শনিবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১৮

মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়

পরিস্থিতি


‘শর্মিলা, এই শর্মিলা, একটু শুনে যাও না ।’ ঘুম জড়ানো গলায় ডাক দেয় অলক ।
ময়দা মাখা হাত নিয়েই ঘরে ঢুকে শর্মিলা চোখ পাকিয়ে বলে, ‘কী হল, উঠবে, তবে তো চা দেব নাকি ?’
‘না গো, চা নয় । সে তো উঠেই খাব ।’ বলে অলক ।
‘তবে এত হাঁকডাক কেন ?’ শর্মিলা ছদ্মরাগে বলে ।
‘তুমি বড্ড কুঁড়ে হয়ে যাচ্ছ । কদিন ধরে এত জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়েছে আর তুমি কম্বলগুলো রোদে দেবার নামগন্ধও করছ না ।’ একটু নিচুস্বরেই বলে অলক । জানে এর পরের কথাগুলো খুব একটা সুখকর হবে না ।
কিন্তু অবাক করে দিয়ে বিপরীত প্রতিক্রিয়া পায় শর্মিলার কথায় ।
‘আরে জানি তো । কিন্তু লতা আজ নিয়ে চারদিন আসছে না । হিমসিম খেয়ে যাচ্ছি সামলাতে । ঠিক আছে দেখছি । আজ যেভাবেই হোক রোদে দেব । কিন্তু তুমি উঠে পড়ো । নাহলে কিন্তু অফিসে লেট হয়ে যাবে ।’
অলক অফিসে আর কুন্তলা কলেজে বেরিয়ে যেতেই শর্মিলা ভাবে, আগে কম্বলগুলো ছাদে রোদে দিয়ে আসি । অলকটা খুব শীতকাতুরে । ঠান্ডায় বেচারা বড্ড কাবু হয়ে যায় ।
ছাদে উঠতে পাশের বাড়ির সিক্তাদির সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায় । এই ভদ্রমহিলাকে শর্মিলা একটু এড়িয়ে চলারই চেষ্টা করে । যত রাজ্যের পিএনপিসির খবর মজুত ওনার কাছে ।
সামান্য হেসে উল্টোদিকে পা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই ডাক দেন সিক্তাদি ।
‘শুনেছ শর্মিলা, রাজীবের ছেলেটা চোর হয়ে উঠেছে ! নিজের বাড়ির আলমারি থেকেই টাকা চুরি করেছে । রাজীব কী মারটাই না মারল ছেলেটাকে । আর কী অদ্ভুত ব্যাপার জান, ছেলেটা দাঁতে দাঁত চেপে মার খেল, তবু একটা কথা তো দূর, চোখ দিয়ে একফোঁটা জলও পড়ল না ।’
স্তম্ভিত হয়ে যায় শর্মিলা । হাত থেকে কম্বলগুলো আপনাআপনিই পড়ে যায় ।
বুবান এই কাজ করেছে ! এই তো সবে দশে পড়ল । কয়েকমাস আগেই কত ধুমধাম করে উপনয়ন হল । বাড়িতে এসে রাজীব আর মালা দুজনেই নিমন্ত্রণ করে গেল । মালা বলল, ‘জানোই তো শর্মিলাদি বুবানের অন্নপ্রাশনে কিছু হয়নি । রাজীবের মা তার একমাস আগে মারা গিয়েছিলেন । তাই আমার ইচ্ছে ওর পৈতেটা একটু ধুমধাম করে হোক । আর আমার বাবা-মায়েরও বয়েস হচ্ছে । ওনাদেরও একটা ইচ্ছে যে নাতির পৈতেটা দেখে যাবে ।’
‘আরে সে তো খুব ভাল কথা । কিন্তু বুবানটা যে বড্ড ছোট । এই তো নয় বোধহয় । পারবে তো সব নিয়মকানুন মানতে ?’ বলে শর্মিলা ।
‘হ্যাঁ গো পারবে, পারবে । ছেলেটা তো বড় বাধ্য, জানোই তো । জন্ম ইস্তক তো দেখছ । আর তুমি হলে ওর স্পেশাল মানুষ । জেঠিমা হয়েও মাসুন ।’ বলেই হেসে ফেলে মালা ।
ঠিকই তো । ছোট্ট বুবান একদিন কচি কচি গলায় ডেকেছিল মাসুন বলে । শর্মিলা হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘ওরে আমি তোর জেঠিমা হই ।’
দুটো গোলগোল চোখ মেলে মিষ্টি গলায় বলেছিল, ‘মাসুন !’
সেই বুবান নাকি চোর ! বুবানের মায়াভরা মুখটা বারবার ভেসে উঠছিল শর্মিলার চোখের সামনে । রাস্তায় দেখতে পেলেই দৌড়ে কাছে চলে আসবে । বলবে, ‘মাসুন ভাল আছ ? কোথায় যাচ্ছ ? সাবধানে যাবে । কুন্তলাদিদি কি কলেজ গেছে ?’
মেলাতে পারে না শর্মিলা । সব কিরকম তালগোল পাকিয়ে যায় । সিক্তাদি আরও কত কী বলে যায় । কানেই ঢোকে না শর্মিলার । শুধু বলে, ‘আমি আসছি সিক্তাদি । অনেক কাজ পড়ে আছে ।’
নিচে ঘরে এসে গুম হয়ে বসে পড়ে শর্মিলা । মনের মধ্যে একটা তোলপাড় চলে । বুবান তো সামনের রাস্তাটায় রোজ বিকেলে সাইকেল চালায় । গত দুদিন দেখেনি । তাহলে এইজন্যেই বুবান বাইরে বেরোয়নি !
রাতে অলককে সব কথা বলে শর্মিলা । অদ্ভুত এক নির্লিপ্ত মানুষ অলক । বলে, ‘ছাড়ো তো ওসব । ছেলে অন্যায় করেছে, বাবা তাই মেরেছে । এই নিয়ে এত মাথাব্যথার কিছু নেই ।’
কিন্তু শর্মিলা এত সহজে ব্যাপারটা ঝেড়ে ফেলতে পারে না । মনে মনে ভাবে, আজ হোক, কাল হোক, বুবানকে বাইরে বেরোতে দেখলেই ব্যাপারটা বুবানের মুখ থেকেই জানবে ।
কিন্তু একদিন, দুদিন, তিনদিন, এই করে সাতদিন কেটে গেল, বুবানের দেখা মিলল না । অথচ বুবানদের বাড়িতে গিয়েও খোঁজ নিতে পারল না । যদি মালা কিছু মনে করে ।
আটদিনের মাথায় বাইরের জানলা দিয়ে শর্মিলা দেখল বুবান সাইকেল চালিয়ে ওদের বাড়ির দিকেই আসছে । অবশ্য এই ছোট রাস্তাটা, এটাই বুবানের সাইকেল চালানোর রুট । নিজেদের বাড়ি থেকে শর্মিলাদের বাড়ি ।
বুবান কাছাকাছি আসতেই শর্মিলা ডাকে, ‘বুবান, একবার আয় ।’
বুবান সাইকেল থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, কিন্তু কাছে আসে না । মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে ।
‘আয় না সোনা, দরকার আছে আমার ।’ আবার ডাকে শর্মিলা ।
গুটিগুটি পায়ে  ঘরের ভিতরে এসে দাঁড়ায় । কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ‘কী হয়েছিল রে ? বাবা মেরেছিল কেন ?’
চোরের ঠ্যাঙানি খেয়ে যে ছেলে কাঁদেনি, সেই ছেলে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল ।
বলল, ‘কী করব মাসুন, বাপি তো ঠিক করে খেতে দেয় না । অর্ধেকদিন রান্নাই করে না । খিদে পেয়েছে বললে, বলে বিস্কুট খা । তুমিই বলো মাসুন, বিস্কুটে কি খিদে মেটে ?’
‘এই দাঁড়া দাঁড়া । তোর বাবা রান্না করবে কেন ? তোর মা কোথায় ?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে শর্মিলা ।
বুবান বলে, ‘তোমরা তো কেউ জানো না মাসুন । মা তো মামারবাড়ি চলে গেছে । অনেকগুলো দিন, মনে হয় একমাস হবে । বাপি আর মায়ের তো খুব ঝগড়া হত অনেকদিন ধরে । শেষকালে মা চলে গেল । আমাকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিল । কিন্তু বাপি কিছুতেই যেতে দেয়নি । মা বলেছিল, ছেলেটা তো তোমার পথের কাঁটা হবে । তার থেকে আমি নিয়ে যাই আমার ছেলেকে । তাও বাপি যেতে দেয়নি । আবার এখন বাপি কী বলে জানো ? আর কিছুদিন পরেই নতুন মা আসবে । তখন পেট ভরে খাস । আচ্ছা মাসুন, নতুন মা মানে তো স্টেপমাদার, তাই না ?’
শর্মিলা কী বলবে, সে তো স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে ছোট্ট ছেলেটার মুখের দিকে ।
বুবান নিজের মনেই ঘাড় নেড়ে বলে যায়, ‘আমি জানি, স্টেপমাদাররা খুব খারাপ হয় । খেতে দেয় না, ভালবাসে না । শুধুই মারে । আমি তো তাই টাকা চুরি করেছিলাম । ভেবেছিলাম পেট ভরে খাব । তারপর ট্রেনে করে মামারবাড়ি চলে যাব । কিন্তু হল না গো মাসুন । আর আদর করে ভালবেসে কেউ আমায় খাওয়াবে না । আধপেটা খেয়ে, মার খেয়েই থাকতে হবে ।’ অঝোরে কাঁদতে থাকে বুবান ।
শর্মিলা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে । ভাবে, এ কোন্‌ বুবান ? নির্দয় পরিস্থিতির চাবুক কী করে এইটুকু সময়ের মধ্যে এত পালটে দিল ছোট্ট ছেলেটাকে !
চিত্রঋণ : পাবলো পিকাসো 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন