শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

অ্যাঞ্জেলিকা ভট্টাচার্য


                   দুর্গা   
                     

মৃত্যু পরবর্তী প্রতিটি পর্ব একই থাকে যেমন – প্রিয়জনের আর্তনাদ ,  আত্মীয় অনাত্মীয়র বিলাপ  সঙ্গে স্মৃতিচারন । নাটকের সমাপতন ঘটে  দাহকার্য শেষে সুরাপানে , আর একটি মানুষের সব অস্তিত্ব সঞ্চিত হয় একটি অস্থি কলসে  । কিন্তু এক্ষেত্রে পর্বগুলি  প্রারম্ভেই হিতাকাঙ্খীদের তির্যক মন্তব্যে  কিছুটা ছত্রভঙ্গ – সদ্য বিধবা এতো বুকের পাটা পায় কোথা থেকে ?  কারন পঁচিশ বছরের  দূর্গা নিজের স্বামীর মৃতদেহ আগলে । মুখে শুধু একটাই কথা আমার স্বামীর শেষ ইচ্ছে – ওর চোখদুটো যেন একটা মানুষের অন্ধকার জীবন আলোতে ভরিয়ে দেয়  ।  ছেলের শোকে বিমলাদেবী পাগল হয়েগেছেন । চমকে উঠেছেন – কি রাক্ষুসি বউ , পেটে শত্তুর পুষে  স্বামীর মৃতদেহ নিয়ে সমাজ সেবা করতে চলেছে । বিমলাদেবী ভৎসনার সুরে বললেন - নাওগো শেষবারের  মত সিঁদুরটা পড়িয়ে দাও বউমাকে , শাঁখা ভাঙো । আমার খোকা যে আর থাকবে না । দূর্গার গলা আগের থেকেও কঠিন – আমি এগুলো কিছু করতে পারব না মা । পেটের শত্তুর ততক্ষনে খিদের জন্য হুঙ্কার দিচ্ছে । দুর্গা জানে আর কিছুক্ষন না খেয়ে থাকলে মাথা ঘুরে পরে যাবে ।  - আমার খোকার আত্মা শান্তি পাবেনা ।বিমলা দেবী মাথা ঠুকছেন দেওয়ালে । হসপিটালের লোক চলে এসেছে । তারা দেহ দিয়ে যাবে ।চক্ষুদান পর্ব সারা হলে আবার দেহ পরিবারের হাতে দিয়ে দেবে ।  বিমলা দেবী চিৎকার করলেন – আমার খোকাকে অন্ধ করে আমি স্বর্গে যেতে দেব না ।দুর্গা মাথায় হাত রাখলেন -   দের হলে চোখটা  কোন কাজে আসবে না ।মৃত্যুর  পর চোখ আর কোন কাজে আসে না । কিন্তু যদি মৃত্যুর পর চক্ষুদান করে যাওয়া যায়, একজন অন্ধ মানুষের অন্ধকার দূর করা যায় ।   বিমলাদেবী এবার রাগে চিৎকার করে উঠলেন কি অলুক্ষুনে মেয়েরে বাবা । এক ফোঁটা চোখে জল নেই !-  মা  ফুলশয্যার দিন যেদিন জানতে পারলাম আপনার ছেলের হার্টের অসুখ , কিডনির সমস্যা । আপনারা এগুলো কিছু না জানিয়ে একটা গরিব বাড়ির মেয়ে উদ্ধার করেছেন । সেদিন সারা রাত খুব কেঁদে ছিলাম । আর কোনদিন চোখে জল আসেনি । কিন্তু মানুষটা খুব ভালো ছিল ,কখনও আমার অনিচ্ছায় আমার সম্ভ্রম নষ্ট করেনি । ভালোবেসে কাছে টেনে নিয়েছিল । কদিন আগে  বলেছিল-   ‘দূর্গা আমি যেকোন দিন মরে যেতে পারি , আমার মৃত্যুর পর আমার চোখদুটো  দান করবে কথা দাও’  । মা আমি সেই কথাই  রাখতে চাই  চক্ষুদান পর্ব মিটেছেদেহ সৎকার হয়েছে ।  এখন শুধু চারিদিকে চাঁপা গুঞ্জন -মেয়েটার কপাল খুলে গেল  লাখ লাখ টাকা  ,  সরকারি চাকরি সবই পাবে ।  
  কিছু ঘণ্টায় একটা মানুষের রুপের সাথে চরিত্র কেমন পাল্টে যায় । এখন দূর্গার কপালে বড় সিঁদুরের টিপ নেই , হাতে শাঁখা পলা নেই । আগামীকাল দুর্গার বিয়ের একবছর পূর্ণ হবে । চুপচাপ শান্ত মেয়েটার গলায় এতো জোর এলো কোথা থেকে !  আয়নার সামনে  সাদা থানে নিজেকে দেখে চিনতে পারছিল না । শুধু  শরীরের মধ্য ভাগে চোখ পরতেই স্ফত পেটের ওপর হাত রেখে বলল লড়াই এখন অনেক বাকি । ওদিকে শাশুড়ি মা ডেকে যাচ্ছেন হবিষ্যিটা খেয়ে উদ্ধার কর । দূর্গা খুব শান্ত গলায় বলল মা আমি এই খাবার গুল খেলে আমার পেটের বাচ্চাটা বাঁচবে না।  দূর্গার একার পেট নয় , আরেকটি  ক্ষুধার্ত পেট তখন হাহাকার করছে । বিমলাদেবী কি বলবেন বুঝতে পারলেন না । নিজের মধ্যেও একটি মাতৄ সত্তা রয়েছে । পুত্র হারালেও সেই মমতার মৃত্যু ঘটেনি । কিন্তু তবু কথাগুলো শুনে কোথাও একটা ছুঁচ বিঁধল । একটা হা ঘরের মেয়ের  মধ্যে এত তেজ এলো কোথা থেকে ? খুব নিচু স্বরে বললেন আত্মীয় , পাড়া পড়শিদের কি বলব আমি বৌমা ? দূর্গা বিমলাদেবীর পীঠে হাতবুলিয়ে বললেন – মা যখন দেওয়ালে পীঠ ঠেকে যায় , আর পিছনো যায়না । সামনে এগিয়ে যেতে হয় ।বিমলাদেবী দূর্গাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরলেন বৌমা তুমি আমায় ক্ষমা ক ।  
চারমাস পরে দূর্গার একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে ।  বিমলাদেবী নাম রেখেছেন জয়ী । দুর্গার স্বামীর অফিস থেকে চিঠি এসেছে দুর্গার চাকরীর  জয়েনিং লেটার ।আরও তিনমাস পর দূর্গা অফিস জয়েন করবে ।   জয়ীর হাত ধরে দূর্গা আর বিমলাদেবী আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। সামনের দিকে একপা এগলেই মনে হয় অন্ধ  কুসংস্কারের শত বাহু ছিন্ন করে এগিয়ে যাওয়া যায় বহুদূর 



                                                  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন