রবিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২২

সৌমী আচার্য্য

 

                                 

   












শ্রাবণের ধারার মত
(পঞ্চম পর্ব)


তাজপুরের রিসোর্টটি বেশ সাজানো গোছানো।ঊশ্রী এখনো বেহুশের মতো ঘুমোচ্ছে।ওর কপালে আলতো করে হাত রাখল দেবপ্রিয়া।ঘুমোক আরেকটু।এই ছোট্ট প্রাণটায় আঘাত তো কিছু কম নয়।ভোরের আলতো আলোর মায়ায় মন যেন জুড়িয়ে যেতে লাগল।অথচ গোধূলি মাসি বুকের ভেতর আস্ত সূর্য বসিয়ে দিয়েছে।সবাইকে আঘাত দিয়েছে দেবপ্রিয়া?বরুণ চিরকাল তার অন্ধ ভক্ত ছিল।তার লেখার একনিষ্ঠ পাঠক।আকারে প্রকারে ইঙ্গিতে সরাসরি সব রকম ভাবে মুগ্ধতা জানিয়েছে।আর তারপরেও ভয়ংকর ঘটনা ঘটিয়েছে।আর অনুজ সে তো থেকেও ছিলনা।ঊশ্রীর পাঁচ বছরের জন্মদিনেই অনুজকে সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল দেবপ্রিয়া।অনুজ কথাটা শুনে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি মন দিয়ে কিছু পেপারস্ দেখছিল।দেবপ্রিয়া বহুক্ষণ অপেক্ষা করে ঘরে ফিরেছে ঊশ্রীর কাছে।খানিকপর অনুজ ধীর পায়ে বেডরুমে এসে বলে,'ঠিক আছে আজকের রাতটা থাকছি,আগামীকাল চলে যাব।তুমি উকিলের সাথে নিশ্চই কথা বলেছো।মিউচুয়াল ডিভোর্স ফাইল করো আমি সই করে দেবো।'এতটা নির্বিকার হতে পারে কোনো মানুষ!দেবপ্রিয়া ভাবতে পারেনা।অনুজ পরদিন চলে গিয়েছে।আর কখনো বাড়িতে ফেরেনি।কোর্টে এসে সই করেছে চলে গেছে।একবার কোনো খবর জানতে চায়নি ঊশ্রীর বা মায়ের।ডিভোর্সের পর বরুণ এগিয়ে আসার রাস্তা খুঁজেছে সব রকম ভাবে।মাত্র একদিন দেবপ্রিয়া দুর্বল হয়েছিল।সেও তো মানুষ সবাই কি সেটা ভুলে গিয়েছে।ঊশ্রী ভাইরাল ফিবারে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিল সে সময়, এদিকে দুটো বড়ো হাউসের লেখা জমা দিতেই হবে।রাত জেগে জেগে মাইগ্রেনের পেন বেড়েছে।ঠিক তার মধ‍্যেই ওর মা দিপালীর সিঁড়ি থেকে পড়ে বাঁ দিকের ফিমার ভেঙে গেল।অসহায় দেবপ্রিয়ার পাশে বরুণ এসে দাঁড়াল ত্রাতার মত।লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ডাক্তার, নার্সিংহোম, ওষুধ বাড়ির দায় দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিল।ক্লান্ত ধ্বস্ত দেবপ্রিয়া।

-এভাবে একা ছাদে দাঁড়িয়ে আছ যে?কী হয়েছে কাঁদছ নাকি তুমি?প্রিয়া?

-নাহ্ আমার কাঁদবার অধিকার নেই বরুণ।একজন মানুষ সারাজীবন বাইরের টানে ঘরের দিকে ফিরেও চাইল না।আমার ভালোবাসা, ইচ্ছে,জীবন সব একা গহীন রাতের তারা হয়ে জেগে রইল।কোণঠাসা হতে হতে ছেড়ে যাবার কথা উচ্চারণ করলাম কী করলাম না,সব শেষ হয়ে গেল।আমার হাত শূন‍্য হয়ে গেল।তবু আমায় কাঁদতে নেই।মেয়ে আর মা এই তো সম্বল।দুজনাই অসুস্থ অথচ আমায় কাঁদতে নেই।

-এমন ভাবে বলছো কেন প্রিয়া?

-কারণ আছে বরুণ,আজ তথাকথিত পড়াশোনা জানা সংস্কৃতি মনস্ক এক মানুষ আমায় বলেছেন,'তোমার মনটা খুব স্ট্রং দেবপ্রিয়া,অন‍্য কোনো মেয়ে হলে কেঁদেকেটে শেষ হয়ে যেত।ভালো ভালো।যে ভাবে লিখে যাচ্ছো মনটা পাথর না হলে এ পরিস্হিতিতে লিখতে পারতে না।অবশ‍্য হ‍্যাঁ রবীন্দ্রনাথ পারতেন।' ভাবতে পারছ আমি কতটা নির্দয়?

কথাটুকু শেষ করতে পারেনা ফুলেফুলে ওঠে।ভীষণ আবেগ পথ খোঁজে বাইরে বেরিয়ে আসার।বরুণ এগিয়ে এসে মাথায় হাত রাখে।আঙুল দিয়ে মোলায়েম ভাবে মাসাজ দিতে থাকে।

-মানুষ আঘাত কাকে করে জানো?যাকে সে ঈর্ষা করে,তার মতো হতে চায় কিন্তু তার সাধ‍্যে কুলায় না।আর তুমি!তোমার মেধা ঈর্ষণীয় তোমার রূপ লোভনীয়।অথচ তোমাকে কেউ ছুঁতেও পারে না।তো তোমাকে আঘাত করবে না?

বরুণের আঙুলের ছোঁয়া ধীরে ধীরে নেমে আসছে ঘাড় বেয়ে।বহুদিন পর সুখে জারিত হচ্ছে দেবপ্রিয়া।পদ্মকুঁড়িতে মৃদু সুখ কাঁটা।ডুবছে জাগছে।বরুণ দীর্ঘদিনের অপেক্ষা প্রবল আশ্লেষে পূর্ণ করতে লাগল।ভেসে গেল একটা রাত।ছাদের গন্ধরাজ ফুলগাছটা সাক্ষী কী ভীষণ যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়েছিল দেবপ্রিয়া।


-চলে যাও বরুণ প্লিজ।এসব আমি চাইনি।ছিঃ ছিঃ।

-কেন প্রিয়া?আমি তো কাওকে বঞ্চনা করছি না।তোমার কাছেও কিছু চাইছিনা।তোমার পাশে থাকতে চাই।তোমার সঙ্গ চাই।তোমার মনন,মেধা আমার বেঁচে থাকাটা সুন্দর করে।প্লিজ প্রিয়া।

-নাহ্ বরুণ!জোনাক আমার পিসতুতো বোন কেবল নয়,ও আমাকে ভীষণ মান‍্য করে আমি কিছুতেই ওকে ছোট করতে পারবো না।প্লিজ বরুণ।আর এগোনোর চেষ্টা করো না।

এসব ভাবতে ভাবতে কেঁপে উঠল দেবপ্রিয়া এরপরেও বরুণ কতবড়ো সর্বনাশে মেতে উঠেছিল।এরপরেও গোধূলিমাসির মনে হয় সেই সবাইকে আঘাত দিয়েছে।এই কি জীবনের পরিহাস!









কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন