বই
যদি কেউ জিজ্ঞেস করে যে , আপনার প্রিয় বন্ধু কে ? নির্দ্বিধায় উত্তর দিই: বই । এমন বন্ধু আর না পেয়েছি , না পাবো । ফলত , বই নিয়ে লিখতে হলে কত স্মৃতির সলতে পোড়া গন্ধ নাকে এসে লাগছে । ভিতরে ভিতরে ধাক্কা দিচ্ছে । এলোমেলো কত যে স্মৃতি ।
ছোটবেলায় বই বলতে ছবিতে- গল্পে " ছোটদের রামায়ণ " আর " ছোটদের মহাভারত " দিয়েই শুরু । কত যে ছবি দেখেছি আর বারবার পড়েছি । এরপর যে বই দুটির কথা চোখ বুজলেই অমলিন মনে পড়ে সে দুটি হল : ছোটদের বিবেকানন্দ আর ছোটদের রামকৃষ্ণ । উদ্বোধনের বই । চমৎকার সব ছবি । আজো চোখে লেগে আছে ।
আমাদের বাড়িতে বাবা-মা-জ্যাঠার বই পড়বার খুব নেশা ছিল । দেখতাম তাঁরা রাত জেগে বই পড়তেন । পরদিন বাবা বিকেলে সাইকেল নিয়ে ছুটতেন লাইব্রেরিতে । বই পড়া ব্যাপারটা কিছুটা পরিবার থেকেই বোধহয় পাওয়া । আমাদের বাড়িতে তখন সপ্তাহিক 'দেশ' রাখা হত । জ্যাঠামশাই রাখতেন । বাবা প্রতিবছর শারদ সংখ্যা ' বর্তমান' কিনতেন । চমৎকার চমৎকার সব উপন্যাস বেরুত তখন শারদ বর্তমানে । শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের "শাহাজাদা দারাশুকো" তো শারদ বর্তমানেই ছাপা । বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের কত যে ঐতিহাসিক উপন্যাস পড়েছি । তো আমিও বাবা ও পাড়ার এক দাদার সঙ্গে লাইব্রেরিতে যেতাম । খুব ছোট তখন । ক্লাস থ্রি কী ফোর হবে । বাংলার ডাকাত বইটি আমার খুব ভালো লেগেছিল । আর ভূতের গল্প খুব ভালো লাগত । মায়ের দুই পাশে দুই ভাইবোন । শীতের রাত । টিনের চালে কুয়াশা পড়ছে । মা শুয়ে শুয়ে ভূতের গল্প পড়ছেন । গল্পগুলো এত ভয়ের যে নড়াচড়া পর্যন্ত করতে পারছি না । এসব কত কথা মনে পড়ে যাচ্ছে ।
তখন এত টিভি, ফোন ঘরে ঘরে ছিল না । সময় কাটাতে মা-দিদিমা বই পড়তেন । ক্লাস এইট থেকে নিজে নিজে বই পড়তে বিকেলবেলা স্কুল থেকে ফিরে লাইব্রেরিতে যেতাম । হেমেন্দ্রকুমার রায় খুব প্রিয় ছিলেন । সব কটি খন্ড পড়ে ফেলেছিলাম । জয়ন্ত-মানিক-সুন্দরবাবুর দুর্দান্ত সব অভিযান । এবং পান্ডব গোয়েন্দা । সে কী আনন্দ ! শেষ হলেই আরেকটি বই আনতে যেতাম । আজ খুব অবাক হই 'কথা সাহিত্যে'র আড্ডায় বা অন্য অনেক অনুষ্ঠানে অতিথি হিসাবে ষষ্ঠীপদদার পাশে বসি । সংকোচ হয় খুব । আমি কী যোগ্য এত বড় মানুষের পাশে বসার । আমার ছেলেবেলার প্রিয় পাঠ্য পান্ডব গোয়েন্দার স্রষ্টা তিনি । সহজ আন্তরিকতায় দাদা হয়ে উঠেছেন আমাদের । আর ছিল চাঁদমামা এবং শুকতারা । আমার কিশোরবেলার সঙ্গী । তখন বিকেলবেলা লাইব্রেরিতে যাওয়ার একটা সুঅভ্যাস ছিল । যাঁরা যেতেন পাড়ায় তাঁদের বেশ সমীহ করতাম আমরা । পথে দাঁড়িয়েই কিছু কথা বলে নিতাম । কে কী বই তুলেছে লাইব্রেরি থেকে তা দেখতাম । এমনকি অনেক ভালো ভালো বইয়ের খোঁজ পেয়ে যেতাম ।
আর স্মৃতি নয় । অন্য কথা বলি । বইয়ের সঙ্গেই আমার সহবাস । বিছানায় যেদিন বই থাকে না সেদিন ঘুম হবে না । মাথার কাছে নানা ধরনের বই থাকে । বিছানা জুড়ে বই । তোরঙ্গের মধ্যে বই । তিনটে বড় আলমারি জুড়ে বই । সোফার ওপর বই । লোকজন এলে বসতে দিতে পারি না । বই কোথায় নেই ? কত মানুষের কত যে উপহার ।তিনবার বাড়ি বদলজনিত কারণে কয়েকশো বই বিক্রি করে দিতে হয়েছে । লাইব্রেরিতে দান করে চলে আসতে হয়েছে । আজো অবিরাম ধারায় বই কিনেই চলেছি । আমার নিজস্ব লাইব্রেরিতে অনেক দুর্লভ গ্রন্থ আছে ।আছে বিরল পত্র-পত্রিকাও ।
কতজন বই নিয়ে আর ফেরৎ দেয়নি । ইদানীং চাইলেই আর বই দিচ্ছি না । প্রবাদটা সত্য মনে হয় , " বই আর বউ বাইরে গেলে আর ফেরে না " । সে অভিজ্ঞতা কম হল না । বই কেউ নিলে আর ফেরত আসে না । অথবা অনেক কষ্টে ফেরৎ আনতে হয় ।
সকলে বই ঠিক করে পড়তে জানে না । এত অযত্ন নিয়ে পড়ে যে অন্যের পড়ার আর উপায় থাকে না । পৃষ্ঠা মুড়িয়ে রাখে । ভিতরে নানাভাবে পাতায় পাতায় নিজের নাম লেখে । বিচ্ছিরি ভাবে দাগায় । বইটা যত্ন করে পড়া উচিৎ । বই এর পৃষ্ঠা বা মলাট ছিঁড়লে খুব কষ্ট হয় । যেন আমাকেই ছিঁড়ে ফেলেছে কেউ । বই-এর সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক । তাকে বুকের ওপর নিয়েই ঘুমোই । সে যে আমার দোসর । অন্তরের বন্ধু । দুঃখরাতের বন্ধু । বিজন আঁধারে বন্ধু । সুখের ফল্গু নদী । আনন্দের মাধুর্য কেবল ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন