চর্যাপদ চর্যাগীতি ও সমীক্ষা
প্রথম পর্ব
অনুসন্ধান
চর্যাপদ বা চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয় আবিষ্কার বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ সূচনা। সমগ্র উনিশ শতক তো বটেই, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত এই অমূল্য ঐতিহাসিক উপাদানটির অস্তিত্ব শিক্ষিত সমাজের অনেকটা অগোচরেই ছিল বলা যায়। যখন দিকে দিকে বাংলা সাহিত্যের শিক্ষার জন্য গজিয়ে উঠছে স্কুল বা প্রতিষ্ঠান এবং তারই সাথে বর্ণপরিচয়, কথামালা, চরিতাবলী ইত্যাদি হয়ে উঠছে বাংলা ভাষাশিক্ষার প্রাথমিক হাতিয়ার তখনও কারো ধারণাই ছিল না বিদ্যাসাগরের পূর্ব্বেও রামমোহন রায়, গুড়গুড়ে ভট্টাচার্য্যের মত প্রমুখ ভাষাপন্ডিত এই বাংলা সাহিত্যেই তাঁদের প্রচুর সৃষ্টি বা নিদর্শন স্থাপন করে গেছেন অন্তরালে, এবং সেইসব সৃষ্টি-কর্মের বহু প্রমাণাদি পুঁথি আকারে এখনও সংরক্ষিত রয়েছে। পরের দিকে রামগতি ন্যায়রত মহাশয় বাংলা ভাষা ইতিহাস নিয়ে লেখালিখি বা উৎসাহ প্রকাশ করলে, সেই লেখায় কাশীদাস, কৃত্তিবাস কবিকঙ্কণ প্রভূত কয়েকজন প্রাচীন কবির সন্ধান মেলে। এ থেকে একপ্রকার ধারণা উদ্ভব হয় তিনশ বছরের পূর্ব্বে যে কয়েকটি কাব্যের সন্ধান পাওয়া গেছে তা কেবল সংস্কৃতের নিম্নরূপ বা সংস্কৃতের অনুবাদ ব্যতীত আর কিছুই নয়। আরও পরে ন্যায়রত মহাশয়ের অনুকরণে আরও কয়েকটি সাহিত্যের নিদর্শন পাওয়া যায় ঠিকই, বলাই বাহুল্য সেগুলির মধ্যে নতুনত্বের ছোঁয়া বলতে কিছুই পাওয়া যায় না। তাই এইসকল ইতিহাস অস্তিত্বের দরুণ আশি শতকে সাধারণ ধারণা ছিল যে বাংলা এমনই একটি ভাষা যা কেবল অনুবাদেই সীমিত, অর্থাৎ, আক্ষরিক ভাষায়- বাংলা ভাষা শুধুমাত্র ইংরেজি অথবা সংস্কৃত সাহিত্যের একটি অনুবাদীরূপ মাত্র।
1858 সালে রাজেন্দ্রলাল মিত্র 'বিবিধার্থ সংগ্রহ' পত্রিকায় 'বঙ্গভাষার উৎপত্তি' নামে যে প্রবন্ধ প্রকাশ করেন সেখানে বাংলা ভাষার উৎসরূপ হিসাবে হিন্দির পূর্বী শাখাকে নির্দেশ করা হয় এবং আদি নিদর্শন হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায় বিদ্যাপতির রচনাবলী। এছাড়াও 1911 সালে প্রকাশিত হয় দীনেশচন্দ্র সেনের 'The History of Bengali Language and Literature', সেখানে বহু বৌদ্ধ প্রভাব সম্পর্কীয় তথ্যাদি সম্পর্কে ধারনা মেলে। যদিও এই তথ্যগুলোর সত্যতা প্রমাণের অভাবে সেভাবে এগুলোর প্রশস্ততা বিচার করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে নি। তাই ইতিহাসের এই শূন্যস্থান পূরণ ও পূর্ব অনুমিত সূত্রের পুনর্মূল্যায়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে নেপালের রাজকীয় গ্রন্থভাণ্ডার। প্রকৃতপক্ষে, যেকারণে নেপাল ও তিব্বতে রক্ষিত বিভিন্ন বৌদ্ধ শাস্ত্রগ্রন্থের পুঁথির দিকে দৃষ্টি নির্বাপিত হয় সব্বার, সর্বপ্রথম বিশেষ করে বিদেশী গবেষকদের উৎসাহ এক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ। প্রসঙ্গত বলা যায়, প্রচলিত আছে Brian Hodgsen নামক এক জনৈক ইংরেজের তত্ত্বাবধানে নেপাল থেকে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের বেশ কয়েকটি পুঁথি আবিষ্কার হওয়ার পর থেকেই নাকি তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস রচনা ও শাস্ত্র সম্পাদনার ব্যাপারে গবেষকদের অন্দরে একপ্রকার ঢেউ উঠতে শুরু করে। সেই সূত্র ধরে প্রথমে ১৮৪৪ সালে Eugene Burnouf, পরে Deniel Wright ও Cecil Bendall প্রভূত গবেষকের নাম একে একে উঠে আসতে থাকে। প্রসঙ্গত, জানিয়ে রাখা ভালো ১৮২৮ সালে সর্বপ্রথম ইংরেজ গবেষক Brain Hodgson নেপাল থেকে সর্বপ্রথম তান্ত্রিকবৌদ্ধধর্ম বিষয়ক তাঁর আবিষ্কৃত পুঁথিগুলোর তালিকা প্রকাশ করেছিলেন 1784 সালে প্রতিষ্ঠিত স্যার William Jones এর 'The Asiatic Reseaches' নামক পত্রিকাটিতে এবং 1844এ ফরাসি পন্ডিত Eugene Burnouf প্যারিস থেকে প্রকাশ করেন Introduction a I' histoire du Buddisme Indienনামক একটি বৌদ্ধ-ধর্মমূলক গ্রন্থ ও আরেক ইংরেজ গবেষক Daniel Wright তাঁর (Cambraige University) এর জন্য পুঁথি সংগ্রহ করতেও নেপালে যান বলে জানা যায়। এছাড়াও বাঙালি গবেষকরাও এইব্যাপারে মোটেও পিছিয়ে ছিলেন না, যেমন এক্ষেত্রে রাজেন্দ্রলাল মিত্রের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনিও 1882 সালে নেপালে গিয়ে বৌদ্ধ-সংস্কৃত পুঁথি অনুসন্ধান করার পরে 'Sanskrit Buddhist Literature In Nepal' নামে একটি পুঁথির তালিকা প্রকাশ করতে সচেষ্ট হন এবং পরবর্তীতে রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর সরকার হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর উপর বাংলা-বিহার-আসাম-উড়িষ্যার পুঁথিসন্ধান ও সংগ্রহের দায়িত্ব এসে পড়লে সেই সূত্র ধরেই শাস্ত্রী মহাশয় শুরু করেন তার নতুন অনুসন্ধান। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের দীনতার বিষয়টি বুঝতে পেরে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রাজেন্দ্রলালের তালিকা ও নবাবিষ্কৃত পুঁথির ভিত্তিতে নেপালের নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বৌদ্ধ-সংক্রান্ত নানা পুঁথির ও তথ্যের সন্ধানে সম্পূর্ণ মননিবেশ দিতে থাকেন। এবং তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই দৈনতা থেকে মুক্ত পেতে হলে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এইসব বৌদ্ধ উপাদান একান্ত অনস্বীকার্য। তাই বলা হয়, 1886 সালে বেঙ্গল লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার পর থেকেই বাংলা সাহিত্যের একটা নতুন নবজাগরণের সূচনা হয়।
প্রথম পর্ব
অনুসন্ধান
চর্যাপদ বা চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয় আবিষ্কার বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ সূচনা। সমগ্র উনিশ শতক তো বটেই, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত এই অমূল্য ঐতিহাসিক উপাদানটির অস্তিত্ব শিক্ষিত সমাজের অনেকটা অগোচরেই ছিল বলা যায়। যখন দিকে দিকে বাংলা সাহিত্যের শিক্ষার জন্য গজিয়ে উঠছে স্কুল বা প্রতিষ্ঠান এবং তারই সাথে বর্ণপরিচয়, কথামালা, চরিতাবলী ইত্যাদি হয়ে উঠছে বাংলা ভাষাশিক্ষার প্রাথমিক হাতিয়ার তখনও কারো ধারণাই ছিল না বিদ্যাসাগরের পূর্ব্বেও রামমোহন রায়, গুড়গুড়ে ভট্টাচার্য্যের মত প্রমুখ ভাষাপন্ডিত এই বাংলা সাহিত্যেই তাঁদের প্রচুর সৃষ্টি বা নিদর্শন স্থাপন করে গেছেন অন্তরালে, এবং সেইসব সৃষ্টি-কর্মের বহু প্রমাণাদি পুঁথি আকারে এখনও সংরক্ষিত রয়েছে। পরের দিকে রামগতি ন্যায়রত মহাশয় বাংলা ভাষা ইতিহাস নিয়ে লেখালিখি বা উৎসাহ প্রকাশ করলে, সেই লেখায় কাশীদাস, কৃত্তিবাস কবিকঙ্কণ প্রভূত কয়েকজন প্রাচীন কবির সন্ধান মেলে। এ থেকে একপ্রকার ধারণা উদ্ভব হয় তিনশ বছরের পূর্ব্বে যে কয়েকটি কাব্যের সন্ধান পাওয়া গেছে তা কেবল সংস্কৃতের নিম্নরূপ বা সংস্কৃতের অনুবাদ ব্যতীত আর কিছুই নয়। আরও পরে ন্যায়রত মহাশয়ের অনুকরণে আরও কয়েকটি সাহিত্যের নিদর্শন পাওয়া যায় ঠিকই, বলাই বাহুল্য সেগুলির মধ্যে নতুনত্বের ছোঁয়া বলতে কিছুই পাওয়া যায় না। তাই এইসকল ইতিহাস অস্তিত্বের দরুণ আশি শতকে সাধারণ ধারণা ছিল যে বাংলা এমনই একটি ভাষা যা কেবল অনুবাদেই সীমিত, অর্থাৎ, আক্ষরিক ভাষায়- বাংলা ভাষা শুধুমাত্র ইংরেজি অথবা সংস্কৃত সাহিত্যের একটি অনুবাদীরূপ মাত্র।
1858 সালে রাজেন্দ্রলাল মিত্র 'বিবিধার্থ সংগ্রহ' পত্রিকায় 'বঙ্গভাষার উৎপত্তি' নামে যে প্রবন্ধ প্রকাশ করেন সেখানে বাংলা ভাষার উৎসরূপ হিসাবে হিন্দির পূর্বী শাখাকে নির্দেশ করা হয় এবং আদি নিদর্শন হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায় বিদ্যাপতির রচনাবলী। এছাড়াও 1911 সালে প্রকাশিত হয় দীনেশচন্দ্র সেনের 'The History of Bengali Language and Literature', সেখানে বহু বৌদ্ধ প্রভাব সম্পর্কীয় তথ্যাদি সম্পর্কে ধারনা মেলে। যদিও এই তথ্যগুলোর সত্যতা প্রমাণের অভাবে সেভাবে এগুলোর প্রশস্ততা বিচার করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে নি। তাই ইতিহাসের এই শূন্যস্থান পূরণ ও পূর্ব অনুমিত সূত্রের পুনর্মূল্যায়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে নেপালের রাজকীয় গ্রন্থভাণ্ডার। প্রকৃতপক্ষে, যেকারণে নেপাল ও তিব্বতে রক্ষিত বিভিন্ন বৌদ্ধ শাস্ত্রগ্রন্থের পুঁথির দিকে দৃষ্টি নির্বাপিত হয় সব্বার, সর্বপ্রথম বিশেষ করে বিদেশী গবেষকদের উৎসাহ এক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ। প্রসঙ্গত বলা যায়, প্রচলিত আছে Brian Hodgsen নামক এক জনৈক ইংরেজের তত্ত্বাবধানে নেপাল থেকে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের বেশ কয়েকটি পুঁথি আবিষ্কার হওয়ার পর থেকেই নাকি তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস রচনা ও শাস্ত্র সম্পাদনার ব্যাপারে গবেষকদের অন্দরে একপ্রকার ঢেউ উঠতে শুরু করে। সেই সূত্র ধরে প্রথমে ১৮৪৪ সালে Eugene Burnouf, পরে Deniel Wright ও Cecil Bendall প্রভূত গবেষকের নাম একে একে উঠে আসতে থাকে। প্রসঙ্গত, জানিয়ে রাখা ভালো ১৮২৮ সালে সর্বপ্রথম ইংরেজ গবেষক Brain Hodgson নেপাল থেকে সর্বপ্রথম তান্ত্রিকবৌদ্ধধর্ম বিষয়ক তাঁর আবিষ্কৃত পুঁথিগুলোর তালিকা প্রকাশ করেছিলেন 1784 সালে প্রতিষ্ঠিত স্যার William Jones এর 'The Asiatic Reseaches' নামক পত্রিকাটিতে এবং 1844এ ফরাসি পন্ডিত Eugene Burnouf প্যারিস থেকে প্রকাশ করেন Introduction a I' histoire du Buddisme Indienনামক একটি বৌদ্ধ-ধর্মমূলক গ্রন্থ ও আরেক ইংরেজ গবেষক Daniel Wright তাঁর (Cambraige University) এর জন্য পুঁথি সংগ্রহ করতেও নেপালে যান বলে জানা যায়। এছাড়াও বাঙালি গবেষকরাও এইব্যাপারে মোটেও পিছিয়ে ছিলেন না, যেমন এক্ষেত্রে রাজেন্দ্রলাল মিত্রের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনিও 1882 সালে নেপালে গিয়ে বৌদ্ধ-সংস্কৃত পুঁথি অনুসন্ধান করার পরে 'Sanskrit Buddhist Literature In Nepal' নামে একটি পুঁথির তালিকা প্রকাশ করতে সচেষ্ট হন এবং পরবর্তীতে রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর সরকার হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর উপর বাংলা-বিহার-আসাম-উড়িষ্যার পুঁথিসন্ধান ও সংগ্রহের দায়িত্ব এসে পড়লে সেই সূত্র ধরেই শাস্ত্রী মহাশয় শুরু করেন তার নতুন অনুসন্ধান। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের দীনতার বিষয়টি বুঝতে পেরে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রাজেন্দ্রলালের তালিকা ও নবাবিষ্কৃত পুঁথির ভিত্তিতে নেপালের নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বৌদ্ধ-সংক্রান্ত নানা পুঁথির ও তথ্যের সন্ধানে সম্পূর্ণ মননিবেশ দিতে থাকেন। এবং তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই দৈনতা থেকে মুক্ত পেতে হলে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এইসব বৌদ্ধ উপাদান একান্ত অনস্বীকার্য। তাই বলা হয়, 1886 সালে বেঙ্গল লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার পর থেকেই বাংলা সাহিত্যের একটা নতুন নবজাগরণের সূচনা হয়।
বেঙ্গল লাইব্রেরির বৈষ্ণব গান ও সংকীর্তনের বিরাট সংগ্রহের পাশাপাশি জীবনচরিত ও ইতিহাস সম্পর্কিত পুঁথির সংগ্রহ দেখে তিনি শুধু বিস্মিত হন নি, এই সংগ্রহশালার সম্ভার দেখে তাঁর লিখিত পুঁথির প্রতি তাঁর আগ্রহ বা ঝোঁক অনেকাংশে বেড়ে যায়, যা স্পষ্টভাবে বললে- তাঁর বাংলা ভাষার প্রতি একপ্রকার অমোঘ আকর্ষণ জন্মাতে শুরু করে। যার ফলস্বরূপ আকৃষ্ট হয়ে পড়েন শাস্ত্রী ধর্মঠাকুর সম্পর্কে। তাঁর ধারণা হয়- বৌদ্ধ ধর্মের শেষ দেবতা একমাত্র ধর্মঠাকুরই। তাই এই ধারণা সত্যতা প্রমাণের জন্য মননিবেশ করেন ধর্মমঙ্গল পুঁথির সন্ধানে এবং তার কিছুদিনের মধ্যেই পেয়ে যান মাণিক গাঙ্গুলীর 'ধর্মমঙ্গল' ও রামাই পন্ডিতের 'শূন্যপুরাণ'। যার ফলস্বরূপ তিনি মনস্থির করেন নেপালে গিয়ে এই পুঁথি ও তথ্যাদির ব্যাপারে নতুন নতুন অনুসন্ধান শুরু করবেন।
সেইমতো, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রথমবারের মতো নেপালে যান 1887 সালে, দ্বিতীয় বারের জন্য যান তার ঠিক পরের বছরেই। দ্বিতীয় বারের যাত্রায় লাভ হিসাবে পান 'ডাকর্ণব' নামে একটি পুঁথি। এই পুঁথির ভাষাটি তাঁর অজ্ঞাত হওয়াও তাঁকে বেশ সমস্যার মধ্যেই পড়তে হয়। যদিও তিনি বিচলিত না হয়ে সেই পুঁথি অবিলম্বে নকল করে নিয়ে আসেন। বিশেষ উল্লেখযোগ্য, সুভাষিত নামে আরও একটি পুঁথির ভাষা তাঁর নজর কারলেও, পরে অজান্তে ইংরেজ পন্ডিত Cecil Bendall সেটি নকল করে নিলে তাঁর এটি হাতছাড়া হয়ে যায়। এছাড়াও 'দোহাকোষপঞ্জিকা' নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ পুঁথিও এই ইংরেজ গবেষকের কারণেই নাকি পুনরায় হাতছাড়া হয়েছিল বলে সূত্র মারফত জানা যায়। প্রমাণ আছে,পরবর্তীতে ঘটা করে বেন্ডেল 1905 সালে সেই পুঁথিগুলোর ভাষাকে Òdifficult Apabhramsa Prakrit” নামে প্রকাশও করেছিলেন। পুনরায় নতুন তথ্য উন্মোচনের আশায় শাস্ত্রী মহাশয় তৃতীয়বারের জন্য নেপাল যান 1907 সালে। এইবার নেপাল গিয়ে তিনি পেয়ে গেলেন তাঁর জ্যাকপট। এই সেই বহুকাঙ্খিত স্বর্ণভান্ডার- বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদের পুঁথি 'চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়' ও তার পাশাপাশি খুঁজে পান সরোরুহপাদের দোঁহা ও অদ্বয়বজ্রের সংস্কৃতে রচিত 'সহজাম্নায়পঞ্জিকা' এবং কৃষ্ণাচার্য্যের দোঁহা ও আচার্য্যপাদের সংস্কৃতে রচিত 'মেখলা' নামক প্রাচীন বাংলা ভাষায় রচিত টীকা সমগ্র। এই অসম্ভব সৃষ্টির আবিষ্কার সম্পর্কে তাঁর একটি উক্তি এক্ষেত্রে বিশেষ তাৎপর্য্যপূর্ণ-
" ১৯০৭ সালে আবার নেপালে গিয়া আমি কয়েকখানি পুঁথি দেখিতে পাইলাম। একখানিক নাম 'চর্য্যাচর্য্য-বিনিশ্চয়', উহাতে কতকগুলি কীর্ত্তনের গান আছে ও তাহার সংস্কৃত টীকা আছে। গানগুলো বৈষ্ণবদের কীর্ত্তনের মত, গানের নাম 'চর্য্যাপদ'। আর একখানা পুস্তক পাইলাম তাহাও দোঁহাকোষ, গ্রন্থাকারের নাম সরোরুহবজ্র, টীকাটি সংস্কৃতে, টীকাকারের নাম অদ্বয়বজ্র। আরও একখানি পুস্তক পাইলাম, তাহার নামও দোঁহাকোষ , গ্রন্থাকারের নাম কৃষ্ণাচার্য্য, উহারও একটি সংস্কৃত টীকা আছে। "
বাংলা ১৩২৩ সনে অর্থাৎ ইংরেজি সাল1907-এ আবিষ্কৃত 'চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়' এর পাশাপাশি 'সরোরুহবজ্র' ও 'কৃষ্ণাচার্য্য' নামে দুটি দোঁহাকোষ এবং 1887 ও 1888 মধ্যবর্তীতে কোনো একসময়ে পূর্বপ্রাপ্ত 'ডাকার্ণব' এই চারটি পুঁথি একত্রে নিয়ে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী 'বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ' থেকে প্রকাশ করেন একটি সম্মিলিত সাহিত্য সংকলন, যার নাম - "হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোঁহা।" যার ফলে এই গ্রন্থ প্রকাশের পর একদিকে যেমন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ বিষয়ক পূর্বের সিদ্ধান্তগুলো ভঙ্গুর হয়ে পড়লো আবার তেমনই অন্যদিকে নেপালের পুঁথির প্রতি ভারতীয় গবেষকদের আগ্রহের পাশাপাশি বাংলা সাহিত্য ও তার উদ্ভব নিয়ে নিবিড় বিশ্লেষণের প্রারম্ভ হয়েছিল বলা যায়।
ক্রমশ..............
অলংকরণ- শ্রেয়সী ভট্টাচার্য্য
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন