সোমবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৮

মৌসুমী মৌ


শ্মশান কালী //  

সকাল থেকেই ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি ঝরেই যাচ্ছে | যাকে আদর করে সবাই ইলশে গুঁড়ি বলে | ভারি অলস সকাল, কারণ নেই তবু মন কেমন করা এক চিনচিনে   কষ্ট | টুশকি নিজের মনকে খুব একটা বেশি পাত্তা না দিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়লো | আজ সে ঠিক করেছে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে অফিসে যাবে না, একটা দিন নিজের মতো করে কাটাবে |

টুশকির শ্বশুরবাড়িটি আধা যৌথ পরিবার, (আধা বলতে পৃথকান্ন  কিন্তু মনে মনে সবাই সবার পাশে আছে) নিউক্লিয়ার পরিবার থেকে এসে এই  পরিবারের এতো লোকজন , তাদের সব বিচিত্র ধরণধারণ, বাচনভঙ্গি বেশ লাগে | এমনকি এদের অকারণ অতিরিক্ত কৌতূহল পর্যন্ত | আজ বেলা পর্যন্ত জানলা খোলা দেখে পাশের ঘরের মিষ্টি কাকী কথা ছুঁড়ে দিলো , কিরে টুশকি অফিস যাবিনা, দীপ্ত বেরিয়ে গেছে ?
--- সেতো  ট্যুরে, আর আমি আজ যাবো না গো |
বেলায় পারলে এসো আড্ডা দেব |
মর্নিংওয়াক থেকে ফেরার পথে মধুরা টুশকিকে দেখে এক গাল হেসে বলে,’ কিগো আজ ডুব মারলে | তাহলে চলো ‘ হামি ’দেখে আসি ‘? টুশকি এই সুযোগে রসিকতা  করতে ছাড়ে না, ‘মিষ্টি কাকীর কান বাঁচিয়ে বলে ওটা কি দেখার’ ? মধুরাও কম সেয়ানা নয় উত্তরে চোখ টিপে বলে, ‘তাহলে চলো চেখে আসি’|
হালকা রসিকতায়  টুশকির মনের মেঘ আসতে আসতে কেটে যায় |

হঠাৎ দেখে সামনে পিছনে দরাদ্দম দরজা, জানলার কপাট গুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে | মধুরাও ছুট্টে ঘরে ঢুকে গেল | কিছু বোঝার আগেই হঠাৎ সেই বুক ফাঁকা করা আওয়াজ, ‘কীরে রাঙা বৌ বাড়ী আছিস , অনেকদিন বাদে দেখলাম তোকে,খুশি করে দিবি কিন্তু আজ, শনিবার মায়ের পুজো আছে রাতে |’

টুশকির চোখে দুস্টুমি ঝিলিক মারে , এবার সে বুঝতে পারে কেন সবাই দরজায় খিল দিলো | যতটা না ভয় তার থেকে বেশি অজানা আতঙ্ক | এই কালিকা দিদি শ্মশানে থাকে| কপালে মোটা করে সিঁদুর লেপা , মিশমিশে উজ্জ্বল কালো সাড়ে পাঁচফুটের  পেটানো বানডাকা শরীর , যার তীব্র ঝিম ধরা মাদকতা বোধহয় এবাড়ির সাবেকিয়ানার সাথে বড়ো বেমানান, বড়ো দৃষ্টিকটু | শরীরী মাদকতা, ঈষৎ পুরুষালি বাজখাঁই গলা, শ্মশানের চোরা ভয় -- সব মিলে মিশে এই রুচিশীল, স্ট্যাটাস সচেতন বনেদি বাড়িতে কালিকার আগমন বেশ জোরে ঝাপ্টা মারে | সবাই যা করে টুশকি বরাবরই তার বিপরীত করবে এটা ওর স্বভাব | সুতরাং কালিকা দিদিকে দেখে সবাই যখন দরজায় কপাট দিলো তখন  টুশকির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল , এটা ওর ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক | ও ভাবে ভালোই হলো আজ কিছুক্ষন শ্মশান মোশানের গল্প শুনে সময়টা অন্য ভাবে কেটে যাবে |

যে শ্মশানের বাসিন্দা কালিকা, সেখানে এখনো ইলেকট্রিক চুল্লি হয়নি | তিরতির করে বয়ে চলা মজা গঙ্গার পাড়ে এখনো মড়া পোড়ে | টুশকি যেন মনে মনে কালিকার গায়ে সেই আদিম পোড়া গন্ধ পায়, ভালো কি মন্দ সেটা প্রশ্ন নয়, বিয়ের পর থেকে এই দশ বছর  টুশকির এই গন্ধে কোনো অসুবিধে হয়না | দীপ্ত থাকলে সঙ্গে সঙ্গে দশ বিশ টাকা দিয়ে বিদায় দিতো কারণ তার কাছে কালিকার এই আবদার, এই আনসান গল্প পাগলামো ছাড়া কিছু নয় |

কিন্তু এবাড়ির কেউ বোঝেনা এমনকি দীপ্তও নয় মরা পোড়ানো কালিকার বরের পেশা | ওরা জাতিতে  ডোম সহজ সাদা সিধে মানুষ সব | গ্রাম বা শহরের একেবারে শেষ প্রান্তে এদের বাস | বংশপরম্পরা ধরে ওরা এই কাজ করে বলে তথাকথিত ভদ্রলোকেদের অন্তিম  যাত্রা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়| মরা পোড়াবার আগে কালিকার বর এক ভাঁড় তাড়ি খেয়ে নেয় তার পর মরার গায়ে হাত দেয় |
-- টুশকি জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি খাও’?
-- কালিকা বলে কী ?
-- ওই যে তাড়ি !
-- লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলে তা খেতে হয় বটে,
মাঝে মাঝে মরদের সাথে আমাকেও থাকতে হয় তো, ওর সাগরেদ বুধিয়া তো রাতে ভিতে নেশা করে পড়ে থাকে, অনেক সময় কাজ করতে চায় না মোটে, তখন |
-- তোমার ভয় করেনা কালিকা দিদি ?
-- ভয় করবে কেন! আমার বাবাও শ্মশানের ডোম ছিল, বর ও তাই, ভয় কিসের ?এখানে সবাইকে আসতে হয়রে, যতই আমাদের তোরা ঘেন্না করিস |
-- কি যে বলো ! ঘেন্না করবো কেন ?
-- তোর কথা বলছিনা তুই আলাদা কিন্তু ভদ্দর পাড়ায় সবাই আমাদের দেখে ঘেন্না পায়|
-- টুশকি বলে ছাড়ো ওসব কথা এবার অনেকদিন পর তোমায় দেখলাম | কবে তোমাদের মায়ের উৎসব ?

কালিকার মুখে টুশকি আগে শুনেছে ওই শ্মশানে কালী মায়ের মন্দির আছে| প্রতি অমাবস্যার রাতে পুজো হয়| তবে বছরে  দুবার ধুমধাম করে সারা রাত ধরে উৎসব হয় | তখন সেখানে গঙ্গার পাড় জুড়ে মেলা বসে | দূর দূর থেকে সাধু সন্ন্যাসীরা আসে | অনেক আগে নাকি এক কাপালিক আসতো পঞ্চমুন্ডীর  আসনে বসে সারা রাত ধরে সাধনা করতো | যা বলতো তাই ফলে যেত | অনেক রাতে তেনারাও আসতেন | টুশকি ভাবে আহা! ওনারাতো রাতেই ঘুরে বেড়ায়, প্রসাদ খেতে ইচ্ছে করেছে হয়তো | দৈবশক্তিধর কাপালিক যদি আজও বেঁচে থাকতো ও তাহলে ঠিক লুকিয়ে একবার অন্তত দেখা করে আসতো|

টুশকি কালিকাকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে ওঠে তুমি -- ‘দেখেছো ওনাদের ?’
নারে দিদি, বলে হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বলতে শুরু করে-- ‘ তবে অল্প বয়সী একটা বৌ, অপঘাতে মরা আরকি, পরে শুনি বরই কি কারণে খুন করেছে| সোনার পেতিমে দেখতে | একদিন এক বৃষ্টির রাতে  বডি ঢুকলো , আমিও বরের সঙ্গে ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলে গেলাম কাজে | যাত্রী মোটে পাঁচ ছজন | টুকটুকে আলতারাঙা পা দুখানা, কি মনে হতে শাড়ি জামা খোলাতে গিয়ে হঠাৎ বাজের আলোয় মুখটা দেখে বুক কেঁপে ওঠে |  ওমা গো! মা! অতটুকু বৌ কত সাধ আল্হাদ জলাঞ্জলি দিয়ে চললো ওপারে ! ওই একদিনই বরকে বলেছিলুম আজ কিছুতেই আমি তোর সাথে মরা পেটাতে পারবোনা, বুধিয়াকে ডাক|
সে রাতে ঘরে এসেও নিদ্ আসেনি চোখে | শনশন হওয়ার ঝাপটে দূর থেকে যেন গোঙানি ভেসে আসছে,
মন বলছে কোনো অতৃপ্ত আত্মা চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, টুশকিও কেমন আনমনা হয়ে পড়ে | কেন ওই টুকটুকে আলতা পরা বৌটা চলে গেল সবাইকে ছেড়ে ! হয়তো যেতে চাইনি, হয়তোবা বাঁচতে চেয়েছিলো খুব, গুছিয়ে সংসার করার  বড়ো সাধ ছিল তার ….

বৃষ্টিটা আরো বাড়লো| কালিকা তার পাওনাগন্ডা  বুঝে নিয়ে মিনিট পাঁচেক হলো বিদায় নিয়েছে | ঝড়ের দাপটে পুবের জানলার পাল্লাটা জোরে শব্দ করে হাট হয়ে খুলছে, বন্ধ হচ্ছে |  কাল রাতে শুরু হওয়া নাছোড় বৃষ্টিতে বাড়ির পিছনের দিকের মস্ত পাঁচিল থেকে বোধহয় কয়েক গাঁথনি ইঁট খসে পড়ার বুককাঁপানো আওয়াজ হলো প্রচন্ড জোরে , বাদলা দিনের ফিকে আঁধারে রোজ দেখা কালো বিড়ালটার নীলসবুজ চোখ দুটোতে যেন অশরীরি দৃষ্টি !! টুশকি উঠে যে জানলার কপাটটা বন্ধ করবে সেটুকু শক্তি কোই ?? এক অদ্ভুত আবছা আদ্র পরিবেশ টুশকির মনকে আস্তে আস্তে গ্রাস করছে !!!  ও কোথায় যেন ডুবে যাচ্ছে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন