কোল্হাপুর ডায়েরী
কলিংবেলের আওয়াজ শুনে দরজাটা খুলতেই সূর্যর
সহর্ষ চিৎকার-
-"মিমি' এখানকার পাততাড়ি এবার গোটাও। একসপ্তাহের মধ্যে কোল্হাপুর শিফ্ট করবো আমরা।"
মিমির হাঁ-মুখটা বুজতে বোধকরি কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো আর সেই হাঁ করা মুখের দিকে চেয়ে মিটমিট করে হেসে চলেছে সূর্য।
-"মানেটা কি? বলা নেই কওয়া নেই 'ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে'!
ধুসস কি ব্যাপার খোলসা করে বলোই না!"
বছর দুয়েক হোলো মিমি সূর্য ওদের দুই পুত্রকন্যা সহ
পুণেতে এসেছে।অবশ্যই সূর্যের কর্মসূত্রে। এর আগে দীর্ঘ
আঠারো বছরের বিবাহিত জীবন কেটেছে বাংলার বূকেই।
সূর্য পেশায় মেটালার্জিষ্ট।পশ্চিমবঙ্গের একটা বিখ্যাত অ্যালুমিনিয়াম কোম্পানির একটি ইউনিটের সর্বোচ্চ আধিকারিক ছিল সূর্য। বছর তিনেক আগে সেই বেসরকারি কোম্পানিটি অন্য আরেকটি কোম্পানি
টেক ওভার করে।কয়েকমাস যাবার পরে ভারপ্রাপ্ত নতুন আধিকারিকরা এই ইউনিটটি বন্ধ করে দেবার সিদ্ধান্ত নেন। সূর্যকে বদলির প্রস্তাব দেওয়া হয় মধ্যপ্রদেশের চম্পা জেলায় অন্য একটি ইউনিটের প্রধান হিসেবে।
ওদের ছেলের তখন ক্লাস টেন। সামনে আই সি এস ই পরীক্ষা।মেয়ে ছোট ক্লাস ফাইভ। যেহেতু ছোটবেলা থেকেই ওদের কোন প্রাইভেট টিউটর ছিলোনা।মিমি আর সূর্য ই ওদের পড়ানোর দায়িত্বটা পালন করতো।
বদলি হলে সূর্যকে একাই যেতে হবে - এই টানাপোড়েনে যখন তারা ভীষণভাবেই দ্বিধাগ্রস্ত তখন ই পুণেতে কর্মরত মিমির ছোটভাই সূর্যকে পুণে চলে আসার প্রস্তাব দেয়।
সর্য দোনোমোনো করেছিলো। কিন্তূ মিমির প্রবল উৎসাহ আর আগ্রহে শেষমেষ বাংলার পাট চূকিয়ে একরকম হারা উদ্দেশে অনিশ্চিতকে বরণ করে নেবার একটা দুঃসাহসিক
সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলে তারা।
বদলির সিদ্ধান্ত মেনে না নেওয়ায় এবং ইউনিটটি বন্ধ হবার কারণে ছেলের পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের মুভ করার কোনো উপায় ই ছিলনা। আরো একটা কারণ ছিল। মিমির অ্যালায়ানস ফ্রাঁসেজে ফ্রেঞ্চ ক্লাসে সিক্স্থ লেভেল কমপ্লিট করার মাস দুয়েক বাকি ছিল। সব চুকিয়ে
পুণে আসতে বছরের মাঝামাঝি।
তারপর থেকেতো জীবনটা বল্গাছাড়া ঘোড়ার মত ঊর্দ্ধশ্বাসে দৌঁড়েই চলেছে। তার সাথে তাল মেলাতে গিয়ে মিমি দিশেহারা। পুণেতে কনসালট্যান্ট হিসেবে একটা কোম্পানিতে জয়েন করার তিনমাসের মধ্যে সূর্য বদলি হলো দিল্লী। দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে পুণেতে শুরু হলো মিমির চরৈবতি পর্ব। এই দু বছরে সূর্য কখনো দিল্লী কখনো গোয়া কখনো পুণে এভাবে চাকরির সাযুজ্য বজায় রেখেছে। আর মিমি পুণেতে থেকে গেছে ছেলে মেয়ের জন্য। সবে কাল ই ছেলের টুয়েলভের পরীক্ষা শেষ হ য়েছে।
এরমধ্যে সূর্য চাকরির সন্ধান চালিয়ে গেছে নিয়মিত। যেখানে একজায়গায় পরিবারসহ থিতু হতে পারে। আসলে সূর্য বরাবর ই ঘরকুনো বড় বেশী পরিবার ঘেঁষা।
ঘরে ঢুক ধপ্ করে সোফায় বসেই মিমিকে বললো-
'তোমায় বলিনি মিমি। কিছুদিন আগে কোল্হাপুরের একটি বড় কোম্পানির মালিক আমার সাথে যোগাযোগ করেছিলেন ওদের ফ্যাক্টরিতে জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে যোগ দেবার জন্য। সবটাই টেলিফোনিক ইনটটারভিউয়ের মাধ্যমে। অবশেষে সবকিছু ফাইনালাইজ
করে আজ ওরা অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাঠিয়েছে।' কোম্পানি রেন্টেড ফ্ল্যাট আর নিজস্ব ব্যবহারের গাড়ি ও দেবে সেই কোম্পানি। সাত দিনের মধ্যে জয়েন করতে
হবে। অতএব,' চলো মুসাফির বাঁধো গাঠরি।'
মিমির মাথায় এখন আর কিছুই ঢুকছেনা। ওর মনের ভেতর স্লাইড শো হয়ে তখন ভেসে চলেছে একটা অদেখা শহরের স্বপ্নে আঁকা কিছু ছবি। আবার নতুন জায়গা নতুন মানুষ আবার আরেক অনিশ্চিতের হাতছানি যা মিমিকে সারা জীবন অস্থির করে টেনে নিয়ে বেড়িয়েছে দেশ থেকে দেশান্তরের দিকে। সূর্য যখন কিঞ্চিৎ ইতস্তত করেছে মিমি অভয়দাত্রী হয়ে সাহস জুগিয়েছে। টালমাটাল সময়গুলোকে শক্ত হাতে ধরে ঢেউ সামলেছে একের পরে এক।
কোল্হাপুর সম্পর্কে মিমির জ্ঞান ছিলো ওই কোল্হাপুরী চপ্পল অবধিই। বালিগঞ্জ ফাঁড়িতে কোল্হাপুরী সেন্টার নামে জুতোর দোকানটা কোল্হাপুর নামটা সম্পর্কে অবহিত করেছিলো। ব্যস ওই পর্যন্ত ই। আর কোন কৌতূহল বা ধারণা কিছুই ছিলনা। এমনকি এখনো পর্যন্ত মিমির ধারণা নেই পুণে থেকে কোল্হাপুর কতটা দূর!
সূর্যর গলার আওয়াজে ছেলেমেয়েও পায়ে পায়ে বসার ঘরে। সবটাই শুনেছে তারা কিন্ত বিমিশ্র অনুভূতি তাদের দুজনের গলায়। ছেলে খুব খুশী। এমনিতেও ও এবার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চলে যাবে বাইরে। কিন্তু মেয়ে--!!!
এখানে দু'বছরে এখানকার স্কুল ও পরিবেশে অনেকটাই ধাতস্থ হয়ে গেছে সে। নতুন ভাষা মারাঠীকেও বেশ ভালোরকম করায়ত্ত্ব করেছে সে এই দুই বছরেই। এখানে নামী কনভেন্টে ভর্তি হবার সুযোগই শুধু সে পায়নি এখানকার স্কুলেও ভালো ছাত্রী হিসেবে স্কুলের সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে ফার্ষ্ট অথবা সেকেন্ড হয়েছে প্রতিটা পরীক্ষায়।
আবার নতুন স্কুলে নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার পরীক্ষা মেয়েটাকে ভীতচকিত করে তূলেছে।কিন্তু মেয়ে অসম্ভব বাবা ন্যাওটা। বাবা আবার একসাথে থাকবে এই আশ্বাসটুকু ভরসা করে তাই সেই ভীতিটুকু হজম করেছে চুপ করে বাবার কোলে বসেই।
রাতে সকলে ঘুমিয়ে পড়লে মিমি ডেষ্কটপ খুলে কোল্হাপুর শহরটার ইতিবৃত্ত পড়লো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে।
পুণে থেকে দুশো পঁচিশ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ পশ্চিম মহারাষ্ট্রের একটা ছোট্ট সুন্দর শহর হলো কোল্হাপুর। মূলত কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্রের সংযোগবিন্দু এই উপত্যকা শহরটি স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত মারাঠা সাম্রাজ্যের অধীনে ছত্রপতি শাহু মহারাজের স্বায়ত্ত্বশাসিত রাজ্য ছিল।স্বাধীনতার পরে এটি একটি জেলা হিসেবে পরিগনিত।সহ্যাদ্রি পর্বতমালার পূর্বদিকে অবস্থিত এই ছোট শহরটি কেবলমাত্র নান্দনিক সৌন্দর্যেই সমৃদ্ধ নয়।পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক দিক থেকেও এর তাৎপর্য অপরিসীম।
ইতিহাস প্রাচীন এই শহরটি রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল একসময়।মহারাণী তারাবাঈ কোল্হাপুর, কাগাল ও ইচলকরঞ্জি এই তিনটি পরগণা নিয়ে কোল্হাপুর রাজ্যটির পত্তন করেন।পরে উত্তরাধিকার সূত্রে ছত্রপতি শাহু মহারাজের হাতে এর শাসনভার অর্পিত হয়।
সূর্য উঠেছিল বাথরুমে যাবে বলে। মিমিকে ডেস্কটপের উপর ঝুঁকে বসে থাকতে দেখে মৃদু ধমক দিলো। রাত ও হয়েছে অনেক। কথা না বাড়িয়ে মিমি শুয়ে পড়ার আয়োজন করলো। যেটুকু পড়লো তাতে যাবার আকর্ষণ আরো প্রবল। বাকিটা গিয়েই নাহয় এক্সপ্লোর করা যাবে।
ক্রমশঃ
ছবি ১ঃ কোল্হাপুর লোগো
ছবি ২,৩ ঃ মহারাণী তারাবাঈ
ছবি ৪ঃচিন্ময় গনেশ
ছবি৫ঃ কোল্হাপুর প্রবেশপথের মূল ফটক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন