#বই
মানবজাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় একদম শুরুর দিকে মানুষ দৈববাণী বা বাক্যসমষ্টিকে কণ্ঠস্থ করার চেষ্টা করতো। তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ আমরা পরিবারের মধ্যেই দেখতে পাই। আমার স্বৰ্গীয়া ঠাকুমার কথা মনে পড়ে , তিনি কি নিপুণভাবে দুই পৌরাণিক মহাকাব্য রামায়ণ , মহাভারত সম্পূর্ণ বলতে পারতেন উপযুক্ত বিশ্লেষণ সহকারে। পরবর্তী প্রজন্মও যাতে যথাযথভাবে এ সমস্ত বিষয়ের আস্বাদ গ্রহণ করতে পারে তাই ক্রমশ সেগুলি সংরক্ষণের প্রয়োজন অনুভূত হয়। প্রাচীনকালে কাঠ , কাদামাটি , প্যাপিরাস , পশুর চামড়া বা ভেলাম ব্যবহৃত হতো এগুলি লিপিবদ্ধ করার জন্যে। মূলতঃ ঐসব বইয়ের বিষয়বস্তু ছিল সুদীর্ঘ কাব্য - কাহিনী , জাদুবিদ্যা, রাজবংশীয় দলিল , আইন ,বস্তুজগতের নানা বাস্তবতা ও তার পর্যবেক্ষণ। ওই সময়ের বই গুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ছিল 'মৃতের জন্য গ্রন্থ'। এটি উপহার হিসেবে মৃতের সাথে কবরে দেওয়া হতো। বইয়ের ইংরেজি 'বুক' এই কথাটি এসেছে 'বক' (boc ) থেকে যার অর্থ উৎকীর্ণ লিপি সম্বলিত ফলক। পরিবর্তনশীল জীবনে বিজ্ঞানের অগ্রগতি আমাদের নানা ভাবে প্রভাবিত করলেও বইয়ের বিকল্প আজও তৈরী হয়নি। ছাপার অক্ষরের পরিবর্তে ই- বুক এসেছে , কিন্তু যে প্রকারেই আসুক না কেন বই স্বীয় মর্যাদায় সর্বদাই বিরাজমান। সর্বাঙ্গীন ভাবে সমাজ বা জাতির উন্নতি যথার্থ জ্ঞান ব্যাতিত কখনোই সম্ভব নয়। জাতির উন্নতিকল্পে বই পড়ার ও বই পড়ার উপযোগী পরিবেশ আমাদেরই তৈরী করতে হবে। কোনো জাতি , সভ্যতার কোন্ সোপানে অবস্থান করছে তার পরিমাপ করা যায় তাদের পাঠাভ্যাস দিয়ে। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও মানসিক বিকাশে সব বয়সের সব শ্রেণীর মানুষেরই বই পড়ার অভ্যেস গড়ে তোলা জরুরি। তবেই জাতির মধ্যে আসবে সৃজনশীলতা। শিশু, তরুণ, যুব সম্প্রদায় কু-নেশা আড্ডা বাদ দিয়ে পাঠাভ্যাস তৈরী করতে পারলে সঠিক আলোর দিশা পাবে , প্রসার ঘটবে মানবিক চেতনার। বই কেবলমাত্র ছাপার অক্ষরে লিপিবদ্ধ কিছু শব্দের সমষ্টি নয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের টেনশন স্ট্রেস কমাতে বই খুবই ঘনিষ্ট একটি বন্ধু। সমীক্ষা বলছে ডিমেনশিয়া আলঝেইমার্স ইত্যাদি রোগের নিয়ন্ত্রণেও বই দারুন গুরুত্ত্বপপূর্ণ. মস্তিষ্ক সচল থাকলে তা কখনোই বিকল হবেনা. "reading is to the mind , what exercise is to the body "। মনোসংযোগের অভাব বর্তমানে শিশুদের তো বটেই আমাদের সবারই একটি প্রবল সমস্যা। আকর্ষণীয় একটি বই অবশ্যই শিশুকে অনেকখানি মনোযোগী করে তোলে। তখনকার মতো শিশুটির দুনিয়া সেই বইয়ের পাতাতেই নিবদ্ধ হয়, তা ছড়া গল্প বা ক্লাসিক যাই হোক না কেন। গল্পের বই মানেই খারাপ এই ধারণা একেবারেই ভ্রান্ত. গল্প বই থেকেও বহু সাধারণ জ্ঞান , পৌরাণিক কাহিনী থেকে নিজের দেশের সংস্কৃতি মূল্যবোধ জানতে পারে শিশুটি। রঙিন ছবি মলাটে সহজবোধ্য ভাষায় লেখা কঠিন বিষয়ের বক্তব্যও শিশুর কাছে মনোগ্রাহী হতে পারে। কিছুটা পিছনে ফিরলে কি আমরা দেখতে পাইনা , অভিভাবকদের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে পড়ার বইয়ের মাঝে লুকানো গল্পের বই কিভাবে আমাদের মনোরঞ্জন করেছে। বাড়িতে আলমারি ভর্তি বই থাকা মানেই পাঠাভ্যাস নয়। ইদানিং তা হয়তো বা কিছুটা স্ট্যাটাস সিম্বল। সু পাঠাভ্যাস নিজেদের মধ্যে , ও পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে তৈরী না হলে খুব শীঘ্রই আমরা কেজো কূপমণ্ডুকে পরিণত হবো। শিশুদের বয়সোপযোগী বই উপহার দিন । পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট বা জন্মদিন বা যেকোনো কিছু উপলক্ষে বাচ্ছার পছন্দের উপহারের সাথে সাথে আকর্ষণীয় মোড়কে একটি বইও উপহার দেবার অভ্যেস করুন। খুব ছোটবেলায় আস্ত একখানা ছড়া মুখস্থ বলতে পারার পুরস্কার স্বরূপ আমি আমার মেয়েকে 'আবোল তাবোল ' কিনে দিয়েছিলাম। এর পরেও নানা কারণে অন্য উপহারের সাথে বই ও কিনে দিয়েছি। আজ এখন আমার মেয়ে পুজোয় শাড়ী জামার বদলে বই নেবার আবদার করে। কোনো রুগী মারা গেলে আজও মনখারাপের রাতে বই টেনে নেয় বুকে , অপেক্ষা করে নতুন সকালের।
অর্থের বিনিময়ে বই কিনলেও তার থেকে যে জ্ঞান আর আনন্দ আমরা লাভ করি তার মূল্য নির্ধারণ করা বাস্তবিকই অসম্ভব। বই কিনে আজ অবধি কেউ দেউলিয়া হয়েছেন এই নজির বিরল। অজুহাত খুঁজে বই দূরে সরিয়ে রাখা নেহাতই অর্বাচীনের কাজ। শিশুটির পাশে বসে নিজেও পড়ুন , সঙ্গ দিন ওকে। দেখবেন পরবর্তীতে শিশুটিই বায়না করছে বইয়ের জন্য। শিশুমন বড়োই অনুকরণ প্রিয়। প্রতিটি শিশুকন্যা তার মা কে আর শিশুপুত্র তার পিতাকে অনুসরণ করে সচেতন বা অচেতন ভাবে। প্রায় প্রতিটি শিশুই হাতের কাছে বই কাগজ পেলেই ছিঁড়ে ফেলে। দয়া করে বই বা কাগজটি সরিয়ে বাচ্ছার হাতে মোবাইল তুলে দেবেন না বা ছেঁড়ার কারণে মারধোর করবেন না। পুরোনো কাগজ , বই ছিঁড়তে ছিঁড়তেই একদিন দেখবেন সে ওই কাগজটাই খুঁটিয়ে দেখছে না বুঝলেও। আর এভাবেই নিজের অজান্তে কখন ভালোবেসে ফেলবে মানুষের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি আনন্দভাণ্ডার স্বরূপ বই কে।
বই পড়লে যে শুধুমাত্র শব্দভাণ্ডার বা স্মৃতিশক্তি বাড়ে তা তো নয় .আমাদের কল্পনা শক্তি , বিশ্লেষণ ক্ষমতাও বহুগুন বর্ধিত হয়। নিজেদের পছব্দ , ভালোলাগা খারাপলাগা সম্বন্ধে সজাগ হই। কোনো একটি বই পড়ার পর সেই বই পাঠসংক্রান্ত অনুভূতি ই বলে দেয় তার বিশ্লেষণ ক্ষমতা কতখানি। পুস্তক সংক্রান্ত আলোচনা তার মননশীলতাকে আর সাধারণ পাঁচটা মানুষের থেকে স্বতন্ত্র করে নানা আঙ্গিকে। শিক্ষা আর ডিগ্রি যেমন কখনোই সমার্থক নয় , তেমনই সিলেবাসে নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তক পড়লেই জ্ঞান অর্জন করা যায়না। জীবনে চলার পথে ভালোবেসে বইকে সাথী করতে হয়। প্রকৃত শিক্ষিত হতে গেলে বিভিন্ন ধরণের বই পড়ার অভ্যেসই একমাত্র অবলম্বন। প্রথাগত শিক্ষার আলোকে আলোকিত না হয়েও তাই রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববরেণ্য। প্রায়শঃই দেখা যায় নিউক্লিয়ার ফামিলিতে কর্মরত পিতা মাতার একমাত্র সন্তান বড়োই মুখচোরা। আর পাঁচজনের সাথে মিশতে অনিচ্ছুক। বই এক্ষেত্রে খুব ভালো প্রতিবিধানের কাজ করতে পারে। 'শিশু' কাব্যগ্রন্থ , পান্ডব গোয়েন্দার মতো মজার ঘটনা সমৃদ্ধ সাহিত্য তাকে আরো পাঁচটা বাচ্ছার সাথে হৈচৈ আনন্দ করতে অনুপ্রাণিত করবে। বই আমাদের স্বপ্ন দেখতে শেখায় , শেখায় ভালোবাসতে , ভরপুর আনন্দে বাঁচতে। ছোট্ট শিশু চাঁদের বুড়ির চরকা কাটা শুনে চাঁদে যাবার স্বপ্ন দেখে। কে বলতে পারে যে সেই হবেনা আগামী জীবনে নামী অ্যস্ট্রোনাট , বা সব্যসাচী , গোরার হাত ধরে দেশমাতৃকার সেবক অথবা রবিনহুড কে ভালোবেসে দীন দুঃখীর সহায় ! কে বলতে পারে আজকের দুর্বল বালিকা 'good night stories for rebel girls ' এর অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কালকের মার্গারেট বা এমেলিয়া হবেনা ! আজকের দুর্বল শিশুকে জ্ঞানে বিদ্যায় বুদ্ধিতে মননশীলতায় আগামী দিনের কান্ডারি করে গড়ে তুলতে পারে একমাত্র উপযুক্ত পুস্তকের পাঠাভ্যাস। সবশেষে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার থেকে বলি, জানিনা বই পড়ার অভ্যেস কতটা পরিবার থেকে পাওয়া যায় বা কতটা চেষ্টার মাধ্যমে অর্জন করা যায়। আমার বাবার নাম ছিল রাম। এরকম অদ্ভুত নামকরণের কারণ জিজ্ঞেস করাতে ঠাকুমা জানিয়েছিল যেদিন তৃতীয়বার রামায়ণ পড়া সম্পূর্ণ হয়েছিল সেইদিন আমার বাবা ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে আমাকেও গর্ভাবস্থায় ঠাকুমা সারাদুপুর রামায়ণ মহাভারত বলে শোনাতো। অভিমন্যুর মতো গর্ভস্থ সন্তানের পক্ষে বাইরের গল্প শোনা কতটা সম্ভব জানিনা তবে আমার মেয়েও বইয়ের মধ্যেই জীবনের দুঃখ গ্লানি ভুলে বাঁচার আনন্দ খুঁজে পায়। আজ আমার নিজের কাছে এটাই পরম প্রাপ্তি ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন