নাচনী
( দ্বিতীয়
পর্ব )
নাচনীদের
ভিত্তি:
" এ ছার দেশে নাহি রব পিরীতি নগরে যাব
বেছে লিব রসিক সুজনা প্রাণবন্ধু হে
পিরীতি রতন কাঁচা সোনা "
জনপ্রিয় মনোরঞ্জনী ঝুমুর ও রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা হল এই নাচনীদের নাচের ভিত্তি। আদিরসাত্মক ঝুমুর গানে জমজমাট হয়ে যেত আসর। অথচ রাধা-কৃষ্ণের প্রেমতত্ত্বাশ্রয়ী একটি পরিশীলিত নৃত্যশৈলীর বিকাশ ঘটানো যেতে পারতো এই নাচনী নাচকে কেন্দ্র করে। অনেক সাধক রসিক এই চেষ্টা করে গেছেন বলে জানা যায়। কিন্তু তা জনপ্রিয় না হওয়ায় সেই চেষ্টা প্রত্যাখাত হয়েছে বলা যায়। নাচে যৌন আবেদন থাকতো প্রচুর। পাব্লিক ডিমান্ড!
'টাঁড় ' বা পাথুরে জমিতে যারা চাষআবাদ করেন, তাদের পরিশ্রমকেই যথার্থ "হাড়ভাঙা পরিশ্রম " বলা যেতে পারে। এই হাড়ভাঙা খাটুনিতে ক্লান্ত মানুষ যখন রাত জেগে নাচনীদের নাচ দেখতে যেতেন, তখন তাদের জাগিয়ে রেখে, মনোহরণ করার সব চাইতে সহজ পদ্ধতি যৌন সুড়সুড়ি । নাচনীরা গানের তালে তালে নাচের মুদ্রায় কোমর ও বুক নাচিয়ে,ঝাঁকিয়ে , জাগিয়ে রাখতেন দর্শক- শ্রোতাদের।
মঞ্চের একপাশে সাজিয়ে রাখা হত রাধা-কৃষ্ণের যুগলমূর্তি। দর্শক,শ্রোতারা উঁচু মঞ্চের বা ঢিবির চারপাশে গোল হয়ে বসে, দাঁড়িয়ে আনন্দ উপভোগ করত। যাদের হাতে কাঁচা টাকা থাকত বা কারুর যদি ভীষণ ভালো লেগে যেত কোনো নাচনীর নাচ তবে সে তার শেষ সম্বলটিও সেফটিপিনে (টাকা) গেঁথে দিত নাচনীর বুকের কাপড়ে,ব্লাউজে। সেই অছিলায় নাচনীর বুকে হাত দেওয়ারও যে চেষ্টা করতেন না কেউ কেউ, সেকথা বলা যায় না।
সাজপোশাক :
নাচনীর
সাজপোশাক বেশ রংচঙে হত। রং বেরঙের ঘাঘরা পরে তারা নাচ করত।সাধারণত তারা তিনটি বা
তিন থাকের রঙিন ঘাঘরা ব্যবহার করত।সিল্ক বা সার্টিন জাতীয় চকচকে ব্লাউজ ও খোপায়
রঙিন জরির ফিতা থাকত।মাথায় বেলকুঁড়ির মালা,নাকে বড় নথ ও হাতে থাকত রংবেরঙের
চুড়ি।পাতলা উজ্জ্বল রঙের ওড়নার সঙ্গে দুহাতে ধরা থাকত দুটি রঙিন রুমালের
কোণা।বাজনদারের বাজনার তালে তালে রসিক বা অন্য কোন 'ঝুমুরিয়া' গাইত গানের কলি। সেই
কলির সুরে তালে নানান ভঙ্গিতে ঘুঙুর পায়ে নাচত কখনো সখনো গাইতও নাচনী।
বাদ্য:
প্রধানত
ঢোল,ধামসা,শিঙা,'কেড়কেড়ি', সানাই, ফ্লুট, হারমোনিয়াম, আড়বাঁশি, ঝুমঝুমি ও ঘুঙুর।
পরে পরে এর সাথে সিন্থেসাইজারের মত অন্যান্য আধুনিক বাদ্যযন্ত্রও যোগ হয়েছে।
দল:
একেকটি দলে
পাঁচ থেকে কুড়ি জন সদস্য থাকত।স্বাভাবিক ভাবেই দলের প্রধান হতেন রসিক।স্থানীয়
ভাষায় ' রসক্যা '। বড় দল গুলিতে একাধিক নাচনী থাকত।
নাচনী নাচে
ব্যবহৃত মুদ্রা ও ঠাঁট :
নাচনীর নাচের
মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয় প্রধানত আটটি অঙ্গ। মাথা,ভুরু, চোখ, মুখ,বাহু, বুক বা
ছাতি,কোমর ও পা। সুস্পষ্ট ভাবে কোনো মুদ্রার ব্যবহার এই নৃত্যে দেখা যায়
না।হস্তক,বিভিন্ন গতি, চারী, ভ্রমরী প্রভৃতি ঠাঁটের লক্ষণ এই নৃত্যে দেখা যায় বলে
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
সর্বভারতীয়
প্রেক্ষাপট :
আঠারো ও
উনিশ শতকে ভারতের বিভিন্ন স্থানে রাজা ও জমিদারদের পৃষ্টপোষকতায় বাঈজী নাচের যে
ধারা প্রবাহিত হয়েছিল,মানভূম অঞ্চলে তারই ক্ষয়িষ্ণু রূপ হল নাচনী নাচ। এই অঞ্চলের
'বৈভবহীন' রাজা ও ' বিত্তহীন ' জমিদাররা তাদের অবসর বিনোদনের জন্য ব্যয়বহুল
বাঈজীদের পরিবর্তে নাচে-গানে 'পাকা' নাচনীদের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করেছিলেন। আর জমিদারদের অনুকরণ
করে স্থানীয় মানুষদের মধ্যেও সমান জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এই নাচ। যা কোনোদিন নৃত্যের
মর্যাদা পায়নি। নৃত্যশৈলীর এক অবহেলিত শাখা হিসাবে স্বীকৃত না হলেও, লোকসংস্কৃতির এক শাখা
হিসাবে যা আজও বর্তমান পুরুলিয়া জেলা ও ঝাড়খন্ডে। এখানের অনেক মানুষ আজও হাড়িয়া
খেয়ে, মুখে বিড়ি জ্বালিয়ে, রাত জেগে উপভোগ করেন 'অশৌচ' এই নৃত্যশৈলীটি।
স্মরণীয়
শিল্পী :
এই নাচের
প্রবাদপ্রতিম একজন শিল্পী হলেন সিন্ধুবালা দেবী। প. ব. সরকার তাঁকে " লালন পুরস্কার " দিয়ে সম্মানিত করেছে। ১৯৮৬ তে রাজ্যপাল পুরুলিয়ায় এসে তাঁকে সম্মান জানিয়েছেন। এছাড়াও গীতারাণি,বিমলা , রাজবালা, মালাবতী,পস্তুবালা,
বুটন দেবী, জ্যোৎস্না দেবী, শিলাবতী,কাজল প্রমুখের নাম শোনা যায়।
রসিকদের মধ্যে খুদুভিরসু, চাঁদ মাহাতো,লালমোহন সিং,বুরুহাতুর দিবাকর সিং পাতর, চকহাতুর পদ্মলোচন সিং ও চামু সিং,উলুডির ভুদল সিং,ইছাডি( রাঁচি)র চক্রধর সিং প্রমুখের বেশ নামডাক ছিল বলে জানা যায়।
রসিকদের মধ্যে খুদুভিরসু, চাঁদ মাহাতো,লালমোহন সিং,বুরুহাতুর দিবাকর সিং পাতর, চকহাতুর পদ্মলোচন সিং ও চামু সিং,উলুডির ভুদল সিং,ইছাডি( রাঁচি)র চক্রধর সিং প্রমুখের বেশ নামডাক ছিল বলে জানা যায়।
শেষ বলে কিছু
নেই :
ঝুমুর গান ও
নাচনী নাচের সম্পর্ক সুগভীর। কালে কালে
ঝুমুর গানের উত্তরণ ঘটলেও নাচনী নাচের ক্ষেত্রে তা হয়নি।এখনো নাচনীদের জীবন
জীবিকার প্রশ্নে সামাজিক দৃষ্টিকোণের খুব একটা বদল হয়নি।সরকার এদের কয়েকজনকে
স্বীকৃতি দিলেও সমাজ এদের আপন করে নিতে পারেনি। বাউল বাউলানিরা ধর্মের তকমা লাগিয়ে
সামাজিক স্বীকৃতি আদায় করতে পারলেও,কিংবা সেবাদাসীরা রূপবতী হলে কোথাও রানির
মর্যাদা পেলেও নাচনীরা তা পাননি। নাচনীর উপার্জিত অর্থে রসিক,বাজনদার ও সংশ্লিষ্ট
অন্যান্যদের পরিবার প্রতিপালিত হলেও তাদের ঘরে ঢোকার অনুমতি নাচনীরা কোনোদিন
পাননি। আবার যারা নাচনীদের প্রতি মানুষ হিসাবে সহমর্মিতা দেখিয়েছে সমাজের
রোষদৃষ্টি থেকে তারাও রেহাই পাননি। সুপ্রাচীন নাচনী নাচও স্থূল দৃষ্টিকোণ থেকে
সূক্ষ্মমার্গে পৌঁছাতে পারেনি আজো।
প্রায় একদশক
হল গ্রামগঞ্জে জনপ্রিয় হয়েছে "বুগিবুগি" নামে আর এক উদ্দাম যৌণ আবেদন
মূলক নাচ। চটুল হিন্দি,ভোজপুরি বা পুরুলিয়ার ভাষার গানের সঙ্গে প্রায় নগ্ন ও
যৌণক্রিয়ার ভঙ্গিতে সেই সব নাচের গুতোয় লোকসংস্কৃতি আজ প্রায় বিলুপ্ত হতে বসেছে।
টিমটিম বাতির মত যে কজন আছেন তারাও অচিরেই হারিয়ে যাবেন কালের গর্ভে।কলেজ সোশ্যালের মঞ্চেও যখন এরকম "বুগিবুগি" নাচের ছবি ভাইরাল হয় তখন কি আর সে বিষয়ে সংশয় থাকতে পারে!
টিমটিম বাতির মত যে কজন আছেন তারাও অচিরেই হারিয়ে যাবেন কালের গর্ভে।কলেজ সোশ্যালের মঞ্চেও যখন এরকম "বুগিবুগি" নাচের ছবি ভাইরাল হয় তখন কি আর সে বিষয়ে সংশয় থাকতে পারে!
________________________________________
তথ্যসূত্র :
১) নাচনী নাচ
জমিদারী ঘরানা, সুবোধ বসু রায়
২) পুরুলিয়া পরিচয়,অসিত বসু
৩) অহল্যাভূমি পুরুলিয়া (১ম খন্ড), সম্পাদনা - দেবপ্রসাদ জানা
৪) প্রসঙ্গ পুরুলিয়া ( ১ম খন্ড), সম্পাদনা - সুভাষ রায়
৫) পুরুলিয়া সাহিত্য সংস্কতি রাজন্য অবদান, প্রবীর সরকার
৬) ঝুমুরবালা ( উপন্যাস), শ্রমিক সেন
২) পুরুলিয়া পরিচয়,অসিত বসু
৩) অহল্যাভূমি পুরুলিয়া (১ম খন্ড), সম্পাদনা - দেবপ্রসাদ জানা
৪) প্রসঙ্গ পুরুলিয়া ( ১ম খন্ড), সম্পাদনা - সুভাষ রায়
৫) পুরুলিয়া সাহিত্য সংস্কতি রাজন্য অবদান, প্রবীর সরকার
৬) ঝুমুরবালা ( উপন্যাস), শ্রমিক সেন
সাক্ষাতকার :
১/ শ্যামল কিশোর তেওয়ারী,
প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, "বর্ডার লাইন দি" , পুরুলিয়া। ২/ উমা মাহাতো, কবি ও শিক্ষিকা।
১/ শ্যামল কিশোর তেওয়ারী,
প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, "বর্ডার লাইন দি" , পুরুলিয়া। ২/ উমা মাহাতো, কবি ও শিক্ষিকা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন