রূপতরাসী
আজ সকাল সকাল আয়না নিয়ে বসেছেন তোর্সা | প্রতিদিনের মতই | তবে আজ কিনা রবিবার, তাই কাজ নেই | এখন অনেকক্ষণ নিজেকে দেখেই কাটাবেনতিনি | তোর্সা নয় নয় করেও প্রায় ৩৮ বছরের এক পূর্ণ যুবতী | এখনো বিবাহ না হওয়াতে তিনি এ যাবত একটু মুষড়ে থাকেন | প্রথম দিকে, কাউকেই মনে ধরেনি | কারণ ওই, তাঁর পূর্ণ চাঁদের মায়ার মত রূপ আর তার উপর, বাবাও খুব ধনী তাঁর | এ হেন ধনীর কন্যারা পাত্রের মধ্যে এক আলোকসামান্য মহাপুরুষ আশাকরেন বোধহয় | তাই তোর্সা তাঁর মনের ইচ্ছা পূরণে ব্যর্থ | বিয়েটিয়ে সেকেলে ব্যাপার স্যাপার, না হয় একজন বন্ধুই পেলেন মনের মত! এখন তাঁর সবইচ্ছেগুলো মরে মরে এই তলানিটুকুতে এসে ঠেকেছে | ফোঁশ করে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তোর্সার হৃদকোরক উন্মুক্ত করে | মুখে একটি দুটি রেখাদেখেছেন তিনি আজ | খুব সম্ভবত: তাই এই নিশ্বাস প্রশ্বাস এর অবতারণা |
আজ অফিস নেই | কলকাতার এক নাম করা এডভার্টাইজিং এজেনেসির টপ বসএর একজন তিনি | পড়াশোনা করেছেন বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে | কি সবগেরেম্ভারী কিছু ডিগ্রী তার রয়েছে | কিন্তু যাই হোক, ত্বকের কুঞ্চন তো ওই ডিগ্রীতে যাবার নয় | মুশকিল হলো, ঠিকমত একজন সঙ্গী খুঁজে পাওয়া | এতদিন এতদেখেছেন, শুনেছেন, না কাউকে চোখে ধরেছে, না মনে | মা বাবা বলে বলে হন্যে হয়ে ফিরেছেন | ছবিটবিও দেখিয়েছিলেন কিছু | এর চুল কম, তো এর নাকলম্বা, এর কান বড় তো এর দাঁত উঁচু, এর চাকরি ভালো না, তো ওর তেমন ডিগ্রী নেই, এই সব বলে টলে পাঁকাল মাছের মত সাইড করে বেরিয়েছেন সে সবসম্বন্ধ থেকে | ইদানিং বাবা মায়ের এই সব আয়োজনে ছেদ পড়েছে যেন | বয়স বাড়ছে, আর পারেন না তেমন, তাই সব চুপ এন্ড চাপ | কিন্তু চাপ বেড়েছেতোর্সার | আজকাল কেমন যেন বুড়ি বুড়ি দেখায় নিজেকে আয়নার দিকে তাকালে | তা ছাড়া বিয়েওয়ালা মেয়েদের যে একখানা আহ্লাদী, সখী ধর ধর, আদুরে,নেকুপুশুমুনু ভাবসাব থাকে সৌভাগ্য, সোহাগ আর সোশ্যাল স্টেটাস মিলিয়ে (বিবাহিতরা রেগে যাবেন না যেন, এও প্রশংসার নামান্তর) সেটাই যেন তোর্সা খুঁজেপান না নিজের মধ্যে | বড্ড যেন কাঠ কাঠ, ভ্রুর বিভাজিকায়, হ্যা, যা ভেবেছেন, ‘কাকের পা’, মানে, চোখের চারপাশে সরু রেখাদের যাকে বলে 'ক্রো'জ ফীট' সেই সব, হয়েটোয়ে গেছে আর কি | তোর্সার ইচ্ছে করলো ডাক ছেড়ে কাঁদতে | তারপর আক্রোশ হলো আয়নার উপর | ইচ্ছে হলো অমন বেলজিয়াম কাঁচেরসাধের আয়নায় মারেন এক বাড়ি | কি দিয়ে মারবেন, ও এই তো হাতের কাছেই রয়েছে ব্রাসের ফুলদানিটা | ঠকাং ... বিরাট আওয়াজ হবে | আর কাঁচটা ফেটেযাবে চুর চুর হয়ে | আজ বাড়িতে বাবা মা কেউ নেই, ন মাসির বাড়ি গেছেন সবাই | ফুল্বসিয়ার ছুটি আজ | আর তাই তোর্সা মনের সাধে যা খুশি তাই করবেন বুঝি|
এমন সব এলোঝেলো ভাবনা যখন মনকে অনেক পাকে বেঁধে ফেলেছে ঠিক তখনি উপুর্ঝুপুর বৃষ্টি এলো | তোর্সা মনে যে ঝড় উঠেছে, তারই প্রকাশ আজপ্রকৃতিতে ; এতোল বেতোল ভাবনার তান্ডব চলেছে তোর্সার মনে | তার সাথে ঝুম বর্ষা |
এমন ভারী বৃষ্টিই বুঝি চেয়েছিলেন তোর্সা | ওদের বাড়ি কিছুটা আগের দিনের তাই ঘরের লাগোয়া একটা বিরাট গাড়ি বারান্দা
মানে বারান্দা কাম ছাদ আছে |মনের ময়ুর যেন পাখা মেলল বৃষ্টির রুমঝুম নিক্কনে | ঝুপুস ভিজে যখন ঘরে এলেন তোর্সা তখন মনটা বড় ভিজে, বড় নরম বড় সজীব হয়ে উঠেছে | কোথায়গেল তার সেই রূপতরাসী ভাবনাগুলো | সব ধুয়ে গেছে বৃষ্টির জলে | আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখে যেন চোখ ফেরাতে পারেন না তিনি | আহা আহা !একটাও দাগ নেই মুখে, কেমন সলজ্জ ষোলো বছরের চাহনি | বাইরে এক অবস্থা | রুক্ষ্ম রোদ্দুর লাগা গাছের পাতাগুলি এক লহমায় সবুজ সজীব হয়েছে বৃষ্টিরপরশে | এখন থেকে অনেকটা সময় প্রকৃতির সাথে কাটাবেন, মনস্থ করেন তোর্সা | বড় বেশি কেজো হয়ে পড়েছেন আজকাল | ঠান্ডা ঘর, ল্যাপটপ, মোবাইলফোন থেকে কিছু দুরে থাকবেন | প্রকৃতির মাঝে এখনো রূপটান লুকিয়ে থাকে | কন্সিউমারিসম এর ছাপ লাগানো ব্র্যান্ডেড ক্রিম চুলোয় যাক l ক্রিম বা লোশনব্যবহার না করে এ সব প্রাকৃতিক ভেষজ প্রকৃতির রূপটান নেবেন তোর্সা এবার থেকে | ভালো থাকবেন তিনি |
আর, হ্যাঁ, এবারে সাগর কে আর ফেরাবেন না | তোর্সা হয়ে মিশে যাবেন সাগরের বুকেই |
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন