শনিবার, ২২ জুন, ২০১৯

অর্পিতা বোস



নতুন  স্পর্শ  
------------------
 

আজ সেই প্রত্যাশিত রাত ।আজ সে আর তিয়াসা এক হবে।বাইরের  বারান্দাতে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরিয়ে  অপেক্ষা করছিল দীপ্ত।
সব লোকাচার শেষ হলে, ঘরে প্রবেশ করে দীপ্ত দরজা  বন্ধ করে। ঘরে সে আর তিয়াসা, তার সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী। দরজা থেকে  বিছানাতে বসে থাকা তিয়াসার কাছে  পৌঁছানোর মূহুর্ত পর্যন্ত সে যেন নিজের হৃৎস্পন্দন শুনতে পাচ্ছে।আস্তে আস্তে  বিছানাতে বসে আংটির বাক্স থেকে  আংটিটা হাতে নিয়ে  তিয়াসাকে ছুঁতে যেতেই ,তিয়াসা গম্ভীর গলায় বলে ওঠে,আমার হাতে দিন আমি পরে নিচ্ছি। 
অবাক দীপ্ত  আংটিটা তিয়াসার হাতে তুলে দিল।সে আংটিটা নিজের আঙ্গুলে পরে বলে,দেখুন আমি খুব টায়ার্ড, ঘুমোতে চাই।
 --হ্যাঁ,অবশ্যই।
তিয়াসা উঠে  চেঞ্জ করে এসে শুয়ে পড়ে।
 অবাক দীপ্ত দেখে পাশ ফিরে  তিয়াসা  শুয়ে পড়েছে। একটা  দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে  একটা  সিগারেট ধরাতেই, তিয়াসা বলে, আমার  সিগারেটের ধোঁয়াতে  অসুবিধা হচ্ছে।
 সিগারেটটা জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে সে ভাবে,  আজকের  রাতটা সবার জীবনে অনন্য,সকলের মতো সেও আজকের রাতটা নিয়ে  অনেক স্বপ্ন দেখেছিল। অথচ তিয়াসা,থাক ক্লান্ত  ঘুমোচ্ছে।
পরদিন  সব গোছগাছ শুরু করে মধুচন্দ্রিমাতে গোয়া যাবে তিয়াসা চুপচাপ তার জামাকাপড একপাশে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।তিয়াসার ব্যবহারে অবাক হলেও দীপ্ত ভাবে সময় লাগবে তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে।বয়সের অনেক ফারাক  তিয়াসার সাথে তার। 
  অতি সাধারণ ঘরের দ্বিতীয় কন্যাসন্তান  তিয়াসার কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা অভিজাত পরিবারের সুপ্রতিষ্ঠিত দীপ্তর থেকে  বারো বছরের ছোট তিয়াসার সাথে বিবাহের প্রস্তাব সাগ্রহে স্বীকার করে নেন। যদিও তিয়াসার দিদি তৃষার জন্য সম্বন্ধ আনা হয়েছিল। কিন্তু সদ্যকলেজ ফেরত তিয়াসাকে দেখে দীপ্তর মার পছন্দ হয়।প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকায় দীপ্ত সেসময় কলকাতা আসতে না পারায়,তাকে তিয়াসার ছবি পাঠানো হয়।
তিয়াসা ও তৃষার ব্যাপারে সম্পূর্ণ অজ্ঞ সে তিয়াসার মিষ্টি  ছবি দেখেই মত দিলে শুভ বিবাহে দেরি করেনি দুই পক্ষের কেউই।
 শিলিগুড়িতে কর্মরত 
দীপ্তকে মধুচন্দ্রিমা শেষে কর্মস্থলে ফিরে  যেতে হলেও তিয়াসা কলকাতাতেই তার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত থাকবে।
   রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুতে এলে তিয়াসা বলে, আমার খুব মাথা ব্যাথা করছে, ঘুমোবো।
 দীপ্ত জিজ্ঞেস করে ওষুধ লাগবে কিনা, উত্তর না দিয়ে শুয়ে পড়ে তিয়াসা।
   তিয়াসার  আচরণে অবাক হয়ে সে সিগারেট ধরাতে গেলে মনে পড়ে তিয়াসার অসুবিধার কথা। তাকিয়ে দেখে বাইরের  জোৎস্নার আলোতে ভেসে যাওয়া আলোতে খাটে শুয়ে
থাকা তিয়াসাকে যেন  রূপকথার রাজকন্যার মতো মনে হচ্ছে।ইচ্ছে করেছে গিয়ে  পাশে বসে তিয়াসাকে ছুঁয়ে দেখতে। লাজুক স্বভাবের দীপ্ত তিয়াসার ছবি দেখেই প্রেমে পড়েছিল।কিন্তু তিয়াসা! একটা  দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে।
  সবাইকে বিদায় জানিয়ে ফ্লাইটে বসে তিয়াসা দীপ্তর হাতে প্রথম হাত রাখতে সে তিয়াসাকে ভয় পেতে দেখলে হাতে হাত রেখে আশ্বস্ত করে।নিদির্ষ্ট সময়ে হোটেলে ঘরে পৌঁছতেই তিয়াসা জিজ্ঞেস করে, আপনি আমাকে কেন বিয়ে করলেন? 
--মানে? 
--আমার দিদিকে বিয়ে না করে  আমাকে বিয়ে করলেন? কেন? 
--তোমার অমত ছিল? 
---হ্যাঁ,ছিল, কিন্তু আমাদের মতো ঘরে এমন সম্বন্ধ পেলে আর আমার মতের তোয়াক্কা কে করে?
--তুমি রাজি না হলেই পারতে?
---অরাজি হওয়াতে বলেছিল বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে।কোথায় যাবো?প্রতীকতো চাকরি  পায়নি।
--চাকরি পেলে তুমি কি ওনাকে --
--হ্যাঁ, প্রতীককেই বিয়ে করতাম।আমি ভালোবাসি  প্রতীককে,শুধু ওর চাকরি পাওয়ার জন্য-
  ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে তিয়াসা। বজ্রপাত হলো যেন।দীপ্ত চুপ করে ব্যালকনিতে দাঁড়ালো।কেন এমন হলো?কি করবে সে? কেন বিয়ের আগে একবার দেখা করলোনা সে?নিজের ওপর বিরক্ত লাগছে তার।
 পরবর্তী তিনদিন  মধুচন্দ্রিমাতে এসে দুজন অচেনা মানুষের মতো সময় কাটিয়ে কলকাতা ফেরে।বাড়িতে ফিরে তিয়াসার স্বাভাবিক ব্যবহার দেখে অবাক হলেও দীপ্ত চুপ করে থাকে।কিছুই ভালো লাগেনা।পরদিন সকালে শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয় দীপ্ত।যাওয়ার সময়ে তিয়াসা চুপচাপ থাকলে দীপ্ত শুধু বলে,আলমারিতে টাকা আছে, দরকার হলে ব্যবহার করো।
নিরুত্তর তিয়াসা দাঁড়িয়ে দেখে  দীপ্ত ট্যাক্সি করে বেড়িয়ে গেলো।নিজেকে মুক্ত মনে হচ্ছে, কালকে যাবে কলেজের নাম করে তার প্রেম ,তার স্বপ্ন,প্রতীকের  কাছে ।ভাবতেই ভালো লাগছে।শুধু প্রতীকের চাকরিটা হয়ে গেলেই এই বন্ধন থেকে মুক্তি নেবে সে।
   পরদিন প্রতীকের বাড়ি গেলে তিয়াসাকে দেখে  বিদ্রুপ করে প্রতীক বলে, বড়োলোক বরকে ছেড়ে হঠাৎ এই গরীবের কাছে কেনো? 
তিয়াসা প্রতীকের গলা জড়িয়ে বলে, আমি তোমার  প্রতীক,শুধু তোমার। তোমার  চাকরির জন্য  অপেক্ষা করছি তারপর, ডিভোর্স দিয়ে তোমার সাথে ।
--হ্যাঁ,ততদিনে তোমাকে  লুটেপুটে খাক।
--ছি,এমন বলোনা।আমাকে ছুঁতেও দিইনি।
-- শোনো ওসব বলে  লাভ  নেই, আমি কি দেখতে গেছি গোয়াতে কি করেছ!একজন যখন থাকবেনা তখন  আমার কাছে --
কথাটা  শেষ করার  আগেই প্রতীকের গালে পাঁচটা  আঙ্গুলের ছাপ ফেলে বেরিয়ে আসে তিয়াসা।
বাড়িতে ফিরে ভাবে তাকে এতটুকু বিশ্বাস করলোনা এতদিনের চেনা প্রতীক অথচ ঐ মানুষটা -সেকি  ভুল করলো মানুষ চিনতে? অথচ অচেনা ঐ মানুষটা আমাকে-
 চোখ বেয়ে জল নামে তিয়াসার, কিছু  ভালো লাগছে না।রাতে শুতে এসে যেন ঘরটা যেন বড়ো ফাঁকা লাগছে,ঘুম আসছেনা ,ধুর  কিছু ভালো লাগছেনা।
   পরদিন থেকে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে  তিয়াসা। বাড়িতে দীপ্তর মা-বাবার সাথে বড়ো ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠলেও তিয়াসার বড়ো একা লাগে এবাড়িতে । এরমাঝে একদিন ল্যান্ডলাইনে ফোন বাজলে তিয়াসা ফোনটা ধরলে সেই চেনা গলা , দীপ বলছি,কে মা?
 তিয়াসার বুকটা কেমন করে ওঠে, চোখটা জ্বালা করে, কোনো কথা বলতে পারেনা।
ওপারে আবার সেই গলা, আমি তিনদিনের জন্য একটু ইম্ফল যাবো,হয়তো ফোন করতে নাও পারি, মা-বাবা যেন  চিন্তা না করেন।
  ফোনটা কেটে গেল,কিন্তু তিয়াসার ইচ্ছে করছিল  আরও কথা শুনতে।তার কথা কি কিছুই  জিজ্ঞেস করতে নেই? বড়ো অভিমান চোখ বেয়ে  তার  অজান্তেই  নামলো।
  অ্যাডমিট কার্ড আনতে  গিয়ে দেখে,  প্রতীক যেন ইচ্ছে করেই তিয়াসাকে দেখিয়ে  শ্রেয়াকে বাইকে নিয়ে কোথাও  যাচ্ছে।
বাড়ি ফিরে তিয়াসা প্রতীকের কথাই চিন্তা করছিল, এতদিনের সম্পর্ক, অথচ মানুষ চিনতে এতো ভুল!সব রাগ-দুঃখ-অভিমান কোনও অজানা কারণে গিয়ে জমা হলো দীপ্তর ওপর।ফোনে একবার জানতেও চাইলোনা, সে কেমন আছে।
লাগবে না, কাউকে তার খোঁজ নিতে।কিছু ভালো লাগেনা। 
শেষ পরীক্ষার আগের দিন  তিয়াসা একা বাড়িতে, শাশুড়িমা একটু দরকারে বেরিয়েছিলেন ,আবার ফোন বাজছে।সে জানে দীপ্তর ফোন , প্রায়ই লাঞ্চ টাইমে দীপ্ত ফোন করে নাহলে রাতে। কখনো তার সাথে কথা বলেনা।শ্বশুর -শাশুড়ির ধারনা, মোবাইলে কথা হয় তাদের। কিন্তু কোথাও  কখনো দীপ্ত  ফোন করে না তাকে। খুব  রাগ দুঃখ অভিমান  নিয়ে ফোনটা তুলতে আবার সেই চেনা গলা ,আমি  দীপ-
--আপনার মা আজ একটু বেড়িয়েছেন, আর আপনার তো আমার সাথে কোনো কথা নেই, তাই ফোনটা  কেটে দিতে পারেন।
--তোমার সাথে কথা বলার জন্য তো তোমার প্রতীক-
---না ,সে আমার প্রতীক না ,শ্রেয়ার প্রতীক,  আমার  কেউ নেই, কারো লাগবেনা  আমার সাথে কথা বলতে ।
 অভিমানী গলা দিয়ে আর শব্দ  বেরোয়না ।ফোনটা রেখে  দেয়।
  সে রাতে তিয়াসার চোখ
বেয়ে শুধু জল নেমেছিল।
 পরীক্ষা দিয়ে তিয়াসা জ্বর নিয়ে বাড়ি ফেরে।রাত বাড়লে জ্বর বাড়ে।জ্বরের  ঘোরে অচৈতন্য তিয়াসার মুখে শুধু দীপ্তর নাম ।ভয় পেয়ে  দীপ্তর বাবা ডাক্তার ডাকলে তিনি ওষুধ আর কিছু পরীক্ষা করতে বলেন।পরদিন দুপুরে তিয়াসার মা-বাবা দেখতে আসলে সে জানতে পারে
দীপ্তর বন্ধুর সাথে তৃষার বিয়ের জন্য দীপ্ত চেষ্টা করছে।
বড়ো কান্না পায় তিয়াসার, সবাইকে ফোন করে, সবার সাথে কথা বলে, সবার কথা ভাবে শুধু  তার কথা ছাড়া।
সন্ধেবেলা আবার জ্বর আসছে তিয়াসার, প্রচন্ড গরম কপালে ঠান্ডা হাতের ছোঁয়া,তিয়াসা যেন দেখতে পাচ্ছে দীপ্ত --না-কেমন করে হয়? সে তো শিলিগুড়ি, আর  কেন আসবে তার  কাছে? সে কে?
   তবুও  হাতের  স্পর্শটা সত্যিই  অনুভূত হচ্ছে, সাথে  কানে ভেসে আসছে 
--তিয়া,কেমন  আছো? নিকোটিনের গন্ধটা খুব কাছে এগিয়ে  আসছে,চোখ বেয়ে জল  নামছে  তিয়াসার ,আর সেই জল শুষে নিচ্ছে  দুটো ঠোঁট।
   আজ আবার  জোৎস্নার আলোতে  ঘর ভাসছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন