প্রথম বৃষ্টি
“ জানো শ্রীতমার সঙ্গে
ভীষণ মিল তোমার । “, হোয়াটসঅ্যাপে কী যেন টাইপ করতে করতে বলল রিয়া ।
অফিসফেরত চা খেতে খেতে
বিছানায় আধশোয়া হয়ে নতুন কেনা থ্রিলারের পাতা ওলটাচ্ছিলাম । ভুরু কুঁচকে জিগ্যেস
করলাম , “ কে শ্রীতমা ? “
স্মার্টফোন থেকে চোখ
তুলে বিরক্ত মুখে রিয়া বলল , “ এত ভুলে যাও কেন তুমি ? অর্কর মায়ের কথা কতবার
বলেছি তোমায় … “
আমি ঢোক গিলে বললাম , “
ইয়ে … মানে … কোন অর্ক যেন … “
মোবাইল বন্ধ করে রিয়া
সটান চাইল আমার দিকে । রাগের আঁকিবুকিতে গনগনে হয়ে উঠল ওর মুখটা । উষ্ণ গলায় বলে
উঠল , “ তুমি আমার কোন কথাই শোন না মন দিয়ে । আর কিচ্ছু বলব না তোমাকে … “ , বলতে
বলতে ঝটিতে খাট থেকে নেমে পড়ল ।
আমি প্রমাদ গুনলাম । আসলে রিয়া এত কথা বলে আর এত বিষয় বৈচিত্রে
সেসব ভরপুর থাকে , আমি সবটুকু ঠিকঠাক ধরে রাখতে পারিনা মাথায় । পরে কথায় কথায় সেটা
প্রকাশ হয়ে পড়লে ও খুব হার্ট হয় ।
আঁতি পাঁতি করে খুঁজছিলাম অর্ক আর তার মাকে । মনে পড়ল । আমার ছেলের
সঙ্গে পড়ে।একই স্কুলে নয় , এক কোচিং ক্লাসে । ছেলের সঙ্গে অর্কর যত না বন্ধুত্ব , রিয়ার সঙ্গে অর্কর মায়ের বন্ধুত্ব তার চেয়ে বেশি । সদ্য সদ্য গড়ে
ওঠা বন্ধুতার গাঢ়ত্ব যে ক্রমশই
বাড়ছে ইদানীং মাঝে মধ্যেই সেটা মালুম হচ্ছিল ।
. মা , বাবা ওপরের ঘরে , ছেলে কোচিংএ । চোখে দুষ্টুমি নিয়ে রিয়ার
একটা হাত ধরে টান দিলাম । আমার গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল । দুহাতের বেষ্টনীতে
জড়িয়ে নিলাম ওকে । ঘটনার আকস্মিকতায় লালচে হয়ে উঠল ওর মুখ । ছদ্মরাগে বলে উঠল , “
ছাড়ো ! আমার কথার কোন গুরুত্বই নেই তোমার কাছে … “
ওর গাল টিপে বললাম , “
তোমাকে রাগাচ্ছিলাম । অর্ক ছেলের বন্ধু । আমি জানি । “
পলকেই উজ্জ্বল ওর মুখ । আমার হাত ছাড়িয়ে উঠে বসল । উৎসাহিত গলায়
বলল , “ শ্রীতমা , মানে অর্কর মা একদম তোমার মত । “
১
মজার গলায় বললাম , “
তুমি কি অর্কর মাকে পুরুষালি বলছ না কি আমাকে মেয়েলি বলছ ?“
“ ধ্যাত ! “ , হেসে
ফেলল রিয়া , “ শ্রীতমা খুব সুন্দর দেখতে । আমি বলতে চাইছি ও তোমার মতই রোম্যান্টিক । “
“ কী রকম ? “ , গলায়
বাড়তি উচ্ছাস ফুটিয়ে জিগ্যেস করি ।
“ এই তো , কাল ছেলেদের
কোচিংএ পৌঁছে ফেরার মুখে ঝড় উঠল রাস্তায় । দেখতে না দেখতেই ঝেঁপে বৃষ্টি এল । আমি
তো ব্যাগ হাতড়ে ছাতা খুঁজছি , শ্রীতমা বলে উঠল – ‘ ছাতা খুঁজছ কেন ? বছরের প্রথম
বৃষ্টি । ভিজতে ভালো লাগে না তোমার ? ‘
“ আমি তো থ ! বলে
ফেললাম , ‘ একদম পোষায় না গো । ভিজলেই ঠাণ্ডা লেগে যায় ।‘ বেচারি আর কী করে ?
বাধ্য হয়ে বের করল ওর ছাতাটা … “
শুনতে থাকার ভঙ্গি করে
আমি সন্তর্পণে উল্টে যাই থ্রিলারের আর একটা পাতা । রিয়া সোৎসাহে বলতে থাকে , “ …
তোমার সঙ্গে আরও মিল আছে । ও তোমার মতই সফট হার্টেড , কাউকে কটু কথা বলতে পারে না
। অত বড় চাকরি করে , অথচ টাকা পয়সার সব ঝামেলা ওর বর সামলায় ; তোমারটা যেমন
সামলাতে হয় আমাকে । আর তোমার মতই বই পড়ার নেশা । কত যে বই কেনে …”
বলতে বলতেই হোয়াটস অ্যাপ থেকে ভদ্রমহিলার ডি পি টা বের করে আমার
সামনে ধরে বলে ওঠে , “ দেখ , কী সুন্দর দেখতে ! তোমার সঙ্গে বিয়ে হলে একেবারে
রাজযোটক হত । “ , হাসতে হাসতে একেবারে গড়িয়ে পরে রিয়া ।
চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিতে দিতে এমন বিষম খেলাম মুখের থেকে চা
ছিটকে বই , বিছনা সব ভিজে গেল । অপ্রতিভ মুখে আমার পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে “ সরি “
“ সরি “ বলতে থাকে রিয়া ।
অনেক রাতে আবার বৃষ্টি নামল । ঘুম আসছিল না । একটা সিগারেট ধরিয়ে
পিছনের রেলিং ঘেরা বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম । বৃষ্টিতে আবছা হয়ে আছে চারদিক । সেই
আবছায়ে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল একটা ছবি … মফস্বল শহরের তুমুল বৃষ্টি নামা রাস্তা দিয়ে
সামনে একটা মেয়েকে বসিয়ে উদ্দাম গতিতে সাইকেল চালাচ্ছে ছেলেটা … এলোমেলো হাওয়ার
সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ওদের এলোমেলো কথা … হাসি … ওরা ভিজে যাচ্ছে প্রথম ভালবাসার
বৃষ্টিতে … আচ্ছা , অর্কর মাকেও কি রিয়া তার বরের গল্প করেছে ? …
চমকে উঠলাম সহসাই । গাল বেয়ে লোনা জলের স্বাদ ঠোঁটে … নাগরিক
রাত্রি ভিজছে ভালবাসার বৃষ্টিতে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন