মুখোশ
গাড়িতে উঠতে গিয়েই রথীনবাবুর মনে পড়ল চশমাটা যথারীতি টেবিলে ফেলে এসেছেন । প্রায়ই এ জিনিস ঘটে থাকে তাঁর সঙ্গে । এখন আবার চারতলায় যেতে হবে। বিরক্তিতে মাথা নেড়ে আবার সেই লিফটে চড়ে চারতলায় উঠে এলেন তিনি ,লম্বা করিডরের শেষ মাথায় একটা বাঁক ঘুরেই মুখার্জি এন্ড সন্স , তাঁর অফিস । একটু তাড়া ছিল আজ, মৃদুলার খুড়তুতো ভাইয়ের পঁচিশ তম বিবাহবার্ষিকী । বাপের বাড়ির অনুষ্ঠানে দেরি করলে মুখ তোম্বা হয়ে যায় মৃদুলার। এই চশমার জন্য গরম গরম চাট্টি কথা শুনতে হবে আরকি, মনে মনে ভাবেন তিনি। বাঁকের মুখে এসে গলার আওয়াজে থমকে যান রথীন। কারা কথা বলছে এখানে দাঁড়িয়ে? নিজের নামটা কানে আসতেই অবাক হন , কৌতুহলী হয়ে আড়ি পাতেন যদিও এটা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। তাও আটকাতে পারলেন না নিজেকে।
প্রদীপ্তর গলা পেলেন-- আজকে অতক্ষণ ধরে বিভা কি করছিল রে বুড়োটার কেবিনে?
খিকখিক হাসি শোনেন সুবীরের--- আরে কি করতে পারে বুঝিস না ? সাধে কি আর এত তাড়াতাড়ি পার্মানেন্ট হল । ছমাস হয় নি এখনও চাকরিতে, তার আগেই ...ওদিকে আট মাস হয়ে গেছে প্রকাশ এখনও ঘষটাচ্ছে । বুড়োর রস আছে মাইরি ! আবার খ্যাকখ্যাকে হাসি , না একা সুবীর নয় সম্মিলিত হাসি এবার ।
স্তম্ভিত হয়ে গেছেন রথীনবাবু এত কদর্য ভাবনা এদের ! ছিঃ ছিঃ ! এই দুটো ছেলে যে অত্যন্ত নোংরা ধরনের তা তিনি জানেন। আগেও তার কানে এসেছে এই দুজনের কীর্তিকলাপ । ওপরমহল থেকে সতর্কও করা হয়েছে একবার তাও যে শোধরায়নি বোঝা যাচ্ছে । বিভার মতো একজন সিনসিয়ার দক্ষ কর্মী যার কাজ দেখে জেনারেল ম্যানেজার নিজে ওকে পার্মানেন্ট করেছেন , তাকে জড়িয়ে এত কুরুচিপূর্ণ কথা শুনে নিজেকে স্হির রাখতে পারলেন না রথীন । প্রবল রাগে এগিয়ে যেতে গিয়ে থেমে গেলেন আরেকটা গলা শুনে-- কি বলব দাদা ছোটমুকে বড় কতা হয়ে যাবে তবু না বলে পারচি না যখন বিভাদিদি নন্দী সাহেবের কেবিনে ঢোকে সে কি খিলখিল হাসি আর কথা দুজনের। আমার নিজেরই লজ্জা করে কিন্তু আমি একটা সামান্য পিওন , মানময্যাদায় আপনাদের সমান নইকো তাই চুপ মেরে থাকি.....কথাগুলো বংশীধরের ! অফিসের পিওন হলেও যাকে কিনা যথেষ্ট স্নেহ করেন রথীন । অফিসের পুরনো আর্দালি শশধর চাকরি শেষের মুখে আগে তাঁর কাছে তদবির করে নিজের ছোটভাই বংশীধরকে চাকরিতে ঢুকিয়েছিল । কত বছর তো হয়ে গেল তারপর । বংশীধরের হাবভাবে তাঁর মনে হত ও তাঁকে খুব সম্মান করে । অফিসের কেবিনে ঢুকেই দেখতে পান পরিচ্ছন্ন টেবিলে যাবতীয় দরকারি জিনিস, জলের গ্লাস ছোট কৌটোয় ওষুধ সব গুছিয়ে রাখা , প্রতিদিন। এমনকি তাঁর জন্য লাঞ্চব্রেকে ক্যান্টিন থেকে খাবার নিয়ে আসা , খাবার পরে কি ওষুধ খাবেন সব মনে করায় এই বংশীধর। এত বছরে একটা নির্ভরতার জায়গা তৈরি হয়ে গেছে দুজনের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে । তা তিনিও দায়েদফায় করেন ওর জন্য । এই মাসখানেক আগেই ওর ছেলের গলস্টোন অপারেশন হবে বলে কেঁদে পড়েছিল তাঁর কাছে, সে সময়ে তিনি অফিস থেকে কিছু সাহায্য পাইয়ে দিয়েছিলেন তো বটেই সঙ্গে নিজেও হাজার দশেক টাকা দিয়েছিলেন। একবার না এমন বহুবার হয়েছে। তাহলে কোন বংশীধর সত্যি ? ঐ হাসিভরামুখ, নম্র ভদ্র তাঁর শরীরের জন্য উদ্বিগ্ন হওয়া , বিশেষ খেয়াল রাখা মানুষটা নাকি আজ এই মূহূর্তে এই জঘন্য কুরুচিকর আলোচনায় সামিল মানুষটা ? পাথরের মতো ভারী পা নিয়ে আর এগোতে পারেন না তিনি, কিন্তু কোনটা মুখ আর কোনটা মুখোশ সে ধন্দটা তিলেকমাত্র তিষ্ঠোতে দেয় না সিনিয়র অ্যাকাউন্টস অফিসার রথীন নন্দীকে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন