শনিবার, ১০ জুলাই, ২০২১

শর্মিষ্টা দত্ত

                             


খোঁজ  (একাদশ পর্বের পর)
(১২)

অরুণ ফিরে আসার দিনকয়েকের মধ্যে মেয়ের  বাড়িতেই একদিন ঘুমের মধ্যে নিঃশব্দে চলে গেলেন যোগমায়া l সেরিব্রাল অ্যাটাক l কোমরভাঙার পর বার্ধক্যজনিত সমস্যায় শরীরের কলকব্জা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল l ইদানিং ওষুধের ঘোরে সারাক্ষণই ঝিমোতেন l জাগতিক বোধও লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল l তাঁর সংসারে যে কত বড় বিপর্যয় ঘটে গিয়েছে যাওয়ার আগে তা টেরও পেলেন না l নীরবেই পৃথিবী থেকে মুছে গেল একটা প্রজন্ম l সন্তানদের কাছে অবাঞ্ছিত হওয়ার শুরুতেই তাঁদের মুক্তি দিলেন যোগমায়া l কোনো কোনো মৃত্যু নিকটজনের কাছেও স্বস্তির বার্তা নিয়ে আসে l বিশেষত সংসারের এরকম টালমাটাল পরিস্থিতিতে যোগমায়ার জন্য শোকতাপের অবকাশও ছিল না কারুর l অরুণ জ্যেষ্ঠ সন্তান হলেও মাতৃদায় উদ্ধার করার মত অবস্থায় নেই l অলোক ঘোরতর কমিউনিস্ট, সে এই সব শ্রাদ্ধশান্তির অনুষ্ঠানে বিশ্বাস করে না l রাজশ্রী নিজেই দাহকাজ থেকে শুরু করে পারলৌকিক সব কাজই সামলে নিলেন l  যোগমায়ার সামান্য কিছু চিহ্ন পড়ে রইল তাঁর ঘরে l অরুণকে নিয়ে নিয়মিত হাসপাতালে যাওয়া, পরিচর্যা করতে করতে হাঁপিয়ে উঠছিলেন অপর্ণা l তাঁর নিজের শরীরও ভালো নয় l কাজকর্ম মিটে যাওয়ার পর একদিন রাজশ্রী এসে খাটের তলা থেকে মায়ের ট্রাঙ্কটা বের করলেন l বাক্সের ভিতর অপাংক্তেয় কিছু জিনিস l কয়েকটা সাদা থান,  আর টুকরো কাপড়ে বাঁধা অল্প কয়েকটা খুচরো পয়সা আর নোট l ক্ষয়ে যাওয়া কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো ঝাপসা কাচের ভিতরে প্রায় সাদা হয়ে যাওয়া যোগমায়া আর তাঁর স্বামীর বিবাহকালীন ফটো l এছাড়াও স্বামীর ব্যবহৃত একটি নিকেলের চশমার ফ্রেম একটা ছোট বাক্সে যত্ন করে গুছিয়ে রাখা l আরো কিছু টুকিটাকি l যোগমায়ার গচ্ছিত সম্পদ বলতে এটুকুই l অনেকদিন পরে শাশুড়ির ঘরে খাটের ওপর বসে সেই সাদা থানে হাত রেখে কেঁদে ফেললেন অপর্ণা l এই মানুষটির সঙ্গে কোনোদিনই হৃদ্যতা গড়ে ওঠেনি তাঁর l দুজনের মানসিকতার বিস্তর ব্যবধান, সম্পর্কের মধ্যে একটা অদৃশ্য পাঁচিল তুলে রেখেছিলেন নিজেই l তবু এই মুহূর্তে শাশুড়ির জন্য চোখের জলটুকু মিথ্যে নয় l এভাবেই  সংসারে প্ৰিয় - অপ্রিয় সবকিছুই কখন যেন  জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে ওঠে l  

অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই চিকিৎসায় একটু একটু করে সাড়া দিতে শুরু করলেন অরুণ l চিকিৎসা ও ওষুধের প্রভাবে, বাড়ির পরিবেশ আর পরিবারের সান্নিধ্যে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠতে লাগলেন l এখন অল্পস্বল্প কথা বলেন অপর্ণার সঙ্গে l হ্যাঁ অথবা না বলে মতামত দিতে পারেন l একমাত্র অপর্ণা ছাড়া আর কাউকেই বোধহয় চিনতে পারেন না l চোখের দৃষ্টিটাই যেন পাল্টে গেছে, বড্ড ভয় করে শর্মিলার l বাবার সামনে যায় না বড় একটা l অলোক, শবনম নিজেদের কাজে ব্যস্ত l এক বাড়িতে থেকেও ওদের বৃত্তটা ক্রমশ আলাদা হয়ে যাচ্ছে l রান্নার লোক পুষ্প ছাড়াও মালতী নামে একটি মেয়েকে সারাদিন কাজের জন্য রাখা হয়েছে l মুনমুনের দিকে এখন আর তেমন নজর দিতে পারেন না অপর্ণা, মালতীর মূল কাজ মুনমুনকে দেখাশোনা করা l তাছাড়াও  শবনমের মাও রোজই দুপুরে এসে মুনমুনের কাছে থাকেন l মুনমুন বেশিরভাগ সময় দিদার সঙ্গে নীচের ঘরেই থাকে l আগের মত আর শর্মিলা বা অপর্ণার কাছে ঘেঁষে না l অবশ্য অপর্ণার সময়ও নেই, তবু কষ্ট হয় খুব l মেয়েটা তো তাঁকে এখনও মা বলেই ডাকে ! 
রাজশ্রীও প্রায় রোজই আসেন এ বাড়িতে l শর্মিলার পড়াশোনার খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করেন l রোজ বইপত্র নিয়ে বসলেও পড়ায় মন বসে না l এরমধ্যেই টেস্টের রেজাল্ট আউট হল l বাড়ির এই বিপর্যয়ের মধ্যে পরীক্ষা দিয়ে  কোনোরকমে টেস্টে অ্যালাও হলেও ফাইনালের রেজাল্ট অবধারিতভাবে খারাপ হবে এটা যেন ধরেই নিয়েছে শর্মিলা l অবচেতনে মনের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার জন্ম হয় l ক্রমশ নিজের ভিতরে গুটিয়ে যেতে থাকে l রাজশ্রী বিষয়টা নিয়ে খুবই চিন্তিত হয়ে শর্মিলাকে বললেন 
-- মুন্নি, এবাড়িতে থাকলে তোর পড়াশোনা হবে না l তুই বরং আমার সঙ্গে ও বাড়িতে চল l 
--তোমার তো স্কুল আছে পিসি...একা একা থাকলে আমার আরোই পড়া হবে না l 

এসব বলে তখনকার মত কাটিয়ে দিল শর্মিলা l নিজের বাড়ি ছেড়ে, মাকে ছেড়ে কোনোদিন কোথাও থাকেনি ও l পিসির কোলেপিঠে বড় হয়ে উঠলেও ওই বাড়িটাকে কিছুতেই আপন মনে হয় না ওর l বিকেলে পড়তে গিয়ে মৈত্রেয়ীকে সেকথা বলতেই ও বলল 
-- পিসি ঠিকই বলেছে l ও বাড়ির পরিবেশে তোর পড়াশোনা হবে না l  তুই বরং পরীক্ষার কটা মাস আমাদের বাড়িতে থেকে যা l আমিও  সারাদিন তোর ওপর নজর রাখতে পারব l
 শর্মিলাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ও কাবেরীকাকিমাকে পাকড়াও করে তখনই ছুটল শর্মিলাদের বাড়ি l কাবেরী অপর্ণাকে বললেন 

--অপর্ণা আমি তোমার দিদির মত, সেই অধিকারে বলছি শর্মিলাকে পরীক্ষা অবধি অন্তত আমি আমার কাছেই রাখব l মৈত্রেয়ীর সঙ্গে থাকলে সারাদিন পড়াশোনার পরিবেশে থাকতে পারবে l সেটা এখন ওর জন্য খুব দরকার l দেখো, এমনিতেই ওর পড়াশোনার যথেষ্ট ক্ষতি হয়ে গেছে l এবাড়িতে ও কিছুতেই পড়ায় মন বসাতে পারবে না l  ইন্টেলিজেন্ট মেয়ে, এই দু - আড়াইমাস আদা- জল খেয়ে পড়লে নিশ্চিত ভালো রেজাল্ট হবে l 

অপর্ণাও বিলক্ষণ বুঝেছিলেন এভাবে চললে মেয়ের ভবিষ্যৎ অন্ধকার l এইমুহূর্তে শর্মিলার জন্য এটাই সবথেকে ভালো ব্যবস্থা l 

--তুমি আমায় বাঁচালে কাবেরীদি l এ কটা দিন বরং মুন্নির দায়িত্ব তুমিই নাও l আমি তো আজকাল ওকে দেখতেই পারি না l 

রাজশ্রী একটু মনঃক্ষুন্ন হলেও মুখে বললেন 

--এটাই বরং ভালো হল l মুন্নি তোর জামাকাপড়, বইখাতা গুছিয়ে নে l এ কটা দিন মন দিয়ে পড় l দেখবি ঠিক ভালো হবে রেজাল্ট l মাঝেমাঝে দু - চারদিন পরপর একবার এসে একটু মাকে দেখে যাস l 

মৈত্রেয়ীর বাড়িতে আসার পরে একটু একটু করে আবার পড়াশোনার মধ্যে ডুবে যেতে লাগল শর্মিলা l মৈত্রেয়ী নিজে পড়তে পড়তেও ওর পড়ার দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখে l কাবেরীকাকিমা ঘড়ির কাঁটা ধরে ওদের খাবার খাওয়ান l না খেলে নিজের হাতে খাইয়েও দেন l ওরা টেস্টপেপার সলভ করে, উনি রাত জেগে ওদের সঙ্গে বসে থাকেন l মাঝেমাঝে কফি বানিয়ে এনে দেন l বড্ড স্নেহময়ী মানুষটি, নিজের সন্তানের থেকে বেশীই যত্ন করেন শর্মিলাকে l আদরে, শাসনে শর্মিলার সারাটা দিন ভরে থাকে l এ বাড়ির আশ্চর্য মায়াময় পরিবেশে একা হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণাটা ক্রমশ ফিকে হতে থাকে  l পড়াশোনা করার ইচ্ছেটা একটু একটু করে ফিরে আসে l নিজের প্রতি আস্থাও বাড়ে l রিজ্জুদার মুখটা ক্রমশ ঝাপসা হতে থাকে l সপ্তাহে এক - দুদিন অল্প কিছুক্ষণের জন্য বাড়ি এলে মায়ের মুখটা আলোয় ভরে ওঠে l 

--মুন্নি, কাবেরীদির এই ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারব না l উনি আমাদের দুঃসময়ে যেভাবে পাশে দাঁড়িয়েছেন ! তুমি কিন্তু কক্ষনো কাবেরীদির অবাধ্য হয়ো না l 

বাবার চাকরি নেই, জমানো টাকাও তেমন নেই l সংসারখরচের বেশিরভাগটা বাবাই দিতেন l  চিকিৎসার খরচ যদিও বেশিরভাগটাই পিসি দেয়, ছোটকাও দেয় কিছুটা l এখন সংসারটাও অলোকদের টাকাতেই চলে l সেজন্য মরমে মরে থাকেন অপর্ণা l সবই বুঝতে পারে শর্মিলা l উপর্যুপরি আঘাতে হঠাৎই যেন অনেকটা বড় হয়ে গেছে ও l ছোটকা-কাম্মার নিস্পৃহ আচরণ মাকে কতখানি পীড়া দেয় সেটাও বোঝে l সময় আর পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মন বদলায়, বদলে যায় সম্পর্কের সমীকরণও l শর্মিলা নেই, একা একা যুদ্ধ করতে করতে মা ক্লান্ত l মায়ের চোখের তলায় কালি, দৃষ্টিতে গভীর অবসাদ l ক্রমশ ক্ষয়ে যেতে যেতে শর্মিলাকে খড়কুটোর মত আঁকড়ে ভেসে থাকার চেষ্টা করে মা l নিজেকে মনে মনে ইস্পাতের মত ধারালো করে তোলে শর্মিলা l ভালো রেজাল্ট করতেই হবে ওকে l নিজের জন্য তো বটেই, মায়ের জন্যও l কাবেরীকাকিমার বাড়িতে ফিরে আবার ডুবে যায় পড়াশোনার মধ্যে l 
পরিমলকাকু ব্যস্ত মানুষ l পুলিশের চাকরিতে ছুটি পান না বললেই হয় l তবু বাড়িতে থাকলে এক এক দিন সন্ধ্যেবেলা ওদের ডেকে হই হই করে গল্প করতে বসেন l মৈনাকদা থাকলে সেও যোগ দেয় আড্ডায় l গ্রূপ করে ক্যারম খেলা হয় l কাকিমা চায়ের সঙ্গে নানারকম জলখাবার বানিয়ে আনেন  l এম বি বি এস পাশ করে সরকারি হাসপাতালে ইন্টার্নশিপ করছে মৈনাকদা l বাড়ি কাছে হলেও হোস্টেলেই থেকে যায় বেশিরভাগ সময় l ওর বন্ধু -সহকর্মী কল্লোলদাও আসে l কল্লোলদাকেও খুব ভালোবাসে কাকিমা l সবসময় বলে
-- কল্লোল আমার আর একটা ছেলে l 
কল্লোলদার বাড়ি আসানসোলে, মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে মৈনাকদার সঙ্গেই থাকে l ভালো কিছু রান্না করলেই কল্লোলদাকে ডেকে পাঠায় কাকিমা l  এ বাড়ির পরিবেশটা অনেক খোলামেলা, অনেকটা শর্মিলার চন্দননগরের দাদুর বাড়ির মত l.ঘণ্টাখানেকের আড্ডার পর ফ্রেশ হয়ে আবার পড়তে বসে ওরা l 
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার আগে অনেকটাই আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল শর্মিলা l মৈত্রেয়ীর ধারেকাছে না হলেও প্রিপারেশন একেবারে খারাপ হয়নি l অন্তত পাশ করার চিন্তাটা নেই l এই ক মাস ক্রমাগত টেস্টপেপার সলভ করিয়ে আর নিজে পরীক্ষা নিয়ে মৈত্রেয়ী ওকে অনেকটাই তৈরী করে দিয়েছে l ভাগ্যিস মৈত্রেয়ী আর কাবেরীকাকিমা ছিল ! ঈশ্বর আছেন কি নেই জানে না শর্মিলা l তবে তিনি বোধহয় কাবেরীকাকিমার মতই দেখতে ! 

ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয় l ওদের সিট পড়েছে তালতলার একটা স্কুলে l পরিমলকাকু গাড়ি করে ওদের পরীক্ষার সেন্টারে ছেড়ে দিয়ে আসেন l প্রতিদিন দুটো করে পেপার l মাঝখানে টিফিন ব্রেকে কাবেরীকাকিমা আসেন l জোর করে ডাবের জল, মিষ্টি খাইয়ে দেন l প্রিপারেশন অনুযায়ী পরীক্ষা ঠিকঠাকই হচ্ছে শর্মিলার l নিজের সম্পর্কে এর থেকে আর খুব বেশি কিছু আশা করে না ও l বিকেলে ফেরার সময় ওরা হাঁটতে হাঁটতে গল্প করতে করতে বাড়ি ফেরে l পরীক্ষা দেওয়ার পর মৈত্রেয়ী আর পেপার নিয়ে কোনো আলোচনা করতে দেয় না l অ্যাডিশনাল বায়োলজি পরীক্ষার দিন হল থেকে বেরিয়েই ওরা দেখল কল্লোলদা দাঁড়িয়ে রয়েছে গেটের বাইরে l 

(চলবে )

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন