মাদুলী
তিলপাড়া ময়ূরাক্ষী ব্যারেজ থেকে একটু এগিয়েই শক্তিপুর, আর তার পাশে জুনিদপুর। নদীর পারে দুটো গ্রাম, এটা শুনতে ভাল লাগলেও... এইখানে ময়ূরাক্ষীতে চড়া, জল কম। ভরা শ্রাবণের কথা আলাদা, তবে ওই দু-একমাসে কী হয়... সেই ভেবে কি দিন কাটানো যায়? তারাপীঠ, বোলপুর, দুবরাজপুর, কেন্দুলী এদের অবস্থান বিন্দুগুলো জোড়া লাগালে একটা ঘুড়ি কিংবা হীরক খণ্ডের জ্যামিতিক আকারের মত দেখতে... আর তার প্রায় মাঝামাঝি অঞ্চলে এই শক্তিপুর।
নাহ্... শক্তিপুরের কোনও শক্তিপীঠের গল্প কিংবা বলার মত অন্য কোন গল্পও আছে বলে জানা নেই। তবে ওই বক্রেশ্বর, তারাপীঠ কিংবা আরও অন্যান্য দেশ-গাঁ জুড়ে ছোটবড় মন্দির, থান, মাজার - এসবের প্রভাবে... ঠাকুর-দেব্তায় ভক্তি, পাপ-পুণ্যের ভয়... এইসব এখানেও আছে। আর ঘটনা বা গোলমাল, এইসব কিছুও সেই নিয়ে। তাঁতিপাড়ায় একটা বুড়োশিবের মন্দির আর একটা মা মনসার থান আগে থেকেই ছিল, এই মাস চারেক হ'ল একটা রক্ষেকালীর বেদী বসেছে নিমগাছতলায়। বেদী ছিল না... মানে, কিছুই ছিল না। একটা পুরনো টালিভাঙা ঘরে গেল বছর একটা লোক এলো, সে নাকি ওই বাড়ির শরীক... এখন থেকে এখানেই থাকবে। তারপর দেখা গেল সে মাঝে মধ্যেই ভোরবেলা চান-টান সেরে নিমগাছটার তলায় বসে পুজোটুজো করে। ভিজে মাথা দিয়ে টপটপ করে জল পড়ে... ভিজে ধুতি... গাছতলার মাটি ভিজে যায় পূর্ণিমা, অমাবশ্যা, একাদশী... তিথিতে, বারে বেশ মন দিয়ে পুজো চলছে দেখে লোকজনও আসত প্রণাম ঠুকতে। পয়সা-টয়সা দিয়ে, ফল-শবজি রেখে যেত। তারপর এলো মানত... গাছের ডালে লাল সুতোয় বাঁধা ঢিল... মাটি ঠাসা মাদুলী। ব্যস্... সেই শরীক থেকে গেছেন। কপালে লাল তিলক আর গলায় রুদ্রাক্ষের মালা এসেছে। টালির চাল সারানো হ'ল এবছর বর্ষার আগেই... আর এই মা রক্ষাকালীর বেদী, নিমগাছ তলাটা সিমেন্টে বাঁধিয়ে দেওয়া হ'ল। লোকটা এসেছিল খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর এলোমেলো চুল নিয়ে, কিন্তু থাকতে থাকতে দাড়ি আর চুলও কেমন লম্বা হয়ে গেল - ঠিক যেমনটি সবকিছুর সাথে মানান সই হয়, তেমনটি।
প্রহ্লাদ সহিসের বউকে আজকাল একটু বেশি দেখা যায়, মায়ের বেদীতে মাথা খুঁড়তে, ফাঁড়া কাটাতে কড়ে আঙুল দিয়ে। প্রহ্লাদ সহিস ছাড়াও সহিসদের আরও তিন চারটে পরিবার বহুকাল ধরে আছে তাঁতিপাড়ায়; পুরুলিয়া থেকে এখানে এসেছে প্রায় দুইপুরুষ হয়ে গেল। বুড়োশিবের থান ছাড়া কোথাও এই সহিসদের এত মাথা ঠুকতে দেখা যায় না। অথচ এই মাস দুয়েকের মধ্যে নিমগাছের গোড়ায় চারটে লাল সুতো বাঁধা হয়ে গেছে প্রহ্লাদের বউয়ের। দু'বার এসে মাদুলীও নিয়ে গেছে। সব মেয়ের জন্য। মাস ছয়েক হ'ল প্রহ্লাদের মেয়ে রুমকি বাঁ চোখে কেমন ঝাপসা দেখছে। চোখে চশমা দিয়েও কমেনি। দু'তিন রকম ড্রপ দেওয়ার পর সদরের ডাক্তার বলেছে বড় শহরে নিয়ে গিয়ে দেখাতে, ছুড়িকাঁচি ছাড়া সারবে বলে মনে হয় না। উনিশ-কুড়ি বছরের মেয়ে, সবে কলেজে ভর্তি হয়েছে... কোথায় পড়াশুনো নিয়ে থাকবে, তা নয়, এই উটকো টানাপোড়েনে জেরবার। সেই রুদ্রাক্ষের মালা পরা লোকটা বলছে... মায়ের পা থেকে একটা ফুল নিয়ে মাদুলী দিলে মায়ের কৃপায় সব সেরে যাবে। মেয়ে রুমকি, মায়ের সঙ্গে রোজ সন্ধেবেলা আসে; লোকটার দেওয়া মন্ত্রপড়া জবাফুল চোখে ঠেকায়, মন্ত্রপড়া জল আই ড্রপের মত চোখে দেয়... ভেজা চোখ নিয়ে ঘরে ফিরে যায় ওপরের দিকে তাকিয়ে; যাতে জল গড়িয়ে পড়ে না যায়।
ওই তাবিচ কবচে হোক, ডাক্তারের আই ড্রপে হোক, বা হাবিজাবি যে কারণেই হোক... রুমকি আবার সন্ধেবেলা পড়তে শুরু করল। বই, নোটের খাতা... আর পাতার ফাঁকে গুঁজে রাখা কাগজ। বাপ মায়ের থেকে অনেক বেশি ভক্তি দেখা গেল রুমকির। মা বড়ই জাগ্রত। কলেজে যেতে আসতে দু'বার রক্ষাকালীর থানে মাথা ঠেকিয়ে যেত। সেই লোকটা কাছাকাছি থাকলে ফুলটা, বাতাসাটা দিয়ে দিতো হাতে; মুখে অমায়িক হাসি নিয়ে। রুমকিও হাসত। রুমকি সেই ফুল চোখে ঠেকিয়ে, চরণামৃতর হাত মাথায় মুছে কলেজ যাওয়ার বাস ধরবে বলে এগিয়ে যেত। আর মায়ের সেবায়েৎ সাইকেল বার করে, তাতে চটের ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরতো বাজারের দিকে। একা মানুষ তো কি?... রেঁধে-বেড়ে খেতে তো হয়। মা রক্ষাকালীর পুজো ভাল রকমই চলছিল। প্রহ্লাদ সহিসের মত অন্য আরও অনেকে বেশ ভালই ভক্ত হয়ে উঠল মায়ের। না ঠিক মা একা নয়, তার সঙ্গে তাবিচ, কবচ, আংটি, জল-পড়া... আরও যা কিছু ওই লোকটা ব্যবস্থা করে দিতে পারে। মায়ার শরীর লোকটার। কাউকে ফেরায় না। এমনই একদিন সকালে বিপিন গড়াই এসেছিল মায়ের থানে। একদম সক্কাল সক্কাল এসে হাজির হয়েছিল, দুদিন ধরে পেটে একটা মোচর দিয়ে উঠছে ঘণ্টায় ঘণ্টায়। এই ভাবে মুদির দোকানে বসে থাকা দায়। লোকটা বলেছিল সকাল সকাল খালি পেটে আসতে, একটা শেকড়-বাটা দেবে। খালি পেটে মধু দিয়ে খেতে হবে। কিন্তু এসে দেখল মায়ের থানে কেউ নেই। মা রক্ষাকালী একাই মুখে সকালের রোদে মেখে দাঁড়িয়ে আছেন। কিছু দূরের ওই টালির চালের ঘরটার দরজা বন্ধ, বড় তামাটে রঙের একটা আট-লিভারের তালা সূর্যের আলোয় চকচক করছে। বেলা বাড়তে খবর পাওয়া গেল... প্রহ্লাদ সহিসের মেয়ে রুমকিকেও সকাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ভোরবেলা শেষ দেখা গেছিল, বাড়ির পেছনে পানা পুকুরের দিকে যেতে.. যেমন রোজ সকালে যায়। সাত সকালে মেয়েটা হঠাৎ গেল কোথায়? ক'দিন আগে কলেজের পরীক্ষা শেষ হয়েছে বলে সকালের বাসে মামার বাড়ি চলে গেল? নাকি অন্য কোনও আত্মীয়ের বাড়ি? কাউকে না বলে একাই চলে গেল? প্রহ্লাদের বউ মুখে আঁচল গুঁজে দেওয়ালে পিঠ দিয়ে বসে শুধু ফুঁপিয়ে গেল । প্রহ্লাদ গেল পাশের গাঁয়ে শালার কাছে খোঁজ নিতে। পাড়ার, আর আশপাশের অঞ্চলের আর যারা এই খবর পেয়েছে তারা কেউ চিন্তিত হল, কেউ মুচকি হাসল, কেউ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শুধু বিপিন এসবের মাঝে গাল চুলকোতে চুলকোতে বলেছিল - 'সকাল থেকে ওই মনোহর বাবারও দেখা নাই। পেটটাও শান্তি দেয় না... কী যে করি!'
নাহ্, তিনদিন পার হয়ে যাওয়ার পরেও রুমকির কোনও খবর পাওয়া গেল না। আশপাশের গাঁয়ে কাছাকাছি কোনও জ্ঞাতির বাড়িতেও সে যায়নি। উলটে এতে পাঁচকান হচ্ছে বেশি দেখে প্রহ্লাদ ক্ষান্ত দিলো। স্বদেশ মাস্টারের সদোপদেশ মেনে পুলিশে এফআইআর করল - মিসিং কেস। আর সেই লোকটা... মানে মনোহর; তাকেও আর দেখা গেল না শক্তিপুর বা তার আশেপাশের কোথাও। জাগ্রতা মা পুজো পাচ্ছেন না দেখে বুড়োশিবতলার বামুন তারক ভচ্চাযের ভাইপো বিভূতিই যেচে পড়ে নিমতলায় এসে বসতে শুরু করল। মাকে ত্রিসন্ধ্যা জল-বাতাসা দেওয়ার দায়িত্ব এখন বিভূতির। তবে ওইটুকুই, ওকে কেউ তাবিচ-কবচ-মাদুলী... এসবের জন্য বলে না। আর, মনোহরকে খোঁজার জন্য এফআইআর করার কথা কেউ ভেবেছিল কি না... তাও আর জানা যায় নি।
--- --- ---
- খবরগুলো দেখলেই কেমন লাগে, মুসোলমান ছেলেগুলো বিয়ে করে নিয়ে যাচ্ছে... বলছে 'লাভ জেহাদ'!'
- থাম তো... ফালতু ব্যাপার যেতো। এগুলো নিয়ে লোকে টাইম পাস করে।
- তোমাদের গ্রামে লাভ জেহাদ হয়? এই যে তুমি আমাকে বিয়ে করে নিয়ে এলে। এটা লাভ জেহাদ হ'ল না?
কথাটা শেষে করে ঠাকুরের আসনের সামনে ধূপকাঠিটা রেখে একটা নমস্কার করল রুমকি, তারপর ছোটো প্লেট থেকে চারটে নকুলদানা তুলে এগিয়ে এলো শামসুরের দিকে। নকুলদানাটা একবার মাথায় ঠেকিয়ে মুখে চালান করে দিলো শামসুর। তারপর হাসতে হাসতে বলল " 'লাভ', মানে প্রেমের জন্য কেউ কোথাও সত্যিই জিহাদ করলে তোকে আমাকে এভাবে পালাতে হ'ত? এভাবে বর্ধমানে এসে নাম ভাঁড়িয়ে লুকিয়ে থাকতাম? "
শামসুরের মুখে একেবারেই দাড়িগোঁফ নেই, তাকে দেখে শক্তিপুরের কেউ এখন আর মনোহর বলে চিনতে পারবে কি না কে জানে? কিন্তু জুনিদপুরের লোকজন তো দেখলেই চিনবে! আপাতত, আরও একবার নাম পালটে এই বর্ধমানের একটা অনামী অঞ্চলে ভাড়াবাড়িতে থাকা ছাড়া বেচারার গতি নেই। রুমকি নাম পালটাতে পারেনি, তাহলে ওর আর নতুন কলেজে ভর্তি হওয়া হ'ত না।
চিত্রঋণ : পাবলো পিকাসো
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন