শ্রাবণের ধারার মতো
পর্ব-৪
মাদিকেরীর বুকের ভেতর পাহারের কোলে ছোট্ট জনপদ কাদাগাদাল।কফি বাগানের মাঝেমাঝে পাহাড়ের ঢালে ছোটছোট ছিমছাম বাড়িঘর।সহজ সরল মানুষজন।সকলেই প্রায় কর্ণাটকের আদিবাসিন্দা।মহেশ এখানে মানিয়ে নিয়েছে খুব ভালো ভাবে।গ্রামের সকলেই তাকে বিশেষ ভালোবাসে।সদ্য গড়ে ওঠা রিসর্ট,হোমস্টে,হোটেল সবকিছুর উপর তার কড়া নজরদারি।কোনভাবেই অঞ্চলের স্বাভাবিকতা নষ্ট হতে দেবেনা।নেচার মাদার এনজিওর কর্মী হিসেবে বছর তিনেক হল এখানেই রয়েছে।ধীরে ধীরে নিজের আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে।যে ছোট্ট বাড়িটার একতলায় মহেশ থাকে তারপাশেই কুভান আলভার বাগানবাড়ি।সেখানেই আজ বিকেলে নিমন্ত্রণ।এমনিতে এসব নিমন্ত্রণ এড়িয়ে থাকতেই স্বচ্ছন্দ সে তবে কুভানকে এড়িয়ে যেতে পারেনা।প্রভাবশালী বলেই নয় বছর সত্তরের মানুষটা জ্ঞানের ভাণ্ডার।বিশেষ স্নেহ করেন তাকে।সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ ওর বাড়িতে গিয়ে উপস্হিত হতেই দেখল গোটা বাগানটা সাদা মলমল কাপড়ে মুড়ে হালকা বেগুনি অর্কিডে সাজানো হয়েছে।মহেশ হাতে করে বই নিয়ে এসেছে।কালেকশান অফ্ ও হেনরি।কুভান স্মিতমুখে বইটা বুকে চেপে ধরলেন।
-এরচেয়ে বড়ো কিছু নেই রয়।তুমি ভেতরে এসো একজন তোমার সাথে আলাপ করতে আগ্রহী।
ঘরের ভেতর খুব লো ভল্যুউমে সারেঙ্গী বাজছে।মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে আছে ঘরটায়।কুভান কাওকে চাপা গলায় ডাকলেন।সেই ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এল হলদে জমির উপর ছোট ছোট লাল বুটিদার শাড়ি,লাল ব্লাউজ আর সাদা ফুলের মালায়,মুক্তোর সেটে এক নারী। মহেশ খানিক মুগ্ধ না হয়ে পারলনা।শুভেচ্ছা বিনিময় ও নাম জানার পর ধীরে ধীরে ত্রিচি, মহেশ গল্পে মেতে উঠল।বাগানের মাঝখানে রাখা ছোট্ট গোল টেবিলে কথোপকথন এগিয়ে চলল।সাথে কন্টিনেন্টাল খাবারের সমাহার।
-আপনাদের রাজ্যের দার্জিলিং আমার সবচে প্রিয়।একাধিক বার গিয়েছি কর্মসূত্রে।
-হ্যাঁ দার্জিলিং অসামাণ্য তবে পারলে একবার পুরুলিয়া,বাঁকুড়া ঘুরে আসবেন।ভালো লাগবে।
-আমার ইচ্ছে আছে।বিশেষ করে লাল কাঁকুড়ে মাটির জৌলুস দেখাটাই উদ্দেশ্য।আপনার নানা রকম কাজকর্মের প্রশংসা শুনতে পাই মিস্টার রয়।তাই আমি সরাসরি একটি প্রস্তাব আপনাকে দিতে চাই।
-কী বিষয়ে?
-কুভান একটি ইকো রিসোর্ট চাইছেন দুবরা এলিফ্যান্ট ক্যাম্পের কাছাকাছি।আপনি আমাদের উপদেষ্টা মণ্ডলীতে যোগ দিন।আপনার সাজেশান অনুযায়ী আমরা রিসোর্টটিকে সাজাতে চাই।
মহেশ ত্রিচির চোখে চোখ রেখে বুঝতে চাইল কী উদ্দেশ্য এই নারীর।ঠিক তখন সামাণ্য ঝুঁকে হাত ধরে বলল,'মহেশ আমরা সত্যিই চাইছি দুবরা ইন্টারন্যাশানাল পরিচিতি পাক।'মহেশ উঠে দাঁড়াল।গভীর খাঁজের অমোঘ আকর্ষণ সহজেই এড়িয়ে বলল,'ম্যাডাম ত্রিচি,আমরা চাইছি দুবরা ক্যাম্পে হাতিদের সুরক্ষা আরো বাড়ুক।দর্শকের চাপ কী করে কমানো যায় সেটাই আমাদের লক্ষ্য।আচ্ছা চলি ভালো লাগল আলাপ হয়ে।ভালো থাকবেন।'চলে যাওয়া মহেশের পায়ের রেখায় চোখ রেখে কুটিল হাসল ত্রিচি।দূর থেকে মহেশের কুভানের সাথে করমর্দন দেখে মোবাইলটা হাতে তুলে নিল।টেক্সট করল,'ইউ আর রাইট হিয়ার হি ইজ!অনুজ।'
------------------------------ ------------------------------ --
চন্দ্রনাথ আদিত্যর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া বাঁকা হাসিল।দই চিঁড়া কলা ভালো করিয়া মাখিয়া বৃহৎ একখানি গ্রাস মুখ পুড়িয়া চকাম চকাম আওয়াজ বজায় রাখিতে রাখিতেই কথা বলিতে শুরু করিল।
-তুমি বাপু স্ত্রী লোককে কিঞ্চিৎ অধিক গুরুত্ব দিয়া থাক।আমার শ্যালিকার সহিত সারাদিনে যে পরিমাণ বাক্যব্যয় করিয়া থাক তাহা দৃষ্টিকটূ।
আদিত্যনাথ হতভম্ব হইয়া কহিল,'এ কী রূপ দোষারোপ।তোমার শ্যালিকাটিই বরং পায়ে পায়ে ঘুরিয়া বেড়ায়।সোহাগের কথা শুনিতে চাহিয়া ব্যতিব্যস্ত করিয়া তোলে আর তুমি কিনা চন্দ্র আমাকে দুষছ!'
-আহা চটো কেন?আসলে অমরকন্ঠক হইতে আসিয়া ইস্তক তুমি ব্যাকুল হইয়া রহিয়াছো।বিশেষ করিয়া স্ত্রীরত্নটির জন্য বোধকরি মন উচাটন হইয়াছে।তাহাই স্বাভাবিক।তুমি বরং কয়দিন বাড়ি হইতে ঘুরিয়া আইস।আমি আবার দিন পাঁচের ভিতর জয়পুর যাত্রা করিব ব্যবসাটিকে আরো ঢালিয়া সাজাইতে পারিলে তোমার কর্জটিও চুকাইতে পারি।
আদিত্য শেষের বাক্যগুলি শুনিয়া যারপরনাই অসন্তুষ্ট হইল কিন্তু চন্দ্রনাথকে কঠিন কথা শোনানোর হিম্মত তাহার কোনদিন হয় নাই।বরং খানিক চুপ করিয়া থাকিবার পর তাহার মনে হইতে লাগিল,চন্দ্রনাথকে সে হয়ত না বুঝিয়া কখনো আঘাত করিয়াছে তাই সহসা কর্জ শোধ করিবার প্রসঙ্গ আসিয়া পড়িল।বসারঘরটিতে চন্দ্রনাথের ফলার খাইবার আওয়াজ ব্যতীত অন্যকোন শব্দ নাই।আদিত্য অনেক সময় চুপ করিয়া থাকিল।তারপর কথা বলিয়া উঠিল।
-চন্দ্র তোমার আপত্তি না থাকিলে আমি জয়পুর যাত্রায় তোমার সঙ্গী হতে চাই।
ডানহাতের কনুই পর্যন্ত মিষ্টি রস গড়াইয়া যাওয়ায় সেই রস জিভ দিয়া চাটিয়ে লইবার কাজটির অবসরে এক ঝলক আদিত্যকে দেখিয়া চন্দ্রনাথ বলিল,'সে তো আমার পরম সৌভাগ্য।তবে কিনা মহিলা মহল তোমাকে ছাড়িতে রাজি হইবে কিনা সেটি বিচার্য।তোমার যত্ন আত্তি করিয়া তাহারা সবিশেষ সুখ লাভ করেন কিনা।'আদিত্য বুঝিল গতরাতে চন্দ্রর স্ত্রী রুক্মীনি তাহার খাদ্যের প্রতি অধিক মনোনিবেশ করিবার কারণেই চন্দ্র তাহার সহিত মশকরা করিতেছে।তবু সে বিবেচনা করিল,রাগ করিয়া ফল কী,বরং গৃহে প্রত্যাবর্তন করিয়া সকলের সহিত সাক্ষাৎ করা ভালো হইবে।সে উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল,'চলি চন্দ্র জয়পুর যাত্রার দিনক্ষণ ঠিক করিয়া খবর পাঠাইও।'চন্দ্রনাথ উদাসীন মুখ বলিল,'গৃহে যাইতেছ যাও সোহাগবালার খপ্পরে নিজেকে বাঁধিয়া ফেলিও না।অতি কষ্টে মুক্তি পাইয়াছ,ভুলিও না।'সোহাগবালার নামটি চন্দ্রর মুখে শুনিয়া আদিত্যর বুকটা মোচড় দিয়া উঠিল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন