শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

বনবীথি পাত্র


দেওয়া-নেওয়া

.
উফ্ এই সময় আবার কে এলো !!!!
দেখো না একটু কে .....
আদুরে গলায় কথাটা বলেই পাশ ফিরে শুলো তিস্তা ।
ধুস্ সপ্তাহে এই একটা দিনই তো দুপুরে একটু ঘুমাতে পায় , তাও অসময়ে চটকে গেল । মানুষের আসার একটু সময়জ্ঞান নেই । ঘর থেকে বেরতেই গ্রীষ্মের উষ্ণতা টের পাওয়া যাচ্ছে । ড্রয়িংরুমের দেওয়াল ঘড়িটায় দেখে , তিনটে চল্লিশ । এই ভন্যি দুপুরবেলাতে কার বেড়াতে আসতে মন হলো !!!! একমুখ বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলতে যায় শৌভিক । 

ধুতির ওপর নীল শার্ট পরা যাদবকে চিনতে অসুবিধা হয় না শৌভিকের । কতদিন আগের-ই বা ঘটনা , মাস তিনেক হবে ।
বিয়ের পর হানিমুনে দীঘার থেকে চটজলদি আর কি বা হতে পারে !!!!
তিস্তার জলে ভীষণ ভয় । একদিন কোনরকমে একটুখানি জলে নেমেছিল বরের হাত ধরে । বালিতে বসে সমুদ্র দেখাতেই ওর বেশি মজা । নতুন বৌয়ের ভয় কাটানোর জন্য একা একাই সমুদ্রে নেমেছিল শৌভিক । ছোট ছোট ঢেউগুলো ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে যাচ্ছিল গভীরে । হঠাৎ একটা বিশাল ঢেউ আসায় সবকিছু মুহুর্তে এলোমেলো । জলের টানে ভেসে যাচ্ছে শৌভিক । দুহাত তুলে বাঁচতে চাইছে , অথচ দম বন্ধ হয়ে আসছে । চারদিকে ততক্ষণে হৈ-চৈ পড়ে গেছে । দুচোখে শুধুই অন্ধকার , বুকটা যেন ভারী হয়ে আসছে । ক্লান্ত শরীরটা ঢলে পড়ছিল মৃত্যুর কোলে ....
শক্ত হাতে সেদিন মৃত্যুমুখ থেকে শৌভিককে ফিরিয়ে এনেছিল এই যাদব-ই । সেই মানুষটাকে ভোলে কি করে !!!!
আর একটা দিনও থাকতে চায়নি তিস্তা ওখানে । তাড়াহুড়ো করে ফিরে এসেছিল সমুদ্র থেকে ।
যে মানুষটা নতুন জীবন দিল শৌভিককে , তাকে সামান্য ধন্যবাদ টুকুও জানাবে না !!!!
আসার আগের রাতে একবার সমুদ্রের ধারে গিয়েছিল দুজনে , যদি সেই উপকারী মানুষটাকে দেখতে পায় । স্বামীর জীবন বাঁচানোর জন্য কিছু সাহায্য করবেও ভেবেছিল তিস্তা ।
সমুদ্রের ধারের ছোট ছোট চায়ের দোকানের অনেকেই গতকালের সেই ঘটনার সাক্ষী ছিল । তাই যাদবের পরিচয় পেতে অসুবিধা হয়নি । ঐ চায়ের দোকানের একজনের কাছেই শুনেছিল যাদব নামটা । যাদব তখন নাকি সমুদ্রে মাছ ধরতে গেছে । বড়ো নৌকা-জাল কিছু নেই , একটা ছোট ডিঙি নিয়ে সাগরে যায় । যা পায় তাই দিয়ে পেটের খোরাক জোটায় । মা মরা এক মেয়ে আর নিজে , সংসারে মানুষ তো এই দুজন । যা পায় তাতেই চলে যায় কোনরকমে ।
যাদবের অভাবের সংসারের একটা ছবি ফুটে উঠেছিল তিস্তা আর শৌভিকের ভাবনায় । ভেবেছিল কিছু টাকা ঐ চাওয়ালাকেই দিয়ে আসবে , যাদবকে দিয়ে দেওয়ার জন্য । কিন্তু চাওয়ালা যদি যাদবকে না দেয় !!!! ভরসা করে কিছু টাকা আর দিয়ে আসতে পারেনি । একটা কাগজে নিজের ঠিকানাটা লিখে দিয়ে এসেছিল চায়ের দোকানদারকে । যদি কখনো আমাদের শহরে প্রয়োজন পড়ে , যোগাযোগ করতে বোলো যাদবকে । তিস্তা বারণ করেছিল বলে মোবাইল নম্বরটা দেয়নি , বলা তো যায় না কারণে-অকারণে ফোন যদি বিরক্ত করে !!!!
যাদব যে সেই মেদিনীপুর থেকে মালদায় সত্যি সত্যি চলে আসবে ভাবতেও পারেনি শৌভিক । ড্রয়িংরুমে বসতে বলে তিস্তাকে ডাকতে যায় ।
-- ওঠো , কে এসেছে দেখো ।
ধ্যুত এখন আবার কে এলো ? ভাল্লাগেনা ....
-- যাদব এসেছে ।
-- যাদব আবার কে ?
-- আহ্ ওঠো না একটু , ওকে ড্রয়িংরুমে বসতে বলে এসেছি ।
-- কে এসেছে বুঝতেই পারছি না , ঘুম জড়ানো গলাতে তিস্তার উত্তর ।
-- আরে যাদব গো যাদব । দীঘাতে যে আমাকে বাঁচিয়েছিল .....
কথা শেষ হওয়ার আগেই ধুড়মুড় করে উঠে পড়ে তিস্তা ।
-- কি বলছো কি ? ওতোদূর থেকে ঠিকানা ধরে চলে এসেছে ? কিজন্য এসেছে কিছু বলেছে ?
-- না কোনো কথা হয়নি 

-- অজানা অচেনা একটা মানুষকে ঘরের মধ্যে বসতে দিয়ে চলে এলে ? ঐ ঘরে কতো দামি দামি জিনিস আছে বলো তো !!!! ততক্ষণে নাইটির ওপর হাউসকোটটা চাপিয়ে ফেলেছে তিস্তা ।
-- নিশ্চয় কিছু টাকাপয়সার ধান্দায় এসেছে । পাঁচশোর বেশি দিও না আবার । এ বাজারে পাঁচশো টাকা কিছু কম নয় ।
-- তোমার বরের দাম তোমার কাছে মাত্র পাঁচশ টাকা !!!! তিস্তার কানের কাছে চাপা স্বরে কথাটা বলে শৌভিক ।
তিস্তা কটমট করে তাকাতেই একমুখ হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় শৌভিক । তিস্তাকে রাগিয়ে বেশ মজা পায় ও ।
আরে আরে ওখানে বসেছ কেন !!!! সোফাতে না বসে ঘরের মেঝেতে একপাশে গুটিসুটি মেরে বসে থাকতে দেখে হাঁ হাঁ করে ওঠে শৌভিক ।
আমার ময়লা কাপড়ে আমি এখানেই ঠিক আছি ।
তিস্তা এমন কটমট করে শৌভিকের দিকে তাকায় , যেন অতো বলার কোন দরকার নেই । মাটিতে বসেছে ওটাই ঠিক আছে ।
তারপর বলো , কবে আমাদের শহরে এলে ?
আজ দুপুরেই এসেচি বাবু ।
কোন আত্মীয়স্বজনের বাড়ি বেড়াতে এসেছ বুঝি ?
আমাদের আপন কেউ নেই বাবু এ শহরে । আমার মেয়েটার টানে ছুটে এসেছি বাবু ।
যাদবের চোখে জল....
কি হয়েছে তোমার মেয়ের , তিস্তা জানতে যায় ।
মনে পড়ে সেই চায়ের দোকানদার বলেছিল , যাদবের আপনজন বলতে ওর এক মেয়ে ।
মেয়েটা একটা ছেলের সাথে আপনাদের শহরে পালিয়ে এসেছে । ছেলেটা ভালো না বাবু । আমার মেয়েটা বড্ড বোকা আছে বাবু । মেয়েটাকে যদি বাংলাদেশে পাচার করে দেয় !!!!
তোমার মেয়ের বয়স কত ?
পনের-ষোলো হবে বাবু ।
পকেট থেকে একটা মেয়ের ফটো বের করে শৌভিকের হাতে দেয় যাদব ।
রোগা রোগা এক কিশোরী মেয়ের ছবি ।
দুবছর আগের ছবি বাবু....
তা জানলে কি করে যে তোমার মেয়ে এই মালদাতেই এসেছে ? আর তাহলে তোমাদের ওখানকার পুলিশকে জানালে না কেন ? তিস্তা জানতে চায় ।
মাথা নিচু করে চোখের জল ফেলছে যাদব ।
আরে কাঁদলে কি খুঁজে পাবে মেয়েকে !!!! 

আমাদের চেনাজানা একটা লোক ঐ ছেলেটার সাথে আমার মেয়েকে মালদার বাসে উঠতে দেখেছে....
তাই শুনেই তুমি মালদা চলে এলে , পুলিশকে কিছু জানালে না  !!!! তিস্তা একটু ঝাঁঝিয়েই উঠে....

বাপের মন দিদিমণি , অতো কিছু না ভেবেই ছুটে এসেচি আপনাদের শহরে । 

হঠাৎ উঠে এসে শৌভিকের পা দুটো চেপে ধরে যাদব , মেয়েটাকে বাঁচান বাবু.....
আরে আরে পা ছাড়ো , আমি কি করে বাঁচাবো তোমার মেয়েকে !!!! আমি কি পুলিশ নাকি , কোথায় খুঁজবো তোমার মেয়েকে !!!!
তখনো বড়ো আশায় যাদবের চোখদুটো তাকিয়ে শৌভিক আর তিস্তার দিকে ।
মোবাইলটা নিতে ঘরে আসে শৌভিক , পিছন পিছন তিস্তাও আসে ।
তুমি কাকে ফোন করবে এখন ?
আরে তোমাকে বলেছিলাম না আমার এক বন্ধু ইংলিশবাজার থানায় বেশ ভালো পোস্টে আছে , ওকে একবার ফোন করে বলি ব্যাপারটা ।
তোমার কি মাথা খারাপ হলো নাকি , এই সব ফালতু ঝামেলায় নিজেকে জড়ায় !!!!
আহ্ আস্তে বলো , যাদব শুনতে পাবে ।
ওর চেনাজানা কেউ নেই এই শহরে , একটু সাহায্য না করলে কে মেয়েটাকে খুঁজে পাবে কি করে !!!!
ওর মেয়ে এই শহরেই আছে তুমি জানো ? শেষ অবধি দেখবে মেয়ে পাচারের অভিযোগে নিজেই না ফেঁসে যাও ।
অযথা ঝামেলায় জড়ানোটা হয়তো ভুল-ই হচ্ছে । তিস্তা তো ভুল বলছে না , অকারণ কোন ঝামেলায় ফেঁসে গেলে জীবনটাই বরবাদ হয়ে যাবে ।
আজ বিকালে দিদিভাইরা আসবে ভুলে গেলে নাকি তুমি ? যা হোক্ কিছু টাকা নিয়ে বিদায় করো ওকে এবার । যত সব উটকো ঝঞ্ঝাট.....
সত্যিই ওদের আসার কথাটা ভুলেই গিয়েছিল শৌভিক ।
ওর মেয়েকে খুঁজে দিতে সাহায্য করার কোনো পথ জানা নেই কথাটা যাদবকে বলতেই ওর মুখটা কেমন যেন মেঘলা হয়ে আসে নিমেষে ।
পাঁচশ টাকা ওর হাতে জোর করে গুঁজে দিতে গেলেও নেয়না যাদব ।
টাকা নিয়ে কি করবো বাবু ? মেয়েটাকেই যদি না ফিরে পাই.....
দেখো কোনো পুলিশ স্টেশনে গিয়ে বলো , ওনারা তোমাকে ঠিক সাহায্য করবেন ।
আমরা জল চিনি বাবু , সাগর চিনি-ঢেউ চিনি-ঝড়ের মেঘ চিনি , ইসব শহরের পুলিশ ইস্টিশন চিনি না । ঢেউয়ে ভাসা মানুষকে খুঁজে আনতে পারি কিন্তু আপনাদের এই ঝকমকে শহরে এতো লোকের ভিড়ে নিজের মেয়েটাকেও খুঁজতে জানি না বাবু ।
শৌভিকদের যাবতীয় আভিজাত্য-বিদ্যে-বুদ্ধি-অহংকারকে মাটিতে মিশিয়ে ব্যস্ত শহরের ভিড়ে মিশে যাচ্ছে যাদব.....
তিস্তা ব্যস্ত ঘর সাজাতে । চারতলার ওপরে ব্যালকনি দাঁড়িয়ে যাদবকে দেখছে শৌভিক । বুকের মাঝখানটাতে কি অসহ্য একটা চিনচিনে কষ্ট ।
স্বার্থপর মানুষদের এই যন্ত্রণাটুকু হয়তো সারাজীবন সহ্য করে যেতে হয় নীরবে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন