অভিযোজন (৩)
এ বাড়িতে একমাত্র স্থায়ী রোজগার উমার ...সে একটা সরকারি স্কুলে প্রাইমারী সেকশনের শিক্ষিকা ।বিএ ,বি টি পাশ করে বছর চারেক হলো স্কুলের চাকরিটা করছে সে ।তবে ইদানিং তার আয়ের সিংহভাগটাই চলে যায় সংসারে ।চার বছর চাকরি করলেও বিশেষ কিছু জমাতে পারেনি উমা ।তাই ধবধবে ফর্সা রঙ ,সুন্দর মুখশ্রী থাকা স্বত্ত্বেও একটা কাঠিন্য তার চেহারা ও স্বভাবে ছাপ ফেলে চলেছে ক্রমশ । বড়দা প্রমোদ ব্যাংকের ক্লার্ক ...বিয়ের আগে সংসারে তাঁর অবদান থাকলেও ,বছর সাতেক হলো বিয়ে করে যাদবপুরে অফিসের কাছাকাছি আলাদা থাকেন ...বৌ আর ছ 'বছরের ছেলে নিয়ে নিজের সংসারের দায় সামলাতেই ব্যস্ত ।এ বাড়ীতে আসেন কালেভদ্রে ...পুজোয় মা আর বোনকে দু খানা শাড়ি দেওয়া ছাড়া এ সংসারের প্রতি আর কোন কর্তব্য অবশিষ্ট নেই তাঁর ।মেজদা প্রণবের চাকরিটা স্থায়ী নয় ...ধর্মতলায় একটা ওষুধের কোম্পানিতে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভের কাজ করে ...রোজগারও তেমন নয় ।এর মধ্যেই আড়াই বছর আগে দুম করে পাশের পাড়ার মেয়ে মল্লিকাকে বিয়ে করে , পরপর দু বছরে দুটো মেয়ের বাবা হয়ে বসল ।ফলত বিধবা মা আর ছোট ভাই প্রসূনের সব দায় তো বটেই ...বলতে গেলে গোটা সংসারটাই এসে চাপল উমার ঘাড়ে ।বাবা মারা গেছেন সেই কবে ...তাঁর জমানো টাকা আর কিছুই তেমন অবশিষ্ট নেই ।নিজের বিয়ে এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে ক্রমশ অনিশ্চয়তা বাড়ছে উমার ...তারই ফলশ্রুতি তার উত্তপ্ত মেজাজ ।আজকাল ভাইরা তো বটেই ...মা ও রীতিমতো সমঝে চলে তাকে ।বৌদি মল্লিকা অবশ্য ভারী ঠান্ডা মেয়ে ...যথাসম্ভব মন জুগিয়ে চলে তার ...তবু তাকে দেখলেই কেন যে মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে , বুঝতে পারে না উমা ।
ঝোঁকের মাথায় মল্লিকাকে কালীঘাটের মন্দিরে নিয়ে গিয়ে সিঁদুর পরিয়েছিল প্রণব ...মল্লিকার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার শেষ দিনে । নিজের বিদ্যে যদিও স্কুল ফাইনালের বেশি এগোয়নি তবু নিজের বিশ্বজিত মার্কা চেহারাটা দিয়ে প্রণব বেশ ইমপ্রেস করে ফেলেছিল মল্লিকাকে ।মাত্র দু মাসের প্রেম ...তারপরেই বিয়ে করে তাকে ঘরে নিয়ে তুলেছিল প্রণব ।রোজগারের কোন স্থিরতা নেই ,তাই এ বিয়েতে সায় ছিল না কোনো পক্ষেরই ।দু দিন বাদেই মল্লিকাকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন ভারতী , মাসখানেক বাদেই বুঝেছিলেন মল্লিকা অন্তঃসত্ত্বা ...অতএব সামাজিকভাবে বিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায়ই থাকলো না কোনো পক্ষেরই ...এমনিতেই তো পাড়ায় কান পাতা যাচ্ছিল না !
তিতলি হওয়ার পর অভাব থাকলেও এক ঝলক টাটকা হাওয়ার মতো আনন্দ এসেছিল সংসারে ।উমার কঠিন মনও দ্রবীভূত হচ্ছিল আস্তে আস্তে ।তিতলির একবছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ফের দুঃসংবাদ !...দুঃসংবাদই বটে ...মল্লিকা বুঝতেই পারেনি তার শরীরে ফের বেড়ে উঠছে আরো একটা প্রাণ ।ততদিনে প্রণবের প্রেম এসে দাঁড়িয়েছে কঠোর বাস্তবের কাঠগড়ায় ! নামমাত্র রোজগারে কি করে দুটো বাচ্চার বাপ হতে চলল এ নিয়ে উমার অভিযোগের উত্তরে দৈনন্দিন চাপান-উতোরে বাড়ির পরিবেশ উত্তপ্ত হতে শুরু করল । একটু আধটু অভ্যেস আগেই ছিল ...এবার নিয়মিত মদ্যপান শুরু করল প্রণব ।আগে যত্সামান্য টাকাপয়সা যাও বা দিত সংসারে , এখন তাও অনিয়মিত হয়ে উঠল ,উমার ওপরেই ক্রমে সংসারের যাবতীয় চাপ এসে পড়তে লাগলো । মেজদা তো বটেই মেজবৌদিকে দেখলেও আজকাল মাথার ভিতরে আগুন জ্বলে ওঠে উমার ...ওদের জন্যই তো আজ নষ্ট হতে বসেছে তার জীবনটা !
মর্নিং স্কুল উমার ।দুপুরবেলা স্কুল থেকে ফিরে স্নান সেরে মল্লিকার উদ্দেশ্যে চিত্কার শুরু করল সে "এই যে নবাবনন্দিনী , খেতে দেবে না কি পেটে কিল মেরে বসে থাকবো ! ...সেই সাতসকালে নামমাত্র কিছু মুখে দিয়ে বেরিয়ে যাই , খেটেখুটে এসে টাইমলি ভাতটাও পাব না নাকি ! সারাদিন ঘরে বসে বসে করটা কি ..."তার কথা শেষ না হতেই প্রভা ডাকলেন "খাইতে দিসি ...আয় ।"
"তুমি কেন ?...তোমার মেজবৌমা গেল কোথায় ?"গজগজ করতে করতে রান্নাঘরে ঢুকলো উমা ।নির্বিকারমুখে প্রভা বললেন ,"ভারতী আইস্যা অগো লইয়া গেসে গিয়া...তর মেজদা তো কাইল রাতে বাড়ি ফেরে নাই ,কই ছিল কি জানি ! আইজ সকালে বাড়ি ফিরার পর বৌমা বোধহয় কিসু কইসে ... তার লাইগ্যা বৌয়ের গায়ে হাত তুলসিল ...আমি প্রসূনরে দিয়া ভারতীকে ডাইক্যা কইসি অগো লইয়া যাইতে ..."
কি জানি কেন হঠাতই খিদেটা মরে গেল উমার ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন