ট্যাক্সি নম্বর WB A034
ট্যাক্সিটা প্রায় অফিসের সামনে থেকেই পেয়ে গেল রিঙ্কা। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে
গেছে। ঘড়িতে প্রায় রাত সাড়ে দশটা। কলকাতার রাস্তায় অবশ্য এখনও রাত নামে নি।
সন্ধ্যার উজ্জ্বল আলোর মতোই ঝলমলাচ্ছে শহর। কানে ইয়ারফোনটা গুঁজে শরীরটা ট্যাক্সির
সিটে এলিয়ে দিল রিঙ্কা। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে। তার ওপর সকালবেলা অফিসে ঢুকেই
যে খবরটা পেয়েছে তাতে মন মেজাজ অসম্ভব খারাপ।
বাম্পারে এমন জোর ধাক্কা খেলো ট্যাক্সিটা যে রিঙ্কার মাথাটা প্রায়
ব্যাকসিটে ঠুকে যাচ্ছিল! হঠাৎ ড্রাইভারের
সিটের পিছনে লেখা ট্যাক্সির নম্বরটা চোখে পড়তেই ঘুমটুম চটকে অতিমাত্রায়
সজাগ হয়ে উঠল সে।
গতকালও এইরকম দেরী হয়ে গিয়েছিল। তারমধ্যে অঝোরে বৃষ্টি পড়ে চলেছে। রিঙ্কার
স্মার্টফোনে ওলা-উবেরের অ্যাপ ডাউনলোড করা নেই। ওর কপাল সেদিন ভালো ছিল তাই
ট্যাক্সির অপেক্ষায় ও দুজন সঙ্গী পেয়ে যায়। ওদের অফিসের তিনতলায় গোল্ডেন বিমা
কোম্পানির কর্মী শৌনক ও মধুশ্রী। যেতে আসতে লিফটে দেখা, মুখ চেনামাত্র। রিঙ্কা
যেচেই জিজ্ঞেস করে ওদের গন্তব্য। দুজনেই যাবে গড়িয়া ছাড়িয়ে সোনারপুর। রিঙ্কা
নাকতলা। ও-ই প্রস্তাব দেয় শেয়ার ট্যাক্সিতে যাওয়ার। মধুশ্রী আমতা আমতা করলেও শৌনক
রাজী হয়েছিল। মিটারে ২৪২ টাকা উঠলেও রিঙ্কার কাছে ৩৫০ টাকা দাবী করেছিল ড্রাইভার। বৃষ্টির
মধ্যে এটাই নাকি রেট। বাগবিতণ্ডায় ট্যাক্সির নম্বর ও ড্রাইভারের নাম রিঙ্কা নোট
করে নেয়, কমপ্লেন লজ করবে বলে। বাড়ি গিয়ে অনলাইন- অভিযোগের ফর্মও ফিলাপ করে।
বেশকয়েকবার লিখতে গিয়ে নম্বরটা প্রায় মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল।
অফিসে এসেই দুঃসংবাদটা পায় রিঙ্কা। গতকাল কামালগাজি-বাইপাসে রাস্তার ধারে
একজন যুবক ও যুবতীর মৃতদেহ পাওয়া যায়। ওরা দুজন হল গোল্ডেনবীমা কোম্পানির শৌনক আর
মধুশ্রী। খবরটা শোনার পর থেকেই হাত পা অবশ হয়ে গিয়েছিল ওর। ডেটলাইন,
ইয়ারএন্ডিং-এসবের জন্যই প্রায় জোর করে ও আজ অফিসের কাজ করেছে।
চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে ট্যাক্সি নম্বর WB A034। লুকিং গ্লাস দিয়ে ড্রাইভারের মুখটা দেখেই গায়ে শিহরণ জাগে ওর । এ ও কি সম্ভব? বিপদে যেন সাহস বাড়ে। মধুশ্রী
যতটা সম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রেখে মেসেজ করে ওর সহপাঠী-বন্ধু আই-পি-এস জয়ন্ত
বসুকে। রিঙ্কা জানে মুহুর্তের ভুলে বড় মাশুল দিতে হতে পারে। তাই উত্তেজনা যাতে
প্রকাশ না পায় সে সতর্ক।
সায়েন্সসিটির মোড়ে ট্রাফিকের সিগন্যালে গাড়িটা একটু স্লো হলেই একজন পুলিশ
প্রায় লাফ দিয়ে গাড়িতে উঠে ড্রাইভারের কলার চেপে ধরে। পুলিশের একটা গোটা টীম
ততক্ষণে ঘটনাস্থলে চলে এসেছে।
কাগজের হেডলাইন, কলিগদের ভিড়ে ক্লান্ত
রিঙ্কা। সকলের চোখেই জিজ্ঞাসা। শৌনক আর মধুজা দুজনেই একটা প্ল্যান কষেছিল। বিদেশ
যাত্রার জন্য যে ট্রভেল বীমাগুলো করানো হয় তার প্রায় বেশীরভাগই কোম্পানির প্রফিট।
কারণ সাধারণত ক্লেম হয় না। শৌনক মধুজাকে দিয়ে একটা ভুয়ো বণ্ড ইস্যু করাত। মধুজার মার্কেটিং স্কিল-এর গুণে ক্লায়েন্টরা ইনশিউরেন্স
প্রিমিয়ামের পেমেন্ট দিয়েও ফেলত। ট্রাভেল কোম্পানির ম্যানেজারের সাথে ৫শতাংশ
কমিশনের চুক্তিও ছিল। এইসবই আড়াল থেকে করাত শৌনক। চেকে একাউণ্ট নম্বর থাকত না,
পুরো টাকাটাই শৌনকের একাউণ্টে পড়ত। হঠাৎ একটা কেসে ক্লায়েন্ট ইনশিউরেন্স ক্লেম
করে। দুজনে পালাবে ঠিক করে। মধুজাকে খুন করলে প্রায় ২কোটি টাকা শৌনক আত্মসাৎ করতে
পারবে। একটা নয় শৌনক সেদিন দুটো খুন করেছিল। মধুজা ও ট্যাক্সি ড্রাইভার দীনেশ।
নিজের পরিচয় দীনেশকে দিয়ে ও প্রমাণ করতে চেয়েছিল শৌনক মারা গেছে। তাই মৃত ছেলেটির
মুখ ছিল ক্ষতবিক্ষত। কোম্পানির আরো একজনও হয়ত এই কাণ্ডে জড়িত, যার সাথে দেখা করতেই
শৌনক সেদিন ছদ্মবেশে অফিসে এসেছিল। সঙ্গে যাত্রী থাকলে নিশ্চিন্তে অনেকটা পথ চলে
আসতে পারবে তাই রিঙ্কাকে তুলেছিল। তাড়াহুড়োয় খেয়াল না করেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন