আহমেদ শামলৌকে তিনটি মাত্র কবিতায় ধরা যাবেনা, তবু উদাহরণ দিলাম।
ফার্সি কবিতার নতুনায়নের তিনি কাণ্ডারি, সারাজীবন ধরে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায়
সক্রিয় থেকেছেন।অনুবাদ করেছেন, বিশেষভাবে ফরাসি সাহিত্য থেকে।তিনিই লোরকার কবিতা
অনুবাদ করেন ফার্সি ভাষায়।শামলৌ নাটকও লিখেছেন।ইরানের লোকসংস্কৃতি নিয়ে নিয়ে ছয়
খণ্ডের প্রমাণ্য গ্রন্থ লিখেছেন।সম্পাদনা করেছেন হাফিজ সহ ইরানের প্রবাদপ্রতিম
কবিদের কবিতাসংগ্রহ। ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করেছেন। ফিল্মের নানা শাখার সঙ্গে
জড়িয়ে থেকেছেন। আবার চাকরিও করেছেন।১৯৫২ সালে হাঙ্গেরি দূতাবাসে যুক্ত হন
সাংস্কৃতিক উপদেষ্টা হিসেবে।এই সময়েই তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘মেটাল অ্যান্ড সেন্স’কে
নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সব কপি নষ্ট করে দেওয়া হয়।দু’বছর আত্মগোপন করেন এসময়েই, পরে ধরা
পড়েন পুলিশের হাতে, চোদ্দ মাসের জেল হয় তাঁর, একথা আগেই উল্লেখ করেছি।১৯৫৭ সালে
প্রকাশিত হয় তাঁর মাস্টারপিস ‘ফ্রেশ
এয়ার’।এই বইটি মোড় ঘুরিয়ে দেয় ফার্সি কবিতার। মুক্ত হয় ফার্সি কবিতা ধারাবাহিকতার
শৃঙ্খল থেকে! তৃতীয় স্ত্রী আয়দাকে কেন্দ্রে রেখে তাঁর দুটি বই প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ আর
১৯৬৫ সালে।সম্পাদনার আগ্রহ তাঁর বরাবরের। ‘বামশাদ’, ‘খুশে’, ‘কিতাব-এ-জম’,
‘ইরানশহর’ ইত্যাদি পত্র পত্রিকার সম্পদনার মাধ্যমে তিনি তরুণ কবিদের মধ্যমনি হয়ে
ওঠেন।১৯৭৭ সালে ইরানের শাহ’র বিরোধিতা করে তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। তাঁর
কবিখ্যাতি কিন্তু ওইসময়ে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি বিভিন্ন ‘লেকচারে’ আমন্ত্রিত
হচ্ছেন।অধ্যাপনা করছেন।১৯৭৯ সালে দেশে ফেরার পরে ইরানের ‘লেখক সংঘের’ কাজেও সক্রিয়
হয়ে ওঠেন।তবে ১৯৮০ সালে থেকে ১৯৮৮ অব্দি মৌলবাদী ইরানের শাসকদের রোষানলে পড়ে তিনি
নিজেকে প্রকাশ্য যাপন থেকে বিছিন্ন ক’রে আড়ালে চলে যান এবং স্ত্রী আয়েদার সঙ্গে
যৌথভাবে নানারকম সৃষ্টিশীল কাজ করতে থাকেন।মিখাইল শলোকভের ‘ অ্যান্ড কোয়ায়েট ফ্লোজ
দ্য ডন’-এর অনুবাদ এই সময়েই করেন তিনি।একদিকে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় সৃজনশীল
থাকা এবং অন্যদিকে
মৌলবাদের বিরুদ্ধে আর সামাজিক ন্যায়ের সপক্ষে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা,
এ আর ক’জন একইসঙ্গে করতে পারেন? যাঁরা পারেন তাঁরাই মানুষ থেকে মনিষী হন। ইরানের
মত রক্ষণশীল মৌলবাদে আক্রান্ত একটি দেশে আহমেদ শামলৌ অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন।তাঁর
সাহস ছিল আর ছিল মানুষের প্রতি অগাধ বিশ্বাস। ইওরোপ বা আমেরিকায় যখনই আমন্ত্রিত বা
দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে তিনি গিয়েছেন তাঁর চিন্তাভাবনাকে তুলে ধরেছেন সেখানকার গুণী
মানুষদের কাছে।আর ফার্সি কবিতার দূত হয়ে থেকেছেন সারাজীবন।
#
আহমেদ শামলৌ আমাদের রবীন্দ্রনাথের মতই মূলত কবিই ছিলেন। ফার্সি
কবিতা তাঁর হাতেই আধুনিকতার দিকে বাঁক নেয়। ফার্সি কবিতার সাঙ্গিতীক
আধ্যাত্ম(সুফিয়ানা) আর বয়ানধর্মীতা প্রথমে নিমা উশিজি এবং পরে আহমেদ শামলৌ-এর
মেধাবী ছোঁয়ায় নৈর্ব্যক্তিক হয়ে ওঠে।
শামলৌ-এর কবিতা ছিল জটিল, বহুমাত্রিক কিন্তু ভাষা ছিল একেবারেই চলমান বা চলতি।তাই
সহজ হয়ে যেত সব জটিলতা!তাঁর মৃত্যু হয় ২৩ জুলাই ২০০০ সালে। তবে ইরানের তথা সারা
দুনিয়ার কবিতাপ্রেমী মানুষের কাছে আহমেদ শামলৌ তাঁর কবিতা আর লেখালিখিতে বেঁচে
আছেন, থাকবেন আরো বহুদিন ধরে!
(ক্রমশঃ)
(ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন