যত জানল কি করে? আজ্ঞে দাদারা-দিদিরা আপনিও যদি সরকারী কেরানী তায় মধ্যবিত্ত হন, তাহলে দেখবেন আপনিও ত্রিকালজ্ঞ আঁতেল হয়ে উঠেছেন; আইনস্টাইনের থিওরী থেকে আমেরিকার বিদেশ নীতি, ভারতের বেকার সমস্যা থেকে ভেনেজুয়েলার সংবিধান, চায়নার আগ্রাসন থেকে চেগেভারার গেরিলা নীতি সবই আপনার হাতের মুঠোয়, যাকে বলে খাটে বসেই হাওড়া টু হনলুলুর টিকিট বুকিং, তাও আবার ট্রেনে!

যাকগে অনেক ফালতু কথাই বলে ফেললাম বোধহয়, এই এক দোষ আমার, খেতে দিলে শুতে চাই আর শুলে উঠতেই চাই না; আসলে হয়েছে কি বলুনতো সেদিন অফিস থেকে সবে ফিরেছি, তখনই আমার পাশের বাড়ির লেখক ভদ্রলোক ঘোষবাবু এসে হাজির, আমি ভাবলাম বুঝি টাকা ধার করতে এলেন। সবে বলতে গেছি মাসের শেষ, ভদ্রলোক একগাল হেসে বললেন, "লিখবেন নাকি?"

অবাক হয়ে গেলাম, যাকে বলে মুখে একটা বোদাইচন্ডী কাটিং এসে গেল, তাই দেখে ভদ্রলোক মিচকি হেসে বললেন, "আসলে একটা মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনের উপর থিম করে একটা লেখা দিতে হবে তাই ভাবলাম, আমার যখন ফ্যামিলিই নেই তাই ডাহা মিথ্যা কথাগুলো না লিখে শিববাবুকে দিয়ে লেখালেই হয়, হলই বা কলেজ ফেল, তাই বলে কি আর লিখতে পারবেন না এইটুকু?"

কথাটা শুনেই আমার মাথায় ধাঁ করে রক্ত উঠে গেল সেইসঙ্গে আবার একটা বিষমও খেয়ে বললাম "মশাই বলেন কি, লেখার আবার থিম হয় নাকি?" ঘোষবাবু একটা মুখে উপচে পড়া খুশির ভাব এনে বললেন "সবই হয় মশায়, দুগ্গাপুজো থেকে লেখা সবই থিমের উপর দাঁড়িয়ে আছে, সবই ফরমায়েশ; কেউ বললেন ভূত, তো কেউ বললেন গোয়েন্দা, আবার কেউ বলেন ধার্মিক উপন্যাস আবার কেউ চান বিশুদ্ধ চটিগল্প; বুঝলেন কিনা সবই সম্পাদকীয়?"

বুঝলাম, খুব ভাল করেই বুঝলাম, তারপরেই একটু কেশে জিজ্ঞাসা করলাম আমি কি পারব? মানে শেষ বাইশটা বছর ধরে যে শুধু অফিসের খাতায় হিসাবই করে গেল, সে কি কলম নিংড়েও লেখা বার করতে পারবে? ঘোষবাবু একটা ফিচেল হেসে বললেন "আরে দূর মশাই, মনে যা আসবে লিখে দেবেন, কিছু না এলে সারামাসের সংসার খরচই লিখে দেবেন, সম্পাদক ওটাকেই 'কম খরচে সংসার' বলে একটা প্রবন্ধ বানিয়ে দেবে।"

এই বলে তো ঘোষবাবু পান চিবোতে চিবোতে চলে গেলেন, আর আমি পড়লাম মহাবিপদে; কি লিখি এখন? ভেবে ভেবে এতটাই অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম যে রাতে তরকারি পাশে রেখেই দুটো রুটি শুধু খেয়ে ফেললাম, পরদিন অফিসে বেরোনোর সময় জামা পরে প্যান্টের জায়গায় গামছা পরেছিলাম, ভাগ্যিস গিন্নী দেখলেন নইলে হত আরেক কীর্তি! অফিসে গিয়েও কি শান্তি আছে, দু-দন্ড যে বসে ভাববো তারও সুযোগ নেই, সেইদিনই রাজ্যের ফাইল ক্লিয়ার করত হবে বড়বাবুর নির্দেশ, চলো দুগ্গা বলে লাগাও পানসি; মাঝে হয়ত একবার ভাবসমাধি হয়েছিল, কারণ দেখলাম হিসাবের খাতায় মনের ভুলে (অনিচ্ছাকৃত নয় বোধহয়) বড়বাবুর একটা আবক্ষ মূর্তি এঁকে ফেলেছি। আমার আঁকার হাত যে এত ভাল তা কে জানত? অবশ্য স্কুলজীবনের পর সাধের বায়োলজি খাতা আর পাব কোথায় যে সাপ-ব্যাঙ আঁকব? শেষমেষ গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম আর মনকে বোঝালাম "ওরে পাগলা, তোর হাত তো আর গাছপাকা আম নয় যে, টিপলেই সাহিত্যরস চুঁইয়ে পড়বে, তারচেয়ে যা মনে আসে তাই লেখ; পত্রিকা সম্পাদকের, লেখা ঘোষবাবুর, তাহলে আমার চাপ কিসের?" 

"জয় মা ওলাইচন্ডী" বলে লিখতে শুরু করে দিলাম, আর আপনারাও এখন বোধহয় সেই লেখা পড়তে শুরু করেছেন (যদি সম্পাদকমশাই ছাপেন), আর মনে মনে আমার আর ঘোষবাবুর গুষ্ঠির মুন্ডপাত করছেন, তাহলে আগেভাগেই বলে দি এই লিখে আমার বিন্দুমাত্র দুঃখ নেই, অবশ্যি মধ্যবিত্তের একফোঁটা দুঃখের দামই বা কে দেয়? তবে এইকথাটা বলে রাখি ভবিষ্যতে যদি ঘোষবাবু ও এইরকম সম্পাদকের মিলবন্ধন ঘটে তবে কলম হাতে নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করব না....


(ক্রমশ...)
শুনছেন মশাই? গল্পটা কিন্তু শেষ হয়ে গেছে; যারা ভাবছেন, "এ কিরে? ক্রমশ লেখা রয়েছে যে, তার মানে পরবর্তী কোনও সংখ্যায় আবার এইরকম পাগলের প্রলাপ পাব", তারা সম্পূর্ণ ভুল করছেন। ক্ষেপেছেন নাকি মশাই, মধ্যবিত্ত হল কালীপটকার জাত, কখন পলতেয় আগুন ধরে যাবে কেউ জানে না। 


বি.দ্র-এই লেখার সমস্ত চরিত্র বাস্তবিক এবং জনৈক ঘোষবাবুর ডায়রি থেকে অম্লানবদনে ঝেঁপে দেওয়া। সত্যিই ঘোষকে ঘোষ না দেখলে কে দেখবে?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন