ফাত্রাতুন
"শিবে রুষ্টে গুরুস্ত্রাতা গুরুরুষ্টে ন কশ্চন:
ইতি কঙ্কালমালিনীতন্ত্রে..."
শেষটুকু উচ্চারণের আগেই প্রায় বিবর্ণ পাতা প্রথমে ঝাপসা আর তারপর- 'তুমি তো নারী, তোমার কবিতায় জলের অধিক কিছু থাকার ছিলোনা'। কে রুষ্ট হলো তার? জন্মইস্তক শিবপূজা করে আসছে প্রায় ভগ্ন, অশ্বত্থঘেরা দেউলঘাটে শ্রী, যে পুণ্যভূমি হালিশহরের গঙ্গাজলমৃত্তিকার ঘ্রাণের মধ্যে মিশে থাকেন মহাসাধকের বেড়া বাঁধার সঙ্গিনী লীলাবতী মহাকালী। লোকে বলে তারই অর্জন চট্টোপাধ্যায় বংশে তার বিবাহ, তিন পুত্রের সর্বকনিষ্ঠটির বধূ হলেও তারই হাতে দেড় শতাধিক বৎসর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত পঞ্চলিঙ্গের (বাণেশ্বর, চন্দ্রমৌলীশ্বর, রত্নেশ্বর, রামেশ্বর, অর্ধনারীশ্বর) নিত্যপূজার দায়িত্ব কমলিনী মারফত এসে পড়া। সেই রাতেও কি আরিদ্রা নক্ষত্র হেসেছিলো? জানা নেই। এই প্রাপ্তির লৌকিক ব্যাখ্যা চন্দ্রস্রোতে ভেসে যায় তার গুরুসম্বন্ধীয় অলৌকিক সৌভাগ্যে। সপ্তমবর্ষীয়া কন্যাটি দীক্ষা পেয়েছিলো স্বয়ং শ্রী সারদা মায়ের সাক্ষাত গৃহীশিষ্য শ্রী লাবণ্যকুমার চক্রবর্তীর থেকে। পরমহংসের নশ্বরতা বিষয়ে যারা চর্চা করে থাকেন তাদের কাছে পরিচিত "যুগজ্যোতি" ও "ঠাকুরের বাউল" সহ বহু গ্রন্থের রচয়িতা, প্রেমেশ মহারাজের প্রিয়তম কবি এই সাধকের নাম। শৈবলিনীও বিস্মিত ছিলেন বরাবর এত কিছুর পরেও শ্রীয়ের অন্তর্মুখীনতায়, অধ্যাত্মের পারদভারকে স্ফটিকের স্বচ্ছে নীরব জ্বালিয়ে রাখার দক্ষতায়। সন্তানকে পার্থিব প্রাপ্তিতে সন্তৃপ্ত দেখে সন্তুষ্ট হওয়ার সাধারণ মা তিনি ছিলেন না। ফলত, যোগীচক্ষুর বিচলনের প্রয়োজন পড়েনি। নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন মেয়ে তার শান্তিসূত্রের সমীকরণ নিজেই এঁকে নিচ্ছে বলে। নীলাদ্রীকে দেখে তার নিয়তিতে বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছিল- "বারাণস্যাং তু বিশ্বেশম ত্র্যম্বকং গৌতমীতটে" । তিনি মেনকা ছিলেন না কিন্তু একথাও তো সত্য পার্বতী শুধুমাত্র কিছু পুরাণমতের নাম। শক্তি ও তার আধার প্রসঙ্গে পুঁথি মানা হলে শেক্সপিয়র কেন নয়? "What's in a name?"
সেই শ্রী আজ অন্তর্দ্বন্দ্বে বিক্ষত। কোনো অসতর্ক মুহূর্তে কি বাণলিঙ্গ আঘাত পেয়েছেন? সদাশিবের অত্যন্ত উগ্ররূপ এই উপবৃত্তাকার স্বয়ম্ভু লিঙ্গ। রুদ্রজ ব্রাহ্মণেরাও অতি সন্তর্পণে তাঁকে আরাধনা করে থাকেন। কিন্তু তবুও তো শ্রীয়ের গুরুদাদু আছেন। সে জানে শ্রীশ্রীমা নহবতখানায় থাকাকালীন একদিন তাঁর স্বপ্নধ্যানে পিঙ্গলজটা দুলিয়ে বাঘছাল পরা এক শুভ্রকায় শিশু দৌড়াতে দৌড়াতে এসে নালিশ জানিয়েছিলো- "আমায় ফেলে দিয়েছে"। মা তাকে কোলে বসিয়ে আদর করে বুঝিয়ে শান্ত করেছিলেন এই বলে যে "ইচ্ছে করে তো করেনি বাবা, সবই তো তোমার সন্তান, অপরাধ নিতে নেই"। তাহলে? কীসের অপরাধে তাহলে এই শূন্য বাড়িতে অধিকতর শূন্যতা ধারণ করে তার তাকিয়ে থাকা? আজ ষোলোদিন পেরিয়ে গেলো নীলাদ্রি নার্সিংহোমে। স্বধা রোজ ছয় ঘন্টার জন্য বাড়ি ফেরে। মেয়ের মুখ দেখে সে কোনো প্রশ্ন না রেখেই বুঝে যায় অমাবস্যার দেরী নেই। তাহলে কি... তাহলে কি... সে নিজেই হোতা, অধ্বর্যু ও উদ্গাতা এই আকস্মিক 'যজ' ধাতু ', 'ঞ' প্রত্যয়ের অবশ্যম্ভাবী আবির্ভাবের? আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে যে সূক্ষ্ম চিড় ধীরে মহাখাত হয়ে আলাদা দুটি সভ্যতায় পরিণত করলো তাকে ও নীলাদ্রীকে, সে কি জেন হ্যারিসনের তত্ত্বকেই প্রতিষ্ঠা দিলো তবে?
"Collectivity and emotional tension, two elements that tend to turn the simple reaction into a rite"
শীতল লাভার মতো তার অভিমানসমূহ এভাবে বধযোগ্যতা দিলো নীলাদ্রীকে?
চন্দ্রগর্ভের ক্ষতগুলিকে কলঙ্ক নামে রোম্যান্টিসাইজ করাই প্রথা। সেইহেতু এই প্রশ্ন কখনো ওঠেনা যে শুধুমাত্র শ্রেষ্ঠ সুন্দরী তথা পাণ্ডবশক্তির কেন্দ্রস্থল বলেই দ্যূতসভায় রজস্বলা পাঞ্চালীকে বিবস্ত্র করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিলো নাকি কেশবসখী হওয়ার দায়ে তাঁর জন্মলগ্ন থেকে বিবাহ- প্রতি পলেই কুরুক্ষেত্র? শুধু কৃষ্ণা তো নন, অজস্র উদাহরণ রয়েছে যেখানে ঈশ্বরনির্ভরতাই কারণ জীবনব্যাপী দুর্ভাগ্যের। "দুঃখ তাঁর দয়ার দান" উচ্চারণকারী গান্ধারী কি বাসুদেবকে অভিসম্পাত দানে বিরত থাকতে পেরেছিলেন শেষতক? শ্রী তার জীবনের প্রেক্ষিতে এই সূত্রের বহু সম্ভাব্যতা খোঁজার চেষ্টা করেছে এতো বছর ধরে। সে শৈবলিনীর মতো বৈরাগ্যপ্রতিমা নয়, কমলিনীর মতো সিংহতেজাও না। এই দুইজন ব্যক্তিগত আদর্শকে যাপনে পরিণত করতে পেরেছিলেন কারণ ভাগ্য তাঁদের যে মুক্তি দিয়েছিলো তাতে তারা মেধা ও কাঠিন্য মিশিয়ে নিস্তেল স্বাধীনতার অণ্বেষণে নিজেদের ব্যস্ত করে তুলেছিলেন। অথচ শ্রী? অধ্যাত্মের তীব্র ফল্গু তার মধ্যে প্রবহমান জেনেও তার মা তাকে পাত্রস্থ করেছিলেন অতিরিক্ত দ্রুততায়। যতই শৈবলিনী দাবী করুন নীলাদ্রি সাধারণ পুরুষ নন কিন্তু একমাত্র নিজস্ব মায়াবিশ্বাস ছাড়া এ প্রমাণ তিনি কোথায় দিয়েছিলেন শ্রীকে যে তার জন্য নির্বাচিত জন শর্ব? শ্রী যা পেয়েছে তাতে যদি নীলাদ্রি অনঘও হন তবুও তার রূপ মণিকর্ণিকায় শবের কানে তারকব্রহ্ম নামদায়ী কামারী, কৈলাসে উমার পুরুষ সোম নন। রাগ-রাগিণী সামপ্রিয় নীলাদ্রীর দুর্বলতা অথচ কখনো শ্রীকে শুনতে চাইলেন না তো তিনি। প্রাইমারি থেকে উচ্চবিদ্যালয়- যে শ্রীয়ের দিকে তাকিয়ে হেন প্রাণী নেই অবাক হতোনা গন্ধর্বসম আলোয়, কখনো তাকেই দেখার সময় নীলাদ্রীর চোখে তো মুগ্ধতার অঞ্জন লাগলোনা। কেন? অথচ নীতিজ্ঞান ও চরিত্রে নীলাদ্রীতুল্য পুরুষ দুর্লভ। এক্ষেত্রে তিনি অবিসংবাদী অজাতশত্রু। তাহলে কি অতিশৈশব থেকে ঈশ্বরবোধের যে বেদী নির্মাণ করেছিলেন শৈবলিনী তাইই শ্রীয়ের বোধ ছাপিয়ে শরীরী উপত্যকাকে দেবজ অংশ করে তুলেছিলো যাকে ঘিরে মন্ত্রোচ্চারণ করা যায় কিন্তু অন্তরঙ্গে আনার স্পর্ধা দেখানো যায়না? অগ্নিকে আলিঙ্গন কেই ই বা করেছে কোনদিন? তাহলে কি যে অনীশ্বরকে ভিত্তি করে কমলিনী ও শৈবলিনী সাম্রাজ্যজয়সুলভ সুখলাভ করেছিলেন সেইই শ্রী ও নীলাদ্রীর মধ্যবর্তী আলোকবর্ষ ব্যবধানের মূল রহস্য?
স্বধা পৃথিবীতে আসার আগে ও পরে, মাত্র একবার, প্রথম ও শেষবারের মতো নীলাদ্রীকে আঘাত করতে চেয়েছিলো শ্রী, যদি রূপকথার মতো গুহামুখ থেকে পাথর সরে গিয়ে জন্ম নেয় নদী না হোক অন্তত কোনো সিল্করুট। সে তখন দ্বিতীয়বারের জন্য সন্তানসম্ভবা। ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ তখনো নিষিদ্ধ না হওয়ায় কে আসবে সে জানত।
-- "পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা"
যাক, তোমাকে অন্তত এই যুক্তিতে বিয়েতে রাজি করানো গেছিল"
মুহূর্ত কয়েকমাত্র। উত্তর এসেছিল...
-- "নির্বাচন করো শ্রী। আমি তোমায় চব্বিশ ঘন্টা দিলাম। তুমি এই সন্তানকে জন্ম দেবে কিনা, দিলে আমায় সারাজীবনের জন্য হারাবে। যদিও আমি আমার জীবদ্দশায় তোমার কোনো দায়িত্ব কর্তব্যেই ত্রুটি রাখবো না সে তুমি যে সিদ্ধান্তই নাও। স্বামী কিনা, প্রেমিক তো নই"
পরবর্তী ইতিহাস কোনো পাঁচালী নয়। গর্ভস্থ পুত্রটি হত্যা হয়েছিলো। আর ঠিক সেইদিন থেকে স্বধা দেখেছিলো কীভাবে একই রাতের আকাশের নিচে একই যুদ্ধক্ষেত্রে অন্ধ নৈশব্দ্য নিয়ে পাশাপাশি অবস্থান করে দুই শত্রুশিবির, পরের কোনো সূর্যই যেখানে এমন আসেনা যখন শঙ্খনাদে রণ ঘোষিত হবে। শুধু অস্ত্রেরা নিপুণ থেকে নিপুণতর হতে থাকে, কৌশলেরা নিখুঁত থেকে নিখুঁততর, লক্ষ্যরা তীক্ষ্ থেকে তীক্ষ্তর আর দূরত্ব... অনতিক্রম্য।
স্বধা শুধু ভেবে চলে মাধবের 'শত্রু' সম্বন্ধীয় শ্লোকটি। কী প্রবল পারস্পরিক সংবেদী হলে দুইটি অস্তিত্ব এইভাবে নিজেদের উন্মাদ ক্ষয়কে শক্তিস্তম্ভে প্রতিস্থাপিত করতে পারে? সমর্পণ নয় অথচ প্রত্যাহারও নৈব নৈব চ। যদি এ প্রেম না হয় তাহলে আজ অবধি পৃথিবীতে একটিও কবিতা লেখা হয়নি।
অসাধারণ আলোচনা। সমৃদ্ধ হলাম। ঐশ্বরিক এক মেধা'র পক্ষেই এ লেখা রূপায়িত করা সম্ভব।
উত্তরমুছুনঅসাধারন লেখা।
উত্তরমুছুনTranscendental... realization reaching to your soul Uma if written from heart...
উত্তরমুছুনএই বাংলায় এই অধ্যাত্মে এই লেখা অনির্বচনীয়। সুবোধ ঘোষের ভারত প্রেমকথার ভাষা, তারাশঙ্করের চিন্তা, ambience, যা হারিয়ে গিয়েছিল ফিরিয়ে আনলে! প্রাচীন ভাষায় আধুনিক চিন্তার আধার কিনা শিবকথা? অহো!
উত্তরমুছুনখুবই চমৎকার লেখা। আমার মুগ্ধতা জানাই।
উত্তরমুছুন