শ্রাবণের ধারার মত (পর্ব-৬)
গৃহের দিকে আসিতেই আদিত্যনাথ প্রথম বাঁদরলাঠি গাছটির দিকে চোখ ফেলিয়া মুগ্ধ হইয়া গেল।আহা কী করিয়া যে এমন সুন্দর ফুল বাংলা সাহিত্যে স্হান পাইল না কে জানে?প্রকৃতি যে কত সৌন্দর্য অকৃপণ ভাবে বিলাইয়াছে তাহা গুণিয়া শেষ করা যায় না।কী মনে করিয়া আদিত্য কয়েকখানি ফুল পাড়িয়া লইল তাহা বলা মুশকিল।গৃহে প্রবেশ করিয়াই মোতির মার সহিত সাক্ষাৎ হইল।আদিত্যকে দেখিয়া তাহার মুখখানি সহসা আলোকিত হইয়া উঠিল।
-ছোটখোকা এয়েচ?আহা বাছার মুকখানা যে শুকিয়ে গিয়েচে।যাও মার সাতে দেকা করে উপরে যাও।
আদিত্যর হাতের ফুলগুলিকে মোতির মা লক্ষ্য করিল না দেখিয়া সে খানিক বিচলিত হইয়া বলিল,'ফুলগুলি কেমন মোতির মা?' হাসি চাপিয়া সে বলিল,'ভালোই তো যাও ভেতরে যাও।'প্রকৃতি সম্পর্কে মানুষের এই উদাসীনতা মোটেই পছন্দ করিতে পারেনা আদিত্য।এই রূপ রস আস্বাদন করিতে অধিক শিক্ষার কী প্রয়োজন?আসলে অধিকাংশ মানুষের বাঁচিয়া থাকাটা আদতে পশুপাখির মতোই বাঁচিয়া থাকা।গভীরতা নাই,প্রেম নাই,দর্শন নাই।এমনকি চন্দ্রনাথের কিছু বোধ আদিত্য ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারে না।মাস ছয়েক আগে একদিন সোহাগের সহিত সাক্ষাতের সময় চন্দ্র কী এক কথার পৃষ্ঠে মুখ বাঁকাইয়া বলিয়াছিল,'বৌঠান তোমার ন্যায় স্বামী লইয়া, সাহিত্য লইয়া সময় অতিবাহিত করা বা কল্পনায় ভাসিয়া যাইবার মতো সৌভাগ্য অথবা অভিপ্রায় সকলের থাকে না।আমাদিগের আবার সাংসারিক বিষয়ের উপরেই অধিক টান।'সোহাগ এরূপ কঠিন কথায় আঘাত পায়।মুখ কালো করিয়া কহিয়াছিল,'তবে যে আপনি আপনার বন্ধুটিকে কেবলি দেশ ভ্রমণে বাহির হইতে প্ররোচনা প্রদান করেন তাহাও কী সাংসারিক কর্ম?'চন্দ্রনাথের রক্তিম মুখমণ্ডল,কম্পিত ওষ্ঠ আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস জানাইতেই আদিত্য পরিবেশ শান্ত করিবার অভিপ্রায়ে বলিয়া বসিল,'দেখ সোহাগ যে যাহার মত করিয়া সঠিক।আর তাহা ছাড়া চন্দ্র আমারে বাড়ির বাহির করিতে প্ররোচনা প্রদান করে নাই কখনো। প্রকৃতি নিজেই সেই কাজটি করিয়াছে।'সোহাগ তীব্র বিদ্বেষে দৃষ্টিপাত করিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গিয়াছিল।এই সকল অকারণ কথাগুলি ভাবিতে ভাবিতে কখন যে দোতলার বারান্দায় উপস্হিত হইয়াছে তাহা আদিত্য খেয়াল করিতে পারে না।দুপুরের রোদ মরিয়া আসিয়াছে,আকাশের কোলে কালবৈশাখীর ঘনকৃষ্ণ মেঘখানি হাতছানি দিতেছে।এমন সময় হাসির মৃদু মধুর শব্দে আকৃষ্ট হইয়া ডান পার্শ্বের ঘরখানিতে উঁকি দিয়া স্তম্ভিত হইয়া গেল আদিত্য।যাহা দেখেতেছে তাহার অর্থ খুঁজিয়া না পাইয়া ডাকিয়া উঠিল,'এ সব কী সোহাগ?'
------------------------------ ------------------------------ --
-গোধূলিকাকিমা ঠিক কী বললেন তোমায় ফোনে?সেই থেকে গুম মেরে রয়েছ যে?
মরুণকিশোর দুহাতে চুলমুঠি করে ধরে খানিক বসে রইল।তারপর একটু ম্লান হেসে বলল,'একটা রামধনু রঙা অতীত পথ খুঁজছে মিষ্টি।আর কিছু না।'
-দেখ,খবরদার বলছি আমার সাথে হেঁয়ালি করবে না।
-এই দেখ হেঁয়ালি করলাম নাকি।সত্যি বলছি।
মিষ্টি অত সহজ মেয়ে নয়।নাম মিষ্টি হলেও মনে খটকা লাগলে যুতসই উত্তর না মেলা পর্যন্ত কাউকে তিষ্ঠতে দেয় না।মরুণকিশোর ততধিক সরল।ঠিক যেন সকালের প্রথম আলো।এমন নরম এমন পবিত্র যে কিছু দিয়েই তাকে ময়লা করা যায় না।মিষ্টি নানা প্যাঁচের প্রশ্ন শুরু করলে সে বোকার মতো হাসে।
-ঐ যে গো আমাদের ছোটবেলায় হত না সবাই মিলে বাসে করে ঘু্রতে যাওয়া!একবার তেমন একটা বেড়াতে যাওয়া হল পুরীতে।বিশাল বাসে বাহান্ন জন যাত্রী।আমার চোখ যা দেখে তাতেই অবাক হয়ে কেবলে যায়।পুরীর মন্দিরে গিয়ে কী যে হল মনে পড়ে গেল তাঁকে।
-কাকে?
-শ্রীচৈতণ্য মহাপ্রভুকে।কী যে হল মনে হল আমায় খুঁজে বার করতেই হবে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে তাঁকে।শুরু করলাম খোঁজা।আর পরেরদিন পেয়েও গেলাম।
-কাকে?
-একটা মেয়েকে।ভীষণ গম্ভীর।চোখে চশমা আঁটা।সে যে ঠিক কেমন সুন্দর তোমায় বোঝানো মুশকিল মিষ্টি।সে সরস্বতী নাকি অপ্সরা?সূর্য নাকি চন্দ্র?সমুদ্র নাকি নদী?শুধু এটুকু জেনে রাখো তাকে যে একবার দেখেছে সে কোনোদিন ভুলতে পারবে না কিছুতেই নয়।আমাকে গম্ভীর মুখেই বলল,'গতকাল থেকে দেখছি কিছু খুঁজছ,কী খুঁজছ বলো,সাহায্য করতে পারি।'আমি ভয় পেয়ে ছুট্টে পালিয়ে গেলাম।
-পালিয়ে গেলে?কেন?তোমার তখন কত বয়স?একটা মেয়েকে ভয় পেলে?
-বয়েসটাই ভয় পাবার মত ছিল যে।সতেরো অথবা আঠারো।কিন্তু তুমি কি ভাবলে সে আমায় ছেড়ে দিল?না সে আমায় ছাড়েনি।ঠিক আবিস্কার করেছে ভর দুপুরে একা বালির ঢিবির আড়ালে আমি চৈতণ্য মঙ্গল পড়ছি।তারপর...তারপর...
-কী হল কথা বলছো না কেন?এই!
মরুণকিশোর মায়াভরা চোখদুটো দিয়ে মিষ্টিকে দেখল।তার বিয়ে করা বউ।তার জীবনকে ছন্দে ফেরাতে চেয়ে পরিবারতন্ত্রের ঘটানো এক মস্ত ভুল।ভুল কারণ সে মিষ্টিকে কিচ্ছু দিতে পারেনি।আদৌ কোনদিন হয়তো পারবে না।দেবপ্রিয়া আজ এত বছর পরেও মনের গভীরে প্রদীপ জ্বেলে বসে রয়েছে।কিছুতেই অন্ধকার হয়নি।সে প্রদীপ টিমটিমে আলোর মায়ায় জাগিয়ে রেখেছে স্মৃতি।কিন্তু এত বছর পর কেন তাকে খুঁজছে দেবপ্রিয়া?অনুজের সাথে তাকে তো বেশ মানিয়েছিল।তাছাড়া অনুজের কত নামডাক।দেশের কথা দশের কথা ভাবে যে সুপুরুষ সেই তো তার মতো নারীর যোগ্য।এই নিতান্ত সাধারণ গড়পড়তা এলেবেলে মরুণকিশোর কে আজ এত বছর পর কী দরকার তার?মিষ্টি তাকিয়ে দেখে ঘাড় নুইয়ে চোখ মাটিতে প্রায় মিশিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে তার মানুষটি।তার মানুষ!মনে মনে একটু হেসে নিল মিষ্টি।এ মানুষ কোনদিনই তার নয়।ঘাটশিলার কপার মাইনের প্রোডাকশন ম্যানেজার মরুণকিশোর দাস মিষ্টির জীবনের সাথে বয়ে চলে মাত্র।না ঠিক বয়ে চলে না।বয়ে চলায় মিশে যাওয়া আছে।তাদের জীবন তো মেশেনি।মরুণকিশোর উদাস হয়ে বলেছিল,'মন জাগলে শরীর জাগবে মিষ্টি।তাকে জোর করে সংসারী করতে চাওয়া মুর্খামি।শরীর ছাড়াও এ জগৎ সংসারে কত গভীর সম্পর্ক আছে তাই না!আমরা বরং বন্ধু হতে পারি।আর যদি তুমি স্বাভাবিক কর্তব্যের দায়ে আমায় পেতে চাও তাহলে মনের আরামটুকুও থাকবে না।'মিষ্টি সাধারণ বিএ পাশ করা সাধারণ মেয়ে।এত কথা বোঝে না।তবে এটুকু বোঝে বন্ধু পাওয়া এ পৃথিবীতে সবচে কঠিন।অতীতের অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া মরুণকিশোরকে একটিবার দেখে গভীর নিশ্বাস ফেলে ঘরে যায় মিষ্টি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন