স্মৃতিবিষয়ক গল্প
কপি
প্রবীর বিকাশ সরকার
আজও যখন কখনো কখনো জেরক্স কপিয়ার মেশিনে কপি করতে কোনো দোকানে যাই তখন হঠাৎ করেই শ্যামলদা এবং বিজয়ার মুখ মনে পড়ে যায়। একটি জেরোক্স কপি কীভাবে একটি উঠতি তরুণ-তরুণীর হৃদয়ঘটিত সম্পর্ককে ছিন্নভিন্ন করে দিল---ভাবলে যেমন দুঃখ হয় আবার দুঃখের মধ্যে হাসিও পায়। এমন ঘটনার ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া কঠিন। সম্পর্কটা কলি থেকে ফোটার আগেই ঝরে যাবে এমনটি ধরে নেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। একেই বোধকরি বলে নিয়তি। মাঝে মাঝে শ্যামলদা ও বিজয়ার জন্য মনোকষ্টে জলাক্রান্ত হই।
বিজয়ার সঙ্গে আমার দেখা না হলে এই ঘটনাটি জানতেই পারতাম না। ১৯৯৮ সালে ওর সঙ্গে হঠাৎ করেই আমার দেখা কমলাপুর রেল স্টেশনে। দুজনেই একই ট্রেনের যাত্রী হয়েছিলাম চট্টগ্রাম পর্যন্ত। ওর গন্তব্য দিদির শ্বশুরবাড়ি হালি শহর পর্যন্ত। আর আমার বন্ধুবর সাফায়াত খানের বাসা উত্তর নালাপাড়া।
স্টেশনের প্লাটফর্মে মানুষের ভীড়ে নির্দিষ্ট কামরা খুঁজছিলাম। সিঁড়িতে পা রাখবো এমন সময় ডানপাশ থেকে মেয়েলি কণ্ঠে চমকে উঠলাম।
---আরে প্রবীর না!
ঘাড় ফিরিয়ে দেখি চেনা একটি তরুণী। আরে বিজয়া যে! দ্রুত পা নামিয়ে তার সামনে দাঁড়ালাম।
---বিজয়া তুমি!
---হে। আমি। চিনতে পেরেছো!চকবাজারস্থ বজ্রপুরের কাসারিপট্টি আমরা থাকতাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে পড়তাম। তুমি ইতিহাসে।
---হে। চিনতে পেরেছি তো। কেমন আছো তুমি? যাচ্ছো কোথায়? আরেব্বা কত বছর পর দেখা! একা যাচ্ছো নাকি?
---হে। অনেক বছর পর। তুমি ভালো আছো? তোমার বোন রীনার কাছে শুনেছিলাম তুমি জাপান চলে গেছো। ওখানে বিয়েসাদি করেছো।
---ঠিকই শুনেছো। তুমি বিয়ে করোনি বুঝি? বলে ওর মাথার দিকে তাকালাম। সিঁদূরের কোনো লাল চিহ্ন দেখতে পেলাম না। বেশ বড়সড় ধাক্কাই খেলাম বুকের মধ্যে। শ্যামলদাকে মনে পড়ে গেল। তবে কী ওদের বিয়ে হয়নি!
---সেসব অনেক কথা। তুমি কি চাঁটগা যাচ্ছো?
---হে। আমার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। চলো উঠে পড়ি।
দুজনে উঠে সিট খুঁজে পেলাম ঠিকই কিন্তু ভিন্ন-ভিন্ন জায়গায়। বিজয়া বললো, তোমার সিট কোথায় সেখানেই বসবো। যার সিট সে এলে বুঝিয়ে বলবো চিন্তার কারণ নেই। এসব হরহামেশা ব্যাপার।
পাশাপাশিই বসলাম। বিজয়া নিল জানালার পাশে আমার সিটটি। তেমন যাত্রী নেই তার কারণ হল মঙ্গলবার সবাই কাজে ব্যস্ত। বিকেলের ট্রেন। ঘড়িতে তিনটা বাজছে। প্লাটফর্মে বেশ কোলাহল। মানুষের ভীড়ও কম নয়। পরবর্তী ট্রেনে অনেকেই চড়বে বলে মনে হল। দাঁড়িয়ে প্রতীক্ষমাণ।
ট্রেন ছেড়ে দিলে পরে বেশ হিমহিম বাতাসের ঝাপ্টা শুরু হল। ডিসেম্বর মাসের শেষপ্রায়। শীত তেমন নেই শহরে। তবে খোলা জায়গার বাতাস বেশ ঠাণ্ডা। বিজয়ার মাথার কয়েকটি দীর্ঘ চুল উড়ছে সেই বাতাসে। সে চাদরটাকে টেনেটুনে ঠিক করে আমার দিকে ফিরে তাকালো।
দেখলাম সেই বিজয়া। একদা খুবই সুন্দরী ছিল। বিশেষ করে ওর বড় বড় চোখ ও দীর্ঘ নাক অন্যান্য মেয়েদের থেকে আলাদা। দীর্ঘদেহী সুতনুকা দারুণ আকর্ষণীয় ছিল বন্ধুমহলে। গায়ের রং ফর্সা---মায়ের রংটি পেয়েছে। ওর বাবা তো বেশ কালো। ওর ছোটভাই বরুণ বাবার মতোই হয়েছে।
বিজয়ার শারীরিক পরিবর্তন তেমনটি না ঘটলেও বড় বিষণ্ন মনে হলো। কেমন উদাস-উদাস দৃষ্টি। ও যে ভালো নেই বুঝতে আর বেগ পেতে হয়নি।
বিজয়া মুখ খুললো, কত দিন পর এলে দেশে? এর আগে এসেছিলে বৌদিকে নিয়ে রীনা বললো।
---হে। ১৯৮৮ সালে মহাবন্যার সময় ওকে নিয়ে এসেছিলাম প্রথম। তারপর একাধিকবার এসেছি। ছুটিছাটা পাওয়া যায় না, অনেক খরচও লাগে ইচ্ছে থাকলেও দেশে আসা কঠিন।
---ওখানে কি চাকরি করছো?
---ও দেশে থাকলে কাজ করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ নেই বেঁচে থাকার। বড় কষ্টসাধ্য জাপানের জীবনযাপন।
---জানি। আমার ছোটমামা পিএইচডি করতে তিন বছর ছিল টোকিওতে। খুব ব্যয়বহুল দেশ আর অমানুষিক পরিশ্রম সেখানে করতে হয় বলেছে। বাঙালির শরীরের যে ধাত তাতে এত পরিশ্রম খাপ খায় না। পরিশ্রমী জাতি বলেই উঠতে পেরেছে জাপান।
---কুমিল্লায় কি তোমরা এখন থাকো না? তোমার মামাতো ভাই সুব্রত এখন কোথায়? ওই যে চকবাজারে ব্যবসা ছিল ওদের।
---বড় মামার ছেলে তো? সেই কবেই ওরা চলে গেছে কলকাতায়। সুব্রতদা বিয়ে করে তিন ছেলেমেয়ের বাবা। তোমার ক’ ছেলেমেয়ে?
ক্রমশ .....
কপি
প্রবীর বিকাশ সরকার
আজও যখন কখনো কখনো জেরক্স কপিয়ার মেশিনে কপি করতে কোনো দোকানে যাই তখন হঠাৎ করেই শ্যামলদা এবং বিজয়ার মুখ মনে পড়ে যায়। একটি জেরোক্স কপি কীভাবে একটি উঠতি তরুণ-তরুণীর হৃদয়ঘটিত সম্পর্ককে ছিন্নভিন্ন করে দিল---ভাবলে যেমন দুঃখ হয় আবার দুঃখের মধ্যে হাসিও পায়। এমন ঘটনার ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া কঠিন। সম্পর্কটা কলি থেকে ফোটার আগেই ঝরে যাবে এমনটি ধরে নেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। একেই বোধকরি বলে নিয়তি। মাঝে মাঝে শ্যামলদা ও বিজয়ার জন্য মনোকষ্টে জলাক্রান্ত হই।
বিজয়ার সঙ্গে আমার দেখা না হলে এই ঘটনাটি জানতেই পারতাম না। ১৯৯৮ সালে ওর সঙ্গে হঠাৎ করেই আমার দেখা কমলাপুর রেল স্টেশনে। দুজনেই একই ট্রেনের যাত্রী হয়েছিলাম চট্টগ্রাম পর্যন্ত। ওর গন্তব্য দিদির শ্বশুরবাড়ি হালি শহর পর্যন্ত। আর আমার বন্ধুবর সাফায়াত খানের বাসা উত্তর নালাপাড়া।
স্টেশনের প্লাটফর্মে মানুষের ভীড়ে নির্দিষ্ট কামরা খুঁজছিলাম। সিঁড়িতে পা রাখবো এমন সময় ডানপাশ থেকে মেয়েলি কণ্ঠে চমকে উঠলাম।
---আরে প্রবীর না!
ঘাড় ফিরিয়ে দেখি চেনা একটি তরুণী। আরে বিজয়া যে! দ্রুত পা নামিয়ে তার সামনে দাঁড়ালাম।
---বিজয়া তুমি!
---হে। আমি। চিনতে পেরেছো!চকবাজারস্থ বজ্রপুরের কাসারিপট্টি আমরা থাকতাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে পড়তাম। তুমি ইতিহাসে।
---হে। চিনতে পেরেছি তো। কেমন আছো তুমি? যাচ্ছো কোথায়? আরেব্বা কত বছর পর দেখা! একা যাচ্ছো নাকি?
---হে। অনেক বছর পর। তুমি ভালো আছো? তোমার বোন রীনার কাছে শুনেছিলাম তুমি জাপান চলে গেছো। ওখানে বিয়েসাদি করেছো।
---ঠিকই শুনেছো। তুমি বিয়ে করোনি বুঝি? বলে ওর মাথার দিকে তাকালাম। সিঁদূরের কোনো লাল চিহ্ন দেখতে পেলাম না। বেশ বড়সড় ধাক্কাই খেলাম বুকের মধ্যে। শ্যামলদাকে মনে পড়ে গেল। তবে কী ওদের বিয়ে হয়নি!
---সেসব অনেক কথা। তুমি কি চাঁটগা যাচ্ছো?
---হে। আমার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। চলো উঠে পড়ি।
দুজনে উঠে সিট খুঁজে পেলাম ঠিকই কিন্তু ভিন্ন-ভিন্ন জায়গায়। বিজয়া বললো, তোমার সিট কোথায় সেখানেই বসবো। যার সিট সে এলে বুঝিয়ে বলবো চিন্তার কারণ নেই। এসব হরহামেশা ব্যাপার।
পাশাপাশিই বসলাম। বিজয়া নিল জানালার পাশে আমার সিটটি। তেমন যাত্রী নেই তার কারণ হল মঙ্গলবার সবাই কাজে ব্যস্ত। বিকেলের ট্রেন। ঘড়িতে তিনটা বাজছে। প্লাটফর্মে বেশ কোলাহল। মানুষের ভীড়ও কম নয়। পরবর্তী ট্রেনে অনেকেই চড়বে বলে মনে হল। দাঁড়িয়ে প্রতীক্ষমাণ।
ট্রেন ছেড়ে দিলে পরে বেশ হিমহিম বাতাসের ঝাপ্টা শুরু হল। ডিসেম্বর মাসের শেষপ্রায়। শীত তেমন নেই শহরে। তবে খোলা জায়গার বাতাস বেশ ঠাণ্ডা। বিজয়ার মাথার কয়েকটি দীর্ঘ চুল উড়ছে সেই বাতাসে। সে চাদরটাকে টেনেটুনে ঠিক করে আমার দিকে ফিরে তাকালো।
দেখলাম সেই বিজয়া। একদা খুবই সুন্দরী ছিল। বিশেষ করে ওর বড় বড় চোখ ও দীর্ঘ নাক অন্যান্য মেয়েদের থেকে আলাদা। দীর্ঘদেহী সুতনুকা দারুণ আকর্ষণীয় ছিল বন্ধুমহলে। গায়ের রং ফর্সা---মায়ের রংটি পেয়েছে। ওর বাবা তো বেশ কালো। ওর ছোটভাই বরুণ বাবার মতোই হয়েছে।
বিজয়ার শারীরিক পরিবর্তন তেমনটি না ঘটলেও বড় বিষণ্ন মনে হলো। কেমন উদাস-উদাস দৃষ্টি। ও যে ভালো নেই বুঝতে আর বেগ পেতে হয়নি।
বিজয়া মুখ খুললো, কত দিন পর এলে দেশে? এর আগে এসেছিলে বৌদিকে নিয়ে রীনা বললো।
---হে। ১৯৮৮ সালে মহাবন্যার সময় ওকে নিয়ে এসেছিলাম প্রথম। তারপর একাধিকবার এসেছি। ছুটিছাটা পাওয়া যায় না, অনেক খরচও লাগে ইচ্ছে থাকলেও দেশে আসা কঠিন।
---ওখানে কি চাকরি করছো?
---ও দেশে থাকলে কাজ করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ নেই বেঁচে থাকার। বড় কষ্টসাধ্য জাপানের জীবনযাপন।
---জানি। আমার ছোটমামা পিএইচডি করতে তিন বছর ছিল টোকিওতে। খুব ব্যয়বহুল দেশ আর অমানুষিক পরিশ্রম সেখানে করতে হয় বলেছে। বাঙালির শরীরের যে ধাত তাতে এত পরিশ্রম খাপ খায় না। পরিশ্রমী জাতি বলেই উঠতে পেরেছে জাপান।
---কুমিল্লায় কি তোমরা এখন থাকো না? তোমার মামাতো ভাই সুব্রত এখন কোথায়? ওই যে চকবাজারে ব্যবসা ছিল ওদের।
---বড় মামার ছেলে তো? সেই কবেই ওরা চলে গেছে কলকাতায়। সুব্রতদা বিয়ে করে তিন ছেলেমেয়ের বাবা। তোমার ক’ ছেলেমেয়ে?
ক্রমশ .....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন