পুরুষোত্তম চৈতন্যদেব
চৈতন্যসিংহের নবদ্বীপে অবতার।
সিংহ গ্রীব সিংহবীর্য সিংহের হুঙ্কার।।
..................
দৈর্ঘ্য বিস্তারে যেই আপনার হাতে।
চারি হস্ত হয় মহাপুরুষ বিখ্যাতে।।
........
আজানুলম্বিত ভুজ কোমললোচন।
তিনফুল জিনি নাসা সুধাংশুবদন।।
(চৈতন্য চরিতামৃত,
কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী)
মধ্যযুগে চৈতন্য আবির্ভাব
- বাংলার আকাশে ধর্মীয় নবজাগরণ
ও গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিদেশী শাসকের অহেতুক অত্যাচারের হাত থেকে সনাতন ধর্ম তথা বাংলার সুবিদিত সভ্যতাকে সুপরিকল্পিত ভাবে রক্ষা করার এক ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণ। চৈতন্য পরবর্তী যুগে সুচিন্তিত চৈতন্য গবেষণার কোনো অভাব কোনোকালেই দেখা যায় নি। সমসাময়িক বৃন্দাবন দাস ঠাকুর থেকে শুরু করে আধুনিক সাহিত্যে ডঃ নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী - বিভিন্ন কালে আমরা বহু চৈতন্য জীবনী ও গবেষণা গ্রন্থের মাধ্যমে চিনতে পেরেছি সেই সিংহপুরুষকে। কিন্তু সকল গবেষণাকে আমরা যদি দুভাগে ভাগ করে নিই, তাহলে দেখবো
একটি বিভাগে ধর্মের বন্ধনে চৈতন্য জীবনীতে অবতারতত্ব অর্পণ করে প্রাচীন গ্রন্থকাররা সেই সুবিশাল ব্যাক্তিত্বের সামগ্রিক পরিচয় ধরতে পারেন নি। কোনো একটি বই থেকে আমরা তাঁর সমগ্র জীবনচরিত সংগ্রহ করতে পারি না।১৪৮৬ ক্রীষ্টাব্দের ২৭শে ফেব্রুয়ারী যে মহাপুরুষের জন্ম নদীয়া জেলার জনপদ নবদ্বীপে, সময়ের সাথে তাঁর বেড়ে ওঠা ও সমগ্র ভারতে ধর্মীয় সচেতনতার মাধ্যমে জনমানসে এক বলিষ্ঠ অবিসংবাদী নেতা হয়ে ওঠার কাহিনী আজ আমরা সঠিক ভাবে কতটা জেনে উঠতে পেরেছি, তা অবশ্যই প্রশ্নচিহ্নের মুখে।
প্রকৃত অর্থেই সেই সময় ছিল ভারতের স্বর্ণযুগ। বাংলায় চৈতন্য, উত্তরে রামানন্দ, পশ্চিমে নানক, তুকারাম, মীরাবাঈ দক্ষিণে রামানুজ, ব্যাসরায়-দের সুযোগ্য নেতৃত্বে স্বকীয়তার সাথে এগিয়ে চলেছে ধর্মীয় গণঅভ্যুত্থান। আজ
থেকে প্রায় ৬০০ বছর আগেও বাংলার মাটিতে এক আসনে খেতে বসছেন ব্রাহ্মণ ও তথাকথিত চণ্ডাল - এ এক অকল্পনীয় দৃশ্য। সপার্ষদ চৈতন্যদেবের সিংহহৃদয়েই হয়তো ছিল এমন নিহিত শক্তি - যা খুব অনায়াসেই তাঁকে দেবত্ব আরোপ করেছিল। বৃন্দাবনের কৃষ্ণ মানুষের আরাধ্য হয়ে ওঠেন খুব
সহজে। কিন্তু মহাভারতে এক দক্ষ রাজনীতিজ্ঞ কৃষ্ণকে না জানলে যেমন প্রকৃত কৃষ্ণচরিত্র অধরা থেকে যায়, ঠিক তেমনি চৈতন্যচরিত্রের বহুমুখী দিকগুলো এবং তাঁর নেতৃত্বদানের কৌশলী দক্ষতা অজানা থাকলে তাঁকে অর্ধেক জানা হয়। এই
মহামানব সম্বন্ধে বিবেকানন্দ বলছেন
- "একবার মাত্র এক
মহতী প্রতিভা জাল ছেদন করিয়া উত্থিত হইয়াছিলেন - ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। একবার মাত্র বঙ্গের আধ্যাত্বিক তন্দ্রা ভাঙিয়েছিলো।"
তাঁর মহান ব্যাক্তিত্ব ও ক্ষুরধার দর্শনের কাছে ক্ষুদ্র ছিল শাসকের ইচ্ছে, সমাজপতিদের চাপিয়ে দেওয়া ধর্মের বেড়াজাল। এমনকি সেযুগের কাহিনীকারদের কলমে
আমরা প্রমান পেয়েছি যে 'গৌড়' ও 'গৌর' প্রায়
সমার্থক ছিল। তাঁর চরিত্রের সাথে সাথে আমরা পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে তাঁর সন্ন্যাস গ্রহণের মহান উদ্দেশ্য ও সামনে থেকে নেতৃত্বদানের বিষয়গুলি দেখবো।
পূর্ব ভারতের একমাত্র স্বাধীন বৈষ্ণব সম্রাট উড়িষ্যার গজপতি প্রতাপরুদ্রদেবের(১৪৯৭-১৫৪০) প্রতি তাঁর বিশেষ প্রভাববিস্তার ও দক্ষিণে সুবেদারদের মধ্যে বৈষ্ণব আচার বিতরণ তাঁর সুচিন্তিত নেতৃত্ত্বেরই দাবি রাখে। দক্ষিণ ভারতে আর এক বৈষ্ণব রাজা বিজয়নগরের কৃষ্ণদেব রায়(১৫০৯–১৫২৯) ছিলেন
মহামতি ব্যাসরায় এর শিষ্য আর গজপতি মহারাজা ছিলেন আমাদের প্রানপ্রিয়
চৈতন্যদেবের। এমনকি উড়িষ্যায় গজপতি বংশে বর্তমান কয়েক পুরুষ বাদ দিলে পূর্বের সকল রাজাই ছিলেন গৌড়ীয় চৈতন্য মতে দীক্ষিত।
সেযুগে গৌড়ের কথায় যদি আসতে হয়, তাহলে প্রথমেই দেখতে হয় রাজন্যবর্গের সামাজিক পরিকাঠামো ও তার শাসনপ্রণালীর শৃঙ্খলাগুলি। বাংলার শেষ স্বাধীন হিন্দু রাজা ছিলেন মহারাজ সুবুদ্ধি খাঁ। গৌড় শাসনে তার প্রধান ভিত্তি ছিল সুশাসন ও প্রজার সন্তোষ। কিন্তু তারই বিশ্বস্ত মুসলিম কর্মচারী হোসেন খানের ষড়যন্ত্রে তিনি অন্যায়ভাবে সিংহাসনচ্যুত হন। হোসেন খান 'শাহ' উপাধি যোগে লাভ করেন বাংলার সুবেদারী। রাজ্যশাসনের সুবিধার জন্য বিভিন্ন স্থানে নিযুক্ত করেন মুসলিম কাজী। প্রামাণ্য গ্রন্থ অনুযায়ী জানা যায় তৎকালীন নবদ্বীপের
তেমনই কাজী ছিলেন ‘চাঁদ খাঁ’। স্থানীয় হিন্দু জমিদার ও রাজাদের আনুকূল্যে তাঁরা সন্তুষ্ট রাখতেন বাংলার সুলতানকে। কর
বাবদ যা আয়-উপায় হতো তার কিছু অংশ নিজে রেখে বাকিটা পাঠাতেন সুলতানের নজরানায়। দোর্দণ্ডপ্রতাপ কাজীর শাসনকার্যে বিঘ্ন ঘটায় সাধ্য কার। এমন শাসনপদ্ধতির বেড়াজালে সেকালের হিন্দু বৈষ্ণবগণের যে ধর্মে-কর্মে খানিক বাধা উপস্থিত হতো তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এমন সমাজ কাঠামোয় আমরা পরবর্তীকালে দেখবো সেই উন্নত কাঁধ আর শক্ত চোয়ালের অধিকারী চৈতন্যদেবের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব। তিনি শুধু বলিয়ানের নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন সমাজের অন্তজ শ্রেণীর ভগবান। নামের মাহাত্ম আর কর্তালের সুর অস্ত্র করে তাঁর নৃত্যকলা ও সিংহদৃষ্টি যেন আষ্টেপিষ্টে ধরেছিলো সমাজের শ্রেণীবৈষম্যকে। গঙ্গাতীরের ছোট্ট 'নিমাই' (একমাত্র শচীদেবী এই নামে ডাকতেন প্রভুকে) কখন যে হয়ে ওঠেন আপামর ভারতবর্ষের নয়নের ধন, নররূপী নারায়ণ - তা বোধহয় তৎকালীন সময়ও লিখে রাখতে পারে নি।
বিস্তৃত বঙ্গভূমির বাইরে সর্বভারতীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও তখন চঞ্চল। ভারতবর্ষের প্রতাপশালী হিন্দু রাজা উড়িষ্যার গজপতি প্রতাপরুদ্র ছিলেন যুদ্ধে ব্যাতিব্যাস্ত। তাঁর প্রধান শত্রু বলতে বাংলার হোসেন শাহ আর দক্ষিণে কর্ণাটের (তৎকালীন বিজয়নগর) হিন্দু রাজা কৃষ্ণদেব রায়। পরবর্তী কালে আত্মীয়তার বন্ধনে সন্ধি হলেও দুই হিন্দু রাজা বহুকাল ছিলেন শত্রুতায় মেতে। কথিত আছে গজপতি রাজা যুদ্ধ জয় করে দক্ষিণে কাঞ্চি শহরের দেবতা শ্রীগণেশকে নিয়ে আসেন নীলাচলে। তারপর তাঁর রাজ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন কাঞ্চিগনেশ মূর্তি। আজও পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে আমরা স্বমহিমায় তাঁর উপস্থিতি দেখতে পাই। আবার ওপর দিকে দেখা যায় মহারাজা কৃষ্ণদেব রায় উড়িষ্যার উদয়গিরি দুর্গের কৃষ্ণ মূর্তি হরণ করে বিজয়নগরে প্রতিষ্ঠা করেন এবং বহু জমি দেবোত্তর করে দেন। সঙ্গে নির্মাণ করেন সুবিশাল শ্রীকৃষ্ণ মন্দির। এমনি ছিল দুই শক্তিশালী বৈষ্ণব রাজার পারস্পরিক দ্বন্দ্বের চরিত্র।
তারপরও ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ হিন্দু রাজ্য ছিল উড়িষ্যা। বহুকালে বহু বিদেশীশক্তির আক্রমণ থেকে এই রাজ্য কখনো রক্ষা পায় নি। কিন্তু গজপতি রাজন্যবর্গের প্রতাপে শত্রু প্রতিহত হয়ে উড়িষ্যা বারে বারে পেয়েছে সতন্ত্রতার সম্মান। আজও গজপতি রাজা দিব্যসিংহদেব বাহাদুরকে আমরা প্রতি রথযাত্রায় ভক্তি সহযোগে রথ মার্জনা করতে দেখি।
(ক্রমশ…)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন