শনিবার, ৩০ জুন, ২০১৮

হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়


আত্মশ্লাঘার বিসর্জনের মধ্যাহ্ন



 রোদ্দুরের সময়। রোদ্দুরের হাত ধরে এলোমেলো বিচরণ। গণনার সময় এলোমেলো। তখন কে-ই বা জানে পথের উদ্দেশ্য। পথের টানেই পথ চলা। দিনরাত এক করে অবিরত হেঁটে যাওয়া। পথের দুধারে যা কিছু দৃশ্যমান সবই গোগ্রাসে গিলে চলা। নিজেকে যেভাবে হোক দ্রষ্টব্য করে তোলার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। কখনও তা সফল হয়। কেউ একজন আমার পথ চলার মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ে। কত কিছুই না তার জিজ্ঞাস্য। উত্তর দিতে পেরে আমারও কম তৃপ্তি হয় না। তৎক্ষণাৎ ভেবে ফেলা আমি বোধহয় তার ভাবনার রাজ্যে প্রবিষ্ট হলাম। কত কত বিনিদ্র রাত্রি যাপন। মুখাবয়বও এইভাবে হৃদয়পুরে রাজত্ব করতে পারে তা রাস্তার মাঝে আমাকে কেউ না দাঁড় করালে আমি জানতেই পারতাম না। কিন্তু কতদিন বা চলতে পারে এই পরিভ্রমণ? মনে মনে এক আত্মশ্লাঘা অনুভব করি ------- এই ক'দিনে সবটুকুই যেন পড়ে ফেলা গেছে। 

     আবার পথ চলা শুরু। এইবার চোখের মধ্যে যেন এক অন্য নেশা। চিরপরিচিত বস্তুখণ্ডও যেন অন্য চেনায় চোখে ধরা পড়ে যায়। আমি মাঝে কত কত জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ি। আমি তো দাঁড়াই কিন্তু আমার জন্যে কি কেউ দাঁড়াবার প্রয়োজন মনে করেছে? ভীষণ দুপুরে এই সূক্ষ্ম তত্ত্ব মাথায় আসে না। আমিই একা দাঁড়িয়ে থাকি। কোনো জানলাই খোলে না আমায় দেখে। কিন্তু একবারের জন্যও বিফল মনোরথ মনে হয় না। আসলে তখন তো নিজেকে পড়তেই পারি নি। কী চাই আমি সত্যিই কি জানি! নেশায় দাঁড়িয়ে থাকি। সময় যায়। অটল ধৈর্য্যে এতটুকুও চির খায় না। 

     দেখতে পাই কেউ কেউ দাঁড়িয়ে কানে কানে কথা বলছে। আরও অনেকই দেখতে পাই। কানে আসে "ভালোবাসা"। কিছুই তো জানি না, কিন্তু তবুও শব্দটায় কেমন যেন লোভ জড়িয়ে থাকে। বড় ধরতে ইচ্ছা হয়। মনে হয় হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখি। মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্নের ভিড়। আমিও কি এইভাবে কানে কানে মেতে উঠতে পারি না? 

     এইবার অপেক্ষা পীড়া দেয়। প্রাপ্তির ইচ্ছা এতটাই প্রবল হয়ে ওঠে যে নিজেকে আর অবহেলায় ফেলে দিতে মন চায় না। ভালোবাসার লোভ রয়েই যায়। পাশাপাশি নিজের অপারকতাও নিজেকে কোথাও যেন একটা কোণে ঠেলে দেয়। অনুভব করি কোথাও নিজেকে প্রস্তুত করে নেওয়ার প্রয়োজন আছে। এই প্রস্তুতির রূপ যে কত বিচিত্র তা বলে শেষ করা যায় না। আবার এটাও সত্য আমার প্রস্তুতি আমার মতোই। কাউকেই আমার জগতে এনে ফেলতে পারি না। পাশাপাশি আমার প্রস্তুতিকে কেউ আমলও দেয় না। একটা মানুষ নিজের মতো করে নিজেকে সাজিয়ে নিয়ে পথ চলবে, এটাও কেউ প্রশ্রয় দেয় না। তাই নিজেকে ভালোবেসে আমি নিজেই নিজের পৃথিবী তৈরি করে ফেললাম।

     কত কথা যে আমার বলার আছে তা সাদা পাতার সামনে বসে বুঝতে পারলাম। আমার কথা ----- আমার ভালোলাগা জগৎ , যেখানে বাসা বেঁধে আছে আমার কবিতার শব্দেরা, আমার দুপুর, অজানা স্টেশনে উদ্দেশ্যহীন বসে থাকা। সব আমার। বুঝলাম ভালোবাসা কী! 

     আমার আমিতে ডুবে নিজেকে ভেঙে ফেলার কী প্রগাঢ় ইচ্ছা। দুপুরের নিজস্ব ঘ্রাণ হৃদয়ে না জড়ালে আমি কী পেতাম? নিজের কাছে দাঁড়াতামই বা কোন মুখে। আমার হাতে কী থাকত? পার্থিব বস্তুসকল? আমি পথ চলতাম কীভাবে? নিজের বলে সত্যিই কাউকে দেখাতে পারতাম? উদ্দেশ্যহীন পথ চলার যে দারুণ আনন্দ তা কখনও হৃদয় দিয়ে ছুঁতে পারতাম? অপুর মতো অপরের দুঃখে চোখের জল ফেলার যে আনন্দ তা বুকে নিয়ে কখনও ধনী হতে পারতাম?

     জৈষ্ঠ্যের এক দুপুরে রবীন্দ্রনাথ আমাকে শোনালেন, "আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায় / আমি তার লাগি পথ চেয়ে আছি পথে যে জন ভাসায়।" কোনোদিন বুঝিনি আমার হাতে কী আছে। হাতে কী থাকা উচিত তাও কী কোনোদিন ভেবেছি। জানলা খুলে যেদিন দুপুর দেখলাম সেদিনই প্রথম চিনলাম নিজেকে। নিজেকে দেখতে শিখলাম। হাতের মুঠো খুলে দেখলাম, এক মাঠ খাঁ খাঁ দুপুর। আমার হৃদয়পুরে রাজত্ব করছে। আমি ভেসে গেলাম। আমার চেনা জগৎ কোথায় যেন হারিয়ে গেলো। যে ধুলো নিয়ে আমি এতকাল খেলেছি তারা যেন আজ আর আমার কেউ নয়। চিরচেনা জগৎ ছেড়ে আজ আমি
বসন্তপুরের পলাশবনে একাকী দন্ডায়মান। মনে হয় কিসের পরিচয়? কেনই বা পরিচয়? পরিচয়ের আছেই বা কী? এই যে আমাতে আমিকে দেখতে পাচ্ছি, অনুভব করছি অনন্ত রোদ্দুরের স্পর্শ, সকালের পবিত্রতা ------- আমার এই পরিচয়ের জন্যই কী আমি পথ চেয়ে বসে থাকি নি? 

     আমি তো আমাকে চারদেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ রাখতে চাই নি। খুঁজে দেখতে চেয়েছি নিজেকে। আমৃত্যু সুখস্পর্শে কাটিয়ে দেওয়া যে জীবন আমার পৃথিবীতে তা কখনও গ্রহণযোগ্য হয় নি। আত্মশ্লাঘার মতো পেলব শব্দ-ধ্বনিতে আমি কখনও কান পাতি নি। তাই এই গান শ্রবণমাত্র আমার শরীরযন্ত্রটির মধ্যে রক্তের গতি প্রকৃতি এক অন্যরূপে ধরা  দিল। নিজেকে ভাঙার যে কর্মপরিকল্পনা সেই ইচ্ছা গগনচুম্বী হলো।

     সারাটা দুপুর গাছের নিচে বসে বসে দুপুরের ভেঙে যাওয়া দেখছি। ভাঙছি আমিও। কবেকার বাতাসপুরের মেজমাসির মেয়ে দিতি আজ মনের মধ্যে হঠাৎ করেই যেন চলে আসে। কতদিন দেখিনি তাকে। তবুও মনের মধ্যে কোথাও যেন যত্ন করে তোলা ছিল। আজ কিছুটা উষ্ণ হলেও দখিনের বাতাস দিতিকে কোথা থেকে হৃদয়পুরে এনে হাজির করে দিল। আমি তো এতদিন দিতিতে থাকি নি। কিন্তু তবুও কোথাও যেন সে ছিল। অনেকবছর আগে আলো-আশার, ভালোবাসার প্রদীপ যা সে জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছিল আজও তা জ্বলছে। 

     আসলে ভালোবাসা কোথাও একটা ছিল। ভালোবাসা কোথাও একটা থাকে। অনন্ত পলাশের বসন্তপ্রবাস থেকে তাকে নিয়ে আসতে হয় প্রাত্যহিকতায়। প্রয়োজন হয় মনের ভীষণ প্রশ্রয়ের। বসন্তের সাধনার অন্তে ভালোবাসা আসে। " যে জন দেয় না দেখা, যায় যে দেখে --------- ভালোবাসে আড়াল থেকে --------" এতদিন যে ছিল বসন্তপ্রবাসে সে আজ আমার হৃদয়ঘরে। এই হৃদয়ঘর কোথায়? সেও তো আমার মনের মাঝেই। যেখানে আমার মনের মানুষ থাকে। আমৃত্যু তাকে ছোঁয়া যায় না। লালনের কন্ঠে ঘনিয়ে ওঠে এক অপ্রাপ্তির মেঘ  ------- " সে আর লালন একখানে রয় / তবু লক্ষ যোজন ফাঁক রে। "

     ছোঁয়া না গেলেও তাকে আমরা অনুভব করি। জীবন ভালোবাসাময় বলেই তো বসন্তে শিমুল পলাশের রঙে সম্পৃক্ত হয় আমাদের হৃদয়। দুপুরের রঙ থেকে আহরিত হয় জীবন-বাষ্প। সমুদ্রের অনন্ত ঢেউয়ের দোলায়িত ছন্দে আমাদের মনের ক্যানভাস রক্ত-রঙ পরিধান করে, আর মন গুনগুন করে -------- " আমার মন মজেছে সেই গভীরের গোপন ভালোবাসায়। "

     অনন্ত মগ্নতায় শিল্পীর রঙ তুলি আজ যেন অচিনপুরের পথে। অদ্ভুত এক রূপকথার মোহজালে আমরা আবদ্ধ। অচিরেই শিল্পীর এই ইতিবাচক মোহজাল ছিন্ন হবে। চোখের সামনে আমরা প্রত্যক্ষ করব আলোকিত পৃথিবীর তৃপ্ত যাত্রীদের। ভালোবাসার গভীর গন্ধে তারা মাতোয়ারা। তাদের মনের প্রশান্তি দু'চোখকে আলোময় করে তুলবে। সে প্রশান্তি ছুঁয়ে যাবে আমাদেরকেও। শিল্পীর প্রতিটি রঙ আমাদের সঙ্গে আলাপের জন্য অস্থির হয়ে উঠবে। আমরাও তাদের রঙে বিভোর হয়ে খুলে দেব আমাদের বাতায়ন। বিমূর্ততার জটিলতা মুছে গিয়ে রেখার প্রবাহ ভাষা পাবে আমাদের অনুভূতিলোকে। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন