স্বপ্নভঙ্গ
সকাল আটটা। ডিসেম্বরে কুয়াশা আচ্ছন্ন সকালে আলো তখনও ঠিকমত ফোটেনি । তিননম্বর ফ্লোরে হঠাৎ দুমদুম করে কেঊ যেন দরজা ধাক্কা দিচ্ছে । শ্রেয়া দরজা খুলে বেরিয়ে এল বাইরে। সিঁড়িটা উপরে উঠে গিয়ে মাঝখানে যে একটা চৌকো ফাঁকা জায়গা তৈরী হয়েছে সেদিকে তাকিয়ে, সে বোঝার চেষ্টা করে আওয়াজটা ঠিক কোথা থেকে আসছে। চোখে তখনও ঘুম লেগে। কাল অনেক রাত পর্যন্ত হোম আ্যসাইন্মেন্ট করতে হয়েছে। কিন্তু আওয়াজের তীব্রতা শ্রেয়ার ঘুমকে এক লহমায় উড়িয়ে নিয়ে যায়। ততক্ষনে হোস্টেলের অন্য সব দরজা খুলে এক এক করে জড়ো হচ্ছে করিডোরে। সিঁড়ি ওঠার বাঁক থেকে কেউ বলল “অরে পুনম দরবাজা নহী খোল রহী হ্যায়”। কথাটা শুনে শ্রেয়ার বুকটা ধরাস করে উঠল । সে সঙ্গে সঙ্গে দৌড় লাগাল উপরের তলায়। পুনমের সাথে কালই ওর দেখা হয়েছিল। একই ইন্স্টিটিউটে কোচিং করে। তিন চারদিন হল ওর রুমমেট বাড়ি গেছে। ওর দিদির বিয়ে । পুনম বলছিল একদিন ও খুব শান্তিতে আছে। ওর রুমমেট পূজা নাকি ড্রাগস নেয়। ওর ডিপ্রেসন নাকি মারাত্মক পর্যায়ে। সেকেন্ড টাইম জয়েন্ট দেবে। সাধারন মিডল ক্লাশ ফ্যামিলির মেয়ে, ড্রাগসের পয়সা জোটাতে পার্ট টাইম কল গার্লের কাজ করে। সামান্য ব্যাপারে পুনমের সাথে ঝগড়া করে। সারাক্ষন ফোনে চ্যাট করে। পড়াশুনায় ভীষন ডিস্টার্ব হয়। হোস্টেল সুপারকে জানিয়েও কোন লাভ হয়নি।তবে নেক্সট সেশনে রুম খালি হলে শ্রেয়া আর পুনম ঠিক করেছিল একই রুমে সিফট করবে। উপরে এসে শ্রেয়া দেখল দরজাটা ভেতর থেকে আটকানো সকালে লণ্ড্রী বাস্কেট নিতে এসে সরবতি আন্টি দরজায় ধাক্কা দিয়েছিলো। তখন সাড়া না দেওয়ায় ভেবেছিল হয় ঘুমোচ্ছে অথবা বাথরুমে আছে। এমনিতে সব মেয়েরা আটটা সাড়ে আটটার মধ্যে তৈরী হয়ে ব্রেকফাস্ট রুমে চলে যায়। ওদের কোচিং ক্লাসের আর এক সহপাঠী হিমানী থাকে পাশের রুমে। সে সকালে ইন্স্টিটিউট যাবার আগে পুনমকে ডাকতে এসেছিল,তখন পুনম দরজা না খোলায় সেই পাশাপাশি মেয়েদের ডাকে। এক অজানা আশংকার চোরা স্রোত বইতে থাকে শ্রেয়ার শরীরে-“পুনম পুনম দরবাজা খোল তু শো রহি হ্যায় ক্যায়া” কিন্তু ভিতর থেকে কোন শব্দই আসে না। সব নিশ্চুপ। দরজাটা যেন কি রহস্য ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো আরো কিছুক্ষন পড়ে সে রহসয় উন্মোচিত হবে। শ্রেয়া নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। করিডরের জানলা দিয়ে তাকায় বাইরে। বোবা দৃষ্টি যেন পুনমকেই খুঁজছে । কুয়াশা ঘেরা শীতের সকালে সূর্য তার আবছা আলো নিয়ে বেরিয়ে আসছে দূরের কোনো হীমশীতল দেশ থেকে। এখনি সব ধোঁয়াশার অবসান হবে। এত ঠান্ডার মধ্যে সারি সারি ছেলেমেয়েরা চলেছে পীচ ঢালা রাস্তা দিয়ে। রাস্তার শেষে রয়েছে সেই স্বপ্ন যা জীবনকে বদলে দেবে একলাফে। কোটা সেই শহর যেখানে লাখ লাখ কিশোর কিশোরি স্বপ্ন দেখে। নিজেদের সবকিছু গচ্ছিত রেখে বাবা মা তাদের নিজেদের অপূর্ন স্বপ্ন সাকার করতে চান সন্তানদের মধ্যে। শ্রেয়ার সম্বিৎ ফিরে আসে। কি-হোলে চোখ রেখে হিমানি কি যেন দেখছে। ওর মুখটা থেকে কে যেন সমস্ত রক্ত শুষে নিয়েছে। হিমানীর ফর্সা মুখটা ধীরে ধীরে ফ্যাকাসে হয়ে যায়। চোখদুটো ভীষন আর্তনাদে ফেটে পড়তে চাইছে। মুখ থেকে শব্দের বদলে গোঙানি ছাড়া আর কিছুই বের হচ্ছে না। দুটো মেয়ে ধরধর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল নীচে, সুপারকে ডাকতে। কাল ওদের শেষ সেমিস্টারের রেজাল্ট বেরিয়েছিল। পুনমের রেজাল্ট সেরকম ভাল হয়নি। বিকাস স্যর ওকে ডেকে পাঠিয়েছিল। আর তখন থেকেই পুনমকে ডিপ্রেসড লাগছিল শ্রেয়ার। স্যর বলেছিল এরকম রেজাল্ট হলে এন্ট্রান্স ক্লিয়ারের কোন সম্ভাবনাই নেই। শ্রেয়া জানত ওর বাড়ির পরিস্থিতি। ওর পড়াশুনার জন্য অনেক টাকা লোন নিয়েছিলেন ওর বাবা, কয়েকবছর আগে সারা জীবনের সব সঞ্চয় দিয়ে পুনমের দিদির বিয়ে দিয়েছেন। তাই সমস্ত আশা ভরসা পুনমের উপর। পুনম যদি এন্ট্রান্স ক্লিয়ার করতে না পারে তাহলে আর দুই ছোট ছোট ভাইবোনের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে। তাই পুনমের বাবা যখনই ফোন করতেন সেই কথাই বলেন। আগামী মাসে পুনমের মার গলব্লাডার অপারেশন তার টাকাও বাবা ধার করেছেন তার বন্ধুর কাছ থেকে। সবসময় বাবার ওই কথাটাই কানে বাজত পুনমের-“পুনম অভী তু হী মেরা ভরোসা হ্যায়। তু আপনে পয়রোপে খাড়ী হোজায়েগী তো মেরি সারি চিন্তা দূর হো জায়েগী।” পুনম আর কোনদিন নিজের পায়ে খাড়া হবে না। হোস্টেলের ছোট্ট রুম থেকে পুনমের নিথর শরীরটা যখন বের করে আনল পুলিশ তখন হোস্টেলের চারপাশে অনেক লোক জমা হয়েছে। সবার চোখেই আতঙ্ক ,অনেকে হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া ঘটনায় এতটাই বিমূড় যে কথা বলার সমস্ত শক্তি হারিয়ে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শ্রেয়া এখনো সেই আগের জায়গাতেই বসে আছে। চোখ থেকে অবিরল ধারায় অশ্রু মুখ ভাসিয়ে টপটপ করে মাটিতে পড়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। অথচ উঠে পুনমকে দেখার মত মনের জোর তার নেই। এই শহরে প্রতিযোগিতার যূপকাষ্ঠে আটকে পড়াজীবনে একমাত্র বন্ধুকে হারিয়ে নিদারুন শোকে সে আজ বাকরূদ্ধ। এক্রাশ অভিমান গলার কাছে এসে আটকে আছে। একবার কি মন খুলে পুনম ওকে সব কথা বলতে পারল না । তাহলে নিশ্চয় শ্রেয়া বোঝাতে পারত একবার রেজাল্ট খারাপে সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। জীবনে অনেক চান্স আসে কোনবার জেতে আর কোনবার হেরে যেতে হয়। কিন্তু পুনম চিরকালের জন্য জীবনযুদ্ধে হেরে গেল। পুলিশের ভ্যান যখন পুন্মের শরীরটা নিয়ে রওনা হল মর্গের উদ্দেশ্যে তখন দুপুর একটা। পীচের রাস্তাটা এখন ভরে গেছে সূর্যের প্রখর রোদে। তার মধ্যে কিশোর কিশোরীরা চলেছে যে যার হোস্টেলে।ওদের চোখ স্বপ্নের সাতরঙা রামধনু রঙে উজ্জ্বল। ওরা বোধহয় জানে না স্বপ্ন ভাঙ্গার রং। সেই রং নিয়ে পুলিশের ভ্যান্টা রাস্তার বাঁকে মিলিয়ে যায়। শ্রেয়া চেয়ে থাকে সেদিকে।
|
সোমবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৮
নন্দিনী পাল
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন