শুক্রবার, ১৫ মে, ২০২০

দেবযানী রায়

লকডাউন।


উত্তর ২৪পরগনার সীমান্তবর্তী অঞ্চল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক জায়গা।ভিনরাজ্য থেকে বিভিন্ন পণ্য বাংলাদেশে আমদানি রপ্তানি করা হয় বসিরহাটের ঘোজাডাঙা সীমান্ত দিয়ে।বালি , পাথর , সবজি প্রভৃতি-- বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল যায় বাংলাদেশে। আবার সেখান থেকেও পণ্য আসে এদেশের বিভিন্ন রাজ্যে পণ্যবাহী ট্রাকের মাধ্যমে।
           অস্থিরভাবে পায়চারি করছে রাজু-- মানে রাজুশেখ।পণ্যবাহী ট্রাকের চালক সে। দেশে কি এক রোগ এসেছে , তারজন্য সবকিছু বন্ধ হয়ে গেছে।শ'য়ে শ'য়ে ট্রাকচালক তাদের গাড়ি নিয়ে রাস্তায় সার বেঁধে দাঁড়িয়ে।রাজুর ট্রাক ও আছে তারমধ্যে। কিন্তু তার চিন্তার বিষয় অন্য।ট্রাকড্রাইভারের মুখোশের আড়ালে রাজু একজন নারী পাচারচক্রের চাঁই।ওর সাকরেদরা বেশীরভাগ বাংলাদেশের নাগরিক। চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নাম করে বনগাঁ , বসিরহাট , ঘোজাডাঙা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশী মেয়েদের এদেশে আসত রাজু ও তার দলবল। সীমান্তবর্তী অঞ্চলে কয়েকজন এজেন্টদের বাড়িতে ঐ মেয়েদেরকে প্রথমে রাখা হতো। তারপর তারা ছড়িয়ে যেত সারা দেশে। এখন দেশে প্রধানমন্ত্রী লকডাউন ঘোষণা করেছেন। সবকিছু বন্ধ হয়ে বিপদে পড়ে গেছে রাজু। মার্চ মাসে তার ট্রাকে চালের বস্তার পিছনে দুটো মেয়েকে নিয়ে সবে সীমান্ত পার হয়েছে কি হয়নি--রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। রাতের অন্ধকারে সে মেয়েদুটোকে কোনরকমে এক পরিত্যক্ত বাড়িতে নিয়ে তুলেছে। হাত-পা , মুখ বাঁধা থাকলেও মেয়েদুটো ছটপটায়।লকডাউনের কারনে চারিদিকটা বড়ো বেশি নিস্তব্ধ। একটা সূচ পড়লেও যেন তার শব্দ শোনা যায়।এহেন অবস্থায় মেয়েদুটোর গোঁ গোঁ আওয়াজ যদি কেউ শুনে ফেলে এই ভয়ে মরছে রাজু।আর একটু সময় পেলেই মালদুটো সাপ্লাই করে ফেলতো। "শালা !!লকডাউন করার আর সময় পেল না "।---নিজের মনেই গজরাতে থাকে রাজু শেখ। পুলিশের টহলদারি গাড়িগুলো বড়ো বেশি ঘুরে বেড়াচ্ছে আজকাল। মালিকের গুদামে গাড়িটা আনলোড করতে পারলেই কেল্লা ফতে হয়ে যেত।আর মেয়েদুটোর জন্য তো খরিদ্দার রেডিই ছিল। শালা!! বড়ো একটা দাঁও হাত ফস্কে গেল এবার।আর এদুটো এখন তো গোদের ওপর বিষফোঁড়া।মাইরি কপাল করেছিল বটে রাজু।ব্যবসাটা কিছুতেই স্টেডি হচ্ছে না। পুলিশের হুজ্জোতি তো লেগেই আছে।কবে যে এই লকডাউন খুলবে কেজানে।
         মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে রাজু।মাল পাচার করতে না পারলে শেষ করে দেবে মেয়েদুটোকে। এমনিতেই তো ভোগে যেত। নিজের পিঠ বাঁচাতে গেলে আর কোন উপায় নেই তার।।



মুখোশ


পুরুলিয়ার ছৌ নাচ পৃথিবী বিখ্যাত।গদাই , সুদাম , রঘু , শ্রীনাথ , মদনরা সবাই ছৌ নাচের দলের লোক। যেখানে যেমন বরাত পায় , গিয়ে পালা করে আসে। ওস্তাদ শ্যামাপদ মাহাতোর শিষ্য তারা।নাম ডাক বেশ ভালই।তা এবার তাদের পালা হলো "তারকাসুর বধ "। আগামী মাঘী পূর্ণিমা রাতে বর্ধমানের এক গ্রামে তাদের পালা করতে যেতে হবে। জোরকদমে নাচের প্র্যাকটিস চলছে। গুরু বলে দিয়েছে , যেন নাক কান কাটা না পড়ে।মান রাখতেই হবে।
নির্দিষ্ট সময়ে তারা সবাই মিলে চলে এসেছে বর্ধমানের গ্রামে। শুধু তো তারা নিজেরাই নয় , সঙ্গে বাজনদার , মুখোশগুলো ঠিক করে রাখার লোক , সব মিলিয়ে প্রায় ষোল জনের দল।সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ পালা শুরু হবে।মদন শেষ বারের মতো স্টেজ দেখে নিতে গেল। এরপর আর সময় পাবে না। কাল থেকে রঘুর পেট ভাল নেই , বারবার যাচ্ছে আর আসছে। মনটা সেই কারনে একটু রুখুসুখু মদনের। ঠিক মতো করে পালাটা নামিয়ে দিতে পারলেই শান্তি। ছেলেটাকে কয়দিন ছুটি দিয়ে দেবে।
প্রায় সাতটা বাজতে চললো।আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে "তারকাসুর বধ " পালা।ভালোই লোকজন হয়েছে।চারদিক আলো ঝলমল করছে।এই সময়ে রঘু বলে , যাই একবার ঘুরে আসি। নাহলে এতক্ষণ ধরে নাচা যাবেনা। কিছু বলাও যাচ্ছে না ওকে। শুধু মদন বলে , একটু তাড়াতাড়ি করিস রঘু।ঘাড় নেড়ে মুখোশটা খুলে রেখে রঘু দৌড়ে চলে যায়। পালাতে মদন সেজেছে তারকাসুর আর রঘু কার্তিক।এই কার্তিকের হাতেই তারকাসুর বধ হবে।
হৈহৈ করে পালা শুরু হয়েছে। একঘন্টা হতে চললো , এবার কার্তিকের হাতে তারকাসুর বধ হবে। দুজনে দুটো বল্লম নিয়ে জোর যুদ্ধ করছে।বাজনদারেরা মনের সুখে জোরে জোরে বাজনা বাজিয়ে চলেছে। নাচতে নাচতে কার্তিক ঠাকুর অসুরের বুকে বল্লম বসিয়ে দিল , অসুর বধ হয়ে গেল। সবটাই অভিনয়।মুখোশ পরে নাচের মাধ্যমে একটা ঘটনাকে তুলে ধরা হয়।
কিন্তু এটা কিহলো !!তারকা রূপী মদন যে মাটিতে পড়ে আছে , রক্তে ভিজে গেছে জামা।সবাই দৌড়ে গিয়ে দেখে , বুকে নয়--মদনের হাতে গেঁথে আছে বল্লমটা।আর এটা সত্যিকারের বল্লম।
মুখোশটা একটানে খুলে ফেলে চেঁচিয়ে উঠল রঘু "তুই কি ভেবেছিলি মদনা , আমি কিছুই বুঝতে পারিনি।দিনের পর দিন পালা বুঝানোর নাম করে আমার বাড়িতে এসেছিস। আমার থাকা না থাকার সুযোগে বৌটার সাথে আসনাই করেছিস।আমি এতোই বুরবক যে কিছু বুঝব না।সব জানতাম। শুধুমাত্র সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম।পেট খারাপের বাহানায় বল্লম টা বদলে নিয়েছিলাম। শুধু ঠিক মতো বুকে বসাতে পারলাম না। বৌটাকে বিষ দিয়ে এসেছি। তোকে মারতে পারলে শান্তি পেতাম। পারলাম না যখন , তখন নিজেই শান্তি পাই এবার।এই বলেই হাতের বল্লম বসিয়ে দেয় নিজের বুকে। ধারালো ফলায় এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যায় দেহ। মুখোশের আড়ালে প্রতিহিংসার কাহিনী গেঁথে থাকে।।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন