শনিবার, ৩ জুলাই, ২০২১

শর্মিষ্টা দত্ত

                                       




দশম পর্বের পর 
খোঁজ (১১)

ইলেভেনের অ্যানুয়াল পরীক্ষার আগে বেশ কয়েকদিন সর্দিজ্বরে ভুগল শর্মিলা l রেজাল্টও খুব একটা ভালো হল না l খাতায়কলমে শরৎকাল এসে গেলেও সেদিন দুপুর থেকেই ঘোর বর্ষা l ফিজিক্সের লাস্ট  প্রাকটিক্যাল ক্লাসদুটো হল না, দু পিরিয়ড আগেই স্কুল ছুটি হয়ে গেল l মৈত্রেয়ী অ্যাবসেন্ট, ওর জ্বর হয়েছে l শম্পার আরো আগে ছুটি হয়ে গেছে l একাই স্কুল থেকে ফিরছিল  শর্মিলা l সকাল থেকেই কেমন আনমনা হয়েছিল l বেশ কিছুদিন ধরেই রিজ্জুদার চিঠিপত্র বেশ অনিয়মিত l গতমাসে কলকাতায় আসেওনি l অফিসে নাকি খুব কাজের চাপ l কাল রাত্তিরে খাবার টেবিলে বসে কানে এল, কাম্মা খুব উত্তেজিত হয়ে ছোটকাকে বলছে রিজ্জুদাকে  নাকি অফিস থেকে ট্রেনিংএ বিদেশে পাঠাচ্ছে l আগামীমাসেই অন্তত বছরখানেকের জন্য জার্মানি চলে যাবে রিজ্জুদা l অফিসে কাম্মাকে ফোন করে জানিয়েছে l আজ সকালে মুনমুনও বলল 
--জানিস দিদিভাই, মামু না অনেক দূরের একটা দেশে চলে যাবে l 
অথচ আশ্চর্য ! শর্মিলাকে এ বিষয়ে বিন্দুবিসর্গও জানায়নি ! মৈত্রেয়ীদের বাড়িতে তো মাঝে মাঝে ফোন করে ওর সঙ্গে কথা বলে l ওখানে কি একবারও ফোন করতে পারত না ! অভিমানে চোখে জল এসে গিয়েছিল  শর্মিলার l ক্লাসে পড়ায়ও  মন দিতে পারেনি l কেন এমন করল রিজ্জুদা ! অন্যমনস্ক হয়ে না দেখে রাস্তা ক্রস করার সময় একটা সাইকেল হঠাৎ করেই সামনে চলে এল l হুমড়ি খেয়ে মাঝরাস্তায় পড়ে গেল শর্মিলা l মুহূর্তে  জামাকাপড় জলকাদায় মাখামাখি l
--এই শর্মিলা, কি করছ ! এভাবে কেউ রাস্তা দিয়ে হাঁটে ! 
শর্মিলা তাকিয়ে দেখল কল্লোলদা, মৈত্রেয়ীর দাদা মৈনাকদার বন্ধু l মেডিকেল কলেজে পড়ে l ওদের পাড়াতেই থাকে, হোস্টেলে l কল্লোলদাই পৌঁছে দিল ওকে বাড়িতে l হাঁটুতে, কনুইয়ে একটু কেটে ছড়ে গিয়েছিল l জোর করে ওষুধ লাগিয়ে দিল l  এভাবেই শরীর -মনের ব্যথা নিয়ে কেটে গেল কয়েকটা দিন l সপ্তাহখানেক পরে রিজ্জুদার চিঠি এল l মন দিয়ে পড়াশোনা করার দীর্ঘ উপদেশ আর ছোট্ট করে জার্মানি যাওয়ার খবর l যেন এই খবরটার কোনো গুরুত্বই নেই l প্রথম বিদেশ যাওয়ার সুযোগ, সেজন্য কোনো উত্তেজনা নেই l দীর্ঘ একটা বছর, হয়ত বা তারও বেশি দেখা হবে না, সেজন্য কোনো  দুঃখবোধও নেই l খুব উদাসীনভাবে যেন অন্য কারুর প্রবাসে যাওয়ার  কথা লিখেছে l যেন রিজ্জুদা থাকা না থাকায় শর্মিলার কিছু যায় আসে না ! এভাবে একতরফা আবেগে কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠে ! আজকাল রিজ্জুদাকে অনুভূতিহীন পাথর মনে হয় ওর l সত্যিই কি শর্মিলার প্রতি ওর কোনো অনুভূতি নেই ! শর্মিলা কি একাই এই সম্পর্কটা নিয়ে সিরিয়াস ! নিজের ভিতরে ক্রমশ গুটিয়ে যেতে থাকে শর্মিলা l আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভোগে l 

কয়েকদিন পরে রিজ্জুদা কলকাতায় এল l বিদেশ যাওয়ার আগে অপর্ণা একদিন ওকে রাতে  নেমন্তন্ন করলেন, সকলের উপস্থিতিতে শর্মিলার সঙ্গেও  দেখা হল l নেহাতই সৌজন্য সাক্ষাৎ l ও আলাদা করে শর্মিলার ঘরে এসে কথা বলার কোনো আগ্রহ দেখাল না, শর্মিলাও না l রিজ্জুদা যাওয়ার আগেই মাথা ধরেছে বলে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল l ভিতরে ভিতরে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেলেও ইগোর লড়াইতে কোনোমতেই হারবে না শর্মিলা l মৈত্রেয়ী বলল 
--যে তোকে গুরুত্ব দেয় না, তাকে তুই কেন গুরুত্ব দিবি বল তো ! রিলেশনশিপকে যে রেজাল্টের মাপকাঠিতে মাপে সে এমন ব্যবহারই ডিজার্ভ করে l তুই যা করেছিস, একদম ঠিক l রিজ্জুদা যদি কোনোদিন সত্যিসত্যি মিস করে তোকে, তাহলে তোর ইমোশনকে ইম্পর্টেন্স দেবে নিশ্চিত l ও তোর ভালো রেজাল্ট দেখতে চায় তো ! সেটাই করে দেখা l তারপর দেখ না কি হয় ! 

মৈত্রেয়ী যত সহজে কথাটা বলতে পারল, পড়াশোনা করাটা ততটাই কঠিন হয়ে দাঁড়াল শর্মিলার কাছে l 
আগস্টের শেষ রবিবার দমদম এয়ারপোর্ট থেকে দিল্লির উড়ান ধরল রিজওয়ান l শর্মিলার বুকের ভিতরটা যেন খালি হয়ে গেল l ফাঁকা নিস্তব্ধ বাড়ি l অলোক, শবনম  আর মুনমুন গিয়েছে এয়ারপোর্টে l সন্ধ্যাবেলা ঘর অন্ধকার করে নিজের ঘরে শুয়েছিল শর্মিলা l পড়ে গিয়ে কোমর ভাঙার পর যোগমায়া কিছুদিন ধরেই মেয়ের  বাড়িতে রয়েছেন l অপর্ণার শরীর বিশেষ ভালো নেই l হাই ব্লাডপ্রেশার ছাড়াও কার্ডিয়াক কিছু সমস্যায় এখন আর বেশী পরিশ্রম করতে পারেন না l বাবলু - টুবলু এখন ইংল্যান্ডে l রাজশ্রীর বাড়িটা প্রায় খালিই পড়ে থাকে, তাই রাজশ্রী  মাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে রেখেছেন l সেখানেই সকাল - বিকেল দুজন সেবিকা  তাকে দেখাশোনা করে l সন্ধ্যেবেলা অরুণ মাকে দেখতে গিয়েছেন l  চারদিকে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার l অপর্ণা এসে বসলেন মেয়ের মাথার কাছে l 
--মুন্নি, তুমি তো আমার হেরে যাওয়ার মেয়ে নও ! যা ধরে রাখা যায় না, তাকে ধরে রাখার চেষ্টা কোরো না কখনও l এই ভাবনা থেকে নিজেকে মুক্তি দাও মা ! 
মায়ের কোলে মুখ গুঁজে হুহু করে কেঁদে ফেলল শর্মিলা l ওর মাথায় হাত রেখে মা আস্তে আস্তে বলতে থাকলেন 
 
--"আমারে সাহস দাও, দাও শক্তি, হে চিরসুন্দর,
দাও স্বচ্ছ তৃপ্তির আকাশ, দাও মুক্তি নিরন্তর
প্রত্যহের ধূলিলিপ্ত চরণপতনপীড়া হতে,
দিয়ো না দুলিতে মোরে তরঙ্গিত মুহূর্তের স্রোতে,
ক্ষোভের বিক্ষেপবেগে। শ্রাবণসন্ধ্যার পুষ্পবনে
গ্লানিহীন যে সাহস সুকুমার যূথীর জীবনে--
নির্মম বর্ষণঘাতে শঙ্কাশূন্য প্রসন্ন মধুর,
মুহূর্তের প্রাণটিতে ভরি তোলে অনন্তের সুর,
সরল আনন্দহাস্যে ঝরি পড়ে তৃণশয্যা 'পরে,
পূর্ণতার মূর্তিখানি আপনার বিনম্র অন্তরে
সুগন্ধে রচিয়া তোলে, দাও সেই অক্ষুব্ধ সাহস,
সে আত্মবিস্মৃত শক্তি, অব্যাকুল,সহজে স্ববশ
আপনার সুন্দর সীমায়, দ্বিধাশূন্য সরলতা
গাঁথুক শান্তির ছন্দে সব চিন্তা, মোর সব কথা।"

দেশজুড়ে তখন খালিস্তানি আন্দোলনের ঢেউ l স্বাধীন শিখরাষ্ট্রের দাবিতে সোচ্চার সমগ্র শিখসমাজ l অপারেশন ব্লু-স্টারের আঁচ কলকাতার বাঙালিদের ঘরেও এসে লেগেছে l তারস্বরে টিভির খবর চলে আর পার্টিঅফিস বা পাড়ার চায়ের দোকানের তর্ক উঠে আসে শর্মিলাদের বসার ঘরে l বাবা অফিস থেকে ফিরলে পাশের বাড়ির সমীরণকাকু রোজ সন্ধ্যেবেলা আড্ডা দিতে আসেন এ বাড়িতে l ছোটকা থাকলে শুরু হয় তুমুল তর্কবিতর্ক l রাজনৈতিক তরজায় মুখর হয়ে ওঠে বাঙালির অন্দরমহল l বছরখানেক আগে সমীরণকাকু অর্থাৎ শম্পার বাবা আর্মি থেকে রিটায়ার করে কলকাতায় চলে এসেছেন, মেডিসিনের ডিলারশিপ নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন ইদানিং l কেয়ামাসিদের  জমি কেনা হয়েছে  বেলেঘাটায় l কিছুদিনের মধ্যেই বাড়ি করে চলে যাবে ওরা l 
প্রিটেস্ট হয়ে গেছে l এবারেও শর্মিলার রেজাল্ট তেমন ভালো হয়নি l একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়েই বইখাতা খুলে বসে থাকা l বাড়িতে থাকলে বইয়ের সমস্ত অক্ষরগুলোই দুর্বোধ্য ঠেকে l কোনো অঙ্কই মেলে না, মাঝপথে এসে আটকে যায় lআত্মবিশ্বাস ক্রমশ তলানিতে l এখন মনে হয় আর্টস পড়লেই ভালো হত l এভাবে চললে হয়ত পাশই করতে পারবে না শর্মিলা, ভালো রেজাল্ট তো দূরের কথা l আজকাল প্রায় রোজই মৈত্রেয়ীর বাড়িতে গিয়ে ওর কাছে পড়ে শর্মিলা l মৈত্রেয়ী নিজে পড়তে পড়তেও কড়া চোখে ওর পড়ার দিকে নজর রাখে l বারবার পড়া বুঝিয়ে দেয়, অঙ্ক প্র্যাক্টিস করায় l

অক্টোবরের শেষ দিন, বাতাসে হালকা শিরশিরে টান l স্নান করে মৈত্রেয়ীর বাড়িতে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছিল শর্মিলা l বাইরে বেরোতেই তুমুল শোরগোল l অপর্ণা ছুটে এসে বললেন 
--মুন্নি তুই এখন বেরোস না l 
--কি হয়েছে মা?  
--টিভির খবরে বলল প্রাইম মিনিস্টার খুন হয়েছেন l ওঁর নিরাপত্তারক্ষী সামনে দাঁড়িয়ে গুলি করেছে ওঁকে l এবার তো শহরে গোলমাল শুরু হবে l তোর বাবা, ছোটকা, কাম্মা সবাই অফিসে বেরিয়েছে l কি হবে এখন?  
--আমি বরং কেয়ামাসির বাড়ি যাই l সমীরণকাকুকে কি বলে দেখি l 
কিছুদিন আগেই কেয়ামাসিরা  বাড়িতে ফোন কানেকশন নিয়েছেন l সমীরণকাকু ওঁর আর্মির বন্ধুদের থেকে খবরাখবর নিচ্ছিলেন l দিল্লিতে নাকি দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে l রাস্তায়-ঘাটে শিখনিধন যজ্ঞ চলছে l কলকাতা শহরেও  বাস এবং ট্যাক্সি ড্রাইভার বেশিরভাগই শিখ পাঞ্জাবী, তাই ট্রান্সপোর্টের বেহাল অবস্থা l ছোটকাকে অফিসের ফোনে পাওয়া গেল l পরিস্থিতি বুঝে অফিস থেকে বেরোবে l শবনমকে তার এক কলিগ নিজের গাড়ি করে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেলেন l অরুণের অফিসে ফোন করে জানা গেল তিনি অফিস থেকে বেরিয়ে পড়েছেন l বিকেল চারটে নাগাদ অলোক ফিরল, কিন্তু অরুণের দেখা নেই l রেডিও টিভিতে শহরের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষিপ্ত গন্ডগোলের খবর  জানা যাচ্ছে l সন্ধ্যাবেলা অলোক, স্বরূপবাবু আর সমীরণবাবু গেলেন মৈত্রেয়ীর বাবা পরিমল রায়চৌধুরীর কাছে থানায় l দিনের পর দিন শহরের সমস্ত হাসপাতাল, থানায় তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাওয়া গেল না মানুষটাকে l কর্পূরের মত যেন উবে গিয়েছ শর্মিলার বাবা l অপর্ণা পাথরের মত স্থবির l যন্ত্রের মত সংসারের কাজকর্ম করে যান আগের মতই l শান্তশিষ্ট, একান্ত পরিবারঅন্তপ্রাণ মানুষটি যে সোচ্চার না হয়েও শর্মিলার  কতখানি জুড়ে ছিলেন সেটা টের পাচ্ছিল শর্মিলা l বাড়িতে এতগুলো মানুষের মধ্যে বাবার সঙ্গে দিনে কটাই বা  কথা বলত ! কিন্তু বাড়ির সবটুকু জুড়ে যেন বাবা ছিল l মাও এখন নিষ্প্রাণ একটা মানুষ l পিসি রোজ আসে,  মায়ের কাছে বসে কথা বলানোর চেষ্টা করে, কেয়ামাসিও l মা নির্বাক l ছোটকা নিয়ম করে থানায় যায় l পরিমলকাকু তার নিজস্ব সোর্সের মাধ্যমে বাবার সন্ধান জারি রাখেন l টিভিতে নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণায় রোজই বাবার নাম বলা হয় l কিন্তু অরুণ বসু নামটা ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকে l 

দিন যায় l শহর ক্রমশ তার নিজস্ব ছন্দে ফেরে l কিন্তু ওলোটপালোট হয়ে যায় ওদের মা - মেয়ের জীবন l 

মাসদুয়েক পরে তীব্র শীতের মধ্যে কাটোয়ার গঙ্গার ধার থেকে মারাত্মক অসুস্থ অবস্থায় একজন  ভবঘুরেকে  উদ্ধার করে নিয়ে আসা হল  কলকাতায় l পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে অলোককে ডেকে পাঠানো হল l দাদাকে আইডেন্টিফাই করে সম্পূর্ণ স্মৃতিভ্রষ্ট অবস্থায় বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে এল  অলোক l ডক্টর বাগচীর নার্সিংহোমে ভর্তি করার পর শারীরিকভাবে খানিকটা সেরে উঠলেন অরুণ l কিন্তু কিভাবে কাটোয়ায় গিয়ে পড়েছিলেন সেটা রহস্যই থেকে গেল l ডক্টর বাগচী গোবরা মেন্টাল হসপিটালে অরুণের ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করে দিলেন l 

(চলবে )



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন