শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১৮

মানসী গাঙ্গুলী


                              শেষ বেলায়

        খবরটা পেয়ে মিতা কেমন হতভম্ব হয়ে যায়।কাঁদবে কি,সে তো ভাবতেই পারছে না এমনটা কি করে হয়।সুমন চলে গেল!এ যে বিনামেঘে বজ্রপাত! এইতো কিছু আগে সুস্থ মানুষ বাড়ী থেকে বেরল।এটা কি সত্যি নাকি দুঃস্বপ্ন!শেষ সময়ে সে ছিল না সুমনের পাশে।অফিসে গিয়ে ফাইল খুলে বসেই সে অসুস্থ বোধ করে আর অল্পক্ষণের মধ্যেই কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজের টেবিলে লুটিয়ে পড়ে সে।অথচ সকালে বড় ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে খেয়েদেয়ে ছোট ছেলেকে আদর করে সুমন বেরল বাড়ী থেকে আর এইটুকু সময়ের মধ্যে এই খবর!সুমনকে ছাড়া একা পথ চলবে কেমন করে মিতা?কি করবে সে এখন?দু'দুটো দুধের শিশুকে একা বড় করবে সে কেমন করে?ছোটো ২ বড় ৫,সবে কেজিতে পড়ছে।
         বাড়ীর অমতে সুমনকে বিয়ে করে বাড়ী ছেড়েছিল সুমনের হাত ধরে।সে হাত ছেড়ে সুমন চলে গেল তাকে শূন্য করে দিয়ে,এ জীবনতরী  সে বাইবে কেমন করে!তবু চলতে হবে একাকী,জীবন যখন আছে বিশেষ করে ছেলে দুটোর মুখ চেয়ে।চোখের জল ফেলার বিলাসিতা বা সময় কোনোটাই তার নেই।চোখে এখন সে সরষের ফুল দেখছে।কিন্তু জীবন সব কিছু মেনে নিতে শেখায়, তাই মিতাকেও সব মেনে নিতে হয়।সুমনকে শেষ যাত্রায় সাজিয়ে দিয়ে শুরু হল তার জীবনযুদ্ধ।কর্মরত অবস্থায় অফিসে অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়ায়,অফিস থেকে মিতাকে তার যোগ্যতা অনুযায়ী একটা চাকরী দিতে চেয়েছিল কিন্তু মিতা তা নিতে পারেনি,দুধের বাচ্চাদের কার কাছে রেখে সে যাবে কাজে তাই।এবার সুমনের অফিস থেকে যা প্রাপ্য ছিল তা দিয়ে সে শুরু করল লড়াই,বাড়ীতে বসেই সে শুরু করল কাপড়ের ব্যবসা,সেটা দাঁড় করাতেও তাকে কম কষ্ট করতে হয় নি।কোনোরকমে চলে যাচ্ছিল,কিন্তু একটু স্বচ্ছলভাবে থাকার জন্য এবার সে বাড়ীর নীচতলার বসার ঘরটা খালি করে রাখল পেয়িং গেস্ট।
         জীবন তাকে অনেক কিছু শেখাচ্ছে,আরও কত কি শেখার আছে বাকী,দেখা যাক।শোক আঁকড়ে বসে থাকলে চলবে না,চলতে হবে,যেতে হবে অনেকদূর, একা,এপথে কেউ নেই তার সঙ্গী।ছেলেরা বড় হবার সাথে সাথে খরচ বাড়তে লাগল,তাই ব্যবসার ফাঁকে শুরু হল টিউশনি।সারাদিনে ঘরের সব কাজ একা হাতে,নিজের ওপর যথেচ্ছ অবহেলা করে ছেলেদের মানুষ করাই তখন তার একমাত্র ব্রত।মায়ের একনিষ্ঠ সাধনায় ছেলেরা পড়াশুনোয় বেশ ভাল হয়ে উঠতে লাগল,তাই স্কুলের শিক্ষকেরাও তাদের যথাসাধ্য সাহায্য করতেন।এভাবে সবার সহায়তায় ও আশীর্বাদে ছেলেরা এক এক করে স্কুল পার করল ভাল রেজাল্ট করে।বড় হবার সাথে সাথে মায়ের লড়াই তারা দেখেছে,মায়ের কষ্ট উপলব্ধি করেছে,বস্তুতঃ মা তাদের বাবার অভাব বুঝতে দেননি কোনোদিন।তাই ছেলেদের কাছে মা-ই সব।এই লড়াইয়ে চলার পথে কত কুপ্রস্তাব,কত লোভ হাতছানি দিয়েছে মিতাকে কিন্তু সে মোটেই সেসব আমল দেয়নি,মনপ্রাণ ঢেলে দুইছেলেকে মানুষ করেছে, নিজের দিকে তাকানোর কথাও তার মনে পড়ে নি বা সে ইচ্ছাও তার হয়নি।বড় ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিংএ ভর্তি হল যেদিন,বাবার ছবিতে প্রণাম করে,মাকে প্রণাম করে রওনা দিলে সুমনের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে ঝরঝর করে কাঁদে মিতা,তার তো কাঁদবার অবসরটুকুও নেই।দুই ছেলে হবার পর সুমন বলেছিল,"দু'জনকেই ইঞ্জিনিয়ার করব",একজনকে মিতা সেপথে এগিয়ে দিতে সফল হয়েছে,আর একজনকে এগিয়ে দিতে পারলে তবেই হবে তার কর্তব্য শেষ। তিনবছর পর মিতা পেরেছিল ছোটছেলেকেও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পাঠাতে,কি শান্তি সেদিন তার,সুমনের ছবির সামনে গিয়ে দাঁড়ালে তার মনে হয়  ছবির সুমনের মুখে যেন খুশীর রেশ।কিছুদিন পর বড়র পড়া শেষ হলে মিতার পক্ষে তাকে আর পড়ানো সম্ভব হয়নি,সে চাকরী নিয়েছে।তার একাকীত্বে, সুমনের ছবিই তার সঙ্গী,তার সাথে কথা বলেই সে মনে শক্তি পায়।সেদিনও মিতা সুমনের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদে আর বলে,"জীবনের পথে চলতে একাকী লড়াই করতে করতে আমি ক্ষতবিক্ষত, ছোটটি চাকরী পেলে আমার লড়াই শেষ,সেই পর্যন্ত যাতে লড়াইটা চালিয়ে যেতে পারি,আশীর্বাদ কর"।এমন একনিষ্ঠ ভালবাসা, এমন একনিষ্ঠভাবে সন্তানপালন সচরাচর দেখা যায় না।              ছেলেরা বড় হয়েছে,সময়ের সাথে মিতার শরীরে আজ বয়সের ছাপ স্পষ্ট, দেহে মনে ক্লান্ত যখন তখনই ঘটল বিপর্যয়।
          কিছুদিন যাবৎ মিতা মানসিকভাবে বড় অস্থির,সব কাজ ঠিকঠাকই করে কিন্তু মনকে শান্ত রাখতে পারে না।এতকাল যে নিজেকে সংযত করে চলেছে,আজ যখন চুলে রূপোলী রেখা দেখা দিয়েছে,তাই বলে সেইসময়!নিজেকে নিজেই বোঝায় সে,শান্ত রাখার চেষ্টা করে, কিন্তু একি হল! রাতে ঘুম আসতে চায় না,কেবলই যে মিত্রবাবুর মুখটা ভাসে তার চোখে।হ্যাঁ,মিত্রবাবু তার পেয়িং গেস্ট এখন,গত কয়েকমাস হল তিনি এবাড়ী এসেছেন।আসার পর থেকেই তিনি মিতার প্রশংসায় পঞ্চমুখ তার এই লড়াইয়ের জন্য।এরপর তার প্রতিটি রান্নার তারিফ করা,এভাবে আস্তে আস্তে দু'জনের মাঝে একটা সখ্যতা গড়ে ওঠে।মিতার ওনাকে খুব কাছের মানুষ মনে হয়,অবসরে বসে গল্প করে,আজকাল মিত্রবাবুর অনুরোধে ওনার সাথেই একসাথে খায় মিতা,খাবার সময় মিতা ভাল করে না খেলে মিত্রবাবু মৃদু রাগও করেন,বেশ লাগে মিতার।মিত্রবাবুর সপ্রশংস দৃষ্টিতে মিতা নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করে আজকাল।উনি যখন তাকান তার দিকে,মনে হয় যেন খোলা বইয়ের পাতার মত দেখতে পাচ্ছেন তার ভেতরটা।কতবছর পার হয়ে গেল আজ মিতা কোনো পুরুষের সপ্রশংস দৃষ্টিতে লজ্জা পাচ্ছে,কোনো পুরুষের সঙ্গ উপভোগ করছে।মাঝে মাঝে আজকাল তার আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে হয়।আবেগে ভেসে যাচ্ছে মিতা,নিজেকে সংযত করতে ইচ্ছাও হয় না।কিন্তু ছেলে দুটো বাড়ী এলেই মনে হয় ছি ছি,এ ঠিক নয়,এ সে কি ভাবছে!কিন্তু সারাদিন যখন একা থাকে সে,মানুষটার সাহচর্যে সে বড়ই খুশী থাকে,কোনো কাজে আজকাল আর তার ক্লান্তি লাগে না।
         এভাবে চলতে থাকে,দিন যায়, মাস যায়,একদিন মিত্রবাবু মিতাকে প্রেম নিবেদন করে বসেন।অল্পবয়সে বাবা-মা মারা গেলে,ছোট ভাইবোনেদের দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর ওপর।সবার বড় হওয়ায়,তাদের লেখাপড়া  শিখিয়ে,বিয়ে দিয়ে,আজ তাদের সংসারে তিনি অবহেলিত,অপ্রয়োজনীয় হয়ে ঘর ছেড়েছেন।তাদের জন্যই তাঁর সংসার করা হয়ে ওঠে নি,ভাবেনওনি কখনো নিজের কথা,কিন্তু আজ যে তারা এতটা স্বার্থপর হয়ে যাবে তাও তিনি ভাবতে পারেননি।আজ তার আপন বলতে আর কেউ নেই। মিতাকে দেখার পর থেকে বড় আপনার মনে হয়েছে ওনার,বস্তুত দু'জনের জীবনে কিছু মিলও রয়েছে,দু'জনেই আজীবন যুদ্ধ করে কাটালেন সংসারের জন্য।তিনি বলতে দ্বিধা করেননি যে সারাজীবন দায়িত্বের চাপে যে প্রেম তার দরজায় কোনোদিন কড়া নাড়েনি,তা মিতাকে দেখে তার জীবনে এসে হাজির হয়েছে,যা তিনি উপেক্ষা করতে পারছেন না।মিতার হাতদুটি ধরে যখন উনি প্রেম নিবেদন করলেন,আবেগে সারাশরীর থরহর করে কেঁপে উঠেছিল মিতার,যে আবেগ মিতাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল সুমনের শেষযাত্রার সঙ্গে,নাকি তাতে পলি পড়েছিল এতদিন,যা আজ হঠাৎ বাঁধভাঙ্গা হয়ে বুকের মাঝে উথালপাতাল করছে।ভেসে যেতে ইচ্ছে করছে মিতার,তবু সংযমের কাঠিন্য বজায় রেখে সে বলেছে তা সম্ভব নয়,এতে ছেলেরা তাকে সম্মান করবে না।মিত্রবাবু নিজে ছেলেদের সাথে কথা বলতে চেয়েছেন,মিতা রাজী হয় নি যদিও তিনি বুঝেছেন,মিতার অন্তরে তিনি তাঁর একটা জায়গা করতে পেরেছেন আর তাই তিনি বলেছেন অপেক্ষায় থাকবেন সেদিনের যেদিন মিতা রাজী হবে।
          মিতা সুমনের ছবির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়,বলে, "তুমি আমায় শক্তি দাও,তুমি ছাড়া এজীবনে আমার কাছে আর কেউ কোনোদিন আসতে পারে নি তোমার জায়গায়,এ জায়গা আমি অন্য কাউকে দিই কিভাবে"।মন অস্থির,রাতে শুয়ে ঘুম আসে না,স্বপ্নে দেখে সুমন যেন বলছে,"আমি তোমায় কি দিতে পেরেছি,দু'টো সন্তান দিয়ে সমস্যার মুখে ফেলে দিয়ে চলে এসেছি।আমার হাত ধরে তুমি সবাইকে ছেড়ে এলে,সেই আমি থাকতে পারলাম না তোমার বলভরসা হয়ে,সংসার আগলে।তুমি মিত্রবাবুকে বিয়ে করে খুশী থাকো, আমি তাতেই খুশী হব"।ঘুম ভেঙ্গে যায় মিতার,বুকের ভেতর তোলপাড় করছে,খুব ইচ্ছে করছে কারো বুকের মাঝে আশ্রয় নিতে বস্তুত একজন যখন তার জন্য বুক পেতে বসেই আছে।কিন্তু সমাজ,সংসার বড় বালাই।সংযমেরই জয় হল শেষে,আবেগকে দুমড়েমুচড়ে দিয়ে।
          এরপর ছোটছেলের চাকরী হলে,মিতা দুইছেলের একই সাথে বিয়ে দেবে মনস্থ করে,সেইমতই সব ব্যবস্থা হয়।মিত্রবাবু ততদিনে ওদের পরিবারের সদস্য হয়ে গেছেন,কবে থেকে যেন তিনি ছেলেদের অভিভাবক হয়ে উঠেছেন,ছেলেরাও তাঁকে খুব ভালবাসে।সব মিটে গেলে মিত্রবাবু এবার আর মিতার কথা শোনেন না।তিনি দুইছেলে ও দুই বউকে ডেকে আজ মিতাকে বিয়ে করার প্রস্তাব রাখেন,কেবল মিতা সেখানে থাকতে রাজী হয় নি,তাই ছিল না।নিমেষে বাড়ীর চিত্র বদলে গেল।যে মিত্রকাকুকে তারা নিজেদের অভিভাবক,একান্ত আপনার জন ভাবত এতদিন,তাঁকে অপমান করতে সেদিন তাদের বাধেনি,তার সাথে নিজেদের মাকেও তারা দেবীর আসন থেকে টেনে অনেক নীচে নামিয়ে ফেলে।মিতা এমনই আশঙ্কা করেছিল,তাই আগে থেকেই ব্যবস্থা করে রেখেছিল সে,দুই ছেলেকে বাড়ীর দুটোতলা ভাগ করে লিখে দিয়ে নিজে স্বেচ্ছায় গিয়ে উঠল বৃদ্ধাশ্রমে,যেখানে আগে থাকতে তাঁদের দু'জনের জন্য ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন মিত্রবাবু।এতে অন্তত সমাজ-সংসার তাদের দিকে আর আঙুল তুলবে না এই আশা করে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন