শনিবার, ৩০ জুন, ২০১৮

পিনাকী মুখোপাধ্যায়


 ভালোবাসা    
 
সম্বন্ধটা ভেঙে গেল ।রিসিভারটা নামিয়ে পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইলেন সুরেখা । পূর্ণার খুশি খুশি মুখটা ভাসছে চোখের সামনে । অনেক বোঝানোর পরে নিমরাজি হয়েছিল মেয়ে । ছেলের বাড়ি থেকে যেদিন দেখতে এল সেদিনও কেমন কাঠ কাঠ ব্যবহার করছিল পূর্ণা । অপ্রতিভ লাগছিল সুরেখার । কিন্তু সুরেখাকে অবাক করে পাত্রপক্ষ সেদিনই জানিয়ে দিয়েছিল , পূর্ণাকে তাদের খুব পছন্দ হয়েছে । ফটো  দেখে আবির , মানে ছেলে আগেই পছন্দ করেছিল । তারপরেই বিবাহিত দিদিকে সঙ্গে নিয়ে দেখতে এসেছিলেন আবিরের মা , বাবা । আসার কথা ছিল আবিরেরও । কিন্তু শেষ মুহূর্তে অফিসিয়াল ট্যুরে কলকাতার বাইরে চলে যেতে হওয়ায় আসতে পারেনি সেদিন । তার জন্য আবিরের বাবা বার বার দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন ।  
ওঁদের সৌজন্য , আন্তরিকতায় অভিভুত হয়ে পড়েছিলেন সুরেখা । ঠিক হয়েছিল ট্যুর থেকে ফেরার পরে এক বন্ধুকে নিয়ে আবির এসে আলাপ করে যাবে পূর্ণার সঙ্গে । আবিরের মা বলেছিলেন , “ আমাদের দিক থেকে আমরা ফাইনাল করে যাচ্ছি । এবার আবিরকে আপনাদের পছন্দ হলেই পাকা কথা হয়ে যেতে পারে  … “ 
এতটা বোধহয় পূর্ণাও আশা করে নি । ওর মুখের কঠিন রেখা গুলো নরম হয়ে আসতে দেখেছিলেন সুরেখা । বুক থেকে একটা ভারী পাথর যেন নেমে গিয়েছিল ।মনে হয়েছিল এবার বুঝি বুক ভরে শ্বাস নিতে পারবেন । 
একটা অ্যাক্সিডেণ্টে পূর্ণার বাবা যখন  হঠাৎ করে চলে গেলেন তখন পূর্ণা মাত্র দেড় বছরের । মেয়েকে বুকে চেপে সেই শুরু  সংগ্রামের জীবন ।ওঁরা  বিয়ে করেছিলেন  দু বাড়ির অমতে । অমন দুঃসময়য়েও শ্বশুরবাড়ির দিক থেকে কেউ এগিয়ে আসেন নি । সুরেখার দাদা পাশে এসে দাঁড়ালেও ঠারে ঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন সুরেখা বা তার মেয়ের ভার নেবেন না তাঁরা ।সুরেখা আশাও করেননি ।
কম্পেনসেসন গ্রাউন্ডে স্বামীর চাকরিটা পেয়েছিলেন সুরেখা । স্বামীর সহকর্মীরা খুব সাহায্য করেছিলেন । মেয়েকে স্কুলের ডে বোর্ডিঙে রাখার ব্যাবস্থা করেছিলেন । অফিস থেকে ফেরার পথে মেয়েকে নিয়ে ফিরতেন । বহু প্রলোভন ছিল , ছিল হাজার প্রতিবন্ধকতা । দাঁতে দাঁত চেপে , মেয়েকে আগলে লড়াইটা ছিল  সুরেখার একলার ।
অফিসের সময়টুকু বাদ দিয়ে পুরোটা সময় দিয়েছেন মেয়েকে । সখ , আহ্লাদ  , সবই ছিল শুধুই মেয়েকে ঘিরে । বাবার অভাব কোনদিন বুঝতে দেন নি । ভারী বাধ্য ছিল পূর্ণা । পড়াশুনায় ভাল ছোটবেলা থেকেই । ইংরেজিতে ফার্স্টক্লাস নিয়ে গ্র্যাজুয়েশনের পর সদ্য ভর্তি হয়েছে ইউনিভার্সিটিতে । অফিসের এক কলিগের মারফৎ এসেছিল সম্বন্ধটা । নিজের পায়ে দাঁড়ানোর আগে             ১ 
বিয়ের কথা ভাবার  ইচ্ছে ছিল না সুরেখার । কিন্তু যে ভদ্রলোক এনেছিলেন সম্বন্ধটা তিনি বললেন দেখাশোনা হলেই তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না । তাছাড়া পড়াশুনার ভীষণ গুণগ্রাহী ওরা । তাই বিয়েটা যদি হয়েও যায়  পড়াশুনা কনন্টিনিউ করতে কোন অসুবিধা হবে না ।   আর আপত্তি করতে পারেন নি সুরেখা । তারপর তো আবিরের সঙ্গে পরিচয়ের পর আক্ষরিক অর্থেই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন । সুদর্শন , মার্জিত , ভদ্র ইঞ্জিনিয়ার পাত্রটিকে যে মেয়েরও মনে ধরেছে সেটা পূর্ণার মুখ দেখেই বুঝেছিলেন । তাঁর সম্মতি নিয়েই এরপর দুবার বাইরে মিট করেছে ওরা । পূর্ণার মত নাকউঁচু মেয়েও প্রচ্ছন্নভাবে প্রশংসাই করেছে আবিরের । সবকিছুই তো ঠিকঠাক চলছিল । আচমকা কী এমন ঘটলো ভেবে পাচ্ছেন না সুরেখা । আবিরের মা যখন ফোন করে বললেন , এই সম্বন্ধটা নিয়ে তাঁরা আর এগোতে পারছেন না , সুরেখা এত অবাক হয়ে গিয়েছিলেন কিছুক্ষণ কোন কথাই বলতে পারেন নি । তারপর জিগ্যেস করেছিলেন , “ অসুবিধেটা কোথায় যদি একটু বলেন ...”
অদ্ভ ুত  হেসে আবিরের মা বলেছিলেন , “ কথায় কথা বাড়ে ভাই । আমরা যখন ডিসিশন নিয়েই নিয়েছি তখন আর ...নমস্কার ...ভালো থাকবেন ...”
সুরেখাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রেখে দিয়েছিলেন ফোনটা ...
পুরো ঘটনাটা যেন ছায়াছবির মত দেখতে পাচ্ছিল পূর্ণা । আজ রবিবার ।  আজ বিকেলেই আবার আবিরের সঙ্গে দেখা করতে যাবার কথা । খুব যদি ভুল না করে ফোনটা দুপুরের মধ্যেই আসবে । পূর্ণার ইনটুইশন তাই বলছে । যে কোন মুহূর্তে বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে ঘরে এসে ঢুকবে মা ।   
“ মা “ শব্দটা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে একটা নরম আদরের বলয় যেন তৈরি হয়ে যায় পূর্ণাকে ঘিরে । নিরাপত্তার আশ্চর্য উষ্ণতা সেখানে ।হাজার ওঠা পড়া , ঘাত প্রতিঘাতের এতটুকু আঁচও সে বলয় ভেদ করে কখনো স্পর্শ করতে পারেনি পূর্ণাকে । ভালোলাগায় , ভালোবাসায় দুচোখ বুজে আসতে চায় । ঠিক তখনই ঘরে এসে ঢোকেন সুরেখা ।
মায়ের এমন মর্মভেদী দৃষ্টি বুঝি কখনো দেখেনি পূর্ণা । বুকটা কেঁপে ওঠে । ফোনটা কি এসেছিল তবে ? আর কিছু ভাবার আগেই সজোরে একটা চড় এসে পড়ে পূর্ণার গালে । হিসহিসে গলায় সুরেখা বলে ওঠেন , “ কী বলেছিস তুই আবিরকে ? কেন বলেছিস ? তোর আবিরকে পছন্দ নয় তুই তো আমাকেই বলতে পারতিস । অন্য কাউকে যদি পছন্দ করে থাকিস আগে বলিসনি কেন আমাকে ? এরকম একটা প্রহসন কেন করলি তুই ? “
কান্নায় গলা বুজে আসে পূর্ণার । জীবনে এই প্রথম মা গায়ে হাত তুললেন তার । বলল , “ কাউকে পছন্দ করা নেই আমার । তোমাকে তো বলেইছিলাম  আমি রাজি নই । তবুও জোর করলে । কী করব আমি ? “

“ কী করবি মানে ? “ তল কূল খুঁজে পাচ্ছেন না সুরেখা । 
ফোঁপাতে ফোঁপাতে চিৎকার করে ওঠে পূর্ণা , “ শুনে রাখ আবার যদি কোন জায়গায় আমার বিয়ের চেষ্টা কর আমি এই একই কাণ্ড করব । জানিয়ে দেব তিন বছর আগে আমাকে মেণ্টাল অ্যাসাইলামে ভর্তি করার কথা । বাবাও যে পাগল ছিলেন জানিয়ে দেব সে কথাও । “
মাথায় যেন রক্ত চড়ে যায় সুরেখার । পূর্ণার চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে ওঠেন , “ কেন ? কেন এসব বানিয়ে বানিয়ে বলেছিস তুই আবিরকে ? বল কেন বলেছিস ? “ 
কান্না জড়ানো গলায় পূর্ণা বলে ওঠে , “ কারণ ... কারণ  তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব না আমি । তোমাকে একা ফেলে কোত্থাও যাব না আমি ... কোত্থাও না ... কক্ষনো না ... কোনদিন না ... “
হঠাৎ যেন স্তব্ধ হয়ে গেলেন সুরেখা । বুক জুড়ে উথাল পাথাল ঢেউ । কী  যেন আটকে এল গলায় । চোখের বাঁধ ভেঙে গেল সহসাই । বুকের মাঝখানে টেনে নিলেন পূর্ণাকে । ভালোবাসার ওমে জড়িয়ে নিলেন সেই ছোট্টবেলার মত । হাসি আর কান্নার অনুরণন মিলে মিশে গেল তাঁর কণ্ঠস্বরে । বললেন , “ বোকা কোথাকার ! সত্যিই তুই পাগল । আমি ধরতে না পারলেও তোর পাগলামি যে ধরে ফেলেছে ওরা । আবিরের মা ফোন করে বললেন – ‘  অনেক ভাগ্য করে এমন মেয়ে পেয়েছেন ভাই ।ওকে বলবেন  ওর মত পাগলির খোঁজেই ছিলাম আমরা ।বলবেন আবির তার বাবা , মায়ের প্রতি যতটা দায়বদ্ধ ততটাই দায়বদ্ধতা থাকবে তার বউয়ের মায়ের জন্যও । ‘ “ 
একটু থেমে সুরেখা আবার বললেন, “ উনি বললেন তোর যখন খুশি তুই আসবি আমার কাছে । আমিও যাব যখন যখন আমার মন চাইবে । ওরা খুব ভালো রে । তুই আর অমত করিস না সোনা ... “ 
নির্বাক চেয়ে থাকে পূর্ণা । এমনটা হতে পারে কল্পনাই করেনি । আর কী আশ্চর্য !  মায়ের কাছ থেকে তাকে ছিনিয়ে নেবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত মানুষগুলোর ওপর সেই আগের মত  রাগটা কেন যে  আসছে না আর !কেন যে কিছুতেই আর শএুপক্ষ ভাবা যাচ্ছে  না মানুষগুলোকে ! 
আজ সকালে ফোনে অ্যাসাইলামের গল্পটা শোনার পরে গম্ভীর গলায় আবির বলেছিল – ‘ এতো সাংঘাতিক ব্যাপার ! খুব ভালো করেছ জানিয়ে ... ঠিক আছে , আমি একটু ব্যাস্ত আছি এখন । পরে কথা বলছি ...’
পলকের জন্য থমকে গিয়েছিল পূর্ণা । ক্ষুব্ধ হেসে মনে মনে বলে উঠেছিল , “ প্রেমের বেলুন চুপসে গেল এক মুহূর্তে ! এই তো ভালবাসা ! ... “
সেই ‘ ভালোবাসা ‘ শব্দটাই এই মুহূর্তে পূর্ণার কাছে ধরা দিচ্ছে এক অন্যরকম ব্যঞ্জনায় ।মায়ের কোলে মুখ গুঁজে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে ভালোবাসার এক বর্ণালি দেখতে পায় পূর্ণা ।বিভিন্ন রং গুলো তাদের স্বতন্ত্রতা নিয়েও মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন