পারমিতা চক্রবর্ত্তীর সম্পাদনায় গত
কয়েকমাস ধরে অনলাইন পত্রিকা “সৃজন”এর হাত ধরে আমরা পেয়ে যাচ্ছি বিভিন্ন স্বাদের
কবিতা,গল্প,অণুগল্প...এছাড়াও বাংলা সাহিত্যের আরও নানান দিকের খবরাখবর। সৃজন-ব্লগে
একদিকে যেমন কলম ধরেছেন নতুন নতুন লেখক,কবিরা ঠিক তেমন ভাবেই সৃজন এ তাদের সৃষ্টি
তুলে দিয়েছেন অনেক গুণীজনেরাও। সম্পাদিকা পারমিতা চক্রবর্ত্তীর একান্ত ইচ্ছায় আমি
জয়িতা দে সরকার এই সংখ্যা থেকে সৃজন ব্লগে থাকছি একটি নতুন বিভাগ নিয়ে। পারমিতা আমাদের
ফেসবুকগ্রুপ রূপসী হেঁসেলের সাথে অনেকে আগে থেকেই পরিচিত। সেই সূত্র ধরেই সৃজন’এ
এবার থেকে আমরা থাকছি “অন্দরমহলের গল্প” এই বিভাগে। এই বিভাগে থাকছে বিভিন্ন
রান্নাঘরের গল্প। সাথে বেশ কিছু সাবেকী হারিয়ে যাওয়া রান্নার গন্ধও। সত্যি বলতে কি
এখনকার দিনের আধুনিক রান্নাঘরে রান্নার সেই স্বাদ আর খুঁজে পাই না। সেইসব স্বাদের
কথা এখন শুধু স্মৃতির আঁচলে গিঁট বাধাই রয়ে গেছে। আমাদের এই নতুন বিভাগের মধ্যে
দিয়ে আমরা ফেলে আসা সেইসব রান্নাঘরের স্মৃতি রোমন্থন করতে চাইছি। সাথে অবশ্যই
থাকবে পুরোনো কিছু রান্নার প্রণালীও।
“অন্তরমহলের গল্প” বিভাগে এবার কলম
ধরেছেন
কলকাতায় বসবাস ও কর্মরতাশর্মিষ্ঠা নাহা দিদি। যিনি পেশায় প্রাথমিক শিক্ষিকা।
লেখালিখি ওনার প্যাশন। গদ্য ও কবিতা দুয়েতেই ওনার কলম স্বচ্ছন্দ। এবং সবশেষে দিদি জানিয়েছেন সামান্য উপকরণে সুস্বাদু
রান্নার এক্সপেরিমেন্ট করা ওনার হবি। ওনার গল্পের
নামকরণটিই সকলকে টেনে নিয়ে যায় লেখাটির শেষ পর্বে। এবং লেখার শেষে আমরা পেয়ে যাই
একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় রান্নার স্বাদ এবং গন্ধও। এক্ষেত্রে কিন্তু বলতেই হয় লেখকের
কলমের জোরে রান্নার গন্ধ পাঠকের জিভ এবং মনকে উশখুশ করতে বাধ্য করে। আর বেশী
ভূমিকা না করে সোজা চলে গেলাম আজকের রান্নার গল্পে।
কয়েকজন 'সিদ্ধ' পুরুষের কাহিনী -
সিদ্ধপক্ক রান্না খুবই পুষ্টিকর। খাদ্যসামগ্রী খোলা পাত্রে
ভাজা,কষা ও সাঁতলানোর সময় তার পুষ্টিগুণ কিছুটা কমে যায়। ঢাকা
পাত্রে সিদ্ধ করে রান্না করলে সেগুলো রান্নায় থাকে। কিন্তু পুষ্টির জন্য স্বাদের
সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করতে ক জন চায়? আমার পরিচিত কয়েকজন মানুষের
কথা বলি, যাঁরা পরিস্থিতির চাপে দিনের পর দিন সিদ্ধ করে রান্না করতে
ও খেতে বাধ্য হয়েছেন। তবে রান্নাগুলি সুস্বাদুও হয়েছে। ঘটনাচক্রে এঁরা সকলেই
পুরুষ। আমার চোখে ' সিদ্ধ'পুরুষ।প্রথমজন আমার ঠাকমার
বাবা। বলাইবাহুল্য তাঁকে আমি দেখি নি। দেখেছি ঠাকমার ঘরে তাঁর ইকমিক কুকারটি।
একটার ওপর একটা টাইট করে বসানো ওপরের বাটিতে ঢাকা দেওয়া তিনটে বাটির নীচে একটা
খালি চেম্বারমত। ওতে গুলকয়লার ঢিমে আঁচ থাকত। নিচের বাটিতে পাঁঠার মাংস, মাঝের বাটিতে ভাত আর ওপরের বাটিতে মুসুরডাল হত।ঠাকমার বাবা বাড়ি থেকে বহু
দূরের কোনও রেলস্টেশনে স্টেশনমাস্টার ছিলেন। কর্মক্ষেত্রের কাছে কোয়ার্টার নিয়ে
থাকতেন। প্রায়দিন ইকমিক কুকারে সিদ্ধ ভাত খাওয়াই তাঁর জীবন ছিল। কখনও সখনও ইকমিক
কুকারে বানাতেন পাঁঠার মাংস। মাংস ধুয়ে জল ঝড়িয়ে নুন, হলুদ- জিরে-
ধনে- শুকনোলঙ্কা- আদা-পেঁয়াজ বাটা এবং ঘি ভালো করে মাখিয়ে ঘন্টা দুয়েক রেখে ইকমিক
কুকারে পরিমাণমত জল দিয়ে ইকমিক কুকারের নিচের বাটিতে দিয়ে সিদ্ধ হতে দেওয়া হত
যতক্ষণ আঁচ থাকে। ছোট্ট মেয়েটি উদগ্রীব অপেক্ষা করত কখন বাবা বাড়ি ফিরবেন আর ইকমিক
কুকারে মাংস রান্না করে সবাই মিলে খাওয়া হবে।আমার
ঠাকুর্দারা ছ ভাই সাত বোন। আমার জন্মের পর স্থানাভাবে কিংবা কর্মসূত্রে বিভিন্ন
জায়গায় ছড়িয়ে। কিন্তু সরস্বতী পুজো উপলক্ষ্যে সবাই এক জায়গায় হতেন। সকলের জন্য
গোটাসিদ্ধ হত বিশাল বড় এক হাঁড়িতে। কালো কলাইডাল এবং বিভিন্ন সবজি, পরিমাণ মত জল,নুন, সরষের তেল দিয়ে ঢাকনা দিয়ে
উনুনে বসিয়ে দিতে হয়। ঢাকনা খোলা যাবে না। খুন্তি দিয়ে নাড়াও যাবে না। হাঁড়ি ধরে
ঝাঁকিয়ে রান্না করতে হয়। এই হাঁড়ি কোনও মহিলার পক্ষে তোলা সম্ভব নয়। বাবারা ছোট
থাকতে এই কাজ করতেন বাবার বিশালদেহী ছোটকাকা। আমি ছোটবেলায় আমার সেজোকাকাকে এই
দায়িত্ব পালন করতে দেখেছি। তিনি বয়সের কারণে যবে থেকে পারেন না, তবে থেকে বন্ধই হয়ে গেছে এই বিরাট পার্বণ। আমি জীবনে অনেক গোটাসেদ্ধ খেয়েছি।
কিন্তু সেজোকাকার হাতের সেই স্বাদ অন্য কোথাও পাই নি।স্থানাভাবেই পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে
বাবার অফিস কোয়ার্টারে গিয়ে ওঠা। অনভ্যস্ত কাজের চাপে মা তো দিশেহারা। সকালে অফিস-
স্কুলের
রান্না সময়মত বেড়ে দিতে আমার বাবা কিনে আনলেন সেপারেটর সেট যুক্ত একটা বড় প্রেশার
কুকার। আলাদা আলাদা বাটিতে একসঙ্গে দুটো পদ রান্না হয়ে যেত নিমেষে। কোনওমতে খেয়ে
স্কুলে যেতাম। কিছুটা সয়ে যাওয়ার পর থেকে অবশ্য
প্রচুর ভালোমন্দ রান্না করতেন মা। বাবা আজও ভাত আর ডিমসেদ্ধ ছাড়া কিছু পারেন না।
তিনি সত্যিকার 'সিদ্ধ'পুরুষ। অবশ্য এটুকু পারেন
বলে মা একদিন অসুস্থ হলে কোনওমতে চলে যায়।আমি মর্নিং স্কুল জয়েন করার পর আমার
কর্তা কিনে এনেছিলেন ফ্রিজ আর সোলো মাইক্রোওয়েভ ওভেন। আগের দিনের রান্না খাবার
লাঞ্চের আগে মাইক্রোতে গরম করে খেলেই হল।ভালোই চলছিল। হঠাৎ একবার এল.পি.জির সাপ্লাইয়ের কোনও সমস্যা হল। গ্যাস নেই। রোজ হোটেলে
খাওয়া চাপ। হাতে রইল সোলো মাইক্রোওয়েভ। "আচ্ছা,
ওতে খাবার যখন গরম হয়, আর একটু বেশি গরম হলে সেদ্ধ ও হয়ে যাবে।" বললেন আমার কর্তা। " এ কদিন দুবেলা দুমুঠো এতেই ফুটিয়ে নেবো।"পরদিন
স্কুল ফেরৎ হাতেগরম বিটনুন দেওয়া লেবু চা। মাইক্রোয় জল ফুটিয়ে তাতে চা পাতা ভিজিয়ে
তৈরি। ভদ্রলোক ভাত, আলুসিদ্ধ,
মুসুরডালসিদ্ধ আর ডিমের পোচ
ও বানিয়েছেন।চলে যাচ্ছিল। কিন্তু বড় একঘেয়েভাবে। বিশেষ করে মাছের জন্য প্রাণ কেঁদে কেঁদে
উঠছিল। আমার চেয়ে বেশি করে ওঁর।পরদিন বাজার থেকে এল বেগুন,
ইলিশ। নুন-হলুদ মাখানো ইলিশ, বেগুন,
নুন,হলুদ, কাঁচালঙ্কা,কালোজিরে, সরষের তেল ও পরিমাণমত জল দিয়ে কুড়ি মিনিট ধরে গরম করে তৈরি হল বেগুন -
ইলিশ।
ক দিন সেদ্ধ খাওয়ার পর এটুকুই অমৃত ছিল। ভালোই খেয়েছিলাম সে দিন 'সিদ্ধ '
পুরুষের উদ্ভাবনী রান্না।
গোটাসিদ্ধ ( ১২ জনের মত)উপকরণ : কালো মাষকলাই ডাল ৪০০ গ্রাম, আলু,সিম, কড়াইশুঁটি, বেগুন,
গোড়াসুদ্ধু শীষপালংশাক (
প্রত্যেকটি
১২ টা করে। একটু বেশি ও দেওয়া যেতে
পারে)। সরষের তেল অল্প, নুন প্রয়োজনমত, জল ।প্রণালী : একটিবড়
হাঁড়িতে ডাল দিয়ে ঢাকনা বন্ধ করে কিছুক্ষণ উনুনের ওপর বসাতে হবে। একটু পরে হাঁড়ি
ধরে ঝাঁকিয়ে আবার উনুনে বসাতে হবে। ভাজা ভাজা গন্ধ বেরোলে হাঁড়ি নামিয়ে অন্য সব
উপকরণ একসঙ্গে দিয়ে হাঁড়ির মুখ ঢাকা দিয়ে আবার উনুনে বসিয়ে বারবার হাঁড়ি ধরে
ঝাঁকিয়ে দিতে হবে। এভাবে সব সব্জি সুসিদ্ধ হলে নামিয়ে নিয়ে ওইভাবেই রেখে দিতে হবে।
শ্রী পঞ্চমীর রাতে রান্না করেপরদিন ষষ্ঠীর দুপুরে বাসি অবস্থায় খেতে হবে।
রান্নার গল্পে- শর্মিষ্ঠা নাহা (কলকাতা)
বিভাগ পরিচালনায়- জয়িতা দে সরকার
(দুর্গাপুর)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন