লাহিড়ি বাবার আশ্রম॥ অমিতাভ দাস
পড়ার ব্যাচে অনেক দিন ধরেই কথা হচ্ছিল স্যার , আপনি কত জায়গায় বেড়াতে যান । আমাদের কোথাও নিয়ে চলুন । কাছেপিঠে যা যা আছে সব-ই প্রায় আমার যাওয়া । বাংলার নতুন একটি পর্যটনের খোঁজ পেলাম লাহিড়ি বাবার মন্দির । স্টুডেন্টরাও রাজি হয়ে গেল । গতকালকেই আমরা একটা অটো রিজার্ভ করে চলে গেলাম আমাদের নতুন দ্রষ্টব্য স্থান ভ্রমণে ।
আকাশ মেঘাচ্ছন্ন । অক্টোবরের শেষ । দুপুর তিনটে বাজল পৌঁছুতে । ব্যান্ডেল স্টেশান থেকে -সাড়ে তিন -চার কিমি পথ । জায়গাটার নাম রাজহাট । গ্রাম পঞ্চায়েত । নির্জন রাস্তা । দু-পাশে বাঁশবন । অন্যান্য বড় বড় গাছও আছে। ছাত্রী অনন্যা বললে , গত বছর স্যার আমি ঐ জঙ্গলে ময়ূর দেখেছিলাম । আমার তেমন বিশ্বেস হল না । বললাম , জঙ্গল থেকে খাটাস , বন বিড়াল বেরুতে পারে -- ওই দেখ সাদা বক । ওই দেখ দুটো কুকুর ছুটে যাচ্ছে । সবাই হেসে উঠল । এমনকি গম্ভীর প্রকৃতির অটোওয়ালাও হেসে ফেলল ।
মেন রাস্তার ডান দিকে সরু রাস্তায় ঢুকে গেল আমাদের অটো । শুনলাম আগে মাটির ছিল । এখন ঢালাই রাস্তা হয়েছে । পৌঁছে শুনলাম মন্দির চারটায় খুলবে । চারিদিক নির্জন । মন্দিরের গেটে তালা ঝুলছে । দারোয়ান ঘুমুচ্ছে বসে বসে । একটি মাত্র দোকান খোলা । সেখানে চা-বিস্কুট-ঘুগনি পাওয়া যাচ্ছে । চারিদিকে কেবল গাছ আর গাছ । যেন অরণ্যে এসেছি । বড় বড় তাবু -- শুনলাম রাতে তাবুতে লোক থাকে । ওরা গাছ পাহারা দেয় । ফল পাহারা দেয় । একটা লোক নির্জন জঙ্গলের ভিতর মাছ ধরছিল । বললাম , কী আর করবে , ওই যে দূরে চৌকি পাতা -- পড়তে বসো-- আরেক রাউন্ড পড়াশুনো হোক ।
--তার আগে পেট পুজো হোক, আমার কাছে টিফিন আছে , বলেই প্রিয়ান টিফিন বক্স বার করলে । আমরা লুচি- আলু ভাজা খেলাম । মধুমিতা আবার ঘুগনি -চা কিনল ।
এখানে এসে একটা কুকুরের সঙ্গে ভাব হয়েছে আমাদের । সে অনেক সময় আমাদের পিছু পিছু ছিল । ওকে বিস্কুট দিয়েছি, ফলে খুব খুশি ।
২
এসেছি লাহিড়ি বাবার মন্দিরে । কে এই লাহিড়ি বাবা ? ইনি একজন আধ্যাত্মিক সাধক, যোগীরাজ । নাম শ্যামাচরণ লাহিড়ি ।জন্ম নদীয়া জেলার ঘূর্ণী গ্রামে, ৩০ সেপ্টেম্বর ১৮২৮ সালে । তাঁর গুরু ছিলেন মহাবতার বাবাজি । পাঁচ বছর বয়সে নিজেদের বাড়ি বন্যায় ভেসে গেলে তিনি বাবার সঙ্গে বারাণসীতে চলে আসেন ।শৈশবে গঙ্গাস্নান করে নিত্য বেদপাঠ আর শিবপুজো করতেন বালক শ্যামাচরণ । ১৮৪৬ সালে তাঁর বিবাহ হয় । তিনি ছিলেন গৃহীযোগী ।
১৮৬১ সালে হিমালয়ের পাদদেশে রাণীক্ষেতে পাহাড়ে চলার সময় গুরু মহাবতার বাবাজির দেখা পান । দীক্ষা লাভ করেন ক্রিয়াযোগের এবং নিজেকে নিযুক্ত করেন মানবসেবায় । বহুমানুষ তাঁর শিষ্য ছিলেন । যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরমহংস যোগানন্দ । ১৮৯৫ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর এই মহাপুরুষ ইহলোক ত্যাগ করেন ।
৩
মন্দির খুলে গেল ঠিক চারটায় । এই মন্দিরে প্রবেশের কিছু নিয়ম-নীতি আছে । পুরুষরা টুপি ও বারমুডা পরে ঢুকতে পারবে না । মহিলারা মাথায় ওড়না ছাড়া ঢুকতে পারবে না । ওখানে ওড়না ভাড়াও পাওয়া যায় । পা ধুয়ে মন্দিরে প্রবেশ করতে হয় ।
মন্দিরটি চমৎকার শ্বেত পাথরের । একদিকে লক্ষ্মী-সরস্বতী অন্যদিকে ত্রিদেব ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ । মন্দিরের গর্ভগৃহ পাতালে-- রয়েছে শিবলিঙ্গ এবং যোগীশ্রেষ্ঠ শ্যামাচরণ লাহিড়ির মূর্তি । চারিদিকে দেবধূপের গন্ধে আমোদিত। দেওয়ালের গায়ে নানা আঙুলের ধ্যানমুদ্রা । মন্দিরটি বিরাট এবং জলের ওপর স্থাপিত ।
মন্দির সংলগ্ন বাগানটি চমৎকার । দেখলাম কত যে সাদা রাজহাঁস । ডানদিকেই পদ্ম ফুটে আছে জলাশয়ে ।বা দিকে কৃত্রিম কুঁড়েঘর--গুহার মতো । ভিতরে বিরাট এক শিবের মূর্তি , ধ্যানস্থ , সাদা রঙের । ওপর থেকে ঝরনার জল পড়ছে । ভেতরে ঢুকলে আশ্চর্য হতে হয় , কোথায় এলুম রে বাবা-- বাইরে যেন জোর বৃষ্টি হচ্ছে এমন মনে হবে ।নানা রকম পাখি আছে । আছে আরো কিছু মন্দির ।
সকালে গেলে ভোগ পাওয়া যায় । পুজোর ধূপ-মোমবাতি ও অন্যান্য ভেতর থেকেই কিনতে হবে ।
বড় ভালো লাগল । সবাই অনেক আনন্দ করে , ছবি তুলে ফিরলাম ঠিক পাঁচটার পর । কাছাকাছি এত সুন্দর একটা জায়গা আছে অনেকেই জানে না । গেলে বিস্মিত হতে হয় । মুগ্ধ হতে হয় ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন