মঙ্গলবার, ৯ মে, ২০১৭

অনিন্দ্য সান্যাল


যে তারা চিরন্তন 



ত্রস্ত পায়ে নীতাকে আমরা বাহির ঘরে উঠে আসতে দেখলাম, কাপড়চোপড়ের একটা পুঁটলি আর অতি প্রাচীন এক ছবি, ফ্রেম-এ বাঁধানো, এ-ই সম্বলে নীতাকে সংসারের মূল বসবাস এবং অভ্যাস থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে দেখলাম আমরা, যেভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়া বাংলা, বাঙালিকে তাড়া করে বেড়িয়েছে কাঁটাতারের নকশা, শতাব্দীর সেরা ক্রাইম, এ ক্ষত আরোগ্যযোগ্য তো আর না, শুধু দুই বাংলার মিলনের অভিমুখে শিল্পপ্রয়াস, দায়বদ্ধতার ব্যর্থ হাহাকার ; আপাতত নীতাকে আমার ক্যামেরার লেন্স ফলো করে এই বাইরের বিচ্ছিন্ন বসবাসে, নীতা আঁচল চাপল মুখে, ক্রমশ মলিন বিছানার দিকে সে এগিয়ে এবং দরজার পাশে এসে দাঁড়াল  মাকয়েক মুহূর্ত আগে নীতা তার অসুখের গভীরতা অনুমান করতে পেরেছে, তৎকালীন চিকিৎসা ব্যবস্থায় দুরারোগ্য বলেই কথিত এবং মৃত্যুর থেকে তার অবস্থান কয়েক হাত মাত্র, নীতা বুকের ওপর ভর দিয়ে যখন শুয়ে পড়ল, যদিও সে-ই কেন্দ্র, সমগ্র পূর্বাপর যখন তার-ই চতুর্দিকে, তখন আমি ধীরে ধীরে নীতাকে ঝাপসা করে দিলাম, ওর মায়ের মুখে একটা ফ্যাটফ্যাটে আলো রেখে ফোকাস করলাম, আহা, আমাকে শিল্পের দিকটাও ভাবতে দাও, দেখো, নীতা কাশছে, কাশতে কাশতে ওর রুমাল ভিজে লাল, নাঃ, তোমরা কালো শাদায় আরও বেশী লাল-ই দেখবে বলে আমি এখনও নীতাকে অস্পষ্টতায় ঢেকে রেখেছি, এমন কী ওর মা যখন ওর এই অদ্ভুত ব্যবহারের কারণ জিজ্ঞেস করল, আর নীতা যখন উত্তর দিচ্ছে, তখনও তাকে অস্পষ্ট রেখেছি, ক্রমশ নীতার মুখ আমি ফোকাসে আনছি, এমন কি যখন ওর মায়ের মুখেই অনর্গল ডায়ালগ, ক্যামেরার এইসব ব্যাবহারই তো সিনেমার শব্দ, অক্ষর, দাঁড়ি, কমা ; দেখো, সিনেমায় আমি ক্যামেরা স্থির রেখে টেবিল সরাব না হাতপাখাটাকে টানব সেটা যেমন আমি ঠিক করব, সেই রকম ক্যামেরাকে কখন কোথায় ঘেঁটি ধরে মুখ তুলে দৌড় করাব সেটা আমিই জানব, তবে কী কখনও কখনও ক্যামেরা এবং ক্যামেরার সামনে যাদের তোমরা দেখছ তাদের সকলকেই স্তব্ধ করে দেওয়ার কৌশলও রপ্ত করা চাই, তারপরেই তো মনের ভিতর চলচ্চিত্রের দ্বিতীয় এপিসোড আরম্ভ সম্ভব ; আচ্ছা, কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং -এর কথা তোমাদের বলি, চিহ্ন সমীকরণের কল্পরাজ্য তো শৈশবাবধি আমাদের জৈবিক চেতনায় আত্তীকৃত, স্বতঃস্ফুর্ত এই বন্ধন জৈবজগতের সাথে, আমাদের মনস্তাত্বিক গূঢ় চেতনা যা আমাদের আরও এক মাত্রার যোগান দেয়, তা-ই তো প্রকৃতপক্ষে আমরা, আমি, তুমি, তুই, সব্বাই ; এইই তো সকল ক্রিয়েটিভিটির বাজনদার, সে-ই যে বাংলার বুকের মাঝখান দিয়ে, যেভাবে কশাই, যেভাবে দুপাশে দুই ঠ্যাং, আমার মগজের ভিতর, হ্যাঁ, সেঁধিয়ে রয়েছে, অনেকে বলে, আমি জানি, মেঘে কোমল রেখা নাকি ট্রিলজি, যা এই তিনটেকে এক সূত্রে গেঁথে রেখেছে, তা হল, দুই বাংলার মিলন, দুইডা বাংলারে আমি মিলাইতে চাইছি, কারণ এই বিচ্ছেদ, এটা একটা ক্রাইম, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ক্রাইম, এ আবার হয় নাকি, আমি লেন্সের এপারে বসে দেখতে পাচ্ছি ঋত্বিক ঘটককে ভিসা দেওয়া হচ্ছে না বাংলাদেশ-এ যাওয়ার জন্য, তিনি মরিয়া তিতাস করার জন্য, এইসব চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি যে টিবি রোগাক্রান্ত অদ্বৈত, দেখতে পাচ্ছি মহাকালের লোল জিহ্বার তলায় কুঁকড়ে এতটুকু সীতার দু’চোখে ভয়, ক্যামেরাকে সহসা উঠিয়ে নিই অনেক অনেক উঁচুতে যেখান থেকে ঈশ্বরকে লুটিয়ে পড়তে দেখা যায়, ওই একবার মাত্র ক্রেন ব্যাবহার, বাদবাকি সূবর্নরেখার তট জুড়ে শুধুই তোমাদের হেরিটেজ, তোমাদের ইতিহাস, তোমাদের বিগত কয়েকটি দশক আঙুল তুলে দেখাতে চেয়েছি ; নীতার মা এইবার কথা বলে উঠল, আর আমি নীতার মুখকে স্পষ্টতায় আনলাম, কেন জানো, বেদনাকে পাক দেওয়ার আর্টিস্টিক তাড়নায়।  

বড় বড় লম্বা লম্বা শটে তিনি চরিত্রদের ক্যামেরার সামনে মুভ করিয়েছিলেন মেঘে ঢাকা তারায়, অন্যান্য ফিল্মের তুলনায় এই ছবিতে অনেক কম শট-এ, এ কথা আমরা তাঁরই মুখ থেকে শুনেছি, একই শট-এ প্রত্যেক চরিত্রকে অনেক বেশী মুভ, কোনও চাপ নেই, কোনও বিরক্তির অবকাশ নেই, হ্যাঁ, এই মিডল ক্লাসটা কাঁদতে ভালোবাসে তো, এটা একটা pleasure, এটা উপভোগ্য, এটা আমাদের প্রচলিত ভারতীয় মুভির একটা ইউ এস পি, আজ অর্ধশতক পার হয়েও বাঙালির মননে দাদা আমি বাঁচতে চাই-এর বেশী আর কতটুকু রয়ে গেছে একবার যাচাই হওয়া দরকার, তাই-ই তো এক মেঘে ঢাকা তারা খানিকটা পয়সার মুখ দেখেছিল, সেটা পুরোপুরি চলে গেল কোমলগান্ধার-এ, কোমলগান্ধার-এ আমার যথাসর্বস্ব ডুবে গেল, কিন্তু কোনও উপায় কি ছিল, খ্যাতি এবং অর্থ, এই দুয়ের কোনওটির উদ্দেশ্যেই আমার ছবি করার কোনও তাগিদ ……… , কিন্তু আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম যখন কোমলগান্ধারকে দর্শক সেভাবে নিতে পারল না, এটা আমি মনে করি my most intellectual film ; একটা অদ্ভুত ফ্যালফেলে চাহনিতে খানিকক্ষণ তাকয়ে থেকে হেসে বললেন, নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল থাকাই শিল্পীর উচিত, আর এটা তো আমার একটা পার্সোনাল স্টেটমেন্ট, মূলত ফিল্ম ব্যাপারটাই তো তাই, All arts are, in the final analysis …….. Any work that lacks style and viewpoint necessarily lacks personality - and thereby ceases to be art.
I believe in committed cinema.
I mean, committed in the broadest sense of the term.
To me, the great Indian example is Pather Panchali because of its truth, its sense of beauty, its bursts of visual ecstasy and of mental passion. I know I am being a bit old-fashioned, but there it is.
ওই দেখো, আমাদের পুরাতনীতে স্থির থেকে সাতশো বা আটশো শতক পূর্বের গৌরীদান, সে তো essentially Bengali, mother complex ridden বাংলা সমাজ, বাল্যবিবাহ, যে মেয়েটির একলা দুপুরে ফেলে আসা পড়ন্ত বিকেলের মাঠ মনে পড়ে, এই নস্টালজিয়া আমাদের শিরায় শিরায় কাশফুল দোল খায়, আমাদের লোকগান এইসকল কথা গীত করে, যে উমা আমাদেরই উঠোনে একদা কলতলায়, মঞ্চ আলো করা তুলসীর নিভৃত সন্ধ্যায় ; নীতার জন্ম এক জগদ্ধাত্রী পুজোর দিন, যখন তার অসুখের কথা প্রকাশ, তখন মনে পড়ে উমার ফিরে যাওয়ার গান, একটানা, নীতা পাহাড় দেখতে চেয়েছিল, যখন সে প্রকৃতই পাহাড়ের কোলে, তখন তার সন্ধে আসন্ন, আমাদের উমা, আমাদের ঘরেরই তো ……… I consider women the prime force in society and family. So, I have always tried to show love, affection and respect, for them in my films. তা ছাড়া মাতৃমূর্তি আমার সিনেমায় বারবার এসেছে তো, যুক্তি তক্কো গপ্পতে তোমরা দেখেছো ঐ মেয়েটাকে, শাঁওলিকে জ্ঞানেশ বলছে, নাচো, তোমরা নাচো, তোমরা না নাচলে কিছু হবে না, এটা সম্পূর্ণ jungian, তিতাস-এ ছেলেটা তার মা-কে ভগবতী দেখল, এটা একটা মূল সূত্র, মশারি টানাবার সময় দড়ির কানামাত্র খুঁজে নিয়ে আমরা যেমত পেরেকের সান্নিধ্যে নিয়ে যেতে চাই ; না, ভগবতীর সাথে কোনও ধর্মের যোগসূত্র নাই, Primordial force হচ্ছে ভগবান, you cannot deny it, basic primordial force হচ্ছে mother complex - মা -   

তো এমত সময়ে নীতার সদ্যবিখ্যাত দাদা রাস্তা ধরে গান গাইতে গাইতে, পার সিটিং -এ বারোশো টাকার অঙ্ক শুনিয়ে, তা-ও গালের একপাশে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রিতে হাতের তালু ঠেকিয়ে, যা-তে কি না অঙ্কের আধিক্য নিম্নমধ্যবিত্ত তথা উদ্বাস্তু কলোনির চেতনায় জোর একটা চমক দিতে সার্থক, সে-ই দাদা বুড়ো বয়সের প্রেমপত্র কেড়ে নেওয়ার মস্করায় আবিষ্কার করে খুকির রক্তে দাগানো বস্ত্রখন্ড, আর ওই সকল বৃষ্টিভেজা সন্ধেয় ফ্রেমে বাঁধানো ফটো পড়ে যাওয়া মেলোড্রামাটিক, ৩৬০ ডিগ্রী প্যান করিয়ে ক্যামেরাকে পাহাড়ের দেয়ালে দেয়ালে ধাক্কা খাইয়ে, আবহে দাদা আমি কিন্তু বাঁচতে চেয়েছিলাম সেন্টিমেন্টে এক ইন্ধন, সে সব আপাতত থাক, কিন্তু যে কথা বারবার এবং যে কথা পুনরায় উত্থাপিত হওয়া উচিত তা আবারও সেই দুই বাংলার মিলনাকাঙ্খা, একুশে ফেব্রুয়ারি ওরা আমাকে, সত্যজিৎবাবুকে এবং আরও কয়েক জনকে State guest করে নিয়ে গিয়েছিল ঢাকায়, Plane - এ করে যেতে যেতে আমি হাউ মাউ করে কেঁদে ফেললাম, সে বাংলাদেশ আপনারা দেখেননি, সেই প্রাচুর্যময় জীবন, সেই সুন্দর জীবন ………  

সমস্ত ঋত্বিক-এ আমি যা পেয়েছি সব সমস্ত কিছু দেখার পর আঙুল তুলে শুধু ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে

I accuse

কিন্তু,   কা-কে !

উত্তর অমোঘ এবং সম্ভবত একটাই

কারেও না !  

 ঋণ স্বীকার -
ত্বিককুমার ঘটক, নিজের পায়ে নিজের পথে, সিনে সেন্ট্রাল ক্যালকাটা ও মনফকিরা
Cinema & I, Ritwik Ghatak, Dhyanbindu & Ritwik Memorial Trust

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন