শনিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৮

বনবীথি_পাত্র

লুকোচুরি

.
হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনটা ঠিক সময়েই ছাড়ল । ব্যস্ত প্লাটফর্মের সীমানা ছাড়িয়ে , সব হৈ-হট্টগোলকে পিছনে ফেলে চলতে শুরু করেছে , আসতে আসতে বাড়ছে চলার গতি । জানলার ধারে করিডরের পাশে যে দুটো করে বসার সিট থাকে , সে দুটোই আজ রাতটুকুর জন্য বরাদ্দ হয়েছে ওদের নামে । ভারী লাগেজ কোনদিনই পছন্দ নয় ঋষির । কিন্তু এবারের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা । শাওনকে নিয়ে এই ওর প্রথম ঘুরতে যাওয়া । স্বাভাবিক ভাবেই লাগেজ একটু বেশি । লাগেজগুলোকে ঠিকঠাক গুছিয়ে রেখে , নিজের সিটে বসে । 
শাওন অপলক দৃষ্টিতে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ।
রিজার্ভেশন করার সময় এসি তে করতে চেয়েছিল ঋষি । কিন্তু শাওন রাজি হয়নি , ট্রেনের জানলা দিয়ে বাইরের পৃথিবীটাকে দেখতে না পেলে ওর নাকি দমবন্ধ হয়ে যায় ।
সদ্য তিনমাস বিয়ে হয়েছে ওদের । খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে নিতান্ত সম্বন্ধের বিয়ে । বিয়ের আগে দুবার ফোনে কথা হয়েছিল । প্রেম বলতে পুরোটাই বিয়ের পরে । অদ্ভুত রকমের গভীরতা আছে শাওনের ভালোবাসায় । সেই গভীরতায় প্রতিপলে নিজেকে খুঁজে বেড়ায় ঋষি , শাওনকেও খুঁজে পেতে চায় নিজের মধ্যে । কিন্তু তিনমাসে শাওনকে সেভাবে আজো বুঝে উঠতে পারেনি । সবটুকু দিয়েও কেমন যেন আড়ালে রাখে নিজেকে । নাকি নিজের কথাটুকু মুখ ফুটে বলতে পারেনা , কে জানে ?
ছোট স্টেশনে এক্সপ্রেস ট্রেন দাঁড়ায় না , একটা জংশন  স্টেশনে ট্রেনটা দাঁড়াতেই চিন্তার ঘোরটা ভেঙে গেল ঋষির । বৌকে নিয়ে হানিমুনে যাচ্ছে আর কি উল্টোপাল্টা সব ভাবছে । জানলা দিয়ে হকারের কাছ থেকে দুভাঁড় চা কিনে , একটা ভাঁড় ধরিয়ে দেয় শাওনের হাতে ।
উফ্ , শ্রীমুখের ঐ একচিলতে হাসিতেই ঘায়েল ঋষি । এতক্ষণের হাবিজাবি চিন্তা মুহুর্তে উধাও । কাঁচাহলুদ রঙের ল্যাগিংস আর সাদা-সবুজে ছাপা কুর্তিতে আজ ভীষণ উজ্জ্বল লাগছে শাওনকে । মুখে অল্প কথা বললেও চোখেই অনেক কথা বলে দেয় নীরবে । 
ট্রেনটা আবার চলতে শুরু করেছে , বাইরে অন্ধকার হয়ে গেছে । দূরে জ্বলতে থাকা আলোগুলোকে আকাশের তারার মতো লাগছে , কে যেন অগোছালো ভাবেই সাজিয়ে রেখেছে । ঠান্ডা শিরশিরে বাতাস আসছে জানলা দিয়ে , শীত যে আসছে এ তার-ই আগাম নিশানা । ঋষি জানলাটা বন্ধ করতে চাইলে বাধা দেয় শাওন ।
আর একটুক্ষণ খোলা থাক , একটু পরে বন্ধ করো ।
সুন্দরী বৌ , তায় আবার একবারে নতুন , তার কথা অমান্য করার ক্ষমতা ঋষির নেই ।
বাইরের ধূ ধূ অন্ধকারের যে কি দেখছে বুঝতে পারেনা ঋষি ।
পাশের কয়েকটা সিট ফাঁকা ছিল , দুটো বিশাল বিশাল ট্রলিব্যাগ আর কাঁধে একটা ব্যাগ নিয়ে এক ভদ্রলোক সিট নম্বর খুঁজতে খুঁজতে সেখানে এসে পৌঁছালেন । হাওড়া থেকে নয় , আগের স্টেশনে উঠেছেন নিশ্চই । সাথে এক ভদ্রমহিলা আর কোলে বোধহয় ছোট বাচ্চা , চাদর দিয়ে  এমনভাবে ঢাকা যে ভদ্রমহিলার মুখটাও ঢেকে গেছে । ভদ্রলোককে দেখে মায়া হয় ঋষির , ট্রলিগুলোকে সিটের তলায় ঢোকাতে সাহায্য করে ভদ্রলোককে । সহযাত্রীদের সাথে যেচে আলাপ করা ঋষির স্বভাব । একটা হালকা থ্যাংস দিয়ে এড়িয়ে গেলেন ভদ্রলোক । এহেন ব্যবহারে বেশ আশ্চর্য ঋষি । ভদ্রলোক বৌ বাচ্চাকে ঠিক করে বসাতেই ব্যস্ত । পাশের জানলাটা ভালো করে আটকে দিচ্ছে যাতে হাওয়া না আসে । একবার বিরক্ত চোখে ঋষিদের পাশের খোলা জানলাগুলোর দিকে তাকান ভদ্রলোক । 
বৌটার মুখ থেকে চাদরের আড়ালটা সরে যেতেই স্মৃতিতে ধাক্কা খায় ঋষি , পূর্বা না ?
                      না না পূর্বা ঋষির পুরানো প্রেমিকা নয় , পুরানো বান্ধবীও নয় ....এক কলেজে , এক ডিপার্টমেন্টে পড়ার সূত্রে মুখচেনা ছিল মাত্র । যতই সুন্দরী হোক বড়লোকের আদুরে নেকুপুষু মেয়ের সাথে প্রেমের কথা ভাবতেও পারে না ঋষি । আর এই মেয়ে তো বিশ্বন্যাকা ছিল , সুন্দরী বলে অহংকার ও কম ছিলনা । সেবার কলেজ থেকে পিকনিক করতে গিয়েছিল শান্তিনিকেতন । উফ্ তখন ন্যাকামির চূড়ান্ত করেছিল পূর্বা !!!! ধূলো বলে বাস থেকে নামতেই চাইছিল না । বান্ধবীদের জোরাজুরিতে যদি বা নেমেছিল মাঠে বসে খেতে পারল না , ঐভাবে খেতে ওর নাকি লজ্জা করে । সেদিন সবাই রেগে গিয়েছিল ওর ওপর , ওর পিকনিকে না এসে ফাইভ স্টার পার্টিতে যাওয়া উচিত ছিল ।
সেই মেয়ে আজ কত সহজে ট্রেনে এত মানুষের মাঝেই যতটা সম্ভব আড়াল করে বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছে । ন্যাকাটা বেশ জব্দ হয়েছে এতদিনে , ভাবতে গিয়েও কেমন একটা সিমপ্যাথি কাজ করে ঋষির মনে । মেয়েরা মা হলে কত সহজে পাল্টে যায় !!!!
নিজেই একটু লজ্জা পেয়ে ওদিক থেকে চোখ সরাতেই শাওনের সাথে চোখাচোখি , অবাক হয়ে দেখছে ঋষিকে । এই রে এমন ক্যাবলার মতো হাঁ করে পূর্বাকে দেখছিল , কিছু ভাবলো কি না কে জানে !!!!
পরিস্থিতি একটু বদলাতে অকারণ কিছু কথা বলতে থাকে শাওনের সাথে । ট্রেন চলছে দুরন্ত গতিতে , মাতাল হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে শাওনের কপালের ঝুরো চুলগুলো । এবার সত্যি বেশ শীতশীত করছে , আর কোন বারণ না শুনে জানলা বন্ধ করে দেয় ঋষি । জানলা বন্ধ করতে গিয়ে আলগোছে ছুঁয়ে যায় শাওনকে । শাওন হালকা হেসে চোখ বড়বড় করে কপট শাসন করে ঋষিকে । ঋষি কি আর এই চোখের শাসনের পরোয়া করতো , নেহাত ট্রেন ভর্তি লোক তাই ।
         রাতের খাবার খেয়ে এবার শোয়ার পালা । মেয়েকে কোলের কাছে নিয়ে পূর্বা লোয়ার বার্থে আর ওর স্বামী মিডিলে । শাওন লোয়ার বার্থে শুতে অস্বস্তি পাচ্ছে , গায়ের পাশ দিয়ে মানুষজন যাতায়াত করবে ওর ঘুম হবেনা তাতে । অগত্যা বিবিকে ওপরতলায় তুলে নিজেও শুয়ে পড়ে ঋষি , গায়ে চাদরটা জড়িয়ে নেয় আরাম করে । ট্রেনে ঘুমটা ভালোই হয় ঋষির । আচমকা একটা ঝাঁকুনিতে ট্রেনটা থেমে যেতেই যেন ঘুমটা ভেঙে যায় । স্টেশনে যেমন ভাবে থামে , ঠিক যেন তেমনভাবে নয় , যেন হঠাৎ-ই থেমে গেল ট্রেনটা । বাইরে ভোরের আলো এখনো ভালো করে ফোটেনি । রাতের অন্ধকার আর দিনের না ফোটা আলোর এক স্বপ্নালু আবেশ । ঋষির মতই আরো কিছু যাত্রীর ঘুম ভেঙে গেছে ।  ঘুম জড়ানো চোখে সবাই মাপতে চাইছে পরিস্থিতির গভীরতা । শাওন নিশ্চিন্তে ঘুমচ্ছে , ওর গায়ের চাদরটা ভালো করে টেনে দেয় ঋষি । 
বাচ্চার ঘুম ভেঙে যাওয়ায় জেগে উঠেছে পূর্বা । ওর স্বামী বার্থ থেকে নেমে এসে পূর্বার উঠে বসার ব্যবস্থা করে দেয় । বাসী  কাজল রাতজাগা ক্লান্তির মতো লেগে আছে পূর্বার চোখে । এই প্রথমবারের জন্য পূর্বার সাথে চোখাচোখি হয় ঋষির । চেনা-অচেনার দ্বন্দমাখা ক্ষণিকের দৃষ্টিপাত , তারপরেই যেন ইচ্ছা করেই মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয় পূর্বা ।
যেমন হঠাৎ করে থেমেছিল , তেমন হঠাৎ-ই চলতে শুরু করল ট্রেনটা । অনেকে শুয়ে পড়লেও ঋষির আর শুতে ইচ্ছা করে না । মনটা বড্ড চা চা করছে , একটু চা হলে বেশ আমেজের সাথে শুরু হতো সকালটা । পূর্বা মেয়েকে নিয়ে আবার শুয়ে পড়েছে , ওর স্বামী সিটের একধারে বসে আছে চোখ বন্ধ করে । হয়ত রাতের বাকি ঘুমটা শেষ করার চেষ্টা করছে । অদ্ভুত মানুষ ইনি , নিজের স্ত্রীর সাথেও প্রয়োজনের কথাটুকু ছাড়া কথা নেই । কি জানি ওরা কোথায় যাচ্ছে , বেড়াতে নাকি নেহাৎ-ই প্রয়োজনের যাত্রা এটা !!!!
আস্তে আস্তে সকাল হচ্ছে , রক্তিম আলোর রেখায় যেন ঘুম ভাঙছে প্রকৃতির । শাওন ঘুম ভাঙতেই এসে বসেছে জানলার ধারে । ঋষি ইশারায় সকালের পাওনাটা চাইতেই লজ্জা পেয়ে যায় শাওন । লজ্জা পেলে এতো মিষ্টি লাগে শাওনকে ......
চা চলবে নাকি ?
উফ্ এই সময়েই ....
হঠাৎ করে কথাটা শুনে ঘুরে তাকাতেই অবাক ঋষি , পূর্বার স্বামী চা অফার করছে !!!!
হাসি মুখে এগিয়ে দেওয়া চায়ের কাপটা ধরে নেয় ঋষি ।
দ্বিতীয় কাপটা এগিয়ে যায় শাওনের দিকে । চায়ের নেশা না থাকলেও সহজেই টিব্যাগ ডোবানো চায়ের কাপটা ধরে নেয় শাওন । হয়তো পুরোটাই ভদ্রতা অথবা আজ একটু অন্যভাবে সকালটা শুরু করার ইচ্ছা ।
ঋষি পকেট থেকে চায়ের দাম দিতে গেলে বাধা দেন ভদ্রলোক । এবারের টা নাহয় আমি দি , পরেরবার আপনি দেবেন ।
আলাপের ছুতো তো ঋষি কাল থেকেই খুঁজছিল । তাই গল্পে মজে যেতে বেশি সময় লাগল না । ঋষি যেমন ভালো বক্তা , অম্লানবাবু তেমন ভালো শ্রোতা ।
ঋষিদের হানিমুন হলেও ওনাদের যাওয়া নিতান্তই পারিবারিক প্রয়োজনে । অম্লানবাবুরা আগে নামবেন , তার কিছু পরে ঋষিরা । পূর্বা চায় কিনা বুঝতে না পারায় পুরনো পরিচয়ের প্রসঙ্গ তোলে না ঋষি । আর শেষ হয়ে আসছে যাত্রার সময়কাল , আর ঘন্টাখানেক খুব বেশি হলে ।
অম্লানবাবুকে এড়িয়ে হালকা নজরে পূর্বাকে ছুঁয়ে যেতে বেশ লাগছে ঋষির । অম্লানবাবু এই নজরটা ঘোরাতেই বোধহয় যেচে আলাপ করতে এল , অথচ সে ওষুধেও কাজ না হওয়ায় মুখে হালকা বিরক্তির রেখা । সুন্দরী বৌকে সাথে নিয়েই অন্যের স্ত্রীকে আলগোছে দেখা আর বিশেষ করে অম্লানবাবুর বিরক্তিটা মনে মনে বেশ এনজয় করছে ঋষি । তবে ওর বৌকে কেউ যদি এমন করতো কিছুতেই সহ্য করতো না , একটা শিক্ষা দিয়ে ছাড়ত তাকে ।
পরের স্টেশনে নামবে পূর্বারা , ওদের লাগেজ দরজার কাছে নিয়ে যেতে সাহায্য করে ঋষি । পূর্বা বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে এগিয়ে এসেছে , অম্লানবাবু আসার আগে শাওনকে হয়ত বলে আসছিলেন । কি বললেন সেকথা শুনতে পায়নি ঋষি । তবে কাছাকাছি এসে পড়ায় শাওনের মৃদু উত্তর আলতো কানে আসে ঋষির ।
"আমাকে ছেড়ে এভাবেই তো আগে নেমে গেছো ......"
ওনারা নেমে গেছেন , ট্রেন চলছে শুরু করেছে । শাওন উদাস দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে । কোন অনুভূতি যেন ওকে স্পর্শ করছে না ।
নিজেকে ভীষণ বোকা মনে হচ্ছে ঋষির । অম্লানবাবুর সাথে লুকোচুরি খেলতে গিয়ে নিজেই যেন ধরা পড়ে গেল । কোন বহিঃপ্রকাশ ছাড়াই একটা গভীর দাগ রেখে গেল ঋষির জীবনে । তাই কি শাওন আজো এতো উদাসীন !!!!
বাইরের হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে শাওনের কপালের ঝুরো চুল । এদিকে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে ঋষির ভাবনাচিন্তা ।
ট্রেন আপন গতিতে এগিয়ে চলেছে গন্তব্যের দিকে 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন