খোঁজ (১৩)
--এদিকে একটা কাজে এসেছিলাম l ভাবলাম তোদের পরীক্ষা শেষ হলে একেবারে তোদের নিয়েই ফিরব l কেমন হল আজ পরীক্ষা? আজই তো শেষ ! আজ থেকে তোরা মুক্ত বিহঙ্গ l
--না গো কল্লোলদা, এরপরই তো জয়েন্ট l আমার এখন ছুটি নেই l অবশ্য শর্মিলা এখন ফ্রি l ও জয়েন্ট দেবে না l
একটা ট্যাক্সি ডাকল কল্লোলদা l
--শর্মিলা তুই কি আজ বাড়ি ফিরবি নাকি কাকিমার কাছে যাবি ?
--বাড়ি ফিরব কল্লোলদা l কিন্তু এখন আগে কাকিমার কাছেই যাবো, কাকিমা বারবার বলে দিয়েছেন l
কাবেরীকাকিমার কাছে খাওয়াদাওয়া করে সন্ধ্যের আগেই বাড়ি ফিরল শর্মিলা l মনটা ছটফট করছিল l কতদিন পরে আবার নিজের ঘরে মায়ের কাছে শোবে ও ! রেজাল্ট বের হতে এখনও তিনমাস l এত বড় ছুটিটা ও কাটাবে কিভাবে ! গানটা শুরু করবে আবার ! মায়ের সঙ্গে কথা বলতে হবে l কিন্তু বাড়ি ফিরে দেখল বাড়ির পরিবেশটা এখন যেন আরো থমথমে l মায়ের চোখমুখে অনিশ্চয়তার উৎকণ্ঠা l অজানা আশঙ্কায় মনটা ভরে উঠল l ব্যাপারটা অবশ্য আন্দাজ করতে পারছিল l রাতে বিছানায় শুয়ে অপর্ণা জানালেন এ বাড়িটা এবার বোধহয় ছেড়ে দিতে হবে l অলোকের প্রমোশন হওয়ার পরে দুর্গাপুরে ট্রান্সফার হয়ে গেছে l সামনের সপ্তাহেই সেখানে চলে যেতে হবে l শবনম রেলের কোয়ার্টার পেয়েছে নারকেলডাঙায় l সেখানে থাকলে মুনমুনের স্কুলে যাতায়াতের সুবিধা l মুনমুন এবছরই বিডনস্ট্রীটের একটা নামকরা স্কুলে চান্স পেয়েছে l ওখানে স্কুলের বাস আসে l ছোট্ট, দুকামরার ফ্ল্যাট l সেখানে কোনোরকমে মুনমুনকে নিয়ে থাকতে পারবে শবনম l এতজনের জায়গা কুলোবে না l অতএব সংসারখরচ চালিয়ে এই বাড়ির ভাড়া দেওয়া অপর্ণার পক্ষে অসম্ভব l শুধু এই বাড়ি কেন ! এরপর কোথায় থাকবেন, কিভাবে সংসার চলবে সেটা ভেবেও কূলকিনারা পাচ্ছেন না না অপর্ণা l নিজের হাত তো সম্পূর্ণ খালি l মরে গেলেও অলোকদের কাছ থেকে সংসারখরচ চাইতে পারবেন না তিনি l অল্প কিছু গয়না এখনও আছে, কিন্তু সেগুলো বেচে আর ক টাকাই বা পাওয়া যাবে !
হঠাৎই যেন নিজেকে অনেকটাই বড় মনে হল শর্মিলার l ওর সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে গোটা সংসার l দায়িত্ব নেওয়ার সময় হয়েছে এখন l সংসারটাকে বাঁচাতে হলে এখনই একটা চাকরির খুবই দরকার l কিন্তু এই কোয়ালিফিকেশনে কোথায় চাকরি খুঁজবে ও ! তবু বলল,
-- তুমি চিন্তা কোরো না মা l আমি আছি তো ! আমাদের একটা ছোট বাড়ি হলেই চলে যাবে l কাল থেকেই বাড়ি খুঁজব আমি l আর চেষ্টা করলে কিছুদিনের মধ্যেই একটা চাকরি নিশ্চয়ই জোগাড় করে ফেলতে পারব l কারুর সাহায্য লাগবে না আমাদের l
--তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে মুন্নি ! এখন চাকরি করে ভবিষ্যৎটা ঝরঝরে করবি তুই ! শোন, কাবেরীদি সবটাই জানে l এরমধ্যে মৈনাক আমার একটা চাকরির ব্যবস্থাও করে দিয়েছে ঢাকুরিয়ায় ডঃ সিনহার নার্সিংহোমে l রিসেপশনিস্ট কাম ক্লার্কের কাজ l দিনসাতেক ট্রেনিং নিলেই নাকি কাজটা করতে আর কোনো অসুবিধে হবে না l হাজার দেড়েক টাকা মাইনে দেবে ওরা l
পরেরমাসে শবনমরা চলে যাওয়ার পরে অপর্ণারাও উঠে এলেন বেনিয়াপুকুর অঞ্চলের একটা আধাবস্তিবাড়িতে l একতলায় দেড়খানা ঘর, সামনে একচিলতে বারান্দা l সেখানেই রান্নার ব্যবস্থা l বাইরের উঠোনের টাইমের কল থেকে জল ভরে রাখতে হয় l এজমালি বাথরুম l আরো তিনঘর ভাড়াটের সঙ্গে ব্যবহার করতে হয় l জিনিসপত্র প্রায় সবই শবনমকে নিয়ে যেতে বলেছিলেন অপর্ণা l তার ঘরেও এত জায়গা নেই l অনেককিছুই বিক্রি করে দিতে হল শেষমেশ l বাড়ি দেখতে এসে রাজশ্রী কেঁদে ফেললেন l
--এখানে তোমরা থাকবে কি করে বৌদি ! মুন্নি লেখাপড়া করবে কোথায়? এত করে তোমাদের বললাম, আমাদের বাড়িতে চল l জেদ করে তুমি মেয়েটার ভবিষ্যৎ নষ্ট করলে l
ম্লান হাসলেন অপর্ণা l
--তুমিই তো আমাদের শেষ ভরসা রাজু l তুমি না থাকলে আমাদের যে কি হত ! সারাজীবন আমাদের জন্য কম কিছু তো করলে না l আর কত টানবে? আর আমাদেরও তো এবার নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা উচিত ! আর মুন্নির যদি ভাগ্যে থাকে তাহলে এখানে থেকেই লেখাপড়া হবে l বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়াতেই হবে ওকে l আর বাড়িটা তো তোমার নয়, ওখানে থাকার রিকোয়েস্ট তুমি কোরো না প্লিজ l যত কষ্টই হোক, আত্মসম্মানটুকু বিসর্জন দিতে বোলো না আমায় l
বাড়িভাড়ার দুশো টাকা দিয়ে হাতে যা থাকবে তাতে কোনোরকমে সংসার চলে যাবে l শর্মিলার পড়াশোনার খরচও আছে l কিন্তু বাবার ট্রিটমেন্ট চালাতে গেলে পিসির সাহায্য লাগবেই l কিন্তু সমস্যাটা হল শর্মিলার কলেজ শুরু হলে বাবাকে কে দেখবে l বাবাকে স্নান করানো, খাওয়ানো ছাড়াও চোখে চোখে রাখতে হয়ে সবসময় l শূন্য ঘোলাটে দৃষ্টি মেলে সারাদিন স্থবির হয়ে বসে থাকেন অরুণ l মাঝেমাঝে বিড়বিড় করেন নিজের মনে l হৃতচেতনার অন্তরালে কোন রহস্য লুকিয়ে আছে তার খোঁজ পাওয়া যায়নি এখনও l তবে মাঝে মাঝে অসম্ভব অস্থির হয়ে পড়েন, তখন দরজা খোলা পেলে বেরিয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করেন l এই সময়ে তাঁকে আটকাতে রীতিমত সমস্যায় পড়তে হয় l ডাক্তার বলেছেন এমন ডীপ অ্যামনেশিয়ার পেশেন্টকে কখনই একা রাখা চলবে না l
এবাড়িতে শর্মিলাদের পাশের ঘরে যে পরিবারটি থাকে তাদের আগেই চিনত শর্মিলারা l ছোটবেলায় ওরা যে বাড়িতে থাকত তার পাশের বাড়িতে যে খ্রিস্টান পরিবারটি ছিল সেই বাড়িরই মেয়ে রেখাপিসি l বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করেছিল কার্তিক নামে পাড়ার এক উঠতি মস্তানকে l কার্তিক তেমন কোনো কাজকর্মই করে না l রেখাপিসিই ডঃ বাগচীর নার্সিংহোমে আয়ার কাজ করে সংসার চালায় l কখনও কখনও দিন-রাত দু শিফটেও ডিউটি করে l সংসারের যাঁতাকলে পড়ে প্রেম এখন অদৃশ্য l ছিবড়ের মত পড়ে আছে বিবাহিত জীবনের শব l ভাগ্যিস ওদের কোনো ছেলেপুলে নেই l যতক্ষণ বাড়িতে থাকে ততক্ষণ দুজনের চিল চিৎকারে ঘরে থাকা দায় হয়ে যায় শর্মিলাদের l সকালে মা বেরোনোর আগেই জল তুলে, রান্নাবান্না আর সমস্ত কাজকর্ম সেরে নেয় l শর্মিলাকে বারবার বলে যায় যেন ও ঘরে দরজা বন্ধ করে থাকে l কিন্তু তবু মাঝেমধ্যে প্রকৃতির ডাকে বা অন্যান্য প্রয়োজনে দরজা খুলে তো বেরোতেই হয় l কার্তিককাকুর গা ঘিনঘিনে দৃষ্টির সামনে পড়তে হয় তখন l মাকে সেকথা না বললেও অপর্ণা বুঝতে পারেন সবই l কিন্তু এখন তাদের দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করার দিন l মাসদুয়েক পরে একদিন দুপুরে বাথরুমে যেতেই কার্তিক দেয়ালে ঠেসে ধরল শর্মিলাকে l টিনের চাল দেওয়া এই কলঘরে দিনের বেলাতেও ঘুটঘুটে অন্ধকার l চল্লিশ ওয়াটের একটা বাতি জ্বালাতে হয় l শর্মিলা বুঝতে পারেনি, আধো-অন্ধকারে কার্তিক আগে থেকেই লুকিয়ে বসেছিল l প্রাণপণে চিৎকার করে উঠল শর্মিলা l সামনের ঘরের জবাবৌদি আর ডলিকাকিমা টের পেয়েও ভয়ে এগিয়ে এল না l কার্তিক এলাকার ত্রাস l হয়ত ওরাও এর আগে কার্তিকের লালসার স্বীকার হয়েছে l বাবার ঘরের দরজা খোলা ছিল l বিস্ফারিত চোখে হঠাৎই শর্মিলা দেখল বাবা বাথরুমে ঢুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে কার্তিককাকুর ওপর l অমানুষিক জোর বাবার গায়ে l আঁচড়ে, কামড়ে রক্তাক্ত কার্তিককে বাথরুমের মেঝেয় ফেলে এলোপাথাড়ি মারছে বাবা l জন্তুর মত গোঙানি বেরিয়ে আসছে কার্তিকের মুখ থেকে l সারাটা গা গুলিয়ে উঠল ওর l জোর করে বাবাকে সরাতে গিয়েও পারল না l হঠাৎই কার্তিক একটা লাথি মেরে উল্টে ফেলে দিল বাবাকে l মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে এল বাবার l ইতিমধ্যে গোলমালের শব্দে বাইরে থেকে কিছু লোকজন জমে গিয়েছে ওখানে l ডলিকাকিমা তাড়াতাড়ি ওকে নিজের ঘরে নিয়ে এসে একগ্লাস জল খাওয়ালো l লোকজন আসার আগেই জ্ঞান হারাল বাবা l জবাবৌদি পাড়ার টেলিফোন বুথ থেকে মাকে ফোন করল নার্সিংহোমে l মা ফেরা অবধি কাঠের পুতুলের মত বসে রইল শর্মিলা l লোকজনই পুলিশে খবর দিয়েছে ততক্ষণে l বাবাকে ধরাধরি করে উঠোনে এনে শুইয়েছে l ব্লিডিং হয়েই চলেছে l কার্তিকেরও ওঠার ক্ষমতা ছিল না, সেও যথেষ্ট আহত l পুলিশ এসে অ্যারেষ্ট করল কার্তিককে l মা আসার পরেই অ্যাম্বুলেন্স ডেকে বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল l কাবেরীকাকিমাকে নার্সিংহোম থেকেই ফোন করে দিয়েছিল মা l পিসিকে নিয়ে ততক্ষণে হাসপাতালে পৌঁছে গেছে কাবেরীকাকিমা l এমার্জেন্সিতে কল্লোলদা আর মৈনাকদা রেডিই ছিল l আরো একজন সিনিয়র ডাক্তার পরীক্ষা করে তক্ষুণি আই সি ইউতে ভর্তি করে নিলেন বাবাকে l এতক্ষণ ধরে ক্রমাগত রক্তক্ষরণের ফলে কোমায় চলে গিয়েছে বাবা l কিছুক্ষণ পরে সমীরণকাকু আর কেয়ামাসিও এসে পড়লেন l একে একে পিসেমশাই, কাম্মাও চলে এল l ঘন্টাতিনেক টানাপোড়েনের পর কল্লোলদা বেরিয়ে এসে মাথা নাড়ল l
-- অনেক চেষ্টা করেছিলাম কাকিমা, কিন্তু এত ব্লিডিং হয়ে গেছে যে আর...
রাজশ্রী অপর্ণাকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন l
অপর্ণার চোখ খটখটে শুকনো l
--সারাজীবন হেরে গিয়ে অচেতন অবস্থাতেও অন্তত একটা যুদ্ধ জিতে চলে গেল মানুষটা l তোমার দাদা আমাদের মুক্তি দিয়ে গেল রাজু l আমাদের মেয়েটাকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল l
ভীড় থেকে একটু একটু করে শর্মিলা পাশের অন্ধকার গলির দিকে সরে যাচ্ছিল, একা l ওর জন্যই আজ চলে যেতে হল বাবাকে ! জাগতিক বোধ থাকুক, না থাকুক, মানুষটা ছিল তো ! একটা মানুষের থাকা না থাকায় কতখানি পার্থক্য সেটা তো কয়েকমাস ধরেই টের পেয়েছে হাড়ে হাড়ে l নিজের ওপর অসম্ভব ঘৃণা হচ্ছিল শর্মিলার l এমন জীবন থাকার থেকে না থাকাই ভালো l বাবা চলে গেল, এরপর মাকেও যে কত বিপদে পড়তে হবে ওর জন্য, কে জানে l হঠাৎ ঘ্যাঁচ করে একটা অ্যাম্বাসেডর ওর সামনে দাঁড়াল l
--কি করছেন কি ! মরবার ইচ্ছে হয়েছে আপনার !
ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা লোকটা চিৎকার করে উঠল l
-- দাঁড়াও দাঁড়াও, এটা তো শর্মিলা ! তুই এত রাতে এখানে কি করছিস? জানিস না এসব জায়গা ভালো না?
মেঘনার গলা l কি অদ্ভুত সেজেছে মেঘনা ! একেবারে ট্রান্সপারেন্ট একটা শাড়ি, সরু স্লিভলেস ব্লাউজ, চড়া মেকআপ ! সঙ্গে এই লোকটা কে? এটা তো ওর বর না ! ইনি প্রায় ওর বাবার বয়েসী l মাথা কাজ করছিল না শর্মিলার l মেঘনা গাড়ি থেকে নেমে জড়িয়ে ধরল শর্মিলাকে l
-- কি হয়েছে রে? তুই এত রাতে এখানে এসেছিস কেন? কাকু - কাকিমা ঠিক আছেন তো?
ইশারায় ওকে হসপিটালটা দেখাল শর্মিলা l
(চলবে )
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন