গুরু (পর্ব – ২)
শাপলা সপর্যিতা
ক্লাস নাইনে পড়ি। নতুন একটা সাবজেক্ট জোগ হল
জ্যাকা। জ্যামিতি ও কারিগরী। ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে নম্বর তোলা খুব সহজ বলে খুব আগ্রহ
করে জ্যাকা নিলাম। আমার কোনদিন উপরি শিক্ষকের কাছে পড়বার বাতিক ছিলনা। কিন্তু
জ্যাকা আমাকে পড়াবে কে? এই সাবজেক্ট আগে ছিলনা বিধায় বড় ভাইবোনরা কেউ এটা পড়েনি।
গৃহশিক্ষক দরকার। কিন্তু গৃহশিক্ষকে আমার বড্ড এলার্জি। এ বড় বিরক্তিকর কাজ।সবাই
যখন নোট সাজেশনের জন্য প্রাইভেট টিউটরের কাছে দৌঁড়ায় আমি তখন নিশ্চিন্তে ঘরে বসে
পড়ি এলেচি আমাদি আগাথা ক্রিষ্টি আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।শিউলী ফুলে মালা গাঁথি আর দুচার
পংক্তি কাব্য রচনার ব্যর্থ প্রয়াস চালাই।বরাবরই পড়াশোনায় মনোযোগ কম তার ছোট
মেয়েটির আমার মায়ের ধারণা। কিন্তু পড়তে বসলে ঠিক মতো বুঝতে পারে সব। কিন্তু সে
পড়তে বসেই না।বসলেও ক্ষণিকের জন্য। বইর সাথে বেশিক্ষণ সে থাকতেই পারেনা। এটাই
সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে আমার মায়ের চোখে ধরা পড়ে। অতএব তাকে পড়তে বসাতে হবে। সত্যিই,
আমার এখনো মনে পড়ে মা আমাকে সব সময় বলতেন ‘মা রে তুই একটু পড়ার টেবিলটাতে বই নিয়ে
বসে থাক শুধু। তোর পড়াও লাগবেনা। তুই কেবল বইর সাথে কয়েক ঘন্টা একটা জায়গায় থাকতো
মা।’ ধুর আমার ভাল্লাগেনা এক জায়গায় বসে বসে বক বক বক করে জপে জপে পড়া মুখস্ত করা।
আমার যতটুকু পড়ার আমি পড়ে নেই আবার কিছুক্ষণ পড়ই উঠে পড়ে এদিকে ঘুরি ওদিকে ঘুরি।
আম্মার ধারণা এর জন্য আমার রেজাল্ট খারাপ হচ্ছে। রেজাল্ট খারাপ মানে কুমিল্লায়
লালমাইর কোলে ল্যাবরেটরী স্কুলে ফার্ষ্ট হতাম। ক্লাশ ফাইভে বৃত্তিও এনে দিলাম – আর
কি দিলে যে মা খুশী হবেন কে জানে। ক্লাশ সিক্স এ ময়মনসিংহে বিদ্যাময়ী স্কুল।
রেজাল্ট খারাপ হওয়া শুরু। স্কুলে আশা যাওয়ার পথে কেমন কেমন চোখে তাকিয়ে থাকা
বখাটে ছেলেরা টিজ করে। এদো গলি-গলির পাশেই ড্রেন থেকে তুলে ময়লাগুলো আবার ড্রেনের
পাশেই রেখে দেয়া। এমন একটা রাস্তা দিয়ে স্কুলে যেতে যেতে আমি হারিয়ে যাই কেবলই
আমার লালমাইর বুকে স্কুলে যাবার পথের পানে। আহা কি সবুজ কি মায়া কি মনোহর কি
অবিরাম। সেই একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছ পেরিয়ে লম্বা সর্পিল পায়ে চলার পথ ধরে
খেজুর গাছে ঝুলানো রসের হাড়ি দেখতে দেখতে পুকুরের ধার ঘেষে বড় মাঠটা পার করে
আব্বার অফিসের ফুল চুরি করে ব—ড়—রাস্তাটা পার হয়ে স্কুলে ঢুকলেই বিশাল মাঠ। বর্ষায়
জল জমে জমে পায়ের কাছে ঠেকলে কিংবা বাড়ি থেকে বের হয়ে ছোট মাঠের কিনার দিয়ে হাঁটতে
গেলে পুকুর থেকে উপচে পড়া জলের সাথে ছোট মাঠে উঠে আসা মাছ গুলোকে আজলা ভরে তুলে
নিতাম যে আনন্দে।সেই আনন্দের মৃত প্রহরের সাথে আমি চলি ময়মনসিংহ শহরে। স্কুলে
যাবার পথে। এখানে পড়ায় আমার মন বসেনা। বরং আমি পড়ি আগাথা ক্রিষ্টি – আহা অনন্ত সেই
রাত। আমি পড়ি এলিচি আমাদি – আহা আফ্রিকান সেই গাথা।পড়ি শেষের কবিতা – আহা, কালের
যাত্রায় ধ্বনি। পড়ি দেবদাস হায় দেবদাস, পরিণীতা এমনকি গৃহদাহ। পড়ি শীর্ষেন্দু
বঙ্কিম এমনকি মানিক বন্দোপাধ্যায়। পড়ার বইর নীচে লুকিয়ে। বাথরুমে শাওয়ার ছেড়ে
ঘন্টার পড় ঘন্টা গোসলের নামে। এমনকি ক্লাশে যাদরেল শিক্ষকের ক্লাশেও ভূগোল বইর
নীচে নির্মলেন্দু গুণ কিংবা শক্তি চট্টোপাধ্যায় নিয়ে কাটাই নিশ্চিন্তে আমার
স্কুলের পড়া করবার গুরুত্বপূর্ণ সময়। এভাবে কি আর রেজাল্ট ভালো হয়? এই ধরণের উচাটন মনের ছোট মেয়েটিকে পড়ায় মনোযোগী
করার জন্য একমাত্র মহামন্ত্র হলো গৃহ শিক্ষক। এখন নতুন বিষয় জ্যামিতি ও কারিগরী
বিদ্যা – জ্যাকা। কে পড়াবে? জ্যাকার জন্য জীবনে প্রথম
একজন শিক্ষক নিয়োগ করা হল বাসায় এসে পড়াবেন। তিনি তখন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছেন
ময়মনসিংহ পলিটেনিকেল ইন্সটিটিউটে।আব্বাই তার ছাত্রদের মধ্যে ভদ্র সভ্য দেখে একজনকে
নিয়োগ দিলেন আমাকে জ্যাকা পড়াবার জন্য। প্রথম গৃহশিক্ষক। মা বললেন, ‘যিনি শিক্ষক, যার কাছে একটি অক্ষরও শিখেছ তার নাম সারাজীবন মনে রাখবে আর
তাকে শিক্ষাগুরু হিসেবে শ্রদ্ধা করবে।’’ আমি জ্যাকা শেখার চেয়ে স্যারের নামের প্রতি বেশি মনোযোগ
দিলাম। খুব যত্নে মনে রাখলাম আমার জ্যাকার শিক্ষকের নাম গৌরাঙ্গদাস। তিনি খুব নম্র
আর ভদ্র। হিন্দু ধর্মাবলম্বী। যত্ন নিয়ে পড়ান। কিন্তু আমার ওই যত্নে বিরক্তি।
কোনমতে বিষয়টা বুঝে নিয়েই যখন উপলব্ধি করতে পারলাম আমি একাই পেরে উঠবো তখন আর কে
পায় আমারে। নিয়ম করে স্কুলের পড়ার বাইরেও গানের শিক্ষকের কাছে নিয়ম করে গান শিখতে
বসার সাথে সাথে আবার বাড়ি বসে বসে শিক্ষকের চেহারা দেখার মত অতটা ধৈর্যশীল মানুষ
আমি একদম নই। খুব দ্রুতই তাই ধৈর্যের শেষ সীমার আমি পৌঁছে গেলাম। কিছুদিনের মধ্যেই
নানা অজুহাত তুলে দ্বিতীয় শিক্ষকের বাড়া ভাতে নুনের ছিটা দিয়ে বিদায়
করলাম।............(চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন