মঙ্গলবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৭

শাপলা সপর্যিতা


পর্ব
প্রথম গানের শিক্ষক। শ্রী স্বপন কুমার সরকার।মেঝো ভাইয়া উদীচীতে যায় গান করতে।সাথে আমারও উদীচীতে যাওয়া। সকাল সকাল ক্লাস। প্রতি শুক্রবার ক্লাস।আর তাই প্রতি ভোর বেলা দিনের শুরু আমার সারগামে। উদীচীর খুব প্রিয় দুজন শিক্ষক ছিলেন।একজন সোবহান স্যার। রবীন্দ্র সংগীত শেখাতেন। আর অন্যজন স্বপন সরকার। তিনি আমাদের সারগাম করাতেন। কিন্তু মূলত ছিলেন গণসঙ্গীতের শিল্পী।নজরুল সঙ্গীতও করতেন।আর যতীন সরকার পড়াতেন কার্ল মার্কস, বস্তুবাদ, ডারউইনের তত্ত্ব। কিন্তু জন্ম থেকেই আমার প্রথম পছন্দ রবীন্দ্র সংগীত। ধ্রুব পরিষদে ভর্তি হলাম রবীন্দ্র আর শাস্ত্রীয় সংগীতে। পরীক্ষা দিতে হবে। রবীন্দ্র যা হোক কোনোমতে উতরে যাব। কিন্তু শাস্ত্রীয়? ঘরে আনা হলো ওস্তাদ।মেঝোভাইয়ার পছন্দ মতো গানের ওস্তাদ আমার, শ্রী স্বপন সরকার।প্রথমদিনই মাথায় হাত রেখে বললেন কন্ঠটা ভালো তোমার। যত্ন করো। ঠিকঠাক রেওয়াজ করো। সরস্বতীর মন ভোলাতে হবে।ভালো করবে তুমি।তারপর - রোজ ভোরবেলা গলা সাধা একটা নিয়ম হয়ে গেল। ওটা হলো আমার জন্য একটা বিরক্তিকর কাজ। গান গাইতে ভালোলাগে কিন্তু প্রতিদিন ঘুম ভেঙেই গলা সাধতে বসা। উফ। তার মাঝে আমি চাই আমার প্রাণের ঠাকুরের প্রিয় প্রিয় সব গানগুলো তুলতে তিনি আমাকে নজরুলের গানের বিষয়ে উৎসাহী করতে সবরকমের প্রচেষ্টায় নিবেদিত।তার বদৌলতে বেশ কিছু নজরুল সঙ্গীত আমার তোলা হয়ে গেল। নজরুলের সেই সব গান....মনে পড়ে সে কোনো বিদায় সন্ধ্যা বেলা, তুলসী তলায় যবে সন্ধ্যা বেলায়... এসব গানের কথা এখনো মনে পড়ে। ধীরে ধীরে আমার নজরুলের গানের প্রতি আগ্রহ জন্মালো। একসময় বেশ নজরুল সংগীত শুনতেও শুরু করলাম আগ্রহ করে।তখন খুব শুনতাম অনুপ জালোটা, অনুরাধা পাড়ডোয়াল, ফিরোজা বেগম। সপ্তাহে তিনদিন ওস্তাদের কাছে নিয়ম করে হারমোনিয়াম তবলায় সুর সাধা গান শেখা জীবনের একটা অংশ হয়ে দাঁড়ালো। আর কোন উপায়ে আমার গানের প্রথম ওস্তাদকে বিতাড়িত করা আমার সম্ভব হলোনা।গান শেখালেন দীর্ঘদিন।গানের শিক্ষকের সাথে সম্পর্কটা এতটাই নিবিড় হয়ে পড়লো আমাদের পরিবারের সাথে যে তার বিয়ে বাবা হওয়া আর দুইবাড়ি আসা যাওয়াও চলতে থাকে বেশ। খুব সুন্দরী ছিল বৌদিও। ওস্তাদের ছেলে সন্তান দু তিন বছরে কি অদ্ভুত তবলা বাজাতো.......। আমাদের বাসায় এলে আমার বায়া তবলা দিয়ে সামনে বসিয়ে দিতেন স্যার। আর কি অসম্ভব সুন্দর বোলে বোলে তালে তালে হাত চালাতো সেই অবুঝ শিশু আজও মনে হলে মুগ্ধ হই।সময়ও গড়ালো অনেক। বছর বছর। যুগ যুগ।জানিনা আজ কোথায় তারা কেমন আছেন সবাই।একসময় আমি গাই না গাই একটা গানের যন্ত্র আর হারমোনিয়াম তবলা থাকতো আমার সাথে সাথে। কোথা থেকে কোথায় যাই জানিনা আজ বহুদিন হারমোনিয়াম তবলা গানের সুর ছাড়া আমি। দিনান্তে গান শুনবার অবসরটুকুও থাকেনা বেশিরভাগই। তবু জীবন চলছে ঠিকই। তবু কোনো এক বিষণ্ন দুপুরে কোথাও এক দারুণ দুঃসহ তৃষ্ণায় জেগে উঠি। ভেসে আসে রক্তে কাঁপন তোলা আমার স্যারের গণসঙ্গীতের সুর
নোঙ্গর তোলো তোলো/সময় যে হলো হলো/নোঙ্গর তোলো তোলো
সাথে ভেসে ওঠে দেবীর মুখ।হায় দেবী ওস্তাদের কথা রাখিনি আমি।সরস্বতীর মন ভুলাতে আমি পারিনি নাকি ভুলাইনি সেটা আজও এক বিষ্ময়.........(চলবে)




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন