খুব ছুটছিল তিলু ওরফে তিলোত্তমা।বাবার মৃত্যুর দিন কয়েক পরেই সেই ছুট শুরু হয়েছিল।বিধবা মায়ের পেনশনের টাকায় খাওয়া খরচ তো জুটে যায় কিন্তু পড়া চালানোর খরচ সে জোটায় টিউশনির টাকায়।স্কুলে যায় ফিরে আবারও টিউশনি।অদম্য উৎসাহে উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্টও ভালো করে সে।কিন্তু হলে হবে কি বিধি বাম।মার ছিল বিয়ে দেওয়ার তাড়া।তাই পড়াশোনায় ইতি।বিএসসি পড়ার ইচ্ছা ঘুচিয়ে সে বসলো বিয়ের পিঁড়িতে।পাত্র বারকয়েকের চেষ্টায় মাধ্যমিক পাশ।ব্যবসায়ী, যৌথ পরিবার, স্বচ্ছল পরিবার।আর কি চাই?এতো ভালো পাত্র হাতছাড়া করতে আছে?হঠাৎই পরিবর্তনের এই সংকেতে নিজেকে মরুভূমির রাজ্যে পায় তিলু।
কেটে গেল আরও উনিশটি বছর।তিলোত্তমা আজও সংসারের যাতাকলে বন্দী।সকাল থেকেই চলে তার কর্মযজ্ঞ।পুরো সংসারের দায়িত্ব তার।উঠোনের তুলসী গাছটিও যেন অপেক্ষা করে থাকে তার হাতে জল পেতে।
চায়ের টেবিলে যখন বড়রা আড্ডা মারেন অন্য টেবিলে আরও তিনজন দুধের গ্লাস হাতে খুনসুটিতে মেতে ওঠে।বড়টি নন্দিতা, তিলোত্তমা আর বড়কর্তার একমাত্র মেয়ে।বাপ্পা আর রাজামেজ ও ছোট জায়ের ছেলে।তিলোত্তমা র দৌলতে এ বাড়িতে এখনো টিউশনির মাষ্টারের প্রবেশ ঘটে নি।সন্ধের পর ছোট দুই জা রান্না ঘরের দায়িত্ব নেয়।তিলু তখন বাচ্চাদের পড়ানোর ঘরে।রেজাল্ট খুব ভালো করে তারা। তাই এই একটা ব্যাপারে প্রচ্ছন্ন সম্মান অর্জন করেছে বাড়ির সবার কাছে থেকে।যদিও বাড়ির বড়কর্তার আদেশই শেষ কথা তবুও শান্ত, স্নিগ্ধ, সুশ্রী বড়বৌটিকে সবাই একটু সমীহ করে,ভালোওবাসে।কারণ সেই তার ব্যবহার ওআচরণ।বাপ্পা ও রাজা মাধ্যমিকে তিনটিতে স্টার মার্ক পেয়েছে সে শুধু তাদের বড় জেম্মার জন্য।সে কথা এবাড়ির সবাই জানে।তবু বড়কর্তার সামনে সে স্বীকৃতি দেওয়ার সাহস কারো নেই।
তাতে তিলোত্তমার কোন হেলদোল নেই।সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত শুধু কাজ আর কাজ।মেশিন আর বড়গিন্নী যেন এক।কর্মনিষ্ঠায় সে সদা ব্যস্ত।
এই পরিবারে মহিলাদের মতপ্রকাশের কোন জায়গা নেই।সেটা স্পর্ধা মানা হয় এই পরিবারে।একমাত্র সন্তান নন্দিনীর জন্মানোর পর তার উপর যা ব্যবহার হয়েছে তা ভাবলেই শিউরে উঠতে হয়।দ্বিতীয় সন্তান পেটে এলে তার লিঙ্গধারন পরীক্ষায় যেতে রাজি না হওয়ায় বড়কর্তা পঙ্চননবাবু রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে স্ত্রীর পেটে লাথি মারেন।অসহ্য যন্ত্রণা আর রক্ত ক্ষরণে জ্ঞান হারায় তিলোত্তমা।পেটের পুত্র সন্তানটিও নষ্ট হয়।চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় তার মা হওয়া।সেই থেকে সে চুপচাপ।কলঙ্কিত এই সত্যের কাছে জীবনে ক্ষয় হয় বিশ্বাস আর ভালোবাসার।মনুষ্যত্বের মৃত্যু হয় বারবার।
নন্দিতা বিএসসি তে খুব ভালো রেজাল্ট করে এম এ ভর্তি হতে চাইলে পঙ্চাননবাবু জানিয়ে দিলেন তিনি মেয়ের বিয়ে দেবেন আর পড়াশোনা নয়।পাত্র তার হাতের কাছেই আছে।কারো মুখ থেকে 'না'শব্দটি উচ্চারণ হলো না।কারণ এটাই দস্তুর।
নন্দিতা থাকতে না পেরে বলে উঠলো, বাবা আমি আরও পড়তে চাই।
একটু থমকে গিয়ে বাড়ির সদস্যদের দিকে প্রশ্ন ছোড়েন, তোমরা কি বলো?
সবাই চুপচাপ।নন্দিতা তার মাকে জানে।বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ করার ক্ষমতা তার নেই।বাকিরাও চুপ।নন্দিতা শুকনো মুখে চেয়ে থাকে বাবার দিকে।দুচোখে তার জল।কিচ্ছু করার নেই তার আর।আবার মুখ খোলেন গৃহকর্তা,তাহলে সামনের মাসে একটি ভালো দিন দেখে আশীর্বাদটা.....
-না, তা সম্ভব নয়।নন্দিতা পড়াশোনা য় ভালো ।ও আরও পড়বে।বিয়ের কথা আমরা পরে ভাববো।মেয়ের দিকে তাকিয়ে শান্ত ,গম্ভীর গলায় বলে উঠলো তিলোত্তমা।
-তোমাদের কি মত?পঙ্চানন থতমত খেয়ে বাকিদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছোড়েন।
-আমাদেরও ঐ একই মত।নন্দিতা পড়াশোনা করুক।বাজীর পাশা ওল্টাতে দেখেন গৃহকর্তা।
সেদিন বুকের ভার মুক্ত হয়েছিল তিলোত্তমার।দুই দেওর, জা,বাপ্পা, রাজা আর মেয়ের মাঝখানে সব পেয়েছির দুনিয়ায় পৌঁছে গেছিল সে।প্রত্যেকটি সম্পর্কে বাজছিল মধুর ঝংকারের সুর।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন