দুর্গা
মৃত্যু পরবর্তী প্রতিটি পর্ব একই থাকে যেমন – প্রিয়জনের
আর্তনাদ , আত্মীয় অনাত্মীয়র বিলাপ সঙ্গে
স্মৃতিচারন । নাটকের সমাপতন ঘটে দাহকার্য শেষে সুরাপানে , আর একটি মানুষের
সব অস্তিত্ব সঞ্চিত হয় একটি অস্থি কলসে । কিন্তু এক্ষেত্রে পর্বগুলি প্রারম্ভেই হিতাকাঙ্খীদের
তির্যক মন্তব্যে কিছুটা ছত্রভঙ্গ – সদ্য বিধবা এতো বুকের পাটা পায় কোথা থেকে ? কারন পঁচিশ বছরের দূর্গা নিজের স্বামীর মৃতদেহ আগলে । মুখে শুধু
একটাই কথা আমার স্বামীর শেষ ইচ্ছে – ওর চোখদুটো
যেন একটা মানুষের অন্ধকার জীবন আলোতে ভরিয়ে দেয় । ছেলের শোকে বিমলাদেবী পাগল হয়েগেছেন । চমকে
উঠেছেন – কি রাক্ষুসি বউ , পেটে শত্তুর পুষে স্বামীর মৃতদেহ নিয়ে সমাজ সেবা করতে চলেছে ।
বিমলাদেবী ভৎসনার সুরে বললেন - নাওগো শেষবারের মত সিঁদুরটা পড়িয়ে দাও বউমাকে , শাঁখা ভাঙো । আমার খোকা যে আর থাকবে না । দূর্গার গলা আগের
থেকেও কঠিন – আমি এগুলো কিছু করতে পারব না মা । পেটের শত্তুর ততক্ষনে খিদের জন্য
হুঙ্কার দিচ্ছে । দুর্গা জানে আর কিছুক্ষন না খেয়ে থাকলে মাথা ঘুরে পরে যাবে । - আমার খোকার আত্মা শান্তি পাবেনা ।বিমলা দেবী মাথা ঠুকছেন
দেওয়ালে । হসপিটালের লোক চলে এসেছে । তারা দেহ দিয়ে যাবে ।চক্ষুদান পর্ব সারা হলে
আবার দেহ পরিবারের হাতে দিয়ে দেবে । বিমলা
দেবী চিৎকার করলেন – আমার খোকাকে অন্ধ করে আমি স্বর্গে যেতে দেব না ।দুর্গা মাথায়
হাত রাখলেন - দেরী হলে চোখটা কোন কাজে আসবে না ।মৃত্যুর পর চোখ আর কোন কাজে আসে না । কিন্তু যদি
মৃত্যুর পর চক্ষুদান করে যাওয়া যায়, একজন অন্ধ মানুষের অন্ধকার দূর করা যায় । বিমলাদেবী এবার রাগে চিৎকার করে উঠলেন কি অলুক্ষুনে
মেয়েরে বাবা । এক ফোঁটা চোখে জল নেই !- মা ফুলশয্যার দিন যেদিন জানতে পারলাম আপনার ছেলের
হার্টের অসুখ , কিডনির সমস্যা । আপনারা এগুলো কিছু না জানিয়ে একটা গরিব বাড়ির মেয়ে
উদ্ধার করেছেন । সেদিন সারা রাত খুব কেঁদে ছিলাম । আর কোনদিন চোখে জল আসেনি ।
কিন্তু মানুষটা খুব ভালো ছিল ,কখনও আমার অনিচ্ছায় আমার সম্ভ্রম নষ্ট করেনি ।
ভালোবেসে কাছে টেনে নিয়েছিল । কদিন আগে
বলেছিল- ‘দূর্গা আমি যেকোন দিন মরে যেতে পারি , আমার
মৃত্যুর পর আমার চোখদুটো দান করবে কথা দাও’ । মা আমি সেই কথাই
রাখতে চাই । চক্ষুদান পর্ব মিটেছে । দেহ সৎকার হয়েছে । এখন শুধু চারিদিকে চাঁপা গুঞ্জন -মেয়েটার কপাল
খুলে গেল। লাখ
লাখ টাকা , সরকারি চাকরি সবই পাবে ।
কিছু ঘণ্টায় একটা মানুষের রুপের সাথে চরিত্র
কেমন পাল্টে যায় । এখন দূর্গার কপালে বড় সিঁদুরের টিপ নেই , হাতে শাঁখা পলা নেই ।
আগামীকাল দুর্গার বিয়ের একবছর পূর্ণ হবে । চুপচাপ শান্ত মেয়েটার গলায় এতো জোর এলো কোথা থেকে ! আয়নার সামনে
সাদা থানে নিজেকে দেখে চিনতে পারছিল না । শুধু শরীরের মধ্য ভাগে চোখ পরতেই স্ফীত পেটের ওপর হাত রেখে বলল লড়াই এখনও অনেক বাকি । ওদিকে শাশুড়ি মা ডেকে যাচ্ছেন হবিষ্যিটা খেয়ে
উদ্ধার কর । দূর্গা খুব শান্ত গলায় বলল মা আমি এই খাবার গুল খেলে আমার পেটের
বাচ্চাটা বাঁচবে না। দূর্গার একার পেট নয়
, আরেকটি ক্ষুধার্ত পেট তখন হাহাকার করছে । বিমলাদেবী কি
বলবেন বুঝতে পারলেন না । নিজের মধ্যেও একটি মাতৄ সত্তা রয়েছে । পুত্র হারালেও সেই
মমতার মৃত্যু ঘটেনি । কিন্তু তবু কথাগুলো শুনে কোথাও একটা ছুঁচ বিঁধল । একটা হা
ঘরের মেয়ের মধ্যে এত তেজ এলো কোথা থেকে ?
খুব নিচু স্বরে বললেন আত্মীয় , পাড়া পড়শিদের কি বলব আমি বৌমা ? দূর্গা বিমলাদেবীর
পীঠে হাতবুলিয়ে বললেন – মা যখন দেওয়ালে পীঠ ঠেকে যায় , আর পিছনো যায়না । সামনে
এগিয়ে যেতে হয় ।বিমলাদেবী দূর্গাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরলেন বৌমা তুমি আমায় ক্ষমা কর ।
চারমাস পরে দূর্গার একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে । বিমলাদেবী নাম রেখেছেন জয়ী । দুর্গার স্বামীর
অফিস থেকে চিঠি এসেছে দুর্গার চাকরীর
জয়েনিং লেটার ।আরও তিনমাস পর দূর্গা অফিস
জয়েন করবে । জয়ীর হাত ধরে দূর্গা
আর বিমলাদেবী আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। সামনের দিকে একপা এগলেই মনে
হয় অন্ধ কুসংস্কারের শত বাহু ছিন্ন করে এগিয়ে
যাওয়া যায় বহুদূর ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন